হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দাজ্জাল শারীরিক দানব নয়

এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী

চৌদ্দশ’ বছর থেকে মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে দাজ্জাল সম্বন্ধে আলোচনা চলে আসছে। আল্লাহর শেষ রসুল মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যেসব কথা বলে গেছেন, পৃথিবীতে কী কী ঘটনা ঘোটবে সেগুলি সম্বন্ধে আভাস ও সরাসরি যা জানিয়ে দিয়েছেন সেগুলির মধ্যে দাজ্জাল সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণীগুলি যেমন চিত্তাকর্ষক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বিগ্নকর। উদ্বিগ্নকর ও ভীতিপ্রদ এই জন্য যে দাজ্জালের শক্তি, প্রভাব ও প্রতিপত্তি সমগ্র মানবজাতির উপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, সমস্ত মানবজাতিকে বিপথে চালাবার চেষ্টা করবে। শুধু চেষ্টা নয়, বেশ কিছু সময়ের জন্য দাজ্জাল তার শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে গোটা মানবজাতিকেই বিপথে পরিচালিত করবে। কাজেই দাজ্জালকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার বা অবজ্ঞা করার উপায় নেই।
আল্লাহর রসুল বলেছেন আদমের সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এমন কোনো বিষয় বা ঘটনা হবে না, যা দাজ্জালের চেয়ে গুরুতর ও সংকটজনক (হাদীস- এমরান বিন হুসাইন (রা.) থেকে মুসলিম)। তিনি এ কথাও বলেছেন যে- নুহ (আ.) থেকে নিয়ে কোনো নবীই বাদ যান নি যিনি তাঁর উম্মাহকে দাজ্জাল সম্বন্ধে সতর্ক করেন নি (হাদীস- আবু ওবায়দা বিন র্যারাহ (রা.) ও আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে আবু দাউদ, বোখারী, মুসলিম ও তিরমিযি)। শুধু তাই নয়, আল্লাহর নবী নিজে দাজ্জালের সংকট (ফেত্না) থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন (হাদিস- আয়েশা (রা.) থেকে বোখারী)।
যে ব্যাপারটা মানবজাতির সৃষ্টি থেকে নিয়ে ধ্বংস পর্যন্ত যা কিছু ঘোটবে সে সমস্ত কিছুর চেয়ে বড়, সেটা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ আর আমরা সে সম্বন্ধে কতটুকু সজাগ ও সচেতন? বাস্তব অবস্থা এই যে আমরা মোটেই সজাগ নই এবং দাজ্জাল সম্বন্ধে আমাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। যে ঘটনাটিকে আখেরি নবী আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য সবচেয়ে গুরুতর ও সাংঘাতিক ঘটনা বলে চিহ্নিত করেছেন সেই মহা-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজের আলেম সাহেবরাও কোনো গভীর গবেষণা করেন নি। এই মহা-প্রয়োজনীয় ব্যাপারটাকে বোঝার জন্য যতটুকু শ্রম দিয়েছেন তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি শ্রম ও সময় দিয়েছেন দাড়ি-মোছ, টুপি-পাগড়ী, পাজামা, মেসওয়াক, কুলুখ আর বিবি তালাকের মতো তুচ্ছ ফতওয়ার বিশ্লেষণে।
দাজ্জাল সম্বন্ধে মহানবীর হাদিসগুলি প্রধানত দুই রকমের। একটা ভাগ দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের ব্যাপারে, অন্যটি দাজ্জালের পরিচয়জ্ঞাপক। মানবজাতির জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সর্ববৃহৎ বিপদের সম্বন্ধে মানুষ বেখেয়াল ও নিরুদ্বেগ। যারা ধর্মের ব্যাপারে মহা-আলেম হয়েছেন ও ধর্মচর্চার মধ্যে ডুবে আছেন তারাও সংকীর্ণ ও প্রায়ান্ধ দৃষ্টির জন্য দেখতে ও বুঝতে সক্ষম হন নি যে দাজ্জালের আবির্ভাব মানবজাতি ধ্বংসকারী নুহের (আ.) মহাপ্লাবনের চেয়েও, প্রলয়ঙ্করী বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও কেন বড় (আকবর) ঘটনা; কেন মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের (যদি সে ঘটনা সত্য হয়ে থাকে) চেয়েও সাংঘাতিক, যে যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিণী অর্থাৎ প্রায় এক কোটি আদম সন্তান নিহত হয়েছিল। অন্য ভাগের হাদিসগুলিতে আল্লাহর শেষ রসুল মানবজাতি যেন দাজ্জালকে ঠিকভাবে চিনতে পারে ও সাবধান হয়, দাজ্জালকে প্রত্যাখ্যান করে, তার বিরোধিতা করে, সে জন্য তার পরিচিতির চিহ্নগুলি বলেছেন। কিন্তু তার সময়ের মানুষের শিক্ষার স্বল্পতার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে দাজ্জালকে রূপকভাবে বর্ণনা করতে হয়েছে। কিন্তু সে রূপক বর্ণনা আজ পরিষ্কারভাবে ধরা দিয়েছে, যদিও আমাদের প্রায়ান্ধ দৃষ্টির জন্য সে বর্ণনাও আমরা বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না, দাজ্জালকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ও দাজ্জালের পায়ে সাজদায় পড়ে থেকেও বুঝতে পারছিনা যে এই সেই বিশ্বনবী বর্ণিত দাজ্জাল, মাসীহ উল কায্যাব।
