হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

গুরুত্বের নিরিখে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও হজ্ব

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আল্লাহর মানুষ সৃষ্টি এবং এবলিসকে জান্নাত থেকে বহিস্কৃত ও বিতাড়িত করার পর এবলিস আল্লাহকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল (সুরা বাকারা-৩০) তাহলো সে মানবজাতিকে সেরাতুল মোস্তাকিম থেকে বিচ্যুত কোরবে। ফলে মানবজাতি অনিবার্যভাবে অন্যায়- অশান্তি, যুদ্ধ, রক্তপাতে পতিত হবে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে যুগে যুগে হেদায়াহ পাঠানোর অঙ্গীকার কোরলেন যার ধারাবাহিকতায় তিনি সর্বশেষ পাঠিয়েছেন আমাদের প্রিয় রসুল, সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল মোহম্মদকে (দ:)। তাঁর উপর দ্বায়িত্ব দিলেন সমস্ত পৃথিবীব্যাপী এই হেদায়াহ এবং হেদায়াহ ভিত্তিক দ্বীন প্রতিষ্ঠা কোরে সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার (সুরা তওবা-৩৩, সুরা ফাতাহ-২৮, সুরা আস সফ-৯)। এই কাজের নীতি হিসেবে আল্লাহ নির্দিষ্ট কোরে দিলেন সর্বাত্মক সংগ্রামকে। আল্লাহ সরাসরি আদেশ দিচ্ছেন, “সর্বাত্মক সংগ্রাম কর যতক্ষণ না অন্যায়, অশান্তি (পৃথিবী থেকে) নির্মূল হোয়ে সেখানে আল্লাহর দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠিত হয়”(কোর’আন সুরা আনফাল-৩৯)। এই আদেশেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় রসুলাল্লাহর হাদীসেও। তিনি বলেন,“আমি আদিষ্ট হোয়েছি (আল্লাহর কাছে থেকে) পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা নেই এবং আমি মোহাম্মদ (দ:) আল্লাহর রসুল এবং সালাহ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয়।” [হাদীস-আবদুল্লাহ এবনে ওমর (রা:) থেকে বোখারী]। এরকম আরো শত শত কোরানের আয়াত এবং রসুলুল্লাহর হাদীস রোয়েছে যেগুলোকে বিশ্লেষণ কোরলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে উম্মতে মোহাম্মদীর উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব হোল ইসলামের এই শেষ সংস্করণকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা। আর তা হতে হবে অবশ্যই দলগতভাবে জেহাদ ও রাষ্ট্রগতভাবে কেতাল দ্বারা। আর তাই এই দীনে সবচেয়ে বড় পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হোয়েছে এই জেহাদে যারা শহীদ হবে তাদের। যেহেতু ইসলাম একটি ভারসাম্যযুক্ত এবং নিখুঁত জীবনব্যবস্থা, কাজেই এটাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া জেহাদের জন্য যে চরিত্র দরকার তা অর্জনের ব্যবস্থা থাকাও বাধ্যতামূলক। এই চরিত্র অর্জনের প্রশিক্ষণগুলোই হোচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি। শারীরিক এবং আত্মীকভাবে যে প্রশিক্ষণগুলো নিলে মানুষ জেহাদে অপরাজেয়, মৃত্যু ভয়হীন, এবং মৃত্যুর জন্য আকুলভাবে পিপাসার্ত-দুর্ধর্ষ চরিত্র অর্জন কোরতে সক্ষম হবে সেই প্রশিক্ষণ হোল এই নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি। এগুলো উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যে চরিত্র দরকার তার প্রশিক্ষণ দেয় এগুলো। উদ্দেশ্য হোল জেহাদ যার ফলে পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হবে। জেহাদই যদি না থাকে তাহলে নামাজ, রোজা, হজ্বের কোন মূল্য নেই। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া শুধু হজ্ব নয়, কোনো এবাদতই কবুল হবে না।

