হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

করোনাকালে ঈদ

মোহাম্মদ আসাদ আলী

প্রতি বছর মুসলিমদের খুশির বার্তা নিয়ে আসে ঈদ। ঈদের কিছুদিন আগে থেকে শুরু হয় পরিবারের জন্য কেনাকাটা, তারও অনেক আগে থেকে শুরু হয় টাকা জমানো। দিনমজুর বাবা প্রতিদিনের রোজগার থেকে দশ টাকা/বিশ টাকা করে আলাদা করতে থাকেন ঈদে মেয়েকে সুন্দর একটা ড্রেস কিনে দেওয়ার জন্য, ছেলেকে সুন্দর একটা জুতা কিনে দেওয়ার জন্য। নিজের জন্য কিছু না হলেও স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ি তো লাগবেই। ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই বাঁধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ে প্রতিটি মুসলিমের ঘরে ঘরে। সুস্বাদু খাবারের ধুম পড়ে যায়। না, সুস্বাদু খাবার মানে অভিজাত রেস্টুরেন্টের দামি দামি বিদেশি ফুড আইটেম না, লাচ্ছি, সেমাই, গোশত, ভাত, ডাল, দই, মিষ্টি ইত্যাদি। এটুকুই ঈদের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, কারণ এতটুকুই শেষ কবে কোনো দিনমজুর বাবা তার ছেলে মেয়ের মুখে তুলে দিতে পেরেছেন তা হয়ত ভুলেই গেছেন।

ঈদের দিন নতুন জামা গায়ে দিয়ে, সুগন্ধী গায়ে মেখে, মিষ্টান্ন মুখে দিয়ে সেই যে বাবার হাত ধরে ছেলে-মেয়ের ঈদগাহে যাওয়ার মুহূর্তটি- সেই আনন্দঘন অনুভূতির সাথে তুলনা করা চলে এমন কিছু আছে কি? নেই। সেজন্যই যখন ঈদ আসে, তখন সব দুঃখ, কষ্ট, বিয়োগব্যথা একপাশে চাপা দিয়ে রেখে প্রত্যেকটি পরিবারেই শুরু হয় আনন্দের স্ফূরণ! উচ্ছ্বাসের রঙে রঙিন হয় মুসলিমদের একটি দিন।

কিন্তু হায়! সভ্যতার এক করুণ বিপর্যয় মুসলিমদের সেই চিরায়ত আনন্দঘন দিনটিও বোধহয় কেড়ে নিতে চাইছে। করোনা মহামারীর জের ধরে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মানবিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা সত্যিই হৃদয়বিদারক! হঠাৎ করেই জীবিকার চাকা বন্ধ হওয়া কোটি কোটি মানুষের কাছে এবারের ঈদ যে মোটেও আনন্দের উচ্ছাস নিয়ে আসতে পারেনি, তা চারদিকে তাকালেই বোঝা যায়।

খেটে খাওয়া মানুষ যারা এতদিন রিক্সা চালিয়ে, টেম্পো চালিয়ে, বাস চালিয়ে, হকারি করে, বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শ্রম দিয়ে কোনোমতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকত এবং যাদের ওই স্বল্প আয়ের উপর নির্ভর করে পরিবারের অন্য সদস্যরা বেঁচে থাকত, তাদের আয় রোজগার এখন বন্ধ হবার দশা। এই মানুষগুলো এতদিন ভাবতেন- গায়ে শক্তি যতদিন আছে, ততদিন না খেয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু সেই সরল সত্যটিও আজ মিথ্যা হয়ে গেছে। দিনের পর দিন লকডাউন চলায় এই প্রান্তিক পর্যায়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলো অনাহারে অর্ধাহারে ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। রাস্তায় নেমেও কাজ পাচ্ছে না তারা। জীবিকার চাকা ঘোরানোটাই মুশকিল হয়ে গেছে। এই অসহায় মানুষগুলোর বড় একটি সংখ্যা গ্রামে সর্বস্ব হারিয়ে বা ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে শহরে আসে কিছুটা আয় রোজগারের আশায়। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। অস্বাস্থকর পরিবেশে, বস্তিতে বা রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত জায়গায় কুঁড়েঘর বানিয়ে তারা রাতে ঘুমায়। কেউ সে সুযোগটাও পায় না, নিজের রিক্সা-ভ্যানেই রাত কাটাতে হয়। এই মানুষগুলো কাজ হারিয়ে, আয় রোজগার হারিয়ে কোথায় যাবে? গ্রামে যদি কিছু করার থাকতই তাহলে তো শহরে আসত না।

