হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

তাহাজ্জুদ যখন ঘুম নষ্ট রোজা যখন উপবাস

রুহুল আমিন মৃধা:

ভবিষ্যতে মুসলিম নামধারী এই জাতিটির কতখানি আকিদা বিচ্যুতি ঘটবে এবং তার দরুন তারা যে ইসলামের গণ্ডি থেকেই বহিরাগত হয়ে যাবে তা বোঝাতে গিয়ে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহ (সা.) বলেন- ‘এমন সময় আসবে যখন ইসলাম শুধু নাম থাকবে, কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না, আমার উম্মাহর আলেমরা হবে আসমানের নিচে সর্বনিকৃষ্ট জীব, তাদের তৈরি ফেতনা তাদের উপরই পতিত হবে। (আলী (রা.) থেকে বায়হাকী, মেশকাত)। কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে- এই কথাটি কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে তা বর্তমানে এই জাতির দিকে লক্ষ করলেই পরিষ্কার। কোর’আনের হুকুম এবং শিক্ষা এই জাতি প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জালের হুকুম, বিধান মেনে নিয়েছে। কাজেই বর্তমানে কোর’আন শুধুু অক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর কোনো কার্যকারিতা নেই। আবার একই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি অপর একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, “এমন সময় আসবে যখন মানুষ রোজা থাকবে কিন্তু তা হবে না খেয়ে থাকা, রাত জেগে নামাজ পড়বে কিন্তু তা হবে কেবল ঘুম নষ্ট করা (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ হবে না)। (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)।” এই হাদিসগুলোতে মহানবী (সা.) কাদের বোঝাচ্ছেন? প্রথম হাদিসে বলা হয়েছে- ইসলাম শুধু নাম থাকবে। অর্থাৎ ইসলাম শুধুমাত্র নামের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কার্যত ইসলামের নামে যেটা চলবে সেটা প্রকৃত ইসলাম হবে না। আর যেটা প্রকৃত ইসলাম নয় তার অনুসারীরাও যে প্রকৃত মুসলিম নন- তা বোঝা যায় সাধারণ জ্ঞানেই। আবার একই হাদিসে তিনি বলেছেন- মসজিদসমূহ লোকে লোকারণ্য হবে, কিন্তু সেখানে হেদায়াহ থাকবে না। এখানেও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ মানুষ মসজিদে যাবে, সেখানে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ পড়বে কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও তাদের মধ্যে হেদায়াত থাকবে না। আর হেদায়াত না থাকার মানেই হলো তারা হবে পথভ্রষ্ট।
আবার দ্বিতীয় হাদিসে তিনি মানুষ বলতে তাদেরই বোঝাচ্ছেন যারা নিজেদের মুসলিম বলে মনে করে। কারণ তিনি অন্য নবীদের উম্মত খ্রিষ্টান-ইহুদিদের সম্বন্ধে বলছেন না। দ্বিতীয় কথা হলো হাজারো রকমের এবাদতের মধ্য থেকে মাত্র দু’টি তিনি বেছে নিয়েছেন। একটি রোজা অন্যটি তাহাজ্জুদ। তৃতীয় হলো এর একটা ফরদ-বাধ্যতামূলক, অন্যটি নফল- নিজের ইচ্ছাধীন। বিশ্বনবী (সা.) পাঁচটি বাধ্যতামূলক ফরজ ইবাদত থেকে একটি এবং শত শত নফল ইবাদত থেকে একটি বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো এই মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে আল্লাহ রসুল ও দীনের উপর পরিপূর্ণ (মোকাম্মেল) ঈমান ছাড়া কারো পক্ষে এক মাস রোজা রাখা বা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া সম্ভব নয়। এমনকি মোকাম্মেল ঈমান আছে এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে যারা তাহাজ্জুদ পড়েন না। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ বোঝাচ্ছেন তাদের যাদের পরিপূর্ণ দৃঢ় ঈমান আছে আল্লাহ-রসুল-কোর’আন ও ইসলামের উপর। এই হাদিসে তিনি মোনাফেক বা লোক দেখিয়ে করা যায় অর্থাৎ রিয়াকারীদের বোঝান নি। কারণ যে সব ইবাদত লোক দেখিয়ে করা যায় অর্থাৎ মসজিদে যেয়ে নামাজ-হজ্ব-যাকাত ইত্যাদি একটিও উল্লেখ করেন নি। মোনাফেক রিয়াকারী বোঝালে তিনি অবশ্যই এগুলো উল্লেখ করতেন যেগুলো লোক দেখিয়ে করা যায়। তিনি ঠিক সেই দু’টি ইবাদত উল্লেখ করলেন যে দুটি মোনাফেক ও রিয়াকারীর পক্ষে অসম্ভব, যে দু’টি লোকজন দেখিয়ে করাই যায় না, যে দুটি পরিপূর্ণ ঈমান নিয়েও সবাই করতে