হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কেতাব বহনকারী গর্দভ

রাকিব আল হাসান:
মানবজাতির ইতিহসে ধর্মজীবি আলেম পুরোহিত শ্রেণির জন্ম নতুন নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যে দীনগুলো প্রতিষ্ঠিত তার কোনটিতেই এরকম কোন শ্রেণি সৃষ্টির অনুমতি আল্লাহ দেন নি। কিন্তু প্রতিটি দীনেই তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তারা প্রতিটি দীনেই গজিয়েছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠা, সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভের জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের তৈরি করেছেন এবং এর জন্য তারা প্রত্যেক দীনকেই, জীবনব্যবস্থাকেই নতুন ব্যখ্যা ও মতবাদের ভিত্তিতে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলেছেন, গুরুত্বের (Priority) ওলট-পালট করে ফেলেছেন এবং যার ফলে দীনগুলি হয়ে পড়েছে অর্থহীন। পূর্ববর্তী সকল ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি প্রত্যেক দীনের অবস্থা আজ একই রকম। কিন্তু বর্তমানে আল্লাহ প্রদত্ত শেষ দীন ইসলামেও এমন শ্রেণির অস্তিত্ব দেখা যায়, যার উপস্থিতি এ শেষ দীনে কখনই ছিল না।
রসুলের ওফাতের ৬০-৭০ বছরের পর এ উম্মাহ তাদের অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যায়। তারা ভুলে যায় তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তারা প্রেরিত হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত এ শেষ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবনে শান্তি, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা রসুলের এ সুন্নাহ ত্যাগ করে রাজা বাদশাহদের মতো ভোগ বিলাস শুরু করে ও আলেম সমাজ এ দীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাসলা-মাসায়েল উদ্ভাবন করে জাতিকে বহু ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। জাতিতে জন্ম নেয় পূর্ববর্তী অন্যান্য দীনের মতো ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত শ্রেণি। অন্যান্য দীন অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের পুরোহিতদের সাথেও ইসলামের পুরোহিতদের মিল থাকলেও সবচেয় বেশি মিল দেখা যায় ইহুদি ধর্মের পুরোহিতদের সাথে। যেমন, বর্তমান ইসলামে পুরোহিত শ্রেণীদের মাওলানা বলে সম্বোধন করা হয় ও ইহুদিদের পুরোহিত শ্রেণীকে রাব্বাই বলে, যা উভয়ই একার্থবোধক। মাওলা শব্দের অর্থ প্রভু ও মাওলানা শব্দের অর্থ আমাদের প্রভু। একইভাবে রব থেকে রাব্বাই অর্থাৎ আমাদের প্রভু। আল্লাহর রসুল ঈসা ইবনে মরিয়াম (আ.) তাঁর জাতিকে অর্থাৎ ইহুদিদের এ বিকৃতি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। একদিন এক অনুলেখক (scribe) ঈসাকে (আ:) তার গৃহে আমন্ত্রণ জানালে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, “I will come thither when thou wilt promise to call me “Brother” and not “Lord” and shalt say thou art my brother, and not my servant. (Gospel of Barnabas, Chapter 182, Page-493).” অর্থাৎ “আমাকে মওলানা, প্রভু ইত্যাদি বলে ডাকবে না, ভাই বলে ডাকবে, তাহলে আমি তোমার বাড়িতে যাবো।” অথচ তাঁর অনুসারী দাবিদার খ্রিস্টানরা তাঁকে কেবল প্রভুই বলে না একেবারে আল্লাহর পুত্র বলে সাব্যস্ত করে।
ইহুদি ধর্মের রাব্বাইরা যেমন তাদের ‘ধর্মীয়’ জ্ঞানের জন্য প্রচণ্ড অহঙ্কারী তেমনি বিকৃত ইসলামের এই মওলানারাও তাই। ঐ ‘ধর্মীয়’ জ্ঞানের আত্মম্ভরিতার ফলে যুগে যুগে পুরোহিত শ্রেণীরা আল্লাহ থেকে আগত প্রকৃত দীনকে অস্বীকার করেছে। যেমন, ঈসা (আ.) কে রাব্বাইরা অস্বীকার করেছে, শেষ রসুলকে আবু জাহল, উৎবা, শাইবা এরা অস্বীকার করেছিল জ্ঞানের অহংকারের ফলে। তেমনি বর্তমানেও যদি প্রকৃত ইসলামকে উপস্থাপন করা হয় তবে বর্তমানের মওলানা অর্থাৎ ধর্মজীবি পুরোহিতরা একে অস্বীকার করে, এর বিপরীতে প্রচ- বাধা প্রদান করে। আমরা যদি আমাদের রসুলের জীবনীর দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে আমরা দেখবো তিনি সবচেয়ে বেশি বিরোধীতার শিকার হয়েছেন ইব্রাহীম (আ.) এর আনীত দীনে হানিফের বিকৃতরূপের ধ্বজাধারী পুরোহিত আলেম শ্রেণী থেকে। রসুলের বিরোধীতাকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবু জাহেল যার উপাধী ছিল আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা। আমাদের বর্তমান আলেমরাও নিজেদের বড় আলেম ও মহাজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় দেয়ার জন্য নামের আগে আল্লামা (মহাজ্ঞানী, Very high scholar) ট্যাগ লাগান। কিন্তু যে পবিত্র মানুষগুলো স্বয়ং আল্লাহর রসুলের কাছ থেকে ইসলামের আকিদা শিক্ষা করেছেন তাদের নামের আগে এমন কোন বিশেষণ কেউ ইতিহাসের উপর চিরণী অভিযান চালালেও দেখাতে পারবে না। খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রেও আল্লাহ বলেছেন, “তারা তাদের ধর্মগুরু ও পাদ্রীদের তাদের রব (প্রভু) বানিয়ে নিয়েছে (তওবা-৩১)।”
