হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দীন প্রতিষ্ঠা বলতে আমরা কী বুঝি?

মোহাম্মদ আসাদ আলী

ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা দীন প্রতিষ্ঠা বলতে কী বোঝায়? এর মানে আসলে কী? কীভাবে বুঝব কোনো দেশে দীন প্রতিষ্ঠা হয়েছে কিনা? ধরুন, একটি গোষ্ঠী দাবি করল তারা দীন প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের দাবি সঠিক নাকি ভুল, সেটা বোঝার উপায় কী? তাদের লম্বা দাড়ি বা গায়ে আরবীয় জোব্বা থাকলেই কি আমরা ধরে নিব তারা দীন প্রতিষ্ঠা করেছে? নাকি দেশের নাম ইসলামিক আমিরাত বা ইসলামিক স্টেট বা ইসলামিক রিপাবলিকান ইত্যাদি রাখলে ধরে নিব দীন প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে? আসলে বিষয়টা বোঝার উপায় কী?
দীন প্রতিষ্ঠা নিয়ে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে দীন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। দীন মানে জীবনব্যবস্থা। পৃথিবীতে জীবনব্যবস্থা মূলত দুই ধরনের হয়। এক- আল্লাহর দেওয়া, দুই- মানুষের তৈরি করে নেওয়া। আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার নাম ইসলাম, যার আভিধানিক অর্থ শান্তি। আল্লাহ তার জীবনব্যবস্থার নাম “শান্তি” রেখে মানুষকে বোঝাচ্ছেন- হে মানুষ! তোমরা যে শান্তির দেখা পেতে সারা বিশ্ব তোলপাড় করে ফেলছো, যদি আমার দেওয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করো তাহলেই কেবল তোমাদের জীবনে সেই মহাকাক্সিক্ষত “শান্তি” আসবে, অন্যত্থায় আসবে না। যুগে যুগে মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহ দীন পাঠিয়েছেন এবং শেষবার আখেরী নবীর মাধ্যমে যখন দীন পাঠিয়েছেন, তখন মো’মেনদের জন্য দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। (হুজরাত ১৫)
গত কয়েক শতাব্দী ধরে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। বহু আন্দোলন ও সংগঠনের জন্ম হয়েছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য। কোথাও তারা রাজনৈতিকভাবে, কোথাও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, কোথাও সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তারা দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্বের বহু দেশে তারা সফলও হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে। যখনই তারা কোথাও ক্ষমতায় গেছে, অনেকে ধরেই নিয়েছে সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। তাদেরকে নিয়ে অনেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
কিন্তু ওইসব দল কথিত দীন প্রতিষ্ঠার পর শান্তির ছিটেফোঁটাও দেখাতে পেরেছেন কি? তারা কি পেরেছেন ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে? তারা কি পেরেছেন নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে? তারা কি পেরেছেন জনগণকে বাক স্বাধীনতা দিতে? তারা কি পেরেছেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে? তারা কি পেরেছেন মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে? উত্তর আমাদের সবারই জানা। তারা পারেননি। শুধু যে পারেননি তাই নয়, তারা ধর্মের নামে এমন ব্যবস্থা জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন যেটা জনগণকে মুক্তির স্বাদ দেওয়ার বদলে বন্দীত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে দিয়েছে। কথা বলা যাবে না, গান শোনা যাবে না, ছবি আঁকা যাবে না, দাড়ি কাটা যাবে না, নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে না, খেলাধুলা করা যাবে না, টেলিভিশন দেখা যাবে না, মেয়েরা পড়াশোনা করা যাবে না ইত্যাদি বিধিনিষেধ আরোপ করে জনগণকে শাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। অন্যদিকে মানুষ যেটা চায় অর্থাৎ ন্যায়, শান্তি, সুবিচার, মানবাধিকার, উন্নতি, প্রগতি- সেসবের ছিটেফোঁটাও সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ফলে মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেছে এটা ইসলাম নয়, এটা শান্তি নয়। এটা ইসলামের নামে আরেক জবরদস্তির নাম। সেই জবরদস্তি থেকে বাঁচার জন্য এক সময় মুসলিম ঘরের ছেলে মেয়েরাই সংগ্রাম করে তথাকথিত ইসলামী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। তাহলে কী বোঝা গেল?
বোঝা গেল- কোথাও দাড়ি টুপিওয়ালা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখল দেখলেই সেটাকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা দীন প্রতিষ্ঠা বলে খুশিতে আত্মহারা হবার সুযোগ নেই। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, দাড়ি টুপি আর আলখেল্লার নাম ইসলাম নয়। ইসলাম হলো ন্যায়, শান্তি, সুবিচার, নিরাপত্তা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হবার নাম। কোথাও ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়েছে কিনা, বা আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা হয়েছে কিনা সেটা বিচার করারও মাপকাঠি দাড়ি টুপি জোব্বা বোরকা পাঞ্জাবি নয়। সেটা বিচারের মাপকাঠি হলো- ওই সমাজের মানুষ শান্তির দেখা পেয়েছে কিনা, মানবাধিকার পেয়েছে কিনা, নিরাপত্তা পেয়েছে কিনা, নারীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিনা সেটা।
