হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

স্বর্ণযুগের মোল্লাতন্ত্র

রিয়াদুল হাসান

ইসলামের স্বর্ণযুগের একজন দিকপাল ছিলেন ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৯)। তিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, গণিত, ইসলামি আইনশাস্ত্র এবং ভাষাবিজ্ঞানসহ বহু বিষয়ে শতাধিক বই এবং গবেষণাপত্রের রচয়িতা।

ইসলাম জ্ঞানসাধনা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে উৎসাহিত করে। কিন্তু জ্ঞানসাধনা ও গবেষণার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক শান্তি। সাধারণত কোনো পরাধীন জনগোষ্ঠী সৃজনশীল চিন্তা-গবেষণার প্রেরণা পায় না, তারা ব্যস্ত থাকে পেট ও পিঠ বাঁচানোর চিন্তায়। মুসলিম জাতি যখন অপরাজেয় সামরিক শক্তির অধিকারী হলো তখন পর্যায়ক্রমে তাদের জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো, জাতিটি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপে মনোনিবেশ করার পরিবেশ লাভ করল। অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালে মুসলিম শাসিত অঞ্চলগুলো সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এ সময়কে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। ৬২২ সালে মদিনায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নেই এ স্বর্ণযুগের বীজ রোপিত হয়। আর ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের দ্বারা বাগদাদ পতনের পূর্ব পর্যন্ত এই স্বর্ণযুগ ধরা হয়। অন্যদিকে ১৪৯২ সালে স্পেনের গ্রানাডায় খ্রিষ্টানদের হাতে মুসলিমদের চূড়ান্ত পতনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় আন্দালুসিয়ায় মুসলিম স্বর্ণযুগ।

আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের (৭৮৬-৮০৯) সময় বাগদাদে বাইতুল হিকমাহর প্রতিষ্ঠার ফলে জ্ঞানচর্চার প্রভূত সুযোগ সৃষ্টি হয়। মুসলিম বিশ্বের রাজধানী শহর বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোবা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বাণিজ্য ও শিক্ষার বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। মুসলিমরা তাদের অধিকৃত অঞ্চলের প্রাচীন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিল। তারা হারিয়ে যেতে থাকা অনেক ধ্রুপদি রচনা আরবি ও ফারসিতে অনুবাদ করেন। আরো পরে এগুলো তুর্কি, হিব্রু ও ল্যাটিনে অনূদিত হয়েছিল। প্রাচীন গ্রিক, রোমান, পারসিয়ান, ভারতীয়, চৈনিক, মিশরীয় ও ফিনিশীয় সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তারা গ্রহণ, পর্যালোচনা ও অগ্রগতিতে অবদান রাখেন। আল-জাহরাবী, আব্বাস ইবনে ফিরনাস, আল-বেরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনুন নাফিস, আল-খাওয়ারেজমি, ইবনুল হায়সাম, ইবনে খালদুন প্রমুখ মনীষীগণ ছিলেন ইসলামের স্বর্ণযুগের প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব। মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান তাঁর “ইসলাম ২০০০” গ্রন্থে বলেন, “এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আজকের ইউরোপে যে গ্রীক ও হেলেনীয় ঐতিহ্য দেখতে পাওয়া যায়, তা মূলত মুসলিম দার্শনিকগণ কর্তৃক ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সংরক্ষিত ও বিকশিত গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের কল্যাণে এসেছে- যা মুসলিমরা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে উপহার দিয়েছিল বা বলা যায় পাশ্চাত্যের কাছে হস্তান্তর করেছিল।”

মুসলিম সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে যতই শীর্ষে আরোহণ করুক না কেন এর পাশাপাশি ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ কট্টরপন্থা, মোল্লাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান উত্থানও অব্যাহত ছিল। ধর্মই ছিল মুসলিম সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি আর এই শক্তিকেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ। তারা হাজারো মতবাদে বিভক্ত ছিলেন। তাদের ফতোয়াবাজি, পাণ্ডিত্যের লড়াই, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মতবিরোধ ধর্মীয় দল উপদলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করেছিল যা মুসলিম সভ্যতার প্রাণশক্তিকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছিল। এই ধর্মীয় নেতারা সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত-পালিত হতেন এবং বেশ ক্ষমতা ভোগ করতেন। তাদের মতের বিরুদ্ধে সুলতানরা খুব একটা যেতেন না বা যেতে সাহস করতেন না। কারণ তারা ধর্মের কর্তৃপক্ষ আর সুলতানরা মদ্যপান, ব্যভিচার, অন্যায় রক্তপাতসহ বহু অধর্মীয় কার্যাদি করতেন বলে ধর্মনেতাদের সমীহ করতে বাধ্য ছিলেন।