পারে না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি ভবিষ্যত বাণী করেছেন যে এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মতের মানুষ পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী হয়ে নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত-তাহাজ্জুদ ইত্যাদি সর্ববিধ ইবাদত করবে কিন্তু কোন কিছুই হবে না, কোন ইবাদত গৃহীত-কবুল হবে না। যদি দীর্ঘ এক মাসের কঠিন রোজা এবং মাসের পর মাস বছরের পর বছর শীত-গ্রীষ্মের গভীর রাত্রে শয্যা ত্যাগ করা তাহাজ্জুদ নিষ্ফল হয়, তবে অন্যান্য সব ইবাদত অবশ্যই বৃথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যারা শুধু পরিপূর্ণ বিশ্বাসী অর্থাৎ মোকাম্মল ঈমানদারই নয়, রোজাদার ও তাহাজ্জুদীও, তাদের ইবাদত নিষ্ফল কেন? তাছাড়া তাদের এবাদতই যদি বৃথা হয় তবে অন্যান্য সাধারণ মুসলিমদের এবাদতের কী দশা?
মহানবীর (সা.) ঐ ভবিষ্যদ্বাণীর একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে এই যে, তিনি যাদের কথা বলছেন তারা গত কয়েক শতাব্দী ও আজকের দুনিয়ার মুসলিম নামধারী জাতি। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) এই জাতির সম্মুখে যে উদ্দেশ্য স্থাপন করে দিয়েছিলেন সেটা হলো আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন, দীনুল হক পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই আকিদার বিকৃতিতে জাতি তা বদলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য স্থাপন করে নিয়েছে। আল্লাহ রসুলের (সা.) স্থাপিত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল, আনুগত্যশীল, দুর্জেয় সংগ্রামী চরিত্রের প্রয়োজন, সেই চরিত্র তৈরির জন্য যে প্রশিক্ষণ- সেই প্রশিক্ষণ (অর্থাৎ সালাহ, সওম বা নামাজ, রোজা) এবং আরও অন্যান্য ব্যাপারকে ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যই যেখানে নেই বা বিকৃত সেখানে প্রশিক্ষণের আর কোন দাম, অর্থ থাকতে পারে না। কাজেই ঐসব প্রশিক্ষণ অর্থাৎ নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি সর্ব প্রকার ইবাদত আজ নিষ্ফল, অর্থহীন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে আমার এই কথায় বর্তমানের এই জাতিটি- যেটা নিজেকে শুধু মুসলিম নয় একেবারে উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে করে- এই জাতি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। বিশেষ করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এই জাতির সেই অংশ যেটা আল্লাহ রসুলের কঠোর সতর্ক বাণী ও নিষেধ অগ্রাহ্য করে, সেরাতুল মোস্তাকীম ও দীনুল কাইয়্যেমা (জীবনের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর দেয়া বিধান ছাড়া সমগ্র বিধান অস্বীকার, সালাহ ও যাকাত প্রতিষ্ঠা) ত্যাগ করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফতোয়াবাজী করে জাতিকে শত টুকরোয় ভেঙ্গে খান খান করে দিয়েছেন এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে সেই অন্য অংশটি যেটা আত্মার উৎকর্ষ ও আল্লাহর সান্নিধ্যের নাম করে জাতির সম্মুখে আল্লাহ ও রসুলের (সা.) স্থাপিত উদ্দেশ্য (মানবতার কল্যাণ) বদলিয়ে অন্য উদ্দেশ্য স্থাপন করেছেন, যে জাতিকে বিশ্বনবী (সা.) মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সে জাতিকে সংগ্রাম ভুলিয়ে হাতে তসবিহ ধরিয়ে দিয়ে টেনে খানকায় বসিয়ে দিয়েছেন, জাতির বর্হিমুখী দৃষ্টিভঙ্গীকে অন্তর্মুখী করে তাকে কাপুরুষে পরিণত করেছেন, সিংহকে ইদুরে পরিণত করেছেন।
