হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দিবসকেন্দ্রিক সমাজের কাঁধে আদর্শের লাশ

রিয়াদুল হাসান
মে দিবস সকালে আমার ফোনে সরকারি ম্যাসেজ আসলো – ‘মালিক শ্রমিক ভাই ভাই- সোনার বাংলা গড়তে চাই’। ম্যাসেজটি পড়ে আমার মনে প্রশ্ন এলো- এই যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে চাচ্ছে এই ভ্রাতৃত্ব কীসের ভিত্তিতে গড়ে তোলার কথা ভাবছে তারা। সেই ভিত্তির কথাটি কেউ স্পষ্ট করে বলছে না। মালিক ও শ্রমিক শ্রেণি সহোদর নয়, তারা আত্মীয় স্বজন বা মামাতো চাচাতো ভাইও নয়। তাদের সামাজিক অবস্থানের ব্যবধান আকাশ আর পাতাল। এই দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু শিক্ষা, কিছু যুক্তি, একটি আদর্শ বা দর্শন তাদের মধ্যে স্থাপন করতে হবে যার আলোকে তারা একে অপরকে ভাই হিসাবে আপন করে নেবে, সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখবে। একটি আদর্শ ছাড়া কখনওই দুটো ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ বিশেষ করে যাদের মধ্যে মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক তারা ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হতে পারে না। সেখানে থাকতে পারে করুণার সম্পর্ক, থাকতে পারে আনুগত্যের সম্পর্কে। কিন্তু ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের অধিকার ও দাবি সেখানে নিতান্তই খাপছাড়া। মালিকরা যদিও বা করুণার দ্বারা সিক্ত হয়ে শ্রমিকদেরকে ভাই বলে মনে করতে পারেন, শ্রমিকরা কি পারবে বুর্জোয়া শ্রেণির একজন মানুষকে যে কিনা তারই রুটি-রুজির যোগানদাতা তাকে ভাই বলে ভাবতে এবং তেমনিভাবে আচরণ করতে? এটা যারা মেসেজগুলো পাঠাচ্ছেন তারাও জানেন, যারা এ দিবস নিয়ে রাস্তা গরম করছেন তারাও জানেন। মালিক ও শ্রমিক শত শত বছর ধরে একে অপরের প্রায় শত্রু হিসাবে সমাজে বসবাস করে এসেছে। মুখের কথায়, দিবস পালনের মাধ্যমে এই শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশত্রুতা নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। একদিন যদি শ্রমিক দিবস হয় তো বছরের বাকি দিনগুলো হয়ে থাকে মালিক দিবস, সে সময় আর মালিক-শ্রমিক ভাই ভাই থাকেন না। তাই এই একটি দিনে যতই মিছিল, মিটিং আর গণসঙ্গীত চর্চা করা হোক সারা বছর তার কোনো মূল্য থাকে না।
দিবস পালন সার্থক হতো যদি এর দ্বারা সত্যিই সমাজে মালিক শ্রমিকের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ কর্মস্থল প্রতিষ্ঠিত হতো। দিবস পালনের দ্বরা সেটা দেড়শ বছরেও যখন হয় নি, তখন হাজার বছরেও হবে না। এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে যদি কোনো সঠিক আদর্শে মালিক শ্রমিকসহ সমাজের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যায়, যদি এমন কোনো জীবনব্যবস্থা তাদের জীবনে প্রয়োগ করা যায় যার দ্বারা প্রতিটি মানুষ- ধর্মবর্ণ, মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ একে অপরকে ভাই বলে গ্রহণ করবে।
মালিক শ্রমিক ভাই ভাই এই কথাটি আমরা মে দিবস আসলে শুনে থাকি। এটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় ইতিহাসের সেই দিনগুলোর কথা যখন সত্যিই মালিক-শ্রমিক ভাই ভাইতে পরিণত হয়েছিল। আমার মনে পড়ে সেই মক্কাবিজয়ের ঘটনা যেদিন কোরায়েশদের মুক্তদাস বেলাল (রা.) পবিত্র কাবা শরিফের ছাদের উপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, মানুষ ঊর্ধ্বে, মানবতা ঊর্ধ্বে। মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য গড়ে দেয় কেবল তার চরিত্র, তার তাকওয়া। ন্যায় ও অন্যায় মেনে চলার ক্ষেত্রে যে বেশি সতর্ক সেই সমাজে সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান হবে। অধিক সম্পদ কাউকে সম্মান এনে দেবে না, সম্মান এনে দেবে তার সততা, শিক্ষা, আমানতদারী, সত্যনিষ্ঠা।
আমার মনে পড়ছে মসজিদে নববীতে রসুলাল্লাহর জীবনের শেষ ভাষণের কথা যেদিন তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করে থাকি তাহলে এই যে আমার পিঠ উন্মুক্ত করে দিলাম, সে তার প্রতিশোধ নিয়ে নাও।” মানবজাতির মুকুটমণি শেষ রসুল যখন এই কথাগুলো বলছেন তখন সাড়ে বারো লক্ষ বর্গমাইল এলাকার তিনি শাসক, সর্ববিষয়ে নিরুঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। সাম্যের এত বড় উদাহরণ আর কেউ কোনোদিন সৃষ্টি করতে পেরেছেন? আমরা সেই উদাহরণগুলোকে দেখতে চাই না কারণ আমাদের সামনে পশ্চিমা সভ্যতা ইসলামকে অত্যন্ত নেতিবাচকরূপে উপস্থাপন করেছে। শুধু তাই নয়, প্রচলিত ইসলামও এই সাম্যের ইসলামকে তাদের জীবনে ও কর্মে প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেই ইসলাম তাই চাপা পড়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