সুতরাং সর্বযুগেই সকল ধর্মের পুরোহিতরাই আল্লাহ প্রদত্ত সত্য ধর্মকে আড়ালে রেখে নিজেদের মনগড়া কথাকে ধর্ম হিসেবে চালিয়েছে ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেরাই মানুষদের রব বা মওলা সেজে বসে রয়েছে। বর্তমান বিকৃত ইসলামের ধর্মব্যবসায়ী আলেমরাও একই কাজ করে যাচ্ছে। তারা ধর্মের প্রকৃত রূপ মানুষের সামনে না এনে ধর্মকে নিজেদের ফায়দার জন্য ব্যবহার করছে। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেন, “তাদের মধ্যে এমন একদল রয়েছে যারা বিকৃত উচ্চারণের মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যেন তারা কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয় এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর থেকে আগত অথচ এসব আল্লাহর থেকে প্রেরিত নয় (সুরা ইমরান ৭৮)। আল্লাহ কত সুন্দর ভাবে তাদের স্বরূপ আমাদের চিনিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ এছাড়াও কোর’আনের আরো অনেক জায়গায় এই ধর্মজীবি মোল্লাশ্রেণীর ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ধর্মজীবি মোল্লারা আল্লাহর বিধানকে গোপন করে, আল্লাহর দীন বিক্রি করে ও দীনের অতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে মতভেদ সৃষ্টি করে ও জাতির ঐক্য ধ্বংস করে। এছাড়াও তারা সমাজের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে না। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেন, “দরবেশ ও আলেমরা কেন তাদের পাপ কথা ও হারাম ভক্ষণে নিষেধ করেন না? বরং তারা যা করে তাও অতি নিকৃষ্ট (সুরা মায়েদা ৬৩)।
আল্লাহর অমূল্য আসমানী কিতাবকে যারা এভাবে আয়ত্ত্ব করে দীনকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছেন তাদেরকে আল্লাহ তুলনা করেছের কিতাব বহনকারী গর্দভের সাথে (সুরা জুম’আ ৫)। অনেক ধর্মজীবী আলেম আল্লাহর এ সকল দ্ব্যর্থহীন আয়াতের থেকে আত্মরক্ষার জন্য খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যে এ সকল আয়াতগুলো শুধুমাত্র ইহুদি-খ্রিস্টানদের আলেমদের জন্য দেয়া হয়েছে আমাদের জন্য নয়। কিন্তু কোর’আনে আল্লাহ পূর্ববর্তী ধর্মগুলির প্রসঙ্গ টেনেই এনেছেন আমাদের উদাহরণ পেশ করার জন্য যাতে আল্লাহর দীন ধর্মব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত না হয়। কারণ আল্লাহর প্রেরীত এ শেষ দীন কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বা নির্দিষ্ট জায়গার জন্য প্রেরীত হয় নি এই দীন সমগ্র মানবজাতির জন্য। তাই এ শেষ দীন যদি বিকৃত হয়, যদি দুর্বোধ্য হয়ে যায় তবে মানবজাতি মহা সংকটে পড়বে যেমনটি বর্তমানে হয়েছে।
আল্লাহর বহু আয়াতে বজ্রকঠিন হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও এই জনগোষ্ঠীর দুনিয়ালোভী আলেমগণ নামাজ পড়িয়ে, মিলাদ পড়িয়ে, জানাজা পড়িয়ে, ওয়াজ মাহফিল করে, এক কথায় ধর্মেজীবিতার মাধ্যমে টাকা রোজগার করছে। তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো হালাল কে হারাম ও হারাম কে হালাল হিসেবে ফতোয়া দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করছে। আল্লাহর রসুল যে শেষ দীন নিয়ে এসেছিলেন সে দীনে এমন ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণীর কোন স্থান ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সেই দীনের কর্তৃপক্ষ (Authority) হয়ে বসে আছে আলাদা পুরোহিত শ্রেণী। তারা নিজেদের নবীর উত্তরাধিকারী, ওরাসাতুল আম্বিয়া (Spiritual Successor) হিসেবে দাবী করে। কিন্তু আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেন, “তাদের পিছনে এসছে কিছু অপদার্থ যারা উত্তারধিকারী হয়েছে কিতাবের, তারা নিকৃষ্ট পার্থিব উপকরণ আহরণ করছে এবং বলছে, আমাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে। বস্তুত এর অনরূপ সামগ্রী তাদের নিকট আবার যদি উপস্থিত করা হয় তবে তাও তারা গ্রহণ করবে। কিতাবের অঙ্গীকার কি তাদের নিকট থেকে নেয়া হয় নি যে, তারা আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলবে না ( সুরা আরাফ ১৬৯)?
সুতরাং তারা জেনে শুনে হারাম গ্রহণ করছে ও মানুষের কাছে তা গোপন করছে। অন্যদিকে তারাই বলছে যে ইবাদত ও দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন। আল্লাহ অত্যন্ত রাগান্বীত হন যখন কেউ অন্যকে সে উপদেশ দান করে যা সে নিজে করে না। কিন্তু এ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী আল্লাহর ক্রোধকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে এই নিকৃষ্ট কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি যে ভয়বাহ শাস্তির কথা আল্লাহ বলে দিয়েছেন তার প্রতিও তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ  নেই।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...