হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইসলামের ভিত্তি ‘তওহীদ’ আজ হারিয়ে গেছে

মো. মশিউর রহমান
আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (স.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর সময় এই দীনের মূলমন্ত্র রাখা হয়েছে-একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) – এবং পরে যোগ হয়েছে তদানীন্তন নবীর নাম। এই কলেমার মূলমন্ত্রে কখনো এই ইলাহ শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ স্রষ্টা ব্যবহার করেন নি। এটা এই জন্য যে তিনি ‘একমাত্র’ হুকুমদাতা, একমাত্র সার্বভৌমত্বের মালিক যার আদেশ নিষেধ ছাড়া আর কারো আদেশ নিষেধ গ্রাহ্য নয়, যার বিধান এবং নির্দেশ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি ব্যাপারে অলংঘনীয়। কলেমার এই ঘোষণামতে কেউ যদি তাঁর কতগুলি আদেশ নির্দেশ মেনে নিলো কিন্তু অন্য কতকগুলি অস্বীকার করলো, তবে তিনি আর তার ‘একমাত্র’ ইলাহ রইলেন না। সংক্ষেপে এই দীনের ভিত্তি তওহীদের মর্মার্থ হচ্ছে আমি জীবনের প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য আছে সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি যে বিভাগেই হোক না কেন, সেই ব্যাপারে আমি আর কারও কোন বক্তব্য, নির্দেশ মানি না। যে বিষয়ে আল্লাহ অথবা তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য নেই সে বিষয়ে আমরা স্বাধীনভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। এর ঠিক বিপরীত হচ্ছে শেরক। সেটা হচ্ছে, জীবনের যেখানে, যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য বা বিধান আছে, সেখানে তাদের সেই বিধানকে অমান্য করে অন্য কারও তৈরি বিধান মানা। আজ এই শেরকে পুরো মানবজাতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে। অথচ যে বা যারা আল্লাহর তওহীদে থাকবে না, যারা তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের যে কোন একটি ভাগে, অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা নিজেদের তৈরি আইন-কানুন, রীতি-নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করবে তাকে বা তাদের আল্লাহ মাফ না করার অঙ্গীকার করেছেন (সুরা নেসা ৪৮)। তাদের কোন আমলই আল্লাহ গ্রহণ করবেন না।

আল্লাহর এই সুস্পষ্ট ঘোষণা সত্ত্বেও অনেকে বলতে পারেন আমরা কিভাবে কাফের মোশরেক হলাম, আমরা তো নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ করি। তাদের এই মনোভাবের জবাবে বলতে চাই মক্কার কাফের মোশরেকরা রসুল (স.) কে এই কথাই বলতো। রসুলাল্লাহর সমসাময়িক সময়ের যাদেরকে আমরা কাফের মোশরেক বলে জানি, অর্থাৎ আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবা, তাদের ধর্মীয় অবস্থা বর্তমান মুসলিম দাবিদারদের থেকে মোটেই আলাদা নয়। আমাদের মাঝে একটা ভুল ধারণা আছে যে তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখতো না, আল্লাহকে আল্লাহ বলে মানতো না ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর কোর’আন এবং ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। ঐ আরবরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করতো, নামাজ পড়তো, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করতো, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ করতো, কোরবানী করতো, রোজা রাখতো, আল্লাহর নামে কসম করতো, আমাদের মতই ইব্রাহিম (আ.)-তারা জাতির পিতা বলে বিশ্বাস করতো, ইব্রাহিম (আ.)-কে তাদের নবী হিসাবে মানতো। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে-শাদির কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আল্লাহর নাম লিখতো। তারা লিখতো বেসমিকা আল্লাহুম্মা, অর্থাৎ তোমার নাম নিয়ে (আরম্ভ করছি) হে আল্লাহ। আরবের মোশরেকরা আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথায় সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন, “তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (সুরা যুখরুফ- ৯)।” এমন আয়াত আরও আছে।

ইতিহাস ও আল্লাহর সাক্ষ্য, দু’টো থেকেই দেখা যায় যে, যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর রসুল প্রেরিত হলেন তারা আল্লাহকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতো। তারা হাবল লা’ত, মানাতের পূজা করতো ঠিকই কিন্তু ওগুলোকে তারা আল্লাহ বলে বিশ্বাস করতো না, ওগুলোকে স্রষ্টা বলেও মানতো না। তারা বিশ্বাস করতো যে হাবল, লা’ত, মানাত, ওজ্জা এরা দেব-দেবী, যারা ওগুলোকে মানবে, পূজা করবে তাদের জন্য ঐ দেব-দেবীরা সেই আল্লাহর কাছেই সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস ১৮, সুরা যুমার ৩)। ঠিক যেমন আজকে পীরদের ব্যাপারে মানুষ ধারণা করে থাকে।

