হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সোনালি দিন: চোরগুলি কোথায় থাকবে?

আমরা ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত দয়ালু, উদার ও দানশীল হাতেম তাঈয়ের নাম শুনে আসছি। তাঁকে নিয়ে গল্প পড়েছি, নাটক হয়েছে, এমনকি চলচ্চিত্রও হয়েছে বড় পর্দায়! অনেকের ধারণা, দাতা হাতেম তাঈ মূলত কাল্পনিক মানুষ বা গল্পের নায়ক। বাস্তবে এমন কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ইতিহাস বলে, আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন মক্কা বিজয়ের পর আরবের ছোট ছোট শহর অধিকার করছিলেন, তখনও পার্শ্ববর্তী কিছু কিছু শহরে মূর্তিপূজা চলছিল। কুল্স ছিল ‘তাঈ’ গোত্রের পৌত্তলিকদের একটি বিশাল দেবালয়। এই দেবালয়ের দেবতাদের প্রতিমূর্তিগুলোকে ‘ইলাহ’ এর তথা হুকুমদাতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। তাই এটাকে ধ্বংস করার জন্য রাসুলাল্লাহ (সা.) ১৫০ জন অশ্বারোহীসহ আলীকে (রা.) পাঠান।

হাইল শহরে একজন নামকরা ব্যক্তি ছিলেন হাতেম আত-তাঈ নামে গোত্রপ্রধান। যার নাম প্রায় সব আরবরাই জানতো। তাঁর দানশীলতা ও উদারতা ছিল শিখরছোঁয়া এবং এটাই ছিল তাঁর খ্যাতির অন্যতম কারণ। এজন্য হাতেম তাঈ ছিলেন সেই গোত্রের প্রধান। তাঁর সময়টা ছিল ইসলাম পূর্ব সময়ে। তিনি ৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ রসুলাল্লাহ যখন আট বছরের বালক তখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ‘আদি ইবনে হাতেম’ গোত্রের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
আদি যখন জানতে পারলেন রসুলাল্লাহর অনুসারীরা তাঈ গোত্রের দিকে যুদ্ধযাত্রা করেছেন, তখন তিনি পালানোর রাস্তা খুঁজতে থাকেন। কিছু সম্পদসহ উট প্রস্তুত করে রাখেন। যখন নিশ্চিত হলেন মদিনার সৈন্যরা আসছে, তখন তিনি তাঁর গোত্রকে পরিত্যাগ করে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সৌদি আরবের উত্তরে রোমানদের কাছাকাছি এক শহরে পালিয়ে আসেন। আদি আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে রোমানদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। ওদিকে আলী (রা.) নেতৃত্বে মো’মেন মুজাহিদগণ তাঈ গোত্রকে পরাজিত করে কিছু যুদ্ধবন্দী ও তাদের গৃহপালিত পশুগুলোকে মদিনায় নিয়ে আসেন। হাতিম তাঈর কন্যা অর্থাৎ আদির ভগ্নি সফানাকেও সেখান থেকে বন্দি অবস্থায় মদিনায় আনা হয়। তিনি নিজের পিতার পরিচয় জানিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের দাবি জানান।

তাকে রাসুলাল্লাহর (সা.) নিকট আনা হলে তিনি রাসুলাল্লাহর (সা.) নিকট প্রার্থনা করলেন, ‘হুযুর, আমি জগদ্বিখ্যাত দানবীর হাতিম তাঈর কন্যা। আমার ভাই আদি আপনার সেনা বাহিনীর ভয়ে আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমি নিঃসহায় অবলা নারী। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন, আল্লাহ তা’আলা আপনার প্রতি দয়া করবেন।’

রাসুলাল্লাহ (সা.) সসম্মানে সফানাকে মুক্তি দিলেন এবং নির্বিঘ্নে বাড়িতে পৌঁছাবার জন্য একটি উট সঙ্গে দিয়ে দিলেন। এমন সদ্বব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সফানা খুব আনন্দিত হলেন। তিনি তাঁকে মুক্তি দিলেন শুধু হাতেম তাঈয়ের মেয়ে হওয়ার কারণে। তাঁর ভাই আদি আক্রমণের সময় বোনকে রেখে পালিয়ে গেছে শুনে রাসুলাল্লাহ (সা.) প্রথমে অনেকটা ক্রোধ প্রকাশ করেন। তারপর ফিরে গিয়ে ভাইকে পরামর্শ দিতে বলেন, সে যেন রাসুলাল্লাহর (সা.) সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে এবং আদিকে জানায়, ‘মোহাম্মদ (সা.) যদি নবী হন, তাহলে তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখে তাঁর ধর্ম যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করবে, ততই তাঁর মঙ্গল হবে। আর যদি তিনি রাজা হন, তাহলে সুসম্পর্ক গড়ে কিছু অনুগ্রহ বা সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।’
বাড়িতে পৌঁছেই সফানা তার ভাইকে বলতে লাগলো, ‘ভাইজান, রাসুলাল্লাহও (সা.) আমাদের শ্রদ্ধেয় পিতার ন্যায় অতি হৃদয়বান লোক। উনার সদয় ব্যবহার দেখলে শত্রু-মিত্র কেউই তাঁর প্রশংসা না করে থাকতে পারে না। আপনি খুব দ্রুতই তাঁর সাথে দেখা করুন।’