করোনার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কটে সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে, কিন্তু সেই প্রণোদনার বড় অংশটাই পাচ্ছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। ওইসব প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি। কাজেই ওখানে প্রণোদনা দেওয়াতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তাদের বাইরেও তো লক্ষ লক্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট রয়েছে এবং সেগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা- যা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

পরিবহনের সাথে বহু মানুষের রুটি রুজি জড়িত। অন্যদের কথা বাদ দিলেও যেসব মানুষ বাসে বা ট্রেনে হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের উপার্জন দিনের পর দিন বন্ধ থাকলেও বন্ধ নেই ক্ষুধার যন্ত্রণা। ঈদের আমেজ তারা কি আদৌ পাচ্ছেন? তাদের স্ত্রী-সন্তানদের মুখে কি হাসির রেখা ফুটেছে?

শুধু শহরের কথাই কেন বলছি, সারা দেশেই তো হাটবাজার, দোকান পাট, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসায় লক্ষ লক্ষ মানুষ আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। চায়ের স্টল, ভাতের হোটেল ইত্যাদি ঠিকমত চালু না থাকায় বহু মানুষ হয়েছেন বেকার। বহু মানুষ পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন, যে কাজ কখনই করেননি সেই কাজে নেমে পড়ছেন, যে পোশাক কখনও পরেননি সেই পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যে মানের খাবার কখনও খাননি সেই মানের খাবার খেয়েই ঘুমাতে যাচ্ছেন। বাড়িতে ছেলেমেয়ের জন্য হয়ত ফলের গাছ লাগিয়েছিলেন, সেই ফল পেড়ে নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন বিক্রি করতে। স্ত্রী শখ করে সবজি গাছ লাগিয়েছেন। সেই সবজি নিজে না খেয়ে বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন দু’টো পয়সার আশায়।

মানুষ বড়ই কষ্টে আছে। সরকার কতটা খোঁজ খবর রাখতে পারছে জানি না। ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়, সেখানেও অনেকে যেতে পারেন না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যেমন এক বেলা না খেয়ে থাকলেও কারো কাছে ভিক্ষার হাত পাততে পারে না, তেমনি মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো চরম আর্থিক কষ্টে থাকলেও পারে না ত্রাণের গাড়িতে সিরিয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ইদানীং অনেকে বলছেন- ত্রাণ দেওয়ার ছবি যেন অনলাইনে প্রচার করা না হয়। কারণ তারা দেখেছেন- ত্রাণ নিতে যারা আসছে তারা অনেকেই ত্রাণ নেওয়ার মত লোক নন। তারা আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে, লোকলজ্জার ভয় উপেক্ষা করে অনেকটা অপরাধীর মত এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। শুধুই পরিবারের সদস্যদেরকে যাতে অনাহারে থাকতে না হয় সেজন্য। তারা পরিস্থিতির শিকার। এই মানুষগুলোর কথা সরকারকে ভাবতে হবে। তারা কষ্টে আছে, কিন্তু তা বলতে পারছে না, বোঝাতে পারছে না। তাদের এই কষ্ট সরকারি চাকরিজীবীরা বুঝবেন না, তাদের পরিস্থিতিও উপলব্ধি করতে পারবেন না।

পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব যদি হয় জনগণকে ঘরে ঢোকানো, জনসমাগম হতে না দেওয়া, তাহলে সেটা করার সামর্থ্য পুলিশের আছে। লকডাউনের মধ্যে কেউ রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছে- রিক্সা উল্টে রেখে দিলাম, ফুটপাতে কেউ ঝালমুড়ির দোকান দিয়ে বসেছে- দুটো লাঠির বাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিলাম। এগুলো করাই যায়, কিন্তু এগুলো সমাধান নয়। ওই মানুষগুলোর সুবিধা-অসুবিধার কথাও পুলিশকে ভাবতে হবে। তাদের দিকটাও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হবে। প্রাণের মায়া কার নেই? সবাই জানে ঘরে থাকলে নিরাপদে থাকবে, বাহিরে গেলে ভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকবে। করোনা ভাইরাস যাচাই করে দেখবে না কে শখ করে ঘরের বাইরে গেছে আর কে দুই মুঠো খাবার যোগাড় করতে গেছে। করোনার শিকার যে কেউ হতে পারে। তবু তারা কেন বাইরে যাচ্ছে? সেটা পুলিশকে বুঝতে হবে।

