হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

পণ্ডিতদের বাড়াবাড়ি ইসলামকে অপ্রাকৃতিক বানিয়ে ফেলেছে

রিয়াদুল হাসান

ইসলাম বাস্তববাদী জীবন বিধান। তা মানুষকে অপ্রাকৃতিক জীবনচর্চা, বাস্তবতাবিবর্জিত তত্ত্ব ও উপদেশের কারাগারে বন্দী করে রাখতে ইচ্ছুক নয়। বরং এ বাস্তব পৃথিবীতে ঘটনা প্রবাহের আবর্তনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বসবাস করার নীতি ও পদ্ধতিই ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয়। ইসলাম মানুষকে মালায়েক হতে আদেশ করেনা। হাসি, আনন্দ, বিনোদনবিমুখ যন্ত্রেও পরিণত করতে চায় না। তাকে মনোদৈহিক চাহিদাসম্পন্ন, হাটে বাজারে বিচরণকারী মানুষ মনে করেই তার জন্য বিধান দেয়া হয়েছে।
একজন মানুষের প্রতিটি কথাই হবে ‘যিকির’, প্রতিটি কথাই হবে ধর্ম সংক্রান্ত, সে চুপ করে থাকলেও দীন সংক্রান্ত গভীর গবেষণায় নিমজ্জিত থাকবে, কানে হেডফোন দিয়ে কেবল কোর’আন তেলাওয়াতই শুনবে, সমস্ত অবসর কেবল মসজিদে অতিবাহিত করবে এমন অবাস্তব জীবনের পথ ইসলাম নির্দেশ করে না। এমনটা আল্লাহ আশাও করেন না, এমন কর্তব্য আল্লাহ মানুষের উপর চাপিয়েও দেননি। ইসলাম মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাবগত ভাবধারার ওপর পুরো মাত্রায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন এভাবে যে, পানাহার যেমন তার প্রকৃতির চাহিদা তেমনি আনন্দ-স্ফূর্তি ও সন্তুষ্ট-উৎফুল্লচিত্ত হয়ে থাকা এবং হাসি তামাসা খেলা ইত্যাদিও তার প্রকৃতিগত ভাবধারা হয়ে রয়েছে। এ সত্য কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।
অতি পরহেজগারি ইসলামে নিষিদ্ধ কোনো কোনো সাহাবী আধ্যাত্মিকতার প্রাধান্য দিতে গিয়ে চারিত্রিক পরিশুদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার বাসনায় সব সময় এবাদতের মধ্যে ডুবে থাকাকেই তাদের কর্তব্য বলে নির্ধারণ করেছিলেন। তারা যাবতীয় বৈষয়িক স্বার্থ, স্বাদ, আনন্দকে পরিহার করে চলতে চেয়েছিলেন। বিষয় হচ্ছে, রসুলাল্লাহ তাঁদের সম্মুখে কেয়ামতের ভয়াবহতা নিয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন যা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তারা রসুলাল্লাহর ভাষণের এই অর্থ করেছিলেন যে, মো’মেনদের উচিত নয় কোনোরূপ ক্রীড়া, আনন্দফুর্তিতে অংশ নেওয়া। সম্পূর্ণভবে পরকালমুখী ও পরকালীন ধ্যান-ধারণা ও দায়-দায়িত্ব পূরণে আত্মসমর্পিত হয়ে থাকাই বুঝি ¯্রষ্টার দাবি।
কিন্তু তাদের এই ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছিলেন আল্লাহর রসুল। তিনি মসজিদে নববীতে সবাইকে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন জীবনের সৌন্দর্য্য হচ্ছে ভারসাম্যে। তিনি বললেন, “লোকজনের কী হলো যে তারা নিজেদের জন্য স্ত্রীলোক, আহার্য, সুগন্ধি এবং দুনিয়ার পছন্দনীয় জিনিসগুলো নিষিদ্ধ করেছে? আমি তোমাদেরকে সংসারবিমুখ পাদ্রী এবং সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য হুকুম করতে পারি না। আমার দীনের মধ্যে গোশ্ত (পুষ্টিকর খাদ্য) বর্জন, স্ত্রীলোক ত্যাগ এবং দরবেশ-সন্নাসীদের খান্কা ও আখ্ড়া গ্রহণ করার নিয়ম নেই। এবং সওম আমার উম্মতের এবাদত বন্দেগীর সফর আর জেহাদ হলো তাদের রোহবানিয়াত (সংসার ত্যাগ)।
তিনি আরও বললেন: আল্লাহর এবাদত করো। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক কোরো না। হজ্ব ও উমরাহ পালন করো, যাকাত প্রদান করো এবং সিয়াম পালন করো। দীনের উপর দৃঢ়পদ থাকো, আল্লাহ তোমাদেরকে সুদৃঢ় করে দিবেন। তোমাদের পূর্ববর্তীগণ তাশাদ্দুদ -আধিক্য ও বাড়াবাড়ির জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। যখন তারা (দীনের ব্যাপারে) তাদের উপর তাশাদ্দুদ করল তখন আল্লাহও তাদের উপর কঠিন অবস্থা আরোপ করলেন। তাই এখন তারা সাধু-সন্ন্যাসীদের খান্কা ও আখড়ায় বেঁচে আছে মাত্র (বাস্তবজীবনে তাদের দীনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নেই)।
সার্বভৌমত্ব ও জালালের অধিকারী আল্লাহ ইরশাদ করেন: হে মো’মেনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হালাল করেছেন তা তোমরা হারাম কোরো না। সীমালঙ্ঘন কোরো না। এ ধরনের লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না (সুরা মায়েদাহ ৮৭)।