পাঠক, আরও পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য হাদিসের পাতা থেকে দু’টি ঘটনা তুলে ধরছি।
১. প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে অধৈর্য্য হয়ে একবার খাব্বাব (রা.) বিশ্বনবীর কাছে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসুল, আপনি কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের জন্য দোয়া করুন। বিশ্বনবী তখন কী বলেছিলেন তা ইতিহাস হয়ে আছে। বিশ্বনবী বলেছিলেন, শিঘ্রই এমন সময় আসবে যখন সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত একা একজন আরোহী পথ চলবে, তার মনে আল্লাহ ও বন্য জন্তু ছাড়া আর কোনো ভয় থাকবে না। দীন প্রতিষ্ঠার পর কেমন সমাজ তৈরি হবার কথা, সেটা এই হাদিসেই বোঝা যাচ্ছে। সমাজ থেকে ভয় জিনিসটা উঠে যাবে। কোনোকিছু হারানোর ভয় থাকবে না। মানুষ মাইলের পর মাইল পথ চলবে নির্বিঘ্নে।
২. এবার দেখুন হাতিম তাইয়ের ছেলে আদির সাথে রসুলাল্লাহর কথোপকথন। আল্লাহর রসুল আদিকে বললেন- ‘হে আদি, তুমি বোধহয় ইসলাম গ্রহণ করছ না আমার আশপাশের মানুষগুলোর অবস্থা দেখে। তুমি কি আল-হিরার নাম শুনেছ?’ আদি বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনেছি, তবে কখনো যাইনি ওই শহরে।’ নবী (সা.) বললেন, ‘শিঘ্রই এমন সময় আসবে যখন একজন নারী একা হিরা থেকে মক্কায় আসবে তার মনে কোনো ভয়ের কারণ থাকবে না।’ অর্থাৎ এই হাদিসেও সেই একই কথা। কোনো ভয় থাকবে না। কতখানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হবে বোঝাই যাচ্ছে।
পাঠক, হাদিসের আরেকটি দিক লক্ষ করুন। আল্লাহর রসুল দীন প্রতিষ্ঠার পর কেমন সমাজ তৈরি হবে তা বলতে গিয়ে নারীদের সম্পর্কে কী বললেন? তিনি কিন্তু বলেননি- হে খাব্বাব! দীন প্রতিষ্ঠা হলে হিরা থেকে মক্কা পর্যন্ত একজন নারীও ঘরের বাইরে বেরোতে পারবে না, একজন নারীরও চেহারা দেখা যাবে না, একজন নারীও পড়াশোনা করতে পারবে না, একজন নারীও চাকরি বাকরি করতে পারবে না ইত্যাদি! রসুল (সা.) এসব কথা বললেন না, কারণ এই নারীবিদ্বেষী আইন প্রতিষ্ঠা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। বরং তিনি কী বললেন খেয়াল করুন। তিনি বললেন, দীন প্রতিষ্ঠার পর একজন নারী একা হিরা থেকে মক্কায় আসবে কিন্তু সেই নারীর মনে কোনো ভয় থাকবে না। একবার ভাবুন তো, একজন নারী শত শত মাইল পথ চলছে একা একা, কিন্তু কোনো ভয় নেই। তাহলে ওই সমাজের নিরাপত্তা কেমন হতে হবে? মূলত তেমন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার নামই হলো ‘দীন প্রতিষ্ঠা’। আল্লাহর রসুল স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ইসলামের উদ্দেশ্য নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী করা নয়, বরং নারী যাতে একা একা শত শত মাইল পথ নির্ভয়ে চলতে পারে, সমাজে কোনো চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ইভটিজিং না থাকে তেমন পরিবেশ তৈরি করা!
বলা বাহুল্য, আল্লাহর রসুল ঠিকই সেই সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলেন। দীন প্রতিষ্ঠার পর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীটি কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল তার ইতিহাস নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। আদি ইবনে হাতিম তাঁর জীবদ্দশাতেই সেই দৃশ্য দেখে গেছেন এবং সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন।
সুতরাং আজ যারা দীন প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তাদের টুপি দাড়ি বা লেবাস দেখে নয়, তাদেরকে বিচার করা দরকার তারা কেমন সমাজ তৈরি করল সেটা দেখে। ক্ষমতা দখল করা তো কঠিন নয়, কঠিন হলো জনগণকে শান্তি নামক সোনার হরিনটি পাইয়ে দেওয়া। ক্ষমতা দখল করার জন্য ইসলাম লাগে না, সমাজতন্ত্র বা গণতন্ত্রের চেতনা কাজে লাগিয়েও বিশ্বের বহু দেশে ক্ষমতার উত্থান পতন হয়ে থাকে। তেমনি ইসলামের চেতনা ব্যবহার করেও ক্ষমতা দখল করা সম্ভব। কিন্তু যদি সেটা সত্যিকারের ইসলাম না হয়ে থাকে, যদি সেটা আল্লাহ-রসুলের দেওয়া প্রকৃত ইসলাম না হয়ে থাকে, তাহলে তা কস্মিনকালেও ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আর তা না পারলে কখনই সেটাকে দীন প্রতিষ্ঠা বলা যাবে না।
[মতামতের জন্য যোগাযোগ: ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫]

 

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...