আজ করোনায় একশ’ জন মারা যাচ্ছে, কাল যদি এক হাজারও মারা যায়, তবু ওই অসহায় মানুষগুলোকে রাস্তায় নামতেই হবে। এমনকি তাদের পরিবারের কেউ মারা গেলেও তারা ঘরে বসে কোয়ারেন্টাইন পালন করতে পারবে না। তা করতে চাইলে তারা নিজেরাও ক্ষুধায় মরবে, স্ত্রী-সন্তানরাও ক্ষুধায় মরবে। কাজেই তাদেরকে যদি জোর করে ঘুরে ঢোকাতেই চান তাহলে তাদের হাতে এক কেজি চাল, আধাকেজি ডাল, একটু তেল-পেঁয়াজ-মরিচ-লবন ধরিয়ে দিন। তারপর বলুন, “ভাই খেয়ে না খেয়ে ঘরে পড়ে থাকেন। একেবারে বাধ্য না হলে ঘরের বাইরে আসবেন না।” তখন আপনার কথা সে মানবে, সে কষ্ট করে হলেও ঘরে থাকবে। কিন্তু সেটাও তো একদিন দুইদিন পরে ফুরিয়ে যাবে।

মনে রাখতে হবে- এটা কোনো ব্যক্তিগত সঙ্কট নয়, এটা কোনো দলের সঙ্কট নয়, এটা জাতির সঙ্কট। দেশের জনগণ যেমন দেশের দিকটা দেখবে, তেমনি দেশের দায়িত্বশীল মহলকেও জনগণের দিকটা দেখতে হবে। যারা শাসক আছেন, তারা যেন কঠোর থেকে কঠোরতর সিদ্ধান্ত দেওয়ার মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে না ফেলেন। তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে কীভাবে সেটাও তাদেরকে সমাধান করতে হবে। জনগণ তাদের আমানত। এই জনগণের ক্ষুধা-তেষ্টাকে উপলব্ধি করতে হবে। জনগণের দুঃখ কষ্টকে উপলব্ধি করতে পারাই মহান শাসকদের পরিচয়।

উমর ফারুক (রা.) এর খেলাফতের সময় আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। উমর (রা.) শপথ নিলেন- যতদিন আমার জনগণ পেট পুরে খেতে না পায়, ততদিন আমি ঘি ও মাংস স্পর্শ করব না! কারণ হিসেবে বললেন- ‘আমি যদি নিজে পেট পুরে খাই তাহলে কীভাবে বুঝব আমার জনগণ কতটা কষ্টে আছে?’ এই জাতীয় সঙ্কটের মুহূর্তে আমাদের শাসকদের মানসিকতা হোক উমর ফারুক (রা.) এর মতই মানবিক ও জনদরদী।

তবে শাসক মহল যতই জনদরদী হোক, দেশের প্রতিটি পরিবারের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া শাসকের পক্ষে অসম্ভব একটি কাজ। এই কাজ কেবল তখনই সম্ভব হবে যখন জনগণ নিজেরাও উদ্যোগী হবে। আমরা কথায় কথায় বলি- বিরানব্বই পার্সেন্ট মুসলমান! তাই যদি হয় তাহলে সেটার প্রমাণ দেওয়ার সময় এসেছে। স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা অনেক তো হলো। ভবনের নিচের তলায় কে আছে, উপরের তলার মানুষ জানে না। উপর তলার মানুষ খেতে পাচ্ছে কিনা নিচের তলার মানুষ জানে না। এটা কোনো মুসলমানের বৈশিষ্ট্য নয়। মুসলিম সমাজের চিত্র হবে অন্যরকম। আশেপাশের চল্লিশ বাড়ির কেউ কোনো বিপদে আছে কিনা, কেউ না খেয়ে আছে কিনা, কেউ কষ্ট পাচ্ছে কিনা- সেটা খোঁজ নেওয়া মুসলিমদের ঈমানী দায়িত্ব। আমরা কি এই দায়িত্ব পালন করি কখনও? যদি পালন করতাম তাহলে জনগণই যথেষ্ট হত জনগণের দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য এবং এটাই ইসলামের সিস্টেম, ইসলামের নীতি।

আমরা সবসময় নিজেকে ভালো রাখার মধ্যে আনন্দ খুঁজি, নিজের পরিবারকে সুখে রাখার মধ্যে আনন্দ খুঁজি, কিন্তু একজন প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করার মধ্যে যে আনন্দ আছে, নিজের খাবার প্রতিবেশীর সাথে ভাগ করে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, সেটা কি কখনও অনুভব করেছি আমরা? এবারের ঈদের আনন্দগুলো কি তেমনই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ত্যাগ ও সহযোগিতায় সাজিয়ে তোলা যায় না? আসুন জীবনে একটিবারের মত আমাদের ঈদ হোক ত্যাগের ঈদ, অসহায় মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ঈদ। যেমনটা লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ!”

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...