ইসলাম জ্ঞান-অন্বেষণকে ফরজ করেছে এই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রণী করেছিল। কিন্তু একটা সময় এই জ্ঞানকে কেবল ধর্মতত্ত্বের জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে ফতোয়া জারি করা হলো। এই কট্টরপন্থী পণ্ডিতদের মধ্যে ইমাম গাজ্জালির মতো প্রভাবশালী আলেম ছিলেন অন্যতম। এ জাতীয় ফতোয়ার ফলে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রযুক্তি ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে যে অগ্রযাত্রা হচ্ছিল সেটা ব্যাহত হলো। ইসলামে জাদুবিদ্যা বা ব্ল্যাক ম্যাজিক নিষিদ্ধ। আলকেমি বা রসায়নবিদ্যার চর্চাকে জাদুবিদ্যা ও গুপ্তবিদ্যা আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হলো। অথচ ইসলাম এসেছেই জাগতিক জীবনকে শান্তি ও প্রগতির পথ দেখাতে। পরকালে তো দীনের প্রয়োজন নেই। মোল্লাতন্ত্রের কালো থাবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই জয়যাত্রাকে ভিতর থেকে রুখে দিল। বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসককে নাস্তিক, মুরতাদ, জিন্দিক ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে হত্যা পর্যন্ত করা হলো। তাদের হাতে লেখা অমূল্য কেতাবগুলো পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হলো। বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিককে প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগ করতে পর্যন্ত হয়েছে। দার্শনিক আল কিন্দি ও ইবনুল আরাবিকে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়, ওমর খৈয়ামকে নাস্তিক সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর ঘর, গবেষণাগার ও লাইব্রেরি, ইবনে রুশদকে করা হয় নির্বাসিত, অপমান-অপদস্থ, কবি ফেরদৌসীর লাশ মুসলিম গোরস্তানে দাফন করতে দেওয়া হয় নি, আল রাজিকে মেরে অন্ধ করে দেওয়া হয়। মোল্লাতন্ত্রের ফতোয়াবাজি এভাবেই যুগে যুগে মানুষকে বিজ্ঞানহীনতা, কূপমণ্ডূকতা, যুক্তিহীনতার দিকে নিক্ষেপ করেছে। তাদের একটাই হাতিয়ার, সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতি। যতদিন আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম পৃথিবীতে কায়েম ছিল ততদিন জাতির মধ্যে কোনো মোল্লা শ্রেণি, পুরোহিত শ্রেণি, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী মধ্যস্বত্ত্বভোগী ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির উৎপত্তি সম্ভব হয় নি। ইসলাম ছিল সহজ-সরল। পানি ও বায়ুর মতো সকলের সেবনযোগ্য। কিন্তু যখনই দীনের বিধানের অতিব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে তা জটিল করে ফেলা হলো তখন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে চলে গেল এবং ধর্মবেত্তা, বিশেষজ্ঞ শ্রেণির কুক্ষিগত হয়ে পড়ল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তারা যা বলে সেটাই ইসলাম। তাদের সিদ্ধান্তের সামনে কোর’আন পর্যন্ত উপেক্ষিত ও নিষ্ক্রীয় হয়ে গেল। আজও কোনো মুফতি যদি কোর’আনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো ফতোয়া প্রদান করে সাধারণ মানুষ কোর’আন খুলে দেখবে না। তার কথাই মুখ বুজে বিশ্বাস করবে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা কোর’আনে অন্তত অর্ধশত আয়াতে উল্লেখ থাকলেও ধর্মব্যবসা মুসলিমদের সমাজে একটি সম্মানজনক জীবিকা।

এবার আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু ঘটনা দেখাতে চেষ্টা করব যে কীভাবে মোল্লাতান্ত্রিকদের ষড়যন্ত্র ও ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়েছেন যুগশ্রেষ্ঠ মুসলিম বিজ্ঞানী, গবেষক, লেখক, দার্শনিকগণ। প্রথমেই আল কিন্দি (৮০১-৮৭৩ খ্রি.)।

আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-কিন্দি:

আজকের ধর্মান্ধ মুসলমানেরা যেমন একদিকে আল কিন্দির মতো দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে গর্ববোধ করে, তেমনি গণিত, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিদা, জ্যামিতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, মনোবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আবহাওয়া বিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। অথচ আল কিন্দি এই বিষয়গুলোর ওপর বহু মৌলিক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো কোনো বইকে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁর রচনাবলী মধ্যযুগের ইউরোপীয় চিন্তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বারোজন মহান চিন্তনায়কের একজন বলে অভিহিত করা হয়েছিল। বর্তমানে এমন একজন মুসলিম দার্শনিক বা বিজ্ঞানীও কি আছেন যার চিন্তাচেতনার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে মানবজাতি? আল কিন্দি মনে করতেন, জ্ঞানের কোনো দেশ নেই। সত্য যেখানেই পাওয়া যাক তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। অমুক বই পড়লে ঈমান চলে যাবে, ওটা বিধর্মীদের গ্রন্থ- এমন ধ্যানধারণার তিনি বিরোধী ছিলেন। তিনি ধর্মচর্চার দিক থেকে ছিলেন ইসলামের মূলনীতিতে বিশ্বাসী ও মধ্যপন্থী। তিনি তাঁর লেখায় আল্লাহর একত্ববাদের পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পেশ করেছেন। তথাপিও তাঁর সমসাময়িক গোঁড়াপন্থী ওলামাগণ তাঁকে কাফের বলে ফতোয়া প্রদান করেছিলেন। আব্বাসী খলিফা আল-মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩ খ্রি.) তাঁকে বায়তুল হিকমাহ নামক জ্ঞানচর্চাকেন্দ্রের গবেষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আল-মামুনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর যখন কট্টরপন্থী আল-মুতাওয়াক্কিল (শাসনকাল ৮৪৭-৮৬১) খলিফা হলেন তখন আল-কিন্দির উপর পূর্বের ফতোয়া কার্যকর হতে শুরু করল। উদারপন্থী বিজ্ঞানী, গবেষক, দার্শনিকদেরকে প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখোমুখী হতে হলো। আল কিন্দিকেও ভীষণভাবে মারধোর করা হলো, তার পাঠাগারটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হলো। ৮৭৩ সনে বাগদাদে এই মনীষী অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর লেখা অধিকাংশ বইকে পরিকল্পিতভাবে গায়েব করে ফেলা হয়। তদুপরি মঙ্গোলরা বাগদাদ দখলের সময় অগণিত লাইব্রেরি ধ্বংস করে দেয়। পুরো শহর ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়। হালাকু খানের নৃশংস হামলার পরিণতিতে বাগদাদ খেলাফত সমূলে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অগণিত দুষ্প্রাপ্য বই দজলা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। বইয়ের কালি নদীর পানিতে মিশে গিয়ে পানির রঙ কয়েকদিন পর্যন্ত কালো হয়ে গিয়েছিল। এইসব বই সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে, নদীতে স্থানে স্থানে সেগুলোর স্তূপ সেতুর মতো দেখা যেত, তাতার বাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী সেগুলোর উপর দিয়ে যাতায়াত করত। [সিমতুন নুজুম, ইসাম আল মক্কী (রহ.) : ৩/৫১৯, ইলমিয়া মুদ্রণ, মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ (৯ম খণ্ড)- মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল রাইহান]। আল কিন্দির লেখা বইগুলোও তখন পুড়িয়ে ফেলা হয় বলে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন।

আবু বকর মোহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাযি বা আল-রাযি:

মুসলিম স্বর্ণযুগের আরেক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি আল রাজি (৮৫৪-৯২৫)। তিনি একইসঙ্গে চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, দার্শনিক, গণিতবিদ, রসায়নবিদ হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা বিপুল। গণিত ছাড়াও অন্যসব বিষয়ে প্রায় ২০০ গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। কেরোসিন, সালফিউরিক এসিড, অসংখ্য লবণসহ বহু যৌগ ও রাসায়নিক পদার্থ তিনি আবিষ্কার করেন। হাম ও গুটিবসন্তের পার্থক্যনির্ণয়ে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তিনি আল্লাহর অস্তিত্বের বিশ্বাসী হলেও চিন্তা ও দর্শনে ছিলেন পুরোমাত্রায় যুক্তিবাদী ও অন্ধবিশ্বাসের বিরোধী। এর মূল্য তাকে চুকাতে হয় অত্যন্ত করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে।