আজকে মুসলিম নামক এই জাতি যে অবস্থায় আছে তাদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। এরাও আল্লাহ বিশ্বাস করে, নিজেদেরকে মোহাম্মদ (স.) এর উম্মাহ বলে বিশ্বাস করে, হজ করে, কোরবানী করে, খাতনা করে। মক্কার ঐ লোকগুলো ব্যক্তি জীবনে এত কিছু করার পরও তাদেরকে আল্লাহ কাফের মোশরেক বললেন কেন? কারণ তারা আল্লাহর তওহীদ মানতো না, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানতো না, তাদের জাতীয়, সমষ্টিগত জীবন পরিচালিত করতো নিজেদের সমাজপতিদের তৈরি করা আইন বিধান দ্বারা। এজন্য আল্লাহর রসুল এসে প্রথমেই তাদেরকে অন্য কোন কিছু না বলে কেবলমাত্র তওহীদ মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন এবং প্রচণ্ড বাধা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্নভাবে কালেমার বালাগ চালিয়ে গেলেন। নবুয়্যতের প্রথম ১৩ বছর তিনি অন্য কোন কিছুর দিকে আহ্বান করেন নি। তিনি বলেন নি যে, তোমাদের হজ হয় না, হজ ঠিক করে নাও, নামাজ হয় না নামাজ ঠিক করে নাও, কোরবানী হয় না ইত্যাদি ঠিক করে নাও। এমন কি সমাজে তাঁর চোখের সামনে যে অবিচার হতো তিনি সেগুলোরও কোন প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেন নি। শুধুমাত্র নিরবচ্ছিন্ন্নভাবে তওহীদের ডাক দিয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হলে সমাজ থেকে সর্বরকম অন্যায়, অবিচার অর্থাৎ অশান্তি দূর হয়ে যাবে।

বর্তমান দুনিয়াতে যে ইসলামটি চালু আছে তাতে এই সর্বাঙ্গীন তওহীদ নেই, সর্বত্র আল্লাহকে কেবল উপাস্য বা মা’বুদ হিসাবে মানা হচ্ছে, কিন্তু ইলাহ বা সার্বভৌমত্বের আসনে আল্লাহ নেই। তওহীদবিহীন ইসলাম মানেই প্রাণহীন, আত্মাহীন জড়বস্তু। মানুষ নিজেই এখন নিজের জীবনব্যবস্থা তৈরি করে সেই মোতাবেক জীবন চালাচ্ছে, মানুষ নিজেই ইলাহ অর্থাৎ বিধাতার আসনে আসীন। মানুষের তৈরি জীবন-ব্যবস্থাগুলিকেই (দীন) মানবজীবনের সকল সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান হিসাবে মনে করা হচ্ছে যদিও সেগুলির সবই মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। মানুষের ইলাহর আসন থেকে আল্লাহকে সরিয়ে (উবঃযৎড়হরহম) দিয়ে সেখানে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’-কে অর্থাৎ মানুষকে বসিয়ে (Replacement) যে ধর্ম পালন করা হচ্ছে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আমাদের বৃহত্তর ও সমষ্টিগত জীবনে গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার ও গ্রহণ করে নিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের সার্বভৌমত্বটুকু আমরা আল্লাহর জন্য রেখেছি। সেই জাল্লে-জালাল, আজিজুল জব্বার, স্রষ্টা ভিক্ষুক নন যে তিনি এই ক্ষুদ্র তওহীদ গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ওটা তওহীদই নয়, ওটা শেরক ও কুফর। পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে গেলে এমনি করে করতে হয়:

জীবনব্যবস্থা (System)-সার্বভৌমত্ব (Sovereignty)
রাজতন্ত্র-রাজা, বাদশাহ, সম্রাট

গণতন্ত্র-জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা
সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ-জনসাধারণের একটি বিশেষ শ্রেণি
ফ্যাসিবাদ-এক নায়ক বা ডিক্টেটর
ইসলাম-আল্লাহ

এই বিন্যাসই এ কথা পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোন আপস সম্ভব নয়। ওপরের যে কোনো একটাকে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনটি স্বীকার, গ্রহণ করে নিলে সে আর মুসলিম বা মো’মেন থাকতে পারে না। কোন লোক যদি ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ বিশ্বাসী এবং জাতীয় জীবনের আল্লাহ ছাড়া ওপরের যে কোনটায় বিশ্বাসী হয় তবে সে মোশরেক। আর উভয় জীবনেই কোন লোক যদি আল্লাহ ছাড়া ঐগুলির যে কোনটায় বিশ্বাস করে তবে সে কাফের। তাই এই মুসলিম দাবিদার জনসংখ্যাটি তাদের জাতীয় জীবনে কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ রাজতন্ত্র, কেউ একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্র-মন্ত্র, রংস, পৎধপু ইত্যাদি মেনে চলছে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে ঐ সমস্ত তন্ত্রমন্ত্রের সার্বভৌমত্ব মানছে, এভাবে তারাও শেরক ও কুফরে আকণ্ঠ ডুবে আছে। অতএব এখন মুসলিম জাতিকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কার সার্বভৌমত্ব মেনে নিবে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করবে।

[লেখক: সভাপতি, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ হেযবুত তওহীদ; ইমেইল: opinion.hezbuttawheed@gmail.com ফোন:০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...