হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সর্বযুগেই দ্বীনের ভিত্তি ছিল ‘তওহীদ’

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি আদমকে (আ.) সৃষ্টি করে তাঁর স্ত্রীসহ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিলেন তিনি হেদায়াহ দিয়ে পথ-প্রদর্শক পাঠাবেন সেই হেদায়াহর অনুসরণ করলে কারও ভয় নেই (বাকারা ৩৮)। যে হেদায়াহ পাঠাবার অঙ্গীকার আল্লাহ করেছেন তাতে যে তিনি ব্যর্থ হবেন না তা স্বাভাবিক। যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রসুল পাঠিয়ে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন, মানুষকে দেখিয়েছেন হেদায়াহ বা সঠিক পথ। এখন দেখা দরকার সেই হেদায়াহ কী ছিল?
পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেবার পর তাঁর প্রথম সৃষ্টি আদমকে (আ.) দিলেন তার জীবনব্যবস্থা। আমরা ধরে নিতে পারি এ ব্যবস্থা ছিল ছোট, সংক্ষিপ্ত- কারণ তখন অল্প সংখ্যক নর-নারীর জন্যই ব্যবস্থা দিতে হয়েছিল। আদম (আ.) এবং তার পুত্র কন্যা ও নাতি-নাতনিদের জন্য এবং সমস্যাও নিশ্চয়ই ছিলো সীমিত। কিন্তু তারপর আল্লাহর হুকুম মোতাবেক বংশবৃদ্ধি চলল। সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আদমের (আ.) সন্তানরা ক্রমে ক্রমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল, ফলে একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। স্রষ্টা কিন্তু তাঁর দায়িত্ব ভুলে গেলেন না। বনি-আদমের বিভিন্ন, বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীতে তিনি তাঁর প্রেরিত পাঠিয়ে তাদের জন্য জীবনব্যবস্থা পাঠাতে থাকলেন- যে ব্যবস্থা অনুসরণ করলে তারা নিজেদের মধ্যে অশান্তি, ফাসাদ, রক্তপাত না করে শান্তিতে (ইসলামে) বাস করতে পারে। এদিকে ইবলিস অর্থাৎ শয়তানও ভুলল না তার প্রতিশ্রুত কাজ। সেও প্রতিটি বনি-আদমের দেহ-মনের মধ্যে বসে তাকে নানা রকম বুদ্ধি পরামর্শ দিতে থাকল, নতুন নতুন উপায় বাতলাতে থাকল যাতে মানুষ তওহীদের চুক্তি থেকে সরে আসে এবং ফলে সেই অন্যায়, ফাসাদ আর রক্তারক্তিতে জড়িত হয়ে পড়ে। যখনই ইবলিস কোন জনসমাজে সফল হয়েছে তখনই আল্লাহ সেখানে নতুন একজন প্রেরিত পাঠিয়েছেন সেটাকে সংশোধন করতে।
এখন দেখা দরকার যে, বিভিন্ন নবীদের মাধ্যমে, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য আল্লাহ যে জীবনব্যবস্থা পাঠালেন সেটা মূলত কী? পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এর মূল ভিত্তি হচ্ছে- স্রষ্টাকে, আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা, বিধানদাতা, সর্বময় প্রভু বলে স্বীকার ও বিশ্বাস করা, অর্থাৎ তওহীদ। আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর সময় দ্বীনের মূলমন্ত্র রাখা হয়েছে-একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এবং পরে যোগ হয়েছে তদানীন্তন নবীর নাম। এই কলেমার মূলমন্ত্রে কখনো এই ইলাহ শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ স্রষ্টা ব্যবহার করেন নি। যেমন কোন নবীর সময় লা রব্ব ইল্লাল্লাহ বা লা মালেক ইল্লাল্লাহ বা তার নিরানব্বই নামের যে কোনটা হতে পারতো, কিন্তু তিনি তার লক্ষাধিক নবীর মধ্যে কোন নবীর সময়ের কালেমাতেই ঐ ইলাহ ছাড়া অন্য কোন নাম ব্যবহার করেন নি এবং প্রত্যেক নবী তাদের জাতির মধ্যে এসে প্রথমেই কলেমা তওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন। আখেরী নবীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
মক্কার তেরোটি বছর বিশ্বনবী মানুষকে কেবল তওহীদের দিকে ডেকে গেছেন। যখন একটি জনগোষ্ঠী সেই আহ্বান স্বীকার করে নিয়েছে তারপর দ্বীনের অন্যান্য বিধি-বিধানগুলো নাজেল হওয়া শুরু হয়েছে। কোর’আন, হাদীসের সর্বত্র তওহীদের যে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে তা অন্য কোনো বিধান, অন্য কোনোকিছুতে দেওয়া হয় নি। আল্লাহর সার্বভৌমত্বে, সেরাতুল মুস্তাকীমে অর্থাৎ তওহীদে যে অটল থাকবে, বিচ্যুত হবে না, তার পৃথিবী ভর্তি গোনাহও তাকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না- এ ব্যাপারে বোখারী, মুসলিমসহ অসংখ্য হাদীস