আল্লাহ নাচ-গান, চিত্রাঙ্কন, খেলাধুলা, ভাস্কর্য নির্মাণ কোনো কিছুই হারাম করেননি, কোর’আনে কোথাও এগুলো হারাম হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই, তথাপি এই জাতির অতিধার্মিকরা নিজেদের উপর এই হারাম-শরিয়াহগুলো আরোপ করেছেন। আল্লাহ নারী পুরুষকে একত্রে শালীনতার সঙ্গে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছেন আর এরা নারীদেরকে পুরুষদের সামনে আসাই বারণ করে দিয়েছে। এভাবে ইসলামকেও তারা খানকা আর মসজিদের ধর্মে পরিণত করেছে। ইসলাম দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনা করার কোনো অবস্থা আর নেই। তাই ইসলামিক দলগুলো যখন ভোটে দাঁড়ায় তারা আগে থেকেই বলতে থাকে যে আমরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি না। এ কথা বলার কারণ, তারা নিজেদের পরিবারের ভোটটাও ঠিকমত পায় না।
যে কথা বলছিলাম, কোনো কোনো সাহাবী ভেবে নিয়েছিলেন যে সব সময় ইবাদতের মধ্যে ডুবে থাকাই তাদের কর্তব্য এবং বৈষয়িক স্বার্থ স্বাদ-আনন্দ পরিহার করে চলাই বাঞ্ছনীয়। ক্রীড়া আনন্দ স্ফূর্তিতে তাদের অংশ গ্রহণ করা উচিত নয়। সম্পূর্ণভবে পরকালমুখী ও পরকালীন ধ্যান-ধারণা ও দায় দায়িত্ব পরিপূরণে আত্মসমর্পিত হয়ে থাকা একান্তই আবশ্যক।
এ পর্যায়ে মহামান্য সাহাবী হানজালা উসাইদী (রা.) এর একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। তিনি রসুলে করীম (সা.) এর বিশেষভাবে নিয়োগকৃত একজন লেখক ছিলেন। তিনি নিজের সম্পর্কে নিজেই বলেছেন:
একদিন আবু বকর (রা.) আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন: ‘কী অবস্থা হে হানজালা?’ বললাম হানজালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। তিনি বললেন: ‘সুবহানাল্লাহ! বল কী?’ তখন আমি বললাম: হ্যাঁ, ব্যাপার তো তা-ই। আমরা যখন রসুলে করীম (সা.) এর দরবারে বসা থাকি ও তিনি জান্নাত ও দোযখের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তখন অবস্থা এমন হয়, যেন আমরা তা নিজেদের চোখে প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু যখন সেই দরবারের বাইরে চলে আসি, তখন স্ত্রী-পুত্র পরিজন ও কায়কারবারে মন লাগিয়ে দেই, জান্নাত ও জাহান্নামের কথা তখন অনেকখানিই ভুলে যাই। এ কথা শুনে আবু বকর (রা.) বললেন: আল্লাহর নামে শপথ! আমার অবস্থাও তো ঠিক তদ্রƒপ। হানজালা (রা.) বলেন: অতঃপর আমরা দুজন-আমি ও আবু বকর নবী করীমের খেদমতে উপস্থিত হলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রসুল! হানজালা তো মুনাফেক হয়ে গিয়েছে। রসুলে করীম (সা.) বললেন: সে কী রকম? আমি বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা যখন আপনার কাছে থাকি, আপনি জান্নাত জাহান্নামের কথা বলেন, তখন আমরা তা যেন স্পষ্ট দেখতে পাই-এমন অবস্থা হয়। কিন্তু এখান থেকে যখন বের হয়ে যাই, তখন আমরা স্ত্রী-পুত্র পরিজন ও কায়কারবার নিয়ে এত মশগুল হয়ে যাই যে, অনেক কিছুই আমরা ভুলে যাই।
এসব কথা শুনে নবী করীম (সা.) বললেন, “যার হাতে আমার জীবন তাঁর নামে শপথ, তোমরা আমার কাছে থাকা অবস্থায় নিজেদের চিত্তের মধ্যে যে ভাবধারা অনুভব কর, তার মধ্যে যদি তোমরা সব সময়ই থাকতে তাহলে মালায়েকগণ এসে তোমাদের বিছানায় ও পথেঘাটেই তোমাদের সাথে করমর্দন করত। কিন্তু হে হানজালা! সময়ে সময়ে পার্থক্য রয়েছে। সব সময় এক অবস্থায় থাকা যায় না।- এই কথাটি তিনি পর পর তিন বার বললেন (মুসলিম)।
সুতরাং আধিক্য নয় – স্বাভাবিকতা, অতি পরহেজগারি নয় – আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট সীমানারক্ষা, দরবেশি নয় – ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনই মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “তোমাদের উপর তোমাদের নফ্সের হক রয়েছে। নফল সওম রাখো এবং (কোনো কোনো সময়) তা থেকে বিরত থাকো। রাতের বেলা (কিছু সময়) তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করো এবং (কিছু সময়) ঘুমাও। আমি তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করি এবং ঘুমাইও। কোনো কোনো সময় সওম রাখি। আবার কোনো কোনো সময় সওম ত্যাগও কোরি। গোশত খাই, চর্বিও খেয়ে থাকি। স্ত্রীদের নিকটও যাই। (শোনো!) যে আমার সুন্নাহÑতরিকা ত্যাগ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
বর্তমানের বিকৃত ইসলাম মানুষকে অতি মুসলিম হতে পীড়াপীড়ি করে অথচ পৃথিবীতে কোথাও আল্লাহর সার্বভৌমত্বই নেই, আল্লাহর হুকুম কোথাও শাসনকার্য চলে না সেটা এই বিকৃত ইসলামের ধারক বাহকদের নজরেও পড়ে না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...