হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সঙ্কটে আমরা, পরিত্রাণের উপায় কী?

হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
গত এক মাসে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের আচরণ লক্ষ করলে যে কোনো সচেতন মানুষই বলতে দ্বিধা করবেন না যে, ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে স্বাধীন করা সোনার বাংলার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এই পর্যন্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে সহস্র বছরের প্রাচীন পূর্ব পুরুষের ভিটে-মাটি থেকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করার জন্য মানবতাবিনাশী হেন অপকর্ম নেই যা সেনাবাহিনী করছে না। শিশু হত্যা, নারী ধর্ষণ, যুবকদের গুলি করে হত্যা ইত্যাদি তো আছেই, বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ লুটপাট চালানোর পর একে একে গ্রামগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ যেন নব্য হালাকু খানদের পুনরাবির্ভাব হয়েছে। অনেকে পালিয়ে আসতে গিয়ে পথে আটকা পড়ে, না খেয়ে থেকে কিংবা নৌকা ডুবির শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখনও গহীন জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে আছে। ঘাস পাতা খেয়ে বেঁচে আছে তারা। তারপরও নাফ নদী পেরিয়ে বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পেরেছে। আর সেই সাথেই সামরিক ঝুঁকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।
মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেরকে বাঙালি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং সকলকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার আহŸান জানাচ্ছে। তার মানে তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধেই ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। দেশটিতে পরিকল্পিতভাবে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব চাঙ্গা করে দেওয়া হয়েছে। আর সেই সুরেই কথা বলছে সরকার ও সেনাবাহিনী। তাদের সামরিক হেলিকপ্টার ১৯ বার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। সীমানায় মাইন পুঁতে রেখেছে। মজবুত কাঁটা তারের বেড়া নির্মাণ করে সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে। কয়েকবার বাংলাদেশের সীমানায় গোলাগুলিও করেছে। বাংলাদেশের বহু সামরিক বিশ্লেষক মিয়ানমারের এই কর্মকাণ্ডকে দেখছেন সামরিক উস্কানী হিসেবে। এই অঞ্চলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য এই ধরনের উস্কানী মিয়ানমারের পক্ষ থেকে গত কয়েক বছর ধরেই দেওয়া হচ্ছে। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে না, নিশ্চয়ই এগুলো মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ, যা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ঝুঁকি তৈরি করছে।
এদিকে মুসলমানদের উপর এই বর্বরতম নির্যাতনের ঘটনাকে ইস্যু করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো সরব হচ্ছে। আল কায়েদা, আইএস, আবু সাইয়াফসহ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বহু গোষ্ঠী এখানে কথিত জেহাদ শুরু করার জন্য ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরকার উগ্রবাদী গোষ্ঠী যারা বহুদিন থেকে মোক্ষম ইস্যুর সন্ধান করছিল- তারাও একটি মওকা পেয়ে গেছে। যদি তারা সক্ষম হয় তবে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তি এখানে উড়ে আসবে এতে সন্দেহ নেই। তারপর কী হবে সেটার দৃষ্টান্তের তো অভাব নেই। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ এদিক দিয়েও আমাদের সামনে সামরিক ঝুঁকি উপস্থিত হয়েছে।
বর্তমানে আমাদের সরকার চেষ্টা করছে কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে যেন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অধিবাসীরা নিজেদের ভিটেমাটিতে গিয়ে বসবাস করতে পারে এবং তাদের উপর চলা নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে পারে। কূটনৈতিক এই উদ্যোগ সরকারের দায়িত্ব এবং সরকার তা পালন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমাদের জনগণের কী দায়িত্ব রয়েছে তাও ভেবে দেখা দরকার।
তাদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সঙ্কটটা অনুধাবন করা। কত ভয়াবহ সঙ্কট এটা! একে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের পৈত্রিক ভিটেমাটি থেকে উদ্বাস্তু হয়েছে গণহত্যার শিকার হন। খুব দূরে নয়, একেবারে আমাদের বাড়ির কাছের ঘটনা। যাদের ভাষা আমরা বুঝি। যাদের মর্মস্পর্শী দুঃসহ অভিজ্ঞতা প্রতিনিয়ত আমাদের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, আমরা প্রত্যহ সংবাদগুলো দেখছি। এগুলো সিরিয়া-ইরাকের সংবাদ নয়, আফ্রিকার সংবাদ নয়, সুদূরের ফিলিস্তিনিদেরও নয়। ঘরের কাছের সংবাদ। এই তো সেদিনও এই মানুষগুলোর ধন-সম্পত্তি ছিল, বাড়িঘর ছিল, অনেকে জনপ্রতিনিধি ছিলেন, শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ছিলেন। তারা আজ পথের ভিখিরির মত দিনাতিপাত করছেন। তাদের আত্মীয়-স্বজন ছিল, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ছিল, এখন সবাই কাউকে না কাউকে হারিয়েছে। কেউ পুরো পরিবার হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার শিশু বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে যাদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। কচি কচি শিশুগুলো পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ত্রাণবাহী ট্রাকের পিছে দৌড়াচ্ছে। এতবড় ভয়াবহ সঙ্কট কি পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব?
আমরা হেযবুত তওহীদ বহু বছর যাবৎ বলে আসছি যে, মুসলমানদের ভূখণ্ডগুলোকে পরিকল্পিতভাবে একটার পর একটা ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। আজকে যে দৃশ্য আমরা মিয়ানমারে দেখছি সেই একই দৃশ্য আমরা সিরিয়া ইরাক আফগানিস্তানে ফিলিস্তিনে লিবিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেশে দেখে এসেছি। এই ধ্বংসযজ্ঞ কতদূর পৌঁছতে পারে আমরা তা হয়ত কল্পনাও করতে পারছি না। আজ আমরা দর্শকের ভূমিকায় থাকলেও কাল যে আমরাও খবরের শিরোনাম হব না তার নিশ্চয়তা কী? সুতরাং কেবল চোখে দেখে আর কানে শুনে বসে থাকলে চলবে না আমাদের, হৃদয় দিয়েও উপলব্ধি করতে হবে পরিস্থিতিকে।
বিশ্বে চলছে ‘মাইট ইজ রাইট’ এর শাসন। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবলেরা দেখেছে মুসলমানরা দুর্বল। তাদেরকে ইচ্ছে হলেই গণহত্যা করা যায়, স্বদেশ থেকে উচ্ছেদ করা যায়। তাদের নেই কোনো অভিভাবক, নেই কোনো কর্তৃপক্ষ। আজকে পৃথিবীতে ১৬০ কোটি মুসলমান। তাদের কিসের অভাব? সংখ্যার অভাব নেই, সম্পদের অভাব নেই। শিক্ষারও অভাব নেই। লক্ষ লক্ষ তাদের আলেম ওলামা। লক্ষ লক্ষ তাদের আইনজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। কেবল দুর্বলতা একটা জায়গায়- এদের ঐক্য নেই। ফলে তাদের অনৈক্যের সুযোগ নিচ্ছে অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই কথা বলেছেন। এটা তো ইতিহাস থেকে প্রমাণিত যে, মুসলমানরা নির্যাতিত হলে কোনো সংস্থা, কোনো পরাশক্তি, কোনো জাতিসংঘ পাশে দাঁড়ায় না। বরং মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করতেই নীল নকশা প্রনয়ণ করে। তাহলে কেন আমরা অন্য কারো কৃপাপ্রার্থী হয়ে পড়ে থাকব? সঙ্কট আমাদের, সমাধানও আমাদেরকেই করতে হবে। সেটা হতে পারে দু’টি উপায়ে-
প্রথমত, এই ঝুঁকিটি আমরা ইসলাম দিয়েই মোকাবেলা করতে পারি। কীভাবে? সেটা হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা। আল্লাহর রসুল ১৪শ’ বছর আগে আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াতের জাতিটিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তারা হানাহানি, অন্ধত্ব, কলহ-বিবাদ, অজ্ঞতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ফলে তারা হয়েছিল শক্তিশালী শ্রেষ্ঠ জাতি। যে জাতি ঐক্যের শক্তিতে শক্তিশালী, তারা যে কোনো সংকটই মোকাবেলা করতে পারে।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে দেশপ্রেম। মদীনাকে রক্ষা করার জন্য রসুল ও তাঁর সাহাবীরা কীভাবে না খেয়ে, পেটে পাথর বেঁধে খন্দক খুড়েছিলেন, পাহারা দিয়েছিলেন সে ইতিহাস আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। আমরা এই দেশের কাছে আজন্ম ঋণী। এই ঋণ শোধ করার এখন সময় এসেছে। আমরা বাংলায় কথা বলি, এখনে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে। এই স্বাধীন ভূখণ্ড আছে বিধায় আমরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে বাস করি, চাকরি বাকরি করি, ধর্মপালন করি। ভূখণ্ড না থাকলে আমাদের পরিচয় থাকবে না, আমরা হবো উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তুর কোনো অধিকার থাকে না, সম্মান থাকে না, ধর্মও থাকে না। এসব থাকার জন্য ভূখণ্ড থাকা জরুরি। এজন্য আল্লাহ মানুষকে ভূখণ্ডের উপর সৃষ্টিগত অধিকার দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাঙালিরা একটি স্বাধীন  ভূখণ্ড পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনের পর থেকে একটা দিনও শান্তিতে থাকতে পারি নি দুটি কারণে। ধর্ম ব্যবসায়ী একটা শ্রেণি যারা ধর্মের নামে বিভিন্ন ফতোয়া দিয়ে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে বারবার জাতি বিনাশী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর একটি শ্রেণি হলো স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক গোষ্ঠি। তারা ঔপনিবেশিক আমলের সেই স্বার্থের রাজনীতি এদেশে কায়েম করেছে। স্বার্থের রাজনীতি আর ধর্মের অপব্যবহার এই উভয় প্রকার অপশক্তির কারণে আমরা একদিনের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি নাই। এখনও যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষরা যুদ্ধ করে যে ভূখণ্ড দিয়ে গেছেন, সেটা আমরা রক্ষা করতে পারব না। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ হতে হবে অস্তিত্বের প্রয়োজনে। এক্ষেত্রে কারো ধর্মপরিচয়, নৃতাত্তি¡ক পরিচয় মুখ্য নয়, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। তাদের জাতি হবে একটি, নেতা হবে একজন, সিদ্ধান্ত হবে একটি। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। সেই লক্ষ্যেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ।
যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...