অনেক ঐতিহাসিকের মতে, সে সময় গুটিবসন্ত মহামরি আকার ধারণ করেছিল। মানুষ মনে করত যে গুটিবসন্ত হচ্ছে আল্লাহর অভিশাপের ফল। এ থেকে বাঁচার জন্য বহুরকমের আমল ও প্রার্থনার আয়োজন করতেন ওলামাগণ। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। কিন্তু আল-রাজি গবেষণা করে গুটিবসন্ত প্রতিরোধ করার উপায় তাঁর “আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ” নামক গ্রন্থে ব্যাখ্যা করলেন। সেখানে তিনি গুটিবসন্ত সম্পর্কে প্রচলিত কুসংস্কারের মূলে আঘাত হেনে কিছু শক্ত কথা বলেন যা ওলামাদের পছন্দ হয় না। তারা বুখারার আমিরের কাছে রাজির বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ করে। রাজিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে অভিযোগ সত্য কিনা। তিনি বললেন, “আমি যা সত্য তা-ই লিখেছি।” আমির বললেন, আল রাজির মতো মুরতাদকে চরম শাস্তি দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হলো, আল রাজি যে বই রচনা করেছেন সে বই দিয়েই তার মাথায় আঘাত করা হবে, যতক্ষণ না সেই বই কিংবা আল রাজির মাথা দুটির একটি ছিন্ন না হয়। আমিরের নির্দেশে রাজির মাথায় তাঁর বই দিয়েই একনাগাড়ে প্রহার করা হচ্ছিল। বইয়ের শক্ত মলাটের আঘাতে আঘাতে একসময় রাজির মাথা রক্তাক্ত হয়ে যায়। রক্তাক্ত রাজিকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর বাড়িতে। অসুস্থতা ও মারাত্মকভাবে রক্তশূন্যতার কারণে পরবর্তীকালে নষ্ট হয়ে যায় তাঁর দুই চোখ। ফলে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে খুবই দুর্দশায়।

গিয়াসউদিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি:

দার্শনিক, কবি, গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়ামও সমসাময়িক গোঁড়াপন্থী ওলামা গোষ্ঠীর ফতোয়ার শিকার হয়েছিলেন। তিনি সুফিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ধর্মের প্রচলিত অনেক রীতি-রেওয়াজে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।

তিনি যে কবিতাগুলো লিখে তাঁর ভক্তবৃন্দকে দিতেন সেগুলোর বিরুদ্ধেও গোঁড়াপন্থীরা অভিযোগ তুলল যে খৈয়াম কবিতার মাধ্যমে তাঁর শয়তানি বুদ্ধি লিখে দিচ্ছেন। একদিন একদল ধর্মান্ধ উগ্রবাদী তাঁর বাড়িতে হামলা চালালো। খৈয়াম তখন কাঁটা-কম্পাস নিয়ে সূর্য সম্পর্কে গবেষণা করছিলেন। শোরগোল সৃষ্টি করে সেকালের ‘তওহীদী জনতা’ ঘর থেকে সব বইপুস্তক বের করে আগুন ধরিয়ে দিল। একদল খৈয়ামকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের সামনে নিয়ে এল। খৈয়াম তাঁর প্রিয় ঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হায় আল্লাহ”। তখন উত্তেজিত কয়েকজন লোক তাঁর মুখে আল্লাহর নাম শুনে বিদ্রূপভরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আবার আল্লাহকে বিশ্বাস করো নাকি?” খৈয়াম নরম গলায় বললেন, “আল্লাহ তো খুবই দয়ালু। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর বান্দারা তা নয়”।

নিন্দুকেরা তাকে নাস্তিক-কাফের উপাধি দিলেও তিনি ধর্মে অবিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি কবিতার ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যার অনুবাদ করেছেন কবি নজরুল ইসলাম:

নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম,

কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।

অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,

কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম?

