হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মীয় কাজের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ আগুন খাওয়ার সমতুল্য

রিয়াদুল হাসান

মানবসমাজে প্রচলিত সবচেয়ে বড় অন্যায় হচ্ছে সেই অন্যায় যা ধর্মের নামে করা হয়। আর সবচেয়ে বড় প্রতারক হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে কিনা ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতারণা করে। কারণ এখানে আল্লাহর-রসুল-কেতাব, আখেরাত ইত্যাদির প্রতি মানুষের ঈমানকে ব্যবহার করা হয়। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর পাঠানো সর্বশেষ জীবনব্যবস্থা জীবনবিধান যার চর্চা মানুষকে পৃথিবীতে শান্তিতে রাখবে এবং পরকালেও মুক্তি দেবে। এই ইসলামকে আশ্রয় করে যখন স্বার্থোদ্ধার করা হয়, ইসলামকে ব্যবসায়িক পণ্যে, জীবিকার মাধ্যমে পরিণত করা হয় তখন ইসলাম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলে। সেই বিকৃত ইসলাম দিয়ে সমাজে আর শান্তি আসে না, পরকালেও মুক্তি মেলে না। যে ইসলাম এসেছে মানবতার মুক্তির জন্য সেই ইসলাম তখন হয়ে দাঁড়ায় নির্যাতনের কল। ধর্মব্যবসায়ীরা দুটো কাজ করে।

এক, তারা আল্লাহর নাজেল করা বিধানকে গোপন করে। আপনারা জানেন যে কুফর শব্দের অন্যতম অর্থ হচ্ছে গোপন করা বা ঢেকে রাখা। দুই, তারা ধর্মের নানা আনুষ্ঠানিক কাজের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনের বহু আয়াতে ধর্মব্যবসার কুফল, এর শান্তি, এর বিরুদ্ধে নবী-রসুলদের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর রসুল (সা.) আরবের ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। পূর্বের বহু নবী রসুলের বিরুদ্ধে তারা ধর্ম অবমাননার ফতোয়া বা বস্তাসফেমির অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রশক্তি বা জনগণকে তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে তাঁদেরকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। এই ধর্মব্যবসাকে আলস্নাহ পাক কেবল হারামই করেননি, তিনি একে আগুন খাওয়ার সমতুল্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “বস্তুত, যারা আল্লাহর কেতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না। এবং আল্লাহর হাশরের দিন তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের (হেদায়াহ) পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা (দালালাহ) এবং ড়্গমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করে নিয়েছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল।” (সুরা বাকারা ১৭৪)

এ আয়াতে ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি ঘোষিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে ধর্মের বিনিময়ে গ্রহণ ক্ষমা অযোগ্য অপরাধ ও গোনাহ। আসুন আমরা আয়াতটির গভীরে প্রবেশ করি। আলস্নাহ বলছেন, যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কেতাবের বিধিবিধান ও শিক্ষাকে গোপন করে এবং দীনের বিনিময়ে অর্থ বা স্বার্থ হাসিল করে তারা-

(১) “আগুন ছাড়া কিছুই খায় না।” অর্থাৎ তারা হালাল বা হারাম যা কিছু খায় তা সমস্ত জাহান্নামের আগুন। আগুন যেমন ভালো মন্দ সব কিছুকেই ছাই করে দেয় তেমনি এই ধর্মব্যবসা তাদের সকল নেক আমলকেও বিনষ্ট করে দেয়।
(২) “হাশরের দিন আল্লাহর তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না”। আল্লাহর ঘৃণা করে যার সাথে কথাও বলবেন না তার সেই মহাবিপদের দিন কী দুর্দশা হবে কল্পনা করা যায়?
(৩) “আল্লাহর তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।” আল্লাহর মোমেনদেরকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ করে জান্নাতে দাখিল করবেন। কিন্তু এই ধর্মব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহর পরিশুদ্ধও করবেন না। এর অর্থ হচ্ছে তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেনই নয়, সুতরাং রহমানুর রহিম আলস্নাহর ক্ষমা থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
(৪) “তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব”। এ কথাটি বলে দেওয়ার পর ধর্মের কাজ করে স্বার্থহাসিলকারীরা যে জাহান্নামী এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহের বা দ্বিমত পোষণের অবকাশ থাকে না।
(৫) “তারা হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে”। আমরা আলেমদের কাছে যাই, তাদের ওয়াজ শুনি সুপথের সন্ধান পাওয়ার আশায়। কিন্তু আল্লাহর বলে দিচ্ছেন, যারা স্বর্থের বিনিময়ে ধর্মের কাজ করে তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট। একজন পথভ্রষ্ট মানুষ কী করে আরেক ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে? তাছাড়া অর্থের বিনিময়ে যারা ধর্মের বয়ান করে তাদের কথার কোনো প্রভাবও মানুষের উপর পড়ে না। এ কারণেই মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমারা তাদের আনুগত্য বা অনুসরণ করো যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় কামনা করে না”। (সুরা ইয়াসীন ২১)।

কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি আমাদের সমাজে ধর্মীয় লেবাসধারী একটি শ্রেণি বিনিময় ছাড়া মসজিদে আজান দেওয়া, নামাজ পড়ানো, জানাজা পড়ানো, মিলাদ পড়ানো, বিয়ে পড়ানো, কোর’আন খতম, খোতবা প্রদান, ওয়াজ করা ইত্যাদি কোনো ধর্মীয় কাজই পার্থিব বিনিময় ছাড়া করেন না। অথচ ধর্মের বিনিময় গ্রহণ শুকর বা মৃত জন্তু খাওয়ার চাইতেও নিকৃষ্ট। না, এটিও আমাদের কথা নয়। এই আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে অর্থাৎ সুরা বাকারা ১৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তিনি তো হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং যা আলস্নাহ ব্যতীত অন্য উপাস্যের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি অনন্যোপায় হয়ে, লোভের বশবর্তী না হয়ে বা সীমালঙ্ঘন না করে তা ক্ষন করে তাহলে তার কোনো গোনাহ হবে না।আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।” লক্ষ্য করুন, এ আয়াতে আল্লাহ কয়েকটি বস্তু খাওয়া হারাম করলেন, কিন্তু কেউ যদি বিশেষ পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে খায় তাহলে তাকে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী আয়াতে যেখানে আল্লাহর দীনের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করাকে ‘আগুন খাওয়া’ বললেন, তার পরে কিন্তু এটা বললেন না যে, অনন্যোপায় হয়ে খেলে আলস্নাহ সে অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। বরং বললেন, “তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব”। এতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কোনো অবস্থাতেই, এমন কি মরে গেলেও আল্লাহ দীনের বিনিময়ে স্বার্থ হাসিল করা, একে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না।

জীবিকার জন্য হাজারটা হালাল পন্থা রয়েছে। কিন্তু চুরি, ডাকাতি, সুদের কারবার, জুয়া, দুর্নীতি, মাদকব্যবসা, ধর্মের কাজ করে বা ইসলাম শিক্ষা দিয়ে বিনিময় নেওয়া ইত্যাদি হারাম উপার্জন। আলস্নাহর রসুল বলেছেন, হালাল জীবিকা সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ (তাবরানি ও বায়হাকি) এবং ইবাদাত কবুলের জন্য হালাল খাদ্য অন্যতম শর্ত। রসুলল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো এক ব্যক্তি দু’হাত আকাশের দিকে উত্তোলন করে দোয়া করে বলে, ‘হে আল্লাহ! হে আল্লাহ! অথচ তার খাদ্য, পানীয় ও পোশাক- সবকিছুই হারাম উপার্জনের। এমনকি সে এ পর্যšত্ম হারাম খাদ্য দ্বারাই জীবন ধারণ করেছে। সুতরাং তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে? (সহিহ মুসলিম) প্রশ্ন হচ্ছে যে ব্যক্তি নিজে ধর্মের মুখোস পরে হারাম খাচ্ছে সে কী করে অন্যকে হালাল-হারাম মেনে চলার ফতোয়া দেয়? এর একটাই কারণ, আমরা অধিকাংশ মানুষই জানিই না যে ধর্মজীবিকা ইসলামে নিষিদ্ধ।

 

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...