হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর রাজনৈতিক জীবন

রিয়াদুল হাসান:

ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের সন্তান মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী ছিলেন আধ্যাত্মিক ও মানবিক চরিত্রে বলিয়ান এমন এক মহান পুরুষ যাঁর ঘটনাবহুল ৮৬ বছরের জীবনে একটি মিথ্যা বলার বা অপরাধ সংঘটনের দৃষ্টান্ত নেই। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী (Versatile Genius) ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব, রাজনীতি, সমাজ উন্নয়ন, চিকিৎসা, শিক্ষা, সঙ্গীত, শিকার, ক্রীড়ানৈপুণ্য, সাহিত্যচর্চা, গবেষণা, ইসলামী আন্দোলনের প্রবক্তা ইত্যাদি বহুবিধ অঙ্গনে তিনি অপূর্ব দক্ষতা ও মেধার সাক্ষর রেখেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কিছু ইতিহাস আজ তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম:

কলকাতায় শিক্ষালাভের সময় ভারত উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উত্তাল। তরুণ এমামুয্যামানও এ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই সুবাদে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের বহু কিংবদন্তী নেতার সাহচর্য লাভ করেন। যাঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্, যুগান্তর দলের নেতা শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী অন্যতম। এমামুয্যামান যোগ দিয়েছিলেন আল্লামা এনায়েত উল্লাহ খান আল মাশরেকী প্রতিষ্ঠিত ‘তেহরিক-ই-খাকসার’ আন্দোলনে। ছাত্র বয়সে একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগদান করেও তিনি দ্রুতত জ্যেষ্ঠ নেতাদের ছাড়িয়ে পূর্ববাংলার কমান্ডারের পদ লাভ করেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে দুঃসাহসী কর্মকাণ্ড ও সহজাত নেতৃত্বের গুণে Special Assignment-এর জন্য ‘সালার-এ-খাস হিন্দ’ মনোনীত হন।

সমাজসেবা:

সমাজসেবামূলক কাজ করা ছিল তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। দেশবিভাগের অল্পদিন পর তিনি হোমিওতে ‘ডক্টর অব মেডিসিন’ ডিগ্রি অর্জন করেন। গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন এবং হোমিও মেডিসিন নিয়ে পড