পেশ করা যায়। আল্লাহর নবী বলেছেন- বান্দাদের সাথে আল্লাহর চুক্তি (ঈড়হঃৎধপঃ) হচ্ছে যে তারা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মানবে না, তাহলেই আল্লাহ তাদের কোন শাস্তি দেবেন না (জান্নাতে প্রবেশ করাবেন) (হাদীস – মো’য়াজ (রা.) থেকে বোখারী, মুসলিম)। তিনি আরও বলেছেন- যে হৃদয়ে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর রসুল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন (হাদীস- ওবায়দাহ বিন সোয়ামেত (রা.) ও আনাস (রাঃ) থেকে বোখারী, মুসলিম)। আরেক জায়গায় বলেছেন, জান্নাতের চাবী হচ্ছে তওহীদ (হাদীস- মু’য়ায বিন জাবাল (রাঃ) থেকে আহমদ)। একদিন তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি বলল আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই সে জান্নাতে যাবে।’ একজন সাহাবী আবু যার (রা.) বললেন, যদি সে চুরি ও ব্যাভিচার করে তবুও? আল্লাহর রসুল বললেন তবুও জান্নাতে যাবে। এ কথায় সাহাবী কতটা বিস্মিত হলেন তা বোঝা যায় এ থেকে যে, তিনি বারবার রসুলকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন- চুরি ও ব্যাভিচার করার পরও? তখন আল্লাহর রসুল বললেন, হ্যাঁ, সে চুরি করলেও, ব্যাভিচার করলেও, এমনকি আবু যরের নাক কেটে দিলেও। (হাদীস: বোখারী ও মুসলিম)
এই হাদীসে আল্লাহর রসুল একজন চোর ও ব্যাভিচারীকেও জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন শুধুই তওহীদের ঘোষণার কারণে। হাদীসের বইতে আছে তাই লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত জানতে পারছেন যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ঘোষণা করলে এরকম অপরাধীও জান্নাতে চলে যাবে, কিন্তু বিকৃত আকীদার কারণে কয়জন এই কথাটির সঠিক মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারছেন তাতে সন্দেহ আছে। বর্তমানে ইলাহ শব্দের অর্থ করা হয় উপাস্য। তওহীদের কলেমার অর্থ করা হয় আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ তো অবশ্যই উপাস্য, কিন্তু এটা এই দ্বীনের মূলমন্ত্র নয়, যে মূলমন্ত্রের স্বীকৃতি দিলে অন্য কোনো গুনাহের কাজ কাউকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে ইলাহ হচ্ছেন সেই সত্তা, যার হুকুম মানতে হয়, জীবনের যে অঙ্গনে তাঁর কোনো বক্তব্য আছে সেখানে অন্য সকল হুকুম প্রত্যাখ্যান করতে হয়। এই ঘোষণা যদি কেউ দেয় তাহলে তিনি হবেন তওহীদের সাক্ষ্যদানকারী, তার জান্নাত নিশ্চিত। অন্যদিকে এই তওহীদের বিপরীতে শেরক সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেন- আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন, কিন্তু শেরক কখনই ক্ষমা করবেন না (নিসা: ৪৮)। এমনকি নবী-রসুলদের মধ্যেও যদি কেউ শেরক করতেন তাহলে তার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যেত (আন’আম: ৮৮)। শেরক কতটা অমার্জনীয় অপরাধ তা আরও পরিষ্কার বোঝা যায় যখন কোর’আনে আল্লাহ তাঁর সবচাইতে প্রিয় বান্দা তাঁর আখেরী নবীকেও সতর্ক করে বলে দিচ্ছেন- হে নবী, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহি করা হয়েছে যে, যদি আল্লাহর সঙ্গে আপনি অংশীদার স্থাপন করেন, তাহলে আপনার সমস্ত আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন (সূরা যুমার: আয়াত ৬৫)।
অতএব সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে যে হেদায়াহ পাঠাবার অঙ্গীকার করেছিলেন এবং এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল পাঠিয়ে মানুষকে যে সহজ-সরল পথ দেখিয়েছেন ইসলামের মূলমন্ত্র কলেমায়ে তওহীদই সেই হেদায়াহ, সেরাতুল মোস্তাকীম। এবং ইবলিস, যে কিনা আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে রেখেছে সে আল্লাহর দেওয়া সহজ-সরল পথে ওঁত পেতে বসে থাকবে, মানুষের সামনে থেকে পেছন থেকে ডান দিক থেকে ও বাম দিক থেকে আক্রমণ করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে (আরাফ: ১৬-১৭) তারও মূল লক্ষ্য যে মানুষকে দিয়ে এই তওহীদ অস্বীকার করিয়ে মানবজাতিকে শেরক ও কুফরে নিমজ্জিত করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...