হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মব্যবসার উৎপত্তি

রিয়াদুল হাসান

ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত শ্রেণির উদ্ভব ইতিহাসে নতুন নয়। অতীতেও এদের অস্তিত্ব ছিল। এই শ্রেণি সৃষ্টির অনুমতি আল্লাহ কোনো দীনকেই দেন নি, অন্ততঃ যে কয়টি দীন সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। তার আগেরগুলোর কথা বলতে পারি না। কিন্তু প্রত্যেক দীনেই (ধর্মে) এরা গজিয়েছেন। নিজেদের নিজেরা সৃষ্টি করেছেন সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য, সম্মান, প্রভাব ইত্যাদি ভোগ করার জন্য। আর প্রত্যেক দীনকেই, জীবনব্যবস্থাকেই তারা নতুন ব্যাখ্যা করে নতুন মতবাদ সৃষ্টি করে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলেছেন, গুরুত্বের ওলোট-পালট করে ফেলেছেন, যার ফলে ঐ দীন অর্থহীন হয়ে গেছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান, মুসলিম, ইহুদি ইত্যাদি প্রত্যেক দীনের ঐ একই ইতিহাস, একই অবস্থা। বর্তমানে ধর্মগুলোর অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে আলেম পুরোহিত (Religious Clerics) গোষ্ঠীটির অংশগ্রহণ ছাড়া ধর্মের কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না। ধর্ম মানেই তারা, তারাই ধর্মের কর্তৃপক্ষ, তারাই মূর্তিমান ধর্ম।

পূর্বের সবগুলো ধর্মই আসলে ‘ইসলাম’ যার ধারাবাহিকতায় আল্লাহ শেষ নবীর (সা.) উপর নাযেল করেছেন শেষ কেতাব আল কোর’আন। এই শেষ ইসলামে ধর্মব্যবসায়ী পৃথক কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী ধর্ম সম্পর্কে এমন অজ্ঞ থাকবে যে আল্লাহর কাছে মোনাজাতটাও ঠিকমত করতে পারবে না, আর বৃহত্তর জনসাধারণ থেকে আলাদা একটি বেশভূষা চিহ্নিত শ্রেণি যারা অর্থের বিনিময়ে আমাদের মসজিদগুলোতে নামাজ পড়াবেন, মিলাদ পড়াবেন, জানাজা পড়াবেন, কবর জেয়ারত করে দেবেন, ফতোয়া দিবেন, বিয়ে পড়িয়ে দিবেন ইত্যাদি ধর্মীয় কাজগুলো করে দিবেন, আর ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ বৃহত্তর জনসাধারণ ইসলাম সম্পর্কে এ শ্রেণিটির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে এমন কোনো ব্যবস্থা ইসলামের প্রাথমিক যুগে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ছিলই না। তাহলে তাদের জন্ম হলো কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাব জানতে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম পুরুষ মোহাম্মদ (সা:) কে আল্লাহ সর্বশেষ নবী হিসাবে মনোনীত করলেন। তাঁকে আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন তা তিনি পবিত্র কোর’আনে অন্ততঃ তিনবার সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি স্বীয় রসুল প্রেরণ করেছেন হেদায়াহ ও সত্যদীন (ন্যায়পূর্ণ জীবনব্যবস্থা) সহকারে এই জন্য যে, রসুল যেন একে অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থার উপরে বিজয়ী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন (আল কোর’আন: সুরা সফ ৯, সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮)। মানবজাতির একেকটি অংশ একেক শাসকের অধীনে একেক রকম বিধি-বিধান, নিয়মকানুন মেনে জীবন পরিচালনা করছে। সেই সব মানুষকে একটি ন্যায়পূর্ণ জীবনব্যবস্থার ছায়াতলে নিয়ে আসার চেয়ে কঠিন কাজ, গুরুদায়িত্ব আর কী হতে পারে? সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তাদের জীবন চলার পথে আল্লাহ যেটাকে ন্যায় বলেছেন সেটাকেই ন্যায় বলে মান্য করবে, আল্লাহ যে কাজ নিষিদ্ধ (হারাম) করেছেন সেটা করবে না – এমন একটি জাগতিক ব্যবস্থাপনা, দর্শন ও আত্মিক অবস্থারই নামই হচ্ছে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। “সামগ্রিক জীবনে আল্লাহর দেওয়া দিক-নির্দেশনাই সঠিক এবং আমরা সেটাই মান্য করব” – এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই হচ্ছে হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করা একটি জীবনব্যবস্থাও আল্লাহ রসুলকে দান করলেন। সমগ্র মানবজাতির জীবনধারা পাল্টে দেওয়ার এই বিশাল দায়িত্ব একা পালন করার প্রশ্নই আসে না। তাই শুরুতেই তিনি মানুষের মধ্যে তওহীদের আহ্বান প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। মক্কার সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তিনি মানবজাতিকে আহ্বান করলেন, “হে মানবজাতি! তোমরা বল আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা নেই। তাহলেই তোমরা সফল হবে”। এই সাফল্য কেবল ইহকালের নয়, পরকালেরও।