পরবর্তী ঘটনা আদি ইবনে হাতেম নিজেই বর্ণনা করেন, ‘মোহাম্মদ (সা.) এর চেয়ে আর কেউ আমার কাছে এত বিদ্বেষের ছিলেন না। কিন্তু আমি নিজেকে আশ্বাস দিয়ে বলতে লাগলাম, যদি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেখি তিনি যা বলেন তা সত্য বাণী, তাহলে সরাসরি তাঁর কাছ থেকে শুনব আর যদি তা না হয়, তাতেও আমার তেমন ক্ষতির কিছু নেই। ভগ্নির কথায় উৎসাহিত হয়ে আমি কোন নিরাপত্তা ছাড়াই মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। তখন রাসুলাল্লাহ (সা.) মসজিদে ছিলেন। মদিনায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোক আমাকে চিনে ফেলে এবং চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘সবাই দেখো, উনি হাতেম তাইয়ের ছেলে আদি’ সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা অতিউৎসাহে তাঁকে ঘিরে ফেলল। তারা তাঁকে রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘উনি হাতেম তাইয়ের ছেলে আদি।’

আমার পরিচয় পেয়ে তিনি আমাকে যথেষ্ট সম্মান ও অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর বললেন, ইয়া আদি, আসলিম তুসলিম’ (হে আদি, ইসলাম গ্রহণ করো এবং তুমি নিরাপদ হবে)। আদি উত্তর দিলেন, ‘আমি তো একটি ভালো ধর্মের অনুসারী।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও দুইবার বললেন, আদি একই উত্তর দিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে আদি, আমি তোমার ধর্ম সম্বন্ধে তোমার থেকে বেশি জানি। তুমি কি তোমার গোত্রের প্রধান নও?’ আদি বললেন, ‘হ্যাঁ’। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাদের আয়ের চার ভাগের এক ভাগ তোমরা কর হিসাবে নাও না?’, ‘হ্যাঁ, নেই।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো যে তোমার নিজের ধর্ম এটা নিষেধ করে?’ আদি কিছুটা লজ্জা পেলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আদির হাত ধরে তাঁর ঘরের দিকে রওনা দিলেন।

‘পথিমধ্যে এক শিশুসহ একজন বৃদ্ধা ওনাকে থামালেন এবং তাঁর সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নারীটির আশ্বস্ত হওয়া পর্যন্ত কথা বললেন। আমরা তাঁর ঘরে এলে উনি এক পুরাতন ছেঁড়া মাদুর আমার নিচে দিয়ে বসতে বললেন। আমি তখন চিন্তা করছিলাম এই লোক সম্ভবত রাজা নন। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে আর কিছু না দেখে তাঁকে বসতে বললাম। তিনি জোর করে আমাকেই বসতে বললেন। আমি মাদুরে বসে পড়তেই তিনি মাটিতে বসলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আর কোনো প্রভুকে জান কি না আল্লাহ ছাড়া? আমি উত্তর দিলাম, ‘না’। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এমন কাউকে চিনো কি না, যে আল্লাহ থেকে বেশি ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী? আমি আবার বললাম, ‘না’। তখন তিনি বললেন, ‘ইয়াহুদিরা আল্লাহর ক্রোধের পাত্র ও খ্রিষ্টানরা পথভ্রষ্ট এবং যা তারা বিশ্বাস করে তা ভুল’।
তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি বোধহয় ইসলাম গ্রহণ করছ না আমার আশপাশের মানুষগুলোর অবস্থা দেখে (রাজনৈতিক দুর্বলতা ও দারিদ্র্য ইত্যাদি)। তুমি কি হিরা শহরের নাম শুনেছ?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। তবে কখনো যাইনি ওই শহরে’। নবী (সা.) বললেন, ‘এটা শুধু সময়ের ব্যাপার, যখন কোনো নারী একাকি হিরা শহর থেকে মক্কায় কাবা তাওয়াফ করার জন্য আসবে। তার সঙ্গে একজনও নিরাপত্তাসঙ্গী থাকবে না। তার ভয়ের কোন কারণ থাকবে না। এটাও খুব শীঘ্রই ঘটবে যখন আমার উম্মাহ বাবেল নগরের শ্বেত প্রাসাদ পর্যন্ত জয় করবে। কিসরার (পারস্য সম্রাট) ধনভাণ্ডার আমাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে’।