বর্তমানে হজ্বের মৌসুম। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ কোরে মোসলেম নামধারী এই জাতি হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা মদিনায় যাচ্ছেন। তাদের কাউকে যদি বলা হয়, আপনি হজ্বে কেন যাচ্ছেন? তিনি নিঃসন্দেহে উত্তর দিবেন আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তাই যাচ্ছি। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন ঠিকই তবে তিনি তো বিনা কারণে কোন নির্দেশ দেন না। তিনি কেন এই নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি কি তাদের হজ্বের মুখাপেক্ষী? বরং আল্লাহ আমাদের নিজেদের স্বার্থেই নির্দেশ দিয়েছেন। হজ্ব সম্পর্কে আজকের এই জাতির আকীদা, আল্লাহ রসুলের হাতে গড়া জাতির আকীদার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর যুগের একটি ঘটনা উল্লেখ কোরছি যেখানে এই জাতির আকীদার সাথে উম্মতে মোহাম্মদীর আকীদার আকাশ-পাতাল ফারাক প্রতীয়মান হয়।
পারসিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময় আল্লাহর তলোয়ার খালেদ (রা:) মোসলেম বাহিনীকে ফিরাদ থেকে হিরায় স্থানান্তরিত করার সময় হজ্বের সময় এসে গেলো। হজ্ব করার লোভ সামলাতে না পেরে খালেদ (রা:) অন্য একজন সেনাপতির হাতে কর্তৃত্ব দিয়ে বাহিনী রওয়ানা কোরে দিয়ে চুপে চুপে হজ্বে চলে গেলেন। হজ্বও তিনি কোরলেন এমন গুপ্তভাবে- যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে। হজ্ব কোরেই খালেদ (রা:) এমন দ্রুত ফিরে এসে তার বাহিনীতে যোগ দিলেন, যে সেনাপতির উপর তিনি ভার দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ছাড়া আর কেউ টেরই পেলো না যে খালেদ (রা:) কয়েকদিনের জন্য তাদের সঙ্গেই ছিলেন না এবং মোসলেম বাহিনী তার গন্তব্যস্থান হিরায় পৌঁছবার আগেই খালেদ (রা:) তার বাহিনীর সাথে যোগ দিলেন। হিরায় পৌঁছবার কয়েক দিনের মধ্যেই খলিফা আবু বকরের (রা:) কাছ থেকে সেনাপতি খালেদ বিন ওলিদের (রা:) কাছে চিঠি এসে পৌঁছলো। তাতে খলিফা তার প্রিয় সেনাপতিকে জানালেন যে তিনি যে গোপনে হজ্ব কোরতে মক্কায় গিয়েছিলেন তা তিনি জানতে পেরেছেন এবং অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হোয়েছেন এবং তাকে সাবধান কোরে দিচ্ছেন যে খালেদ (রা:) যেন ভবিষ্যতে এমন কাজ আর না করেন।
এই ঐতিহাসিক ঘটনাটির প্রতি লক্ষ্য কোরুন। এতে দু’টি বিষয় ফুটে উঠেছে। প্রথমটি হোচ্ছে বেসামরিক, গোয়েন্দা বিভাগের (ঈরারষ ওহঃবষষরমবহপব) কর্ম-কুশলতা। সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের (গরষরঃধৎু ওহঃবষষরমবহপব) তো কথাই নেই। সেটা অপূর্ব দক্ষ না হোলে তো মোসলেম বাহিনীর অতুলনীয় বিজয়ই সম্ভব হোতনা, এই ঘটনায় বেসামরিক দিকটার কথা বোলছি। কেউ যেন না জানতে পারে যে খালেদ (রা:) ইরাক থেকে মক্কা গেছেন এ জন্য খালেদের এত সতর্কতা, যে সতর্কতার জন্য নিজের সৈন্যরা