জাওজী শামসুদ্দিন মোহাম্মদ হাফিজ আল শিরাজি (১৩১৫-১৩৯০):

ইরানের জগদ্বিখ্যাত সুফিবাদী কবি, মরমি সাধক ও দার্শনিক হাফিজের কপালেও জুটেছিল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাফের, মুর্তাদ, ধর্মবিদ্বেষী ফতোয়া, যদিও তিনি কোর’আনের হাফেজ ছিলেন। তিনি হানাফি, হাম্বলি, শাফেয়ী, মালিকি ইত্যাদি মাজহাব মানতে অস্বীকার করেছিলেন। প্রচলিত ইসলামের অন্তঃসারশূন্য আনুষ্ঠানিক উপাসনাকে তিনি অর্থহীন বলে মনে করতেন। তাঁর লেখা উচ্চমার্গের দার্শনিক কবিতার মর্ম উপলব্ধি না করতে পেরে তার বিরুদ্ধে বারবার ধর্মদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু কাজীর দরবারে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে তিনি নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হন। হাফিজের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও। ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ তাঁকে গৌড়ের (বৃহত্তর বঙ্গ) সভাকবির আসন অলঙ্কৃত করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বয়সজনিত কারণে আসতে পারেন নি। বাংলা ভাষার বড় বড় কবিদের অনেকেই হাফিজের রুবাইয়াত অনুবাদ করেছেন। ৭৩টি রুবাইয়াত ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে কাজি নজরুল ইসলাম। ১৩৯১ সালে হাফিজের মৃত্যুর পর একটি উগ্রপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠী তাঁকে কাফের, বিধর্মী আখ্যা দিয়ে তাঁর জানাজা পড়তে অস্বীকার করেছিল। হাফিজের ভক্তদলের সাথে এ নিয়ে বিসম্বাদের সৃষ্টি হলে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় উভয় দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফিজের সমস্ত কবিতা একত্র করে একজন লোক তার যে কোন স্থান খুলবে; সেই পৃষ্ঠায় প্রথম দুই চরণ কবিতা পড়ে হাফিজের কী ধর্ম ছিল তা ধরে নেয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয়, এভাবে এই দুই চরণ কবিতা পাওয়া গিয়েছিল –

“কদমে দিরেগ মাদার আয জানাযায়ে হাফিজ

কে গারচে গারকে গোনাহ আয জানাযায়ে ববেহশত।”

অর্থাৎ-

যাসনে ফিরে বিশ্বাসীরা হয়ে ক্ষোভে আত্মহারা,

হাফিজ কবির জানাযাতে হোসনে বিরূপ মুসল্লিরা।

হয়তো হাফিজ কোনোমতে, পড়বে গিয়ে সে জান্নাতে,

যদিও বা নিযুত পাপে পূর্ণ তাহার পাপের ঘড়া।

এরপর উভয়পক্ষ মিলে তাঁর জানাজা পড়া হলো এবং ইসলামের বিধানমতে দাফন করা হলো।

আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ ইবন রুশদ:

ইসলামের স্বর্ণযুগের আরেক দিকপাল ছিলেন ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৯)। তিনি স্পেনে জন্মগ্রহণকারী একজন বহুবিদ্যাবিশারদ ছিলেন। দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, গণিত, ইসলামি আইনশাস্ত্র এবং ভাষাবিজ্ঞানসহ বহু বিষয়ে লিখেছেন। তিনি শতাধিক বই এবং গবেষণাপত্রের রচয়িতা। তার দর্শন সংক্রান্ত কাজের মধ্যে আছে অ্যারিস্টটলের উপর বেশ কিছু ব্যাখ্যাগ্রন্থ, যে কারণে তিনি পাশ্চাত্যে ব্যাখ্যাদাতা বা The Commentator এবং যুক্তিবাদের জনক হিসেবে পরিচিত। ইবন রুশদ আলমোহাদ খেলাফতের রাজসভার চিকিৎসক এবং প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে বহুদিন কাজ করেছেন।

