হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

‘যামানার এমাম’ শব্দের অর্থ কী?

কামাল হোসেন:

এমামুযযামান শব্দটির অর্থ যামানার এমাম। যামানা অর্থ যুগ বা সময়; এমাম অর্থ নেতা। শব্দ দুটি মূলত আরবি ভাষা থেকে আগত (বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি) যদিও যামানা শব্দটি ফার্সি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা ভাষায়ও ব্যবহৃত হয়। তাহলে এমামুযযামান তথা যামানার এমাম অর্থ হলো এ সময়ের বা যুগের নেতা, যার আনুগত্যে, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের দেখানো পথে সমস্ত মানবজাতি একতাবদ্ধ হবে। এটা সাধারণ জ্ঞান যে, নেতা ছাড়া কোন দল বা জাতি হওয়া সম্ভব নয়, আর উম্মতে মোহাম্মদী একটি মহাজাতি। সেই জাতি কি কখনও নেতাহীন থাকতে পারে?
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব, মানবতার দিশারী মোহাম্মদ (সা.) আখেরি নবী, বিশ্বনবী। আল্লাহ যুগে যুগে প্রতিটি জনপদে তাঁর বিধানসহ নবী-রসুল পাঠিয়েছেন যেন তারা ঐ বিধান অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করতে পারে। যে জাতি, যে গোত্র আল্লাহর মনোনীত নবী-রসুল, অবতারগণকে মেনে নিয়ে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ঐক্যবদ্ধ থেকেছে তারা শান্তিতে বসবাস করেছে আর যারা এবলিসের প্ররোচনায় নিজেদের মধ্যে অনৈক্য, ভেদাভেদ, দলাদলি ইত্যাদি করেছে তারা পতিত হয়েছে চরম অশান্তিতে। এই অশান্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর আবার যখন আল্লাহ ঐ গোত্রের উপর সদয় হয়েছেন তখন তাঁর একজন মনোনীত নবী-রসুল, অবতার, মহামানব পাঠিয়ে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তির পথে অর্থাৎ ইসলামে ফিরিয়ে এনেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহপাক পুরো মানবজাতিকে এবার এক বিধানের অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করতে চাইলেন।