আমি তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন কিসরা, হরমুজের ছেলে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, কিসরা, হরমুজের ছেলে। আর প্রকৃতপক্ষে এটাও সময়ের ব্যাপারমাত্র যখন মানুষ মদিনার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে সাদকা দিতে চাইবে কিন্তু একজনকেও সাদকা দেওয়ার যোগ্য পাবে না’। এটা শুনে আমি মুসলিম হয়ে গেলাম।

আদি (রা.) পরবর্তী জীবনের কথা মনে করে বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহর (সা.) তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর দুইটাই স্বচক্ষে দেখেছি। মুসলিম রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা নিজে দেখেছি এবং আমি নিজে তাতে অংশগ্রহণ করেছি। [এখানে ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী টেসিফান বিজয়ের যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে।]

আদি বলেন, ‘তারপর জনৈক আনসারী সাহাবীর ঘরে কিছুদিন অতিথিরূপে অবস্থান করলাম। প্রতিদিন সকালে ও বিকালে আমি রাসুলাল্লাহর (সা.) নিকটে হাজির হতাম। একদিন তাঁর নিকট একদল লোক এসে হাজির হল। তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ধন-সম্পদ বাড়িয়ে দিয়ে তোমাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করেছেন। তোমরাও তা হতে অন্যদের দান করে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। এটাই তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। একটি খেজুর কিংবা খেজুরের এক টুকরা হলেও আল্লাহর রাস্তায় দান কর। তাও যদি সম্ভব না হয় তবে মুখের মিষ্টি বাণী দিয়ে মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার কর। তোমাদের প্রত্যেকেরই আল্লাহর সম্মুখে হাজির করা হবে। তখন আল্লাহ তা’আলাও তোমাদেরকে এগুলো স্মরণ করিয়ে দিবেন। আল্লাহ বলবেন- ‘আমি তোমাদেরকে ধনসম্পদ ও সন্ততি দান করেছিলাম না?’ বান্দা বলবে- হ্যাঁ। তখন আল্লাহ আবার বলবেন, ‘আজকের জন্য তোমরা কি রেখেছ?’ সে ডানে, বামে, সম্মুখে ও পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করে কিছুই পাবে না। তার দুনিয়ার কোন সম্পদই তাকে দোযখ থেকে রক্ষা করতে আসবে না।

এরপর রাসুলাল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে লোকসকল, তোমরা অভাবগ্রস্ত হবে, এই আশঙ্কা আমার নেই। কারণ, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সহায় থাকবেন। তিনি তোমাদেরকে এরূপ সম্পদশালী বানিয়ে দিবেন যে, একজন অবলা নারী মদিনা হতে একাকী ‘হিরা’ পর্যন্ত বরং তদপেক্ষা দূরবর্তী পথ ভ্রমণ করবে, অথচ তার অন্তরে চুরি হওয়ার কোন ভয়-আশঙ্কা থাকবে না।’ আদি (রা.) বলেন যে, তখন আমি মনে মনে ভাবছিলাম ‘তাঈ’ গোত্রের চোরগুলি সে সময় কোথায় থাকবে?
একবার আমি তাঁকে আমার পিতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমার বাবা তাঁর আত্মীয়স্বজনদের প্রতি ছিলেন সদয়, দয়ালু এবং মানুষের প্রতি খুব দানশীল, তিনি কি তাঁর কাজের প্রতিদান-পুরস্কার পাবেন?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন, ‘তোমার বাবা যা কামনা-আকাক্সক্ষা করেছিলেন তিনি তা পেয়েছেন।’ (ইবনে হিব্বান)

আদি ইবনে হাতেম (রা.) বেঁচেছিলেন অনেক দিন, অনেকের মতে, ১২০ বছরের কাছাকাছি। তিনি ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা.)-এর হত্যা দেখেছেন, তিনি ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) সঙ্গে মুয়াবিয়ার (রা.) বিরুদ্ধে সিফফিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।

[Dr.Qadi-i Seerah of Prophet (s) থেকে সংকলিত, সম্পাদনায় জাফর আহমেদ]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...