প্রথমেই দাজ্জালের নামটাকে নেয়া যাক। আল্লাহর রসুল একে দাজ্জাল নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এটা কোনো নাম নয়, এটা একটা বর্ণনা, অর্থাৎ বিষয়টার বর্ণনা। যেমন এমাম মাহ্দী কোনো নাম নয়- বর্ণনা। মাহ্দী অর্থ হেদায়াহ প্রাপ্ত, যিনি সঠিক পথ, হেদায়াহ পেয়েছেন, তাঁর নিজের অন্য নাম থাকবে সবার মতো। তেমনি দাজ্জাল শব্দের অর্থ চাকচিক্যময় প্রতারক, যেটা বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু ভেতরে কুৎসিত। যেমন মাকাল ফল, দেখতে অতি সুন্দর, মনে হবে খেতেও অতি সুস্বাদু, কিন্তু আসলে খেতে বিস্বাদ, তিক্ত। ‘দাজ্জাল’ কোনো দৈত্য-দানব নয়, ‘দাজ্জাল’ ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’। পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতা বাইরে থেকে দেখতে চাকচিক্যময়, এর প্রযুক্তিগত সাফল্য মানুষকে মুগ্ধ করে ফেলে, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, কিন্তু এর প্রভাবাধীন পৃথিবী সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবিচারে, দুঃখে, ক্রন্দনে, অশ্র“তে ভরপুর। বিগত শতাব্দীতে এই ‘সভ্যতা’ দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে চৌদ্দ কোটি আদম সন্তান হতাহত করেছে এবং তারপর থেকে বিভিন্ন ছোট খাটো যুদ্ধে আরও দুই কোটি মানুষ হত্যা করেছে। আহত বিকলাঙ্গের সংখ্যা ঐ মোট সংখ্যার বহুগুণ। বিধবা, সন্তানহারা, গৃহহারা, দেশত্যাগীদের কোনো হিসাব নেই। আর এই নতুন শতাব্দীতে শুধু এক ইরাকেই হত্যা করেছে দশ লক্ষ মানব। ইরাক ছাড়াও আফগানিস্তানসহ আরও অনেকগুলো দেশে তার এই হত্যাযজ্ঞ আজও চলছে। এই ‘সভ্যতা’র অধীনস্থ সমস্ত পৃথিবীতে খুন, চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ধর্ষণ, অত্যাচার সীমাহীন এবং প্রতিদিন প্রতি দেশে ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে চলেছে। তাই এর নাম দাজ্জাল, চাকচিক্যময়, চোখ ধাঁধানো প্রতারক।
আল্লাহর রসুল কর্তৃক বর্ণিত আখেরী যামানার দাজ্জাল কোনো দৃশ্যমান (Visible) বা শরীরী (Physical) দানব নয়, তখনকার দিনের মানুষদের বোঝাবার জন্য এটি একটি রূপক (Allegorical) বর্ণনা। এর পরও যদি কেউ জোর করে বলতে চান যে, না, এক চক্ষুবিশিষ্ট, বিরাটকায়, জলজ্যান্ত একটি অশ্বারোহী দানবই আসবে, তাহলে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ধরুন আপনার কথামতো এক চক্ষুবিশিষ্ট এক বিশাল দানব পৃথিবীতে উপস্থিত হলো, তার বাহন ঘোড়া বা গাধার দুই কানের ব্যবধানই সত্তর অর্থাৎ বহু সহস্র হাত [আবু হোরায়রা (রা.) থেকে-বায়হাকী, মেশকাত], তাহলে কি কারো মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকবে যে এটাই রসুল বর্ণিত সেই দাজ্জাল? চোখের সামনে প্রায় পৃথিবীর সমান আয়তনের এক দানবকে দেখে প্রথমেই সকলের মনে প্রশ্ন আসবে, এই বিরাট দানব আসলো কোত্থেকে! তাকে দেখে কেবল মুসলিমরাই নয়, অ-মুসলিমরাও এক মুহূর্তে চিনে ফেলবে যে, এই তো ইসলামের নবীর বর্ণিত দানব দাজ্জাল। সকল মানুষেরই তখন আমাদের নবীর উপর এবং ইসলামের উপর ঈমান এসে যাবে।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহর রসুল বলেছেন, দাজ্জাল ইহুদি জাতি থেকে উদ্ভূত হবে এবং আমার উম্মতের সত্তর হাজার (অসংখ্য) লোক দাজ্জালের অনুসরণ করবে [ইবনে হানবাল (রা.) থেকে মুসলিম]।
দাজ্জাল যদি রসুলের বর্ণনা অনুযায়ী সত্যিই জ্যান্ত কোনো দানবীয় প্রাণী হয় তাহলে কি করে এমন দানব মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ইহুদি জাতির মধ্য থেকে আসতে পারে? আর মুসলিমরাই কী করে আল্লাহকে ছেড়ে একটি দানবকে অনুসরণ করতে পারে?