নেতৃত্বহীন খণ্ডিত উম্মতে মোহাম্মদী
এই লক্ষ্যে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে সমস্ত মানবজাতির জন্য নাজেলকৃত পূর্বের সকল বিধানকে রদ করে তাঁর সর্বশেষ রসুলের মাধ্যমে একটি বিশ্বজনীন জীবনব্যবস্থা পাঠালেন। এবারে তিনি আর কোন নির্দিষ্ট জনপদের জন্য প্রেরিত নন, তাঁর কর্মক্ষেত্র সারা দুনিয়া। তাঁকে আল্লাহ এমন একটি দীন দিলেন যা প্রাকৃতিক ও চিরন্তন। পূর্বের কেতাবগুলোর সংরক্ষণভার আল্লাহ গ্রহণ করেন নি, কিন্তু দীনের শেষ সংস্করণ আল্লাহর কেতাবের রক্ষণভার নিলেন স্বয়ং তিনি নিজে (সুরা হিজর-৫)। আখেরি নবীর আবির্ভাবের পরে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেলো যে, পুরো মানবজাতি হবে একটি জাতি, পুরো মানবজাতির জীবনব্যবস্থা হবে একটি, দীন ইসলাম। তাদের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হবেন একজন, রসুলাল্লাহ। এজন্য আল্লাহর রসুলকে আল্লাহ দায়িত্ব দিয়েছেন অন্য সমস্ত রকম জীবনবিধানের উপরে এই জীবনবিধানকে প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীতে এই দীনটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই লক্ষ্য নিয়ে রসুলাল্লাহ সংগ্রাম শুরু করলেন। রসুলাল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় আরব ভূখণ্ডে দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করলেন। মানুষের জীবনে অপরিমেয় শান্তি আসলো। সেই শান্তিময় সমাজের বর্ণনা দেওয়া এত অল্প পরিসরে সম্ভব নয়। যেহেতু শেষ রসুলের দায়িত্ব সারা দুনিয়ায় দীন কায়েম করা, এবং এই কাজ একার দ্বারা সম্ভব নয়, তাই তাঁকে উম্মতে মোহাম্মদী নামে একটি জাতি তৈরি করতে হয়েছে যে জাতি তাঁর অবর্তমানে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পূরণে কাজ করে যাবে। যতোদিন পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতি একজাতিতে পরিণত হয়ে পৃথিবীর প্রতিটি স্থানে শান্তি অর্থাৎ ইসলাম কায়েম না হবে ততোদিন তাঁর উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ হবে না। আল্লাহ তাঁকে যে উপাধি দিয়েছেন, রহমাতাল্লিল আলামিন-সমস্ত দুনিয়ার উপর রহমতস্বরূপ তাও পূর্ণ হবে না। তাঁর চলে যাওয়ার পর তাঁর সৃষ্ট প্রচণ্ড গতিশীল, দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ যোদ্ধা চরিত্রের সেই প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেলেন ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত এবং পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের উপর এই দীনকে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
রসুলাল্লাহ চলে যাবার পর জাতির এমাম (নেতা, Leader) হলেন আবু বকর (রা.)। তাঁর নেতৃত্বে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেলো। তারপর ওমর (রা.) এবং তাঁর পরে ওসমান (রা.) পর্যন্ত জাতি অখণ্ডই ছিল। এরপর এই পবিত্র দায়িত্ব আসলো আলীর (রা.) উপর। তাঁর সময়ে জাতির জন্য ঘটল এক মহা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, জাতির ঐক্য বিনষ্ট হয়ে গেলো যা ছিল ইসলামের আকিদা, রসুলাল্লাহর শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী কাজ। সেই ঐক্যভঙ্গের পেছনে কে দোষী আর কে নির্দোষ অথবা কে কতটুকু দায়ী তা নিরূপণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, আসল কথা হলো- যে মহান উদ্দেশ্যে রসুলাল্লাহ জাতি সৃষ্টি করেছিলেন এই বিভক্তির পর থেকে ক্রমান্বয়ে জাতি তাদের সেই লক্ষ্য ভুলে গতি হারিয়ে ফেললো। জাতি শিয়া-সুন্নীতে বিভক্ত হয়ে পড়লো। একজন মানুষকে দুই টুকরো করলে যেমন মরে যায় তেমনি এই জাতির ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। জাতির নেতারা সংগ্রাম ত্যাগ করে শান-শওকতের সঙ্গে রাজত্ব শুরু করল, আলেম ওলামারা ব্যস্ত রইলেন শরিয়তের মাসলা মাসায়েলের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে, আর সুফি দরবেশরা চালাতে লাগলেন আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদে আকবর। শিয়া, সুন্নী, উমাইয়া, ফাতেমী, আব্বাসী, তুর্কী, মোঘল, পাঠান সব হলো কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদী আর হলো না, জাতির অখণ্ড নেতৃত্বের ধারণাও সবার আকিদা থেকে হারিয়ে গেলো। আল্লাহ এক হাজার বছর অপেক্ষা করার পরও তারা যখন ফিরলো না, তখন আল্লাহ তাদেরকে ইউরোপের খ্রিষ্টানদের গোলাম বানিয়ে দিলেন। ব্রিটিশদের গোলাম হবার পর জাতির জাতীয় সত্তা বলে কিছু রইল না এখনও নেই। চূড়ান্তভাবে তাদের দাসে পরিণত হলো। তারপর ব্রিটিশ খ্রিষ্টান প্রভুরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তাদের তৈরি বিকৃত ইসলাম কিভাবে শিক্ষা দিলো সেটা এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস।