অকপট সত্যান্বেষী মন নিয়ে চিন্তা করলে দেখতে পাবেন যে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে জাতীয় জীবনে অস্বীকার করে মানুষের তৈরি জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিণতিতে পৃথিবীতে যে অন্যায়-অবিচার শোষণ-রক্তপাত হচ্ছে সে সবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে সে সব থেকে মুখ ফিরিয়ে যারা মহা এবাদতে মশগুল হয়ে আছেন যাবতীয় অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে যারা প্রচণ্ড বিরোধ গড়ে তুলছেন না, যারা নানাভাবে জাতির ঐক্য ধ্বংস করে যাচ্ছেন তারাই হচ্ছেন রসুলাল্লাহর (সা.) ঐ ভবিষ্যতবাণীর লক্ষ্য। আল্লাহ এই জাতিকে লক্ষ্য করে বলছেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি (উম্মাহ) কারণ মানবজাতির মধ্যে থেকে তোমাদিগকে উত্থিত করা হয়েছে এই জন্য যে (তোমরা মানুষকে) সৎ কার্য করার আদেশ দান এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত করবে, আল্লাহকে বিশ্বাস করবে (কোর’আন- সুরা আলে-ইমরান ১১০)।” অর্থাৎ এই উম্মাহকে মানব জাতির মধ্য থেকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষকে অসৎ কাজ (আল্লাহর বিধানের বিরোধী কাজ অর্থাৎ যে কাজে মানুষের অকল্যাণ হয় তাই হলো অসৎ কাজ) থেকে নিবৃত্ত করা ও সৎ কাজ (আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাজ অর্থাৎ যে কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয় তাই হচ্ছে সৎকাজ) করার আদেশ করার জন্য এবং এই কাজ করার জন্যই সে জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি। যে বা যারা এবাদতের নাম করে আল্লাহর যিকরের নাম করে বা যে কোন ছুতোয় বিরোধিতার ভয়ে, পার্থিব ক্ষতির ভয়ে, যে জন্য তাদের মানব জাতির মধ্য থেকে উত্থিত করা সেই কাজ থেকে পালায় তবে সে বা তারা আর সেই শ্রেষ্ঠ জাতির মধ্যেই নেই সুতরাং তাদের সব রকম ইবাদত অর্থহীন, নিষ্ফল। (যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্ব পালন ত্যাগ করা হয় তখন মানুষের কোন আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। হাদিস তিরবানী।)
এইখানে আরও একটি কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। কোর’আনের এই আয়াতে আল্লাহ সৎকাজের জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটা হলো আদেশ, আরবিতে ‘আমর’। আদেশ তখনই করা যায় যখন সে আদেশকে কাজে পরিণত করা যায়, অর্থাৎ কাজে পরিণত করার শক্তি থাকে, নইলে খুব জোর অনুরোধ করা যায়। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত করার ব্যাপারেও তাই। মানুষকে অর্থাৎ সমাজকে সৎকাজ করার আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার শক্তি শুধু রাষ্ট্রের থাকে অন্য কারো নয়। অন্য যে কেউ করতে গেলে তাকে শুধু অনুরোধ বা কাকুতি-মিনতি করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ অনুরোধ শব্দ ব্যবহার করেন নি, করেছেন ‘আমর’ আদেশ অর্থাৎ ঐ কাজ করতে হবে রাষ্ট্রশক্তিতে। উপদেশ ও অনুরোধে যে ও কাজ হবে না তার প্রমাণ বর্তমান মানব সমাজ। এই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ, অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা যে আল্লাহ উপদেশ, অনুরোধের মাধ্যমে করা বোঝান নি তা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কোর’আনের আরেকটি আয়াতে। তিনি বলেছেন- এরা (মো’মেন) তারা, যাদের আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত (নামাজ) কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং ন্যায়, সৎ কাজের আদেশ দেয়, এবং অন্যায়, অসৎ কাজ থেকে বিরত করে (কোর’আন- সুরা আল-হজ ৪১)। এখানে লক্ষ্য করুন-মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য আল্লাহ কী পূর্বশর্ত দিচ্ছেন। তিনি বলছেন আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পর, কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে, ন্যায় কাজের আদেশ ও মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা এ দু’টোর কোনটাই সম্ভব নয় রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া। সুতরাং যারা অনুরোধ, উপদেশ, কাকুতি-মিনতি করে ঐ কাজ করতে চেষ্টা করছেন তারা পণ্ডশ্রম করছেন। কাজেই রাষ্ট্রশক্তি যাদের নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্যই হলো সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত হওয়া এবং জাতিকে বিরত রাখা। এর জন্য যে সঠিক আদর্শ দরকার তাই আমরা তুলে ধরছি।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...