তৃতীয়ত, আল্লাহর রসুল বলেছেন, দাজ্জালের দুই চোখের মাঝখানে (অর্থাৎ কপালে) কাফের লেখা থাকবে। শুধু মো’মেন, বিশ্বাসীরাই তা দেখতে এবং পড়তে পারবে; যারা মো’মেন নয়, তারা পড়তে পারবে না [ আবু হোরায়রা (রা.), আবু হোযায়ফা (রা.) এবং আনাস (রা.) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।
অর্থাৎ কিছু লোক (মো’মেন) দাজ্জালকে কাফের বলে বুঝতে পারবে আর কিছু লোক (যারা মো’মেন নয়) দাজ্জাল যে কাফের তা বুঝতে পারবে না, এবং বুঝতে পারবে না বলেই বহু সংখ্যক লোক তাকে রব বলে মেনে নেবে। দাজ্জাল যদি শরীরী কোনো দানবই হয় তাহলে সবাই তাকে প্রথম দর্শনেই দাজ্জাল বলে চেনার কথা। তারপরও সে কাফের কি কাফের নয় এ নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিমত হওয়া সম্ভব? ধরুণ কোনো লোকালয়ে বা জনবহুল স্থানে হঠাৎ একটি বাঘ এসে পড়ল; সেখানের অবস্থাটা কি হবে ভাবুন। ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারবে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করবে, তাই নয় কি? অথচ অকল্পনীয় বিরাট, ভয়ঙ্কর একটি দানব, যার বাহনের এক পা পৃথিবীর এক প্রান্তে আরেক পা পৃথিবীর অপর প্রান্তে, তাকে সামনা সামনি দেখেও কেউ চিনবে- কেউ চিনবে না, কেউ তাকে অনুসরণ করবে- কেউ করবে না, কেউ তার কপালের কাফের লেখা পড়তে পারবে- কেউ পারবে না এ কি হতে পারে?
তাহলে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে দাজ্জাল কোনো শরীরী বা বস্তুগত দানব নয়, এটি একটি বিরাট দানবীয় শক্তির রূপক বর্ণনা; সেই সাথে এ কথাতেও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে ঐ বিরাট শক্তিটিই হচ্ছে বর্তমান দুনিয়ার পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী যান্ত্রিক ‘সভ্যতা’।
[সমস্ত পৃথিবীময় অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ ও রক্তপাত ইত্যাদি নির্মূল করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সনে এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী হেযবুত তওহীদ নামক আন্দোলনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তাঁকে প্রকৃত ইসলামের যে জ্ঞান দান করেছেন তা তিনি যতটা সম্ভব হয়েছে বই-পুস্তক লিখে, বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারের চেষ্টা করেছেন। এই লেখাটি মাননীয় এমামুযযামানের লেখা “দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা!” বইটি থেকে থেকে সম্পাদিত। দাজ্জালের মতো এত ব্যাপক একটি বিষয় এইটুকু লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা কষ্টকর, তাই ‘দাজ্জাল’ সম্মন্ধে বিস্তারিত জানতে যামানার এমামের লেখা “দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা!” বইটি পড়–ন এবং এর উপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রটি দেখুন।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...