হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ আমরা কতটুকু মনে রেখেছি?

এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী:
কোন লোক যদি একটি বিরাট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা, অবিশ্বাস্য ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি সৃষ্টি করেন, তবে তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় তার সৃষ্ট জাতিটাকে কী উপদেশ দিয়ে যাবেন? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি তার শেষ উপদেশে সেই সব বিষয়ই মূলত উল্লেখ করবেন যে সব বিষয়ের উপর তার জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এবং তার অবর্তমানে যে সব বিষয়ে জাতির ভুল ও পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকবে। তাই নয় কি?

এবার দেখা যাক শেষ নবী (সা.) তাঁর বিদায় হজ্বে, যে হজ্ব তিনি জানতেন তাঁর শেষ হজ্ব, তিনি তার জাতিকে কি কি বিষয়ে (চড়রহঃ) বলছেন। বিদায় হজ্ব ছিল বিশ্বনবীর (সা.) জীবনের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ। এতে তাঁর ভাষণকে তিনি কতখানি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় এই থেকে যে, অতবড় সম্মেলনেও খুশি না হয়ে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, যারা উপস্থিত আছেন তারা তাঁর নির্দেশগুলি যেন যারা উপস্থিত নেই তাদের সবার কাছে পৌঁছে দেন- অর্থাৎ আরও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, তাঁর সমস্ত উম্মাহ তা শুনুক, জানুক। এখন দেখা যাক কী কী ছিলো তার বক্তব্যে। আমরা পাই-

(১) এই উম্মাহর লোকদের পরস্পরের সম্পত্তি ও রক্ত নিষিদ্ধ, হারাম করা।
(২) আমানত রক্ষা ও প্রত্যার্পন করা।
(৩) সুদ নিষিদ্ধ ও হারাম করা।
(৪) রক্তের দাবী নিষিদ্ধ করা।
(৫) পঞ্জিকা অর্থাৎ দিন, মাস, বছরের হিসাব স্থায়ী করা।
(৬) স্বামী-স্ত্রী, নর-নারীর অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া।
(৭) কোর’আন ও সুন্নাহকে জাতির পথ-প্রদর্শক হিসাবে রেখে যাওয়া।
(৮) একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করা।
(৯) সত্যনিষ্ঠ নেতার আনুগত্য বাধ্যতামুলক করে দেয়া।
(১০) জীবন-ব্যবস্থা, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ করা।
(১১) এই জাতির মধ্যকার সর্বপ্রকার ভেদাভেদ নিষিদ্ধ করা।
(১২) স¤পত্তির ওসিয়ত নিষিদ্ধ করা, অর্থাৎ আল্লাহ যে উত্তরাধিকার আইন দিয়েছেন তা লংঘন না করা।
(১৩) স্বামীর বিনানুমতিতে স্ত্রীর দান নিষিদ্ধ করা।

বিদায় হজ্বের এই ভাষণটি পর্যালোচনা করলে যা দেখা যায় তা হচ্ছে এগুলো আগে থেকেই কোরান-হাদীসে ছিল। তারপরেও তিনি জোর দিয়ে গুরুত্ব সহকারে তাঁর জীবনের সর্বশেষ সমাবেশে এই নির্দেশনাগুলি আবারো জাতিকে স্বরণ করিয়ে দিলেন। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তাঁর নির্দেশনাগুলির ছিল সবই জাতীয়, সামাজিক, আইনগত, অর্থনৈতিক, একটিও পুরোপুরি ব্যক্তিগত ছিল না। সেই ভাষণে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে জাতির ঐক্য সম্বন্ধে তাঁর ভয় ও চিন্তা। এটা স্বাভাবিক, কারণ সারাজীবন ধরে সংগ্রাম করে, শত নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করে, অপমান সহ্য করে, কাফের মোশরেকদের নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তিলে তিলে যে জাতিটিকে তিনি গড়ে তুললেন সেই জাতির উপর তাঁর কাজের দায়িত্ব অর্পন করে চলে যাবার সময় মানুষের মনে ঐ শঙ্কাটাই বড় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ ঐক্য ভেঙ্গে গেলেই সর্বনাশ, জাতি আর তার আরদ্ধ কাজ করতে পারবে না, শত্রুর কাছে পরাজিত হবে। তাই তাকে বিদায় হজ্বের ভাষণে বলতে শুনি- ‘‘হে মানুষ সকল! আজকের এই দিন (১০ই জিলহজ্ব), এই মাস (জিলহজ্ব) এই স্থান (মক্কা ও আরাফাত) যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অন্যের প্রাণ, স¤পদ ও ইজ্জত তেমনি পবিত্র (হারাম)। শুধু তাই নয় এই দিন, এই মাস ও এই স্থানের পবিত্রতা একত্র করলে যতখানি পবিত্রতা হয়, তোমাদের একের জন্য অন্যের জান-মাল-ইজ্জত ততখানি পবিত্র (হারাম)। খবরদার! খবরদার! আমার (ওফাতের) পর তোমরা একে অন্যকে হত্যা করে কুফরী করো না।’’ এই সাবধানবাণীটি তিনি একবার নয়, বার বার উচ্চারণ করেছিলেন। এখানে লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে যে, নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটিকে, অর্থাৎ জাতির ঐক্য নষ্ট করাকে নবীজী কোন পর্যায়ের মধ্যে ফেলেছেন? একেবারে কুফরের পর্যায়ে।