আল্লাহর অভিপ্রায় কিভাবে পূরণ হবে?
আজ ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জাল সারা দুনিয়াটা দখল করে তার হুকুম কায়েম করে রেখেছে, তাই আল্লাহর অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে গেলে, অর্থাৎ মানবজাতিকে একটি জাতিতে পরিণত করতে হলে আজ সারা দুনিয়াকে দাজ্জালের কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু আল্লাহর অভিপ্রায় হয়েছে এবং আল্লাহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন সেহেতু তা হবেই হবে। প্রশ্ন হলো কিভাবে? এই বিরাট কাজ এখন করবে কে?
আল্লাহর রসুল বলেছেন- যে তার সময়ের এমামের বায়াত না নিয়ে মারা গেলো সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল (মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৯৬); অর্থাৎ মো’মেনরা কখনোই ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হেজরত ও জেহাদ- এই পাঁচ দফার ঐক্যবন্ধনী থেকে আলাদা থাকতে পারে না। মো’মেনদের অবশ্যই একজন এমামের (নেতার) আনুগত্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। হাশরের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি ও জাতিকে তাদের এমামসহ আল্লাহ আহ্বান করবেন। তিনি বলেন, ‘সেই দিন আমরা প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার এমামসহ ডাকবো” (বনি ইসরাইল-৭১)। সেজন্যই সকল যুগে একজন ‘হক্ব এমাম’ থাকা এবং তাঁর আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক। এমাম যদি বাতিল হন, বিপথগামী হন তবে জাতিও তার পেছন পেছন জাহান্নামে প্রবেশ করবে। প্রত্যেক ব্যক্তি, যে এমন জীবনব্যবস্থার অনুসরণ করে যার অনুসরণের অনুমতি আল্লাহ দেন নি সে ব্যক্তি বাতিল এমামের অনুসারী এবং কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তিকে সেই এমামের সাথেই ডাকা হবে এবং তার সাথেই তাকে জাহান্নামে পাঠানো হবে। যেরকম ফেরাউন স¤পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘সে কিয়ামতের দিন তার সম্প্র্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে এবং সে তাদেরকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করবে (সুরা হুদ ঃ ৯৮)’।
এখন বিরাট প্রশ্ন হলো, বর্তমান যুগে এই উম্মাহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীন অবস্থায় আছে যা প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর পক্ষে অসম্ভব এবং অবাস্তব অবস্থা। পৃথিবীর অন্যায়, অশান্তি, হীনতা, লাঞ্ছনা এবং পরকালে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে জাতিকে বাঁচতে হলে অবশ্যই একজন হক এমামের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যথায় এ জাতির মধ্য থেকে যারা মৃত্যুবরণ করবে রসুলাল্লাহর ভাষায় তাদের মৃত্যু হবে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ। এই নেতৃত্বসঙ্কট থেকে আল্লাহ জাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাঁর নিজের পক্ষ থেকে একজন ব্যক্তিকে এই জাতির, তথা মানবজাতির জন্য হক এমাম হিসাবে মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ রসুলাল্লাহর উপর অর্পিত দীনের প্রকৃত যে আত্মা ও আকিদা টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের সন্তান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর হৃদয়ে এলহামের মাধ্যমে নাযেল করেছেন। তিনি মানুষকে আবার তওহীদের পথে আহ্বান করলেন এবং যে মহাসত্য আল্লাহ তাঁকে বুঝিয়েছেন সেটি তিনি মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন। আমরা যারা তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছি আমরা তাঁকে এমাম হিসেবে মানি। আল্লাহ যে তাঁকে সত্য এমাম বলে মনোনীত করেছেন এটা আমাদের দাবি নয়, আল্লাহ নিজে দু’টি বিরাট মো’জেজা ঘটিয়ে তাঁকে সত্যায়ন করেছেন। দু’টি মো’জেজা নিয়েই আমরা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি, যে কেউ চাইলে যাচাই করে দেখতে পারেন।
যাহোক, আল্লাহ যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে রসুলাল্লাহকে পাঠিয়েছিলেন, অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজাতিকে একজাতিতে পরিণত করা ও সুখ শান্তি এবং নিরাপত্তায় লালন করা, আমরা সেই মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে অগ্রসর হচ্ছি। এমামুযযামান যে মহাসত্যের ডাক দিয়েছেন অচিরেই সম্পূর্ণ মানবজাতি সেই ডাকের আওতায় আসবে এনশা’আল্লাহ। এটাও আল্লাহ মো’জেজার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই সমগ্র মানবজাতিকে একজাতিতে পরিণত করার জন্যই যামানার এমামের আবির্ভাব। কিন্তু একটি কথা পাঠককে মনে রাখতে হবে, নবী আর আসবেন না। শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.)। এই ঈমান যাদের থাকবে না তারা অতি অবশ্যই কাফের। কাজেই মাননীয় এমামুযযামান নিজেও হাজার হাজার বার বলেছেন যে, ‘আমি নবী নই, রসুল নই, নবী আর আসবেন না। আমি আখেরি নবীর একজন সাধারণ উম্মত হিসেবে আল্লাহ আমাকে যেটা বুঝিয়েছেন সেটাই আমি তোমাদেরকে বোঝাচ্ছি।’ তবে এটা বাস্তবতা যে শেষ নবী যে আকিদা নিয়ে এসেছিলেন সেই আকিদা এই ১৬০ কোটির মুসলিম দাবিদার জনসংখ্যার কাছে অবশিষ্ট নেই, ইসলাম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলেছে। লক্ষ লক্ষ ধর্মব্যবসায়ী, মাজহাব ফেরকাধারী মোফাসসের, মোহাদ্দেস, ফকীহ, মুফতি, আলেম, ওলামা, আধ্যাত্মিক তরিকাপন্থী গাউস, কুতুব, পীর সাহেবদের খপ্পরে পড়ে সেটা বিকৃত হয়ে গেছে। তাই হাজারও ফেকাহ, তফসীর আর দুর্বোধ্য জটিল মাসলা-মাসায়েলের পাহাড়ের নিচে পড়া সহজ, সরল ইসলাম তার অনাবিল রূপে যামানার এমাম, এমামুযযামান প্রকৃত ইসলাম মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন। এখনকার সময়ের জন্য তিনিই আল্লাহর মনোনীত এমাম। কাজেই এই সময়ে যারা মো’মেন মুসলিম হতে চায়, আল্লাহর সঠিক দিক নির্দেশনা, হেদায়াহ লাভ করতে চায় তাদের এমামুযযামানের আনুগত্য করা ছাড়া মুক্তি নেই।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...