তিনি ইমাম গাজ্জালির মতো ধর্মতত্ত্ববিদগণের সমালোচনার বিরুদ্ধে গিয়ে বলেন যে, দর্শনের চর্চা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে অনুমোদিত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। পূর্বে বলে এসেছি যে, ইমাম গাজ্জালি স্বাধীন বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও গবেষণাকে নিরুৎসাহিত ও নিন্দা করেছেন। আল বিরুনির বিখ্যাত গ্রন্থ ভারততত্ত্বের ভূমিকায় অনুবাদক আবু মহামেদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন, “এগারো শতকের শেষে নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমাম গাজ্জালি সুফিবাদ, দর্শন, আইন ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে যে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করে মুসলমানদের ধর্মচিন্তাকে সংহত ও নিয়ন্ত্রিত করতে সফল প্রভাব বিস্তার করেন, তাতেও স্বাধীন বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও গবেষণাতে স্পষ্ট নিরুৎসাহিত ও নিন্দা ব্যক্ত করা হয়েছে।” ইবনে রুশদ তাঁর “তাহ্ফাত-উত-তাহ্ফা” গ্রন্থে দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আনীত গাজ্জালি ও গোঁড়া ধর্মবিদদের অভিযোগের যুক্তিযুক্ত বিরোধিতা করেন। গ্রন্থটি রচনার পর তিনি গাজ্জালির অনুসারীদের প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হন। রুশদের বিচার বসাতে বাধ্য হন সুলতান মনসুর যদিও রুশদ ছিলেন সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিচারের পর রুশদকে নির্বাসিত করা হলো ইহুদি অধ্যুষিত লোসিনিয়ায়। দর্শন ও দার্শনিকদের বিরুদ্ধে জারি করা হলো আইন। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম এ বলা হয়েছে যে খলিফা গোঁড়াপন্থী আলেম-উলামার সমর্থন লাভ করতে ইবন রুশদকে নিজের থেকে দূরে সরাবার ব্যবস্থা করেন।

লোসিনিয়াতেও মানসিক পীড়ন ও শারীরিক নির্যাতন অব্যাহত থাকলে তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। গাজ্জালির অনুসারী গোঁড়াপন্থীরা তাঁকে ধরে কর্ডোভায় এনে আলজামা মসজিদের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখল হেনস্থা করার জন্য। চেহারা বিমর্ষ, পরণে ছেঁড়াফাড়া কালিময়লা পোশাক। মুসল্লিরা তাঁর গায়ে থুথু ফেলছেন। খবর পেয়ে সুলতান মনসুর উদ্ধার করলেন রুশদকে। তাঁকে মরোক্কোর মারকাশের কাজীর পদে নিযুক্ত করলেন। এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে সেখানকার বড় বড় সব পাঠাগার জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় ছাপাখানা ছিল না। লেখকদের প্রতিটি বই হাতে লিখে কপি করা হতো। কোনো বই পুড়িয়ে দিলে সেই জ্ঞান আর ফিরে পাওয়ার উপায় ছিল না। হালাকু খানেরা মুসলিমদের জ্ঞানসাধনার অবদান হাজার হাজার গ্রন্থ কেতাব পুড়িয়ে যেমন উল্লাস করেছে ঠিক তেমনি ভাবে মুসলমানদের স্বর্ণযুগে জন্ম নেওয়া বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের গবেষণাগ্রন্থগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে মুসলিম নামধারী ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠটি। তারা বহু মুসলিম বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদকে নাস্তিক, কাফের, মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে হত্যা করে ফেলেছে। এভাবেই ধর্মান্ধতার ধারক-বাহকেরা মুসলিম সভ্যতার সোনালি সূর্যকে নিবিয়ে দিতে ভিতর থেকে বিভীষণের ভূমিকা পালন করেছে। আজও তাদের প্রেতাত্মারা জ্ঞানবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে, যুক্তিশীলতার বিরুদ্ধে তাদের ফতোয়ার বাণ নিক্ষেপ করেই চলেছে। এখনও তারা সুযোগ পেলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে কোনো গ্রন্থাগার, পাঠাগার, সঙ্গীতাঙ্গন, জাদুঘর পুড়িয়ে দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করে না। সাম্প্রতিক সময়ে এর উদাহরণ আমরা বারবার দেখেছি। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য্য প্রকাশের পথে এই কট্টরপন্থী মোল্লাতান্ত্রিক গোষ্ঠীই প্রধান অন্তরায়।

সহায়ক গ্রন্থ:

(১) মুসলিম মনন ও দর্শন অগ্রনায়কেরা- স্বকৃত নোমান।

(২) মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ- মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাইল রাইহান।

(৩)  ইসলাম ২০০০- মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান।

(৪) উইকিপিডিয়া ও উইকি ইসলাম।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...