এবারে আসুন নবীজীর সেই সাবধান বাণীটি আমরা কতটুকু মেনে চলছি তা বাস্তবের সাথে মিলিয়ে দেখি। আজ বিশ্বনবীর উম্মাহর দাবীদার জাতিটি আমরা পঞ্চাশটির মত ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত। শিয়া-সুন্নিতে, মযহাবে মযহাবে, ফেরকায় ফেরকায় বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তপাতে মশগুল হয়ে আছি। দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ীকে রসুলাল্লাহ যে নিষেধ করলেন তা আজ অতি সওয়াবের কাজ মনে করছি। কিন্তু তারপরেও প্রতিবছর হজ্জ করতে যাচ্ছি কোথায়? সেই জায়গায় যেখানে দাঁড়িয়ে নবীজী ঐক্যহীনতাকে কুফর বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই অনৈক্যে ডুবে থাকলেও আমরা হজ্বের অতি সামান্যতম খুঁটিনাটিও অতিযত্নের সাথে পালন করছি আর ভাবছি আমাদের হজ্ব আল্লাহ কবুল করছেন, আমাদের জন্য আল্লাহ জান্নাত সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। আমাদের ঐ আশা যে কতখানি হাস্যকর তা বোঝার ক্ষমতাও আজ আমাদের নেই।

আল্লাহর রসুল তাঁর অবর্তমানে যে যে বিষয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন ঠিক সেই বিষয়গুলোই আজ এই জাতি করছে অতি সওয়াবের কাজ মনে করে। শিয়ারা সুন্নিদের আর সুন্নিরা শিয়াদের রক্তে হলি খেলছে। উভয় আশা করে তাদেরকে আল্লাহ খুশি হয়ে জান্নাত দান করবেন। এদিকে জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থাকে তো তিনশ’ বছর আগেই বিতাড়িত করা হয়েছে। কাজেই আল্লাহর হুকুম মোতাবেক শাসনকারী আমীরের আনুগত্যেরও কোন বালাই নাই। যে সুদকে আল্লাহর রসুল মায়ের সাথে যেনার সঙ্গে তুলনা করেছেন, সেই সুদের ভিতরে এই জাতি আজ আপাদমস্তক ডুবে আছে। পঞ্জিকার কথা বলতে গেলে তো বলা যায় যে, এই জাতির যে নিজস্ব একটি পঞ্জিকা রয়েছে তা এদের অধিকাংশ সদস্য আজ জানেই না। স্বামী-স্ত্রীর কার কী অধিকার ও কর্তব্য তাও অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর অজানা। আল্লাহর রসুল যে নারীকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেলেন, যে নারীরা মসজিদে নববীতে হাসপাতাল পরিচালনা করল, বাজার দেখাশোনা করল, সেই নারীদেরকে গৃহবন্দী জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং এর মাধ্যমে জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিষ্কৃয় করে রাখা হয়েছে। কোর’আন ও সুন্নাহ’র বদলে গত কয়েক শতাব্দী যাবৎ ব্রিটিশের চাপিয়ে দেওয়া মতবাদ ও তন্ত্র-মন্ত্রের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী চলছে জাতীয় জীবন। আল্লাহর রসুল বললেন আরবের উপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, যেমন নেই অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব, সাদার উপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, যেমন নেই কালোর উপর সাদার, মানুষে মানুষে মর্যাদার মাপকাঠি হলো তাকওয়া- অথচ আজ আমরা দেখি আরবরা আমাদের দেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মুসলমানদেরকে ডাকে মিসকিন বলে। তারা আরব এই অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। যদিও অনৈক্য, হানাহানি, শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব ইত্যাদির কারণে মাত্র দেড় কোটি ইহুদির হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে তিরিশ কোটির বেশি আরব। তবু অপমান বোধ নেই। তাকওয়া অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায় মেনে চলার ভিত্তিতে কেউ মর্যাদার অধিকারী হচ্ছেন না, বাস্তবতা হলো- আজকে যিনি যত সচ্চরিত্রবান তাকে তত অবাঞ্ছিত ভাবা হয়। সমাজে তার কোনো প্রভাব থাকে না, তার কথার কোনো দাম দেওয়া হয় না। বরং যারা যত দুরাচারী, কালো টাকার মালিক, তাদেরকে সবাই সমীহ করে চলে, তাদের প্রভাব সর্বত্র।