আমার মনে পড়ছে সেই ইতিহাস যখন ‘ক্রীতদাস’ যায়েদের নেতৃত্বে, পরবর্তীতে ‘দাসপুত্র’ ওসামার নেতৃত্বে যুদ্ধযাত্রা করেছে আরবের অভিজাতেরা। এমন কি ওমর, ওসমান, আবু বকর (রা.) প্রমুখ সাহাবীগণও ওসামাকে তাদের সেনাপতিরূপে মেনে নিয়েছিলেন। সেই বাহিনীর মধ্যে সেনাপতি আর সাধারণ সৈনিকের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য ছিল না, তারা একই রকম পোশাক পরতেন, একত্রে বসে এক থালায় খাবার খেতেন।
আমার মনে পড়ছে সেই দিনের কথা যেদিন অনলবর্ষী সূর্যের নিচে তপ্ত বালুকারাশির উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন অর্ধপৃথিবীর খলিফা ওমর। তাঁর হাতে ধরা উটের রশি। উটের পিঠে বিব্রতমুখে বসে আছেন তাঁর ভৃত্ত। ওমরের (রা.) মনে ছিল রসুলাল্লাহর সেই ভাষণ, “তোমাদের খেদমতকারী তোমাদের ভাই, তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা-ই খাওয়াবে, তোমরা যে পোশাক পরবে তাদেরকে সেই মানের পোশাকই পরাবে। মনে রাখবে তারাও মানুষ। তাদেরও একটি হৃদয় আছে যা দুঃখ পেলে কাঁদে, আনন্দে উৎফুল্ল হয়।” তখন কোনো শ্রমিক দিবস ছিল না, শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল না, কিন্তু মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ছিল ভ্রাতৃত্ব। এই ভ্রাতৃত্ব এসেছে এক মহান আদর্শে তাঁরা দীক্ষা নিয়েছিলেন বলেই। তাই আটার ভারি বস্তাটি ওমর নিজের ভৃত্তের পিঠে না চাপিয়ে নিজেই বহন করেছিলেন। তাঁরা জানতেন আল্লাহর কাছে একদিন মালিক শ্রমিক, খলিফা ও ভৃত্ত উভয়কেই এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। সেদিন তাদের মধ্যে সমতাবিধান করা হবে। দুই দিনের এই পৃথিবীতে কার কী পরিচয়, কী সামাজিক অবস্থান তার কোনো মূল্যই সেদিন থাকবে না। ইসলাম তাদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছিল যে, সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি, তারা এক বাবা-মায়ের থেকে আগত। সুতরাং তারা সৃষ্টিগতভাবেই ভাই-ভাই, কেউ তাদের মধ্যে কোনোপ্রকার বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করবে ইবলিস যে মানুষের চিরশত্রু। তাই যাবতীয় বিভাজনের প্রাচীরকে লুপ্ত করে দেওয়ার মাধ্যমেই আল্লাহর অভিপ্রায়ের পূর্ণতাবিধান করতে হবে মানুষকে। এটাই হচ্ছে মানুষের এবাদত।
মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেয়ে কঠিক কোনো কাজ নেই। কিন্তু সেই শিক্ষা আরবের মানুষগুলোর হৃদয়গুলোকে এক সূত্রে বাঁধতে পেরেছিল। এর জন্য তাঁদেরকে প্রশিক্ষিত হতে হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে। তারা একসঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে সালাহ কায়েম (নামাজ) করেছেন, সে সময় তাঁরা মনে মনে ভেবেছেন, আমার পাশে যে দাঁড়িয়েছে সে হয়তো এককালে ক্রীতদাস ছিল, সে হতে পারে আমার চাইতে বিদ্যাবুদ্ধিতে কম কিন্তু হয়তো আল্লাহর দৃষ্টিতে সে হয়তো আমার চাইতে আপন। সেই সমানে ন্যায়বিচারের চর্চা হতো। ভৃত্তকে অন্যায়ভাবে আঘাত করার দরুন বহু মালিক দণ্ডিত হয়েছে। কোনো আভিজাত্যের অহঙ্কারের প্রশ্রয় পেত না সেই সত্যনিষ্ঠ শাসকদের সামনে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেই মানুষগুলোও ছিল প্রত্যেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এভাবে তাদের সমাজে ছিল ন্যায় বিচার। মনে পড়ছে সেই বজ্রকঠিন ঘোষণা- আজ আমার প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতেমাও যদি যদি চুরি করত তাঁকেও আমি এই দণ্ডই দিতাম।” রসুলাল্লাহ সেই জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন যে জাহেলিয়াতের যুগে একজন ধনী ও ক্ষমতাবান মানুষকে বিচারক দণ্ড প্রদান থেকে বিরত থাকতেন, কিন্তু দুর্বলের উপর ঠিকই প্রবল হয়ে দণ্ড বিধান করতেন।
আজ আমাদের জীবনব্যবস্থায় সেই শিক্ষা নেই, সেই আদর্শ নেই, সেই ন্যায়বিচার নেই। কেবল আছে মুখে মুখে বড় বড় বুলি, সাম্যবাদের গালভরা কথা। গালভরা কথায় গাল ভরে, কিন্তু পেট ভরে না। এ কারণেই কার্ল মার্কসের সাম্যবাদ মানুষকে শান্তি দিতে পারে নি, অর্থনৈতিক মুক্তিও দিতে পারে নি। গণতন্ত্রও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে। এইসব আদর্শের শব আর আধমরা দেহগুলোকে কাঁধে নিয়ে আত্মপ্রতারণার এক দুর্গন্ধময় যুগ অতিক্রম করছে মানবজাতি।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...