পর্য্যন্ত জানতে পারলো না যে খালেদ (রা:) তাদের মধ্যে নেই, তা সত্ত্বেও আবু বকরের (রা:) বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সতর্ক চক্ষুকে তিনি ফাঁকি দিতে পারলেন না এবং মক্কায় হজ্বে খালেদের উপস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে মদীনায় খলিফা আবু বকরের (রা:) কাছে রিপোর্ট হোয়ে গেলো। দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে, যখন আল্লাহর তলোয়ার খালেদ (রা:) এই গোপন হজ্বটি কোরেছিলেন তখন কোন যুদ্ধ চোলছিলো না, তিনি শুধু তার বাহিনীকে ফিরাদ থেকে হিরায় স্থানান্তর (গড়াব) কোরছিলেন। এর আগেই উপর্যুপরি কয়েকটি তীব্র যুদ্ধে (হুসেইদ, মুযাইয়াহ, সানীহ, যুমেইল ইত্যাদি) মোসলেম বাহিনী পারসিক বাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছিলো। ঠিক তখন তাদের দিক থেকে নতুন কোন আক্রমনের সম্ভাবনা ছিলো না। আর মোসলেম বাহিনীকে রওয়ানা কোরে দিয়ে তাদের গন্তব্যস্থানে হিরায় পৌঁছবার আগেই খালেদ (রা:) হজ্ব শেষ কোরে আবার বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হোয়েছিলেন। কিন্তু এত সব কারণ থাকা সত্ত্বেও আবু বকর (রা:) খালেদকে (রা:) ছেড়ে দেন নি। তাকে ভর্ৎসনা (ঈড়হংড়ৎ) কোরলেন এবং ভবিষ্যতে যেন কখনও এরকম কাজ না করেন সেজন্য তাকে সাবধান কোরে দিলেন। খলিফার এই কাজের একটি মাত্র অর্থ হয় আর সেটা হলো- সংগ্রাম, জেহাদ, শুধু জেহাদ নয় জেহাদের কোন কিছুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, জড়িত থাকাও হজ্বের চেয়ে বড় কর্তব্য। নিজের অসুস্থতার সময় উম্মতে মোহাম্মদীর নামাজের এমামতি, নেতৃত্ব দেবার জন্য রসুলাল্লাহ (দ:) যাকে মনোনীত কোরেছিলেন সেই আবু বকর (রা:) ইসলাম কী, তার উদ্দেশ্য কি, তার প্রক্রিয়া কি তা কি শেখেন নি? হজ্ব ও সংগ্রামের মধ্যে কোনটার প্রাধান্য, গুরুত্ব (চৎরড়ৎরঃু) তা শেখেন নি? আজ এই জাতির অতি ধার্মিকদের মধ্যে শুধু নামাজ, রোজা, হজ্ব নয়, বহু নফল, ছোট-খাট অপ্রয়োজনীয় ধর্মকর্ম আছে- নেই শুধু জেহাদ, সংগ্রাম যেটা এই জাতির মূল লক্ষ্য, মূল আদর্শ। তা থেকে এই জাতি লক্ষ মাইল দূরে।
আবু বকরের (রা:) ইসলাম, সাহাবাদের ইসলাম আর বর্তমানের অতি মোসলেমদের ইসলাম দুইটি বিপরীতমুখী ইসলাম, দু’টি বিপরীতমুখী আকীদা। একটি মূল উদ্দেশ্যমুখী, অন্যটি মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতমুখী, আর তাই একটি সহায় সম্বলহীন পাঁচ লাখের জাতি অর্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর দীন কায়েম কোরেছিলো, অন্যটি প্রায় একশ’ষাট কোটি হোয়েও, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের একটা বিরাট অংশের মালিক হোয়েও আল্লাহদ্রোহীদের দয়ার উপর, কৃপার উপর বেঁচে আছে, অজ্ঞানতার, কুশিক্ষার অন্ধকারে ঘৃণিত জীবন যাপন কোরছে। আকীদা এতখানি বিকৃত হোয়েছে যে আসল লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়ে, লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়াকেই লক্ষ্য মনে কোরে, তাই নিয়ে মহা ব্যস্ত হোয়ে থেকে এই জাতি পরকালে আল্লাহর কাছে থেকে পুরস্কারের আশা কোরছে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...