এভাবে জাতীয়, সামাজিক, আইনগত, সকল বিষয়ে রসুলের আশংকাগুলোই আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাঁর সাবধানবণীকে এই জাতি সামান্য পরিমাণ গুরুত্ব দেয়নি। আমাদের কাছে এটা কোন গুরুত্ব দেবার মত বিষয়ই নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দাড়ি, টুপি, মোজা, পাজামা, টাখনু, তসবীহ, তাহাজ্জুদ, কুলুখ, যেকের, ডান পাশে শোয়া, নফল নামাজ-রোযা করা, মেসওয়াক করা ইত্যাদি। আমরা এই বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি না কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করছি যে, ফরজ বা আল্লাহর সরাসরি আদেশ লঙ্ঘন করলে ব্যক্তিগত নফল-সুন্নাহ যতই ত্রুটিহীনভাবে মেনে চলা হোক, সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে না, সেগুলোর সওয়াব আল্লাহ দিবেন না। আগে ফরজ, তারপর নফল। একটি মানবদেহের হৃৎপিণ্ড যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেই মানবদেহের অন্যান্য অঙ্গ সুস্থ ও পরিপাটি থেকেও লাভ হয় না। দেহের মৃত্যু ঘটে। ইসলাম নামক দেহের হৃদপিণ্ড হলো তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা ও আল্লাহর হুকুম মোতাবেক সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করা। সেটাই যখন বাদ দেওয়া হয়েছে, তখন ব্যক্তিগত নফল ও সুন্নতের কোনো সুফল পাওয়া যাবে কি? অথচ এইগুলো করেই আমরা ভেবে রেখেছি যে, জান্নাতের দরজা খুলে আল্লাহ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কতখানি নির্বুদ্ধিতার পরিচয়!

আজকে পৃথিবীময় মুসলিমদের এই যে পরাজয়, লাঞ্ছনা ও অপমান, এর জন্য দায়ী এটাই। আল্লাহর রসুল তাদের সামনে যে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেলেন, সেটা এরা বহু পূর্বেই ভুলে গেছে। আর তারই প্রাকৃতিক পরিণতি ভোগ করছে জাতিগতভাবে। এখন সময় এসেছে পুনরায় আল্লাহর রসুলের দেখানো পথ-নির্দেশনায় ফিরে যাওয়ার। তার জন্য সর্বপ্রথম জাতিকে একটি নেতৃত্বের অধীনে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

[সম্পাদনা: মোহাম্মদ আসাদ আলী।
যোগাযোগ: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৭১১-০০৫০২৫, ০১৭১১-৫৭১৫৮১
]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...