লক্ষণীয় যে তিনি এখানে সম্বোধন করলেন, “হে মানবজাতি বলে।” সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, এই শেষ দীনের লক্ষ্য হচ্ছে পুরো মানবজাতিকে একটি জীবনব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা, একজন নেতার নেতৃত্বে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মহাজাতিতে পরিণত করা। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে রসুলাল্লাহ ১৩ বছর মক্কায় কেবল তওহীদের ডাক দিয়ে গেলেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন আম্মা খাদিজা (রা.), আলী (রা.), আবু বকর (রা.), যায়েদ (রা.), আম্মার (রা.), ওমর (রা.), বেলাল (রা.) প্রমুখ সাহাবিগণ। রসুলাল্লাহ এবং তাঁর সাহাবিগণ তওহীদের ডাক দিতে গিয়ে ১৩ বছর মক্কায় অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করলেন। তারপর আল্লাহ যখন তাঁকে মদীনায় একটি জনগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব দান করলেন তিনি সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন এই জাতির মধ্যে এর আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে কোনো মতভেদ ছিল না। পুরো উম্মতে মোহাম্মদী ছিল একটি জাতি এবং তাদের নেতা ছিলেন একজন স্বয়ং রসুলাল্লাহ। রসুলাল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় ঐ জাতিকে সঙ্গে নিয়ে জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম) চালিয়ে গেলেন এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার অধীনে এলো। বাকি পৃথিবীর যাবতীয় অন্যায় অবিচার দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব স্বীয় উম্মাহকে অর্পণ করে রসুলাল্লাহ প্রভুর কাছে চলে গেলেন। রেখে গেলেন পাঁচ দফার অমূল্য এক কর্মসূচি। এই কর্মসূচি তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করার সময় বলছেন “আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ দিয়েছেন। আমি তোমাদের উপর সেই পাঁচটি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করছি। সেগুলো হলো:-

(১) ঐক্যবদ্ধ হও।
(২) (নেতার আদেশ) শোন।
(৩) (নেতার ওই আদেশ) পালন করো।
(৪) হেজরত করো।
(৫) (এই দীনুল হককে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করো।

যে ব্যক্তি (কর্মসূচির) এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হলো, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেললো- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামাজ পড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে। (হাদিস: আল হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত।)

উম্মতে মোহাম্মদী এ কর্মসূচি ও তাদের উপরে তাদের নেতার অর্পিত দায়িত্ব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ এই যে, ঐ উম্মাহ বিশ্বনবীর (সা.) ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পার্থিব সব কিছু কোরবান করে তাদের নেতার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করতে জন্মভূমি আরব থেকে বের হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন এক নেতার নেতৃত্বে বজ্রকঠিন ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, নেতার হুকুমে জীবন উৎসর্গকারী, অন্যায়ের ধারকদের জন্য ত্রাস সৃষ্টিকারী একটি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি। তাদের মধ্যে কোনো মতভেদ ছিল না। রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে কিছু সাময়িক মতবিরোধের ইতিহাস থাকলেও সেটা গোটা জাতির প্রাণশক্তিকে হরণ করতে পারে নি। ফলে অল্পসময়ে তারা অর্ধদুনিয়ায় একটি নতুন শান্তিময় সভ্যতার উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হন যা পরবর্তীতে সুফলদায়ী মহীরুহের আকার ধারণ করে। মোটামুটি ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত এই জাতি তার লক্ষ্যে অটল থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল। পরিণতিতে অর্ধ পৃথিবী ইসলামের ছায়াতলে এসে গিয়েছিল, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীতে একটি মহান সভ্যতার ভিত নির্মিত হয়েছিল।

সেই জাতির কোর’আনের কোনো অখণ্ড কপিও ছিল না, হাদিসের কোনো বই ছিল না, ফেকাহ, তফসির, ফতোয়ার কেতাব তো দূরের কথা। তবু অর্ধেক দুনিয়া আল্লাহ এ জাতির পায়ের নিচে দিয়ে দিলেন। জাতির সবাই ছিলেন সত্যনিষ্ঠ মো’মেন। যিনি ছিলেন যত বড় মো’মেন তিনি ছিলেন তত বড় ন্যায়যোদ্ধা। এর কারণ মো’মেনের সংজ্ঞা কী তা এই জাতির সামনে সুস্পষ্ট ছিল। সেটা হচ্ছে, আল্লাহ বলেছেন, কেবলমাত্র তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি বিশ্বাস (তওহীদ) স্থাপন করে, অতঃপর এতে কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ না করে দৃঢ়পদ থাকে এবং আল্লাহ রাস্তায় নিজ জীবন সম্পদ দিয়ে জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (আল কোর’আন: সুরা হুজরাত ১৫)

প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী এই সংজ্ঞার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ মো’মেন ছিলেন যদিও তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু তারা ছিলেন ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ, পিঁপড়ার মতো সুশৃঙ্খল জাতি, নেতার আদেশে নিজেদের জীবন উৎসর্গকারী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ত্রাসসৃষ্টিকারী যোদ্ধা। কোনো বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে তারা নেতার সিদ্ধান্তের উপর ন্যস্ত করে দিতেন এবং নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। ভুলেও জাতির ঐক্য নষ্ট করে ‘কুফর’ করতেন না। দীনের ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী, আল্লামা, মাওলানা, মুফতি, মোফাসসের টাইটেলধারী, মসজিদে, খানকায়, হুজরায় নিরাপদে বসে জনগণের মধ্যে ফতোয়া প্রদান করে জীবিকা নির্বাহকারী একটি আলাদা ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি কল্পনাও করা যেত না।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...