হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মীয় কার্যাদিতে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির প্রয়োজনীয়তা আছে কি?

রিয়াদুল হাসান

ইসলামকে আল্লাহ বিজয়ী করবেন এটা তিনি পবিত্র কোর’আনে ঘোষণা করেছেন (আল কোর’আন: সুরা মুজাদালাহ ২১)। এটা কখন হবে, কীভাবে হবে, কাদের মাধ্যমে হবে সেটা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের কাজ হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মান্য করা, আল্লাহর আদেশ নিষেধ কার্যকর করার মাধ্যমে সাম্য, সুবিচার, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, মানবতা এক কথায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে যদি কেবল আনুষ্ঠানিক উপাসনা, যিকির আজকার, আল্লাহর গুণকীর্তন করা হয় তাহলে কি সমাজে শান্তি আসবে? মনে রাখতে হবে, আল্লাহ চান শান্তি। এজন্য এই দীনের নাম তিনি দিয়েছেন ইসলাম। যতদিন পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন যত আনুষ্ঠানিকতাই করা হোক, ইবলিসই জয়ী থাকবে। আর ইবলিস যদি জয়ী হয় তাহলে ঐসব আনুষ্ঠানিক উপাসনা দিয়ে জান্নাতে যাওয়া যাবে না।

এ কথাগুলো বলছি এজন্য যে, অনেকে বলে থাকেন যদি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক কার্যাদির কোনো বিনিময় বা পারিশ্রমিক না দেওয়া হয়, তাহলে সমাজের মাদ্রাসাশিক্ষিত শ্রেণিটি এসব ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে সময় দিতে আগ্রহী হবেন না। ফলে ইসলামের চর্চা হবে না, ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন কে আজান দেবে, কে নামাজ পড়াবে, কে মানুষকে দীন শিক্ষা দেবে, কে বিয়ে পড়াবে, কে সন্তানের আকিকা করিয়ে দেবে, কে মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবে? তাই বিনিময় গ্রহণকে জায়েজ করার জন্য অনেকেই যুক্তি প্রদান করেন যে, ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও বিনিময় প্রদান করতে হবে।

আসলেই কি বিষয়টি এমন? এই প্রথাগুলো কে প্রবর্তন করল? আল্লাহর রসুল (সা.) বা খলিফায়ে রাশেদিনের যুগে তো আল্লাহ ও মানুষের মধ্যবর্তী কোনো পেশাদার শ্রেণি ছিল না। ইসলামের ইতিহাস বলে, তখন শিশু জন্ম নিলে পরিবারের কোনো একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য আযান দিতেন। আকিকার সময় নামও রাখতেন নবজাতকের অভিভাবকগণ। সাহাবিদের বিয়ে পড়াতে, দোয়াদুরুদ পাঠ ও মোনাজাত করতে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণকারী (চধরফ) ‘কাজী’র প্রয়োজন পড়ত না। পরিবার বা সমাজের যে কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি সাক্ষীদের সামনে বিয়ের মধ্যস্থতা করে দিতেন। তাছাড়া এই মধ্যস্থতা বিয়ের অপরিহার্য শর্ত নয়। বিয়ের ফরদ হচ্ছে, বর-কনের সম্মতি, দেনমোহর পরিশোধ করা এবং কয়েকজন সাক্ষীর উপস্থিতি। মো’মেনরা নিজেরাই নিজেদের কোরবানির পশু জবাই করতেন। কাউকে ভাড়া করার প্রয়োজন পড়ত না। মসজিদে নামাজ পড়াতেন খলিফার পক্ষ থেকে নিযুক্ত সামাজিক নেতা (আমির)। তার অনুপস্থিতিতে মুসল্লিরা যাকে পছন্দ করত তিনিই ইমামতি করতেন।

কারো মৃত্যুর পর মৃতের সন্তান, পিতা বা মুসলিমদের সমাজের যিনি নেতা তিনিই জানাজা পড়াতেন। এটি একদিকে তাদের জন্য যেমন ছিল ধর্মীয় কর্তব্য তেমনি ছিল সামাজিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব সম্পর্কে তারা সকলেই সচেতন ছিলেন। এ বিষয়ে শরিয়তের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি যদি কাউকে জানাজার ইমামতি করার অসিয়ত না করে যান তাহলে মৃতের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানাজা পড়াবেন। ঘনিষ্ট আত্মীয়দের মধ্যে প্রথমে পিতা, তারপর দাদা, তারপর পুত্র, তারপর পৌত্র, তারপর ভাই (ইমাম নবভী প্রণীত রওযাতুত তলিবীন, ২য় খ-, ১২১ পৃষ্ঠা)।

প্রসঙ্গত এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। রসুলাল্লাহর (সা.) সময় মসজিদে নববী ঝাড়– দিতেন একজন মহিলা সাহাবি। তিনি যেদিন মারা যান সেদিন রসুলাল্লাহর সাহাবিরা নিজেদের উদ্যোগে তাঁর জানাজা ও দাফন করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ রসুলাল্লাাহকে জানানো হয়েছিল না। তিনি যখন সংবাদটি জানলেন খুব আফসোস করে বললেন, “তোমরা যদি আমাকে খবরটি দিতে।” (হাদিস: বোখারি ‘সালাত’ অধ্যায়, হা/৪৫৮; মুসলিম, ‘জানাজা’ অধ্যায়, হা/৯৫৬)।

একবার চিন্তা করুন, মসজিদে নববী ঝাড়– দিতেন একজন নারী। অথচ আমরা আজ প্রায়ই সাইনবোর্ডে লেখা দেখি, “মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার্থে মহিলাদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ।” এই নিষেধাজ্ঞা যারা জারি করে রেখেছেন তারা ধর্মরক্ষার অজুহাতেই বহু ইজমা কিয়াস করে রসুলাল্লাহর সুন্নাহ বা নীতিকে উল্টিয়ে দিয়েছেন। যাহোক যে বিষয়ে বলছিলাম, উপরে উল্লিখিত কোনো একটি ধর্মীয় কাজেও কিন্তু তখন অর্থের লেনদেন হতো না। সেই রীতি রক্ষা করাই আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য ও অনুসরণ। এই সুন্নাহ বা আদর্শ পরিত্যাগ করে ইসলামের হেফাজত করার দাবি নিতান্তই উদ্দেশ্যমূলক।

ধর্মীয় কাজের বিনিমেয় অর্থগ্রহণ নিষিদ্ধ- এ কথাটি বললে যারা বিনিময় নেওয়ার পক্ষে তারা পাল্টা যুক্তি ছুঁড়ে দেন, “আপনার বাবা মায়ের বিয়ে দিয়েছিল এই আলেমরা, আপনার জন্মের পর আকিকা সম্পন্ন করেছিল এই আলেমরা, আপনি মারা গেলে জানাজা দিবেন এই আলেমরাই। সুতরাং তারা সমাজের অপরিহার্য অংশ।” তাদের এই যুক্তিটি অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি, একটু আগেই দেখালাম, এসব কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য আলাদা কোনো পুরোহিত গোষ্ঠীর অস্তিত্ব এ জাতির মধ্যে ছিল না। জাতির সদস্যরা সবাই এসব কাজ করতে পারতেন। কারণ এ জাতির যিনি প্রতিষ্ঠাতা তিনি বলে গেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরদ। (হাদিস: আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, সুনানে ইবনে মাজাহ)। এ হাদিসে যে জ্ঞান অর্জনের কথা বলা হচ্ছে সেটা কী জ্ঞান, কতটুকু জ্ঞান। সেটা কি ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ বা কোর’আন তাফসিরের জ্ঞান, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিশাল জ্ঞান? না। সেটা হচ্ছে ইসলাম মোতাবেক জীবনযাপন করার জন্য যে জ্ঞানটুকু থাকতেই হবে সেটুকু। যেমন যে ব্যবসা করতে চায় তাকে আগে জানতে হবে ইসলামে ব্যবসা করার নীতিমালা কী। যে বিয়ে করবে তাকে জানতে হবে ইসলামে বিয়ের বিধান কী। যে পশু কোরবানি দেবে তাকেও জানতে হবে কোন পশু খাওয়া যাবে, কোন পশু খাওয়া যাবে না এবং পশু জবেহ করার পদ্ধতি কী। মানুষ মারা গেলে জানাজার নামাজ কীভাবে পড়াতে হয় এটাও তাদেরকে জানতে হবে। কেননা নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলে তাদেরই জানাজা পড়ানো কর্তব্য। এই জ্ঞানগুলো অর্জন করা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জাতির প্রত্যেকের উপর বাধ্যতামূলক। মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এজন্যই। প্রকৃত ইসলামের যুগে মসজিদে যেমন সালাহ হতো তেমনি মুসুল্লিদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহের জন্য বিধিবিধানও এখান থেকেই লোকেরা শিখে যেত বিনে পয়সায়। কিন্তু পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা যখন লুপ্ত হয়ে গেল তখন আল্লাহ ও জনগণের মাঝখানে এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি গজিয়ে উঠল। এই শ্রেণিটিই ইসলামের মধ্যে পুরোহিততন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। তারা জীবন চালানোর জন্য জরুরি উল্লিখিত সাধারণ জ্ঞানগুলোও মানুষকে দান করছে না। ফলে আমাদেরকে ধর্মীয় ব্যাপারে বাধ্য হয়েই তাদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ইসলামের প্রতিটি বিষয়কে নিয়ে তারা বাড়াবাড়ি করে হাজারটা মাসলা মাসায়েল বের করে একটি জটিল ধর্মে পরিণত করেছে যা শিক্ষা করতে একজন মানুষকে তার জীবনের দেড় দুই যুগ পার করে দিতে হবে। সুতরাং সেটা সবার পক্ষে অসম্ভব। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার মতো একটি কৃত্রিম সংকট তারা তৈরি করে রেখেছেন এবং তারপর যুক্তি উপস্থাপন করছেন যে, আপনার বাবা-মায়ের বিয়ে হতো না আমরা না থাকলে ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞতাই বড় পাপ আর আমাদের পূর্বপুরুষকে এবং বর্তমান প্রজন্মকেও অজ্ঞ বানিয়ে রেখেছে যারা তারাই বড় পাপী।

সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে বলা হয়েছে, “ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো নবী অতি-মানব নহেন, তাঁহার কোনো উত্তরাধিকারী ধর্মাধিকরণরূপে অভ্রান্ত (Infallible) বিধান দেওয়ার কোনো অধিকার লাভ করে না, অনুসারীর পাপ মোচনের ক্ষমতা অর্জন করে না। পৌরোহিত্য বা যাজকত্বের স্থান ইসলামে নাই। সুতরাং Theocracy (মোল্লাতন্ত্র) -ও ইসলামে অবান্তর। ধর্মপুস্তক অর্থাৎ কোর’আনের অধ্যয়ন এবং ইহার ব্যাখ্যা দান কোনো Consecrated সম্প্রদায়ের বা কোনো বর্ণের বিশেষ ইখ্তিয়ারভুক্ত নহে। বরং ইবাদাত এবং নীতিনিষ্ঠ জীবনের প্রয়োজনে কিছুটা কোর’আন শিক্ষা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বিবেচনায় ইসলাম বাধ্যতামূলক শিক্ষা-নীতির প্রবর্তক।” (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম খ- ১৯৪ পৃ, ইসলাম অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।

জ্ঞান আর অন্ধত্ব পরস্পর বিপরীত ধারণা। ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরদ মানেই অন্ধত্ব নিষিদ্ধ। কিন্তু সেই জ্ঞান কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ার কারণে আজ এই ধর্মবিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষই ধর্মান্ধ। তারা কোর’আন হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য পড়েও নির্বোধের মতো ঐ ধর্মব্যবসায়ীদের মুখপানে চেয়ে থাকেন। ধর্মব্যবসায়ীদের প্রভাবে তারা কোর’আন হাদিস সব অস্বীকার করে ফেলেন, তাদের কাছে একটাই অকাট্য যুক্তি, “মাওলানা সাহেব কি কম বুঝেন? তিনি যখন বলেছেন তখন আল্লাহ রসুল কী বললেন, সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করার কে?” বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর চিন্তার এই জড়ত্ব, হৃদয়ের অন্ধত্ব যতদিন না যাবে ততদিন ইসলাম ঐ পুরোহিত শ্রেণির কুক্ষিগতই থাকবে, মুসলিম জাতির ভাগ্যেরও কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।

[রিয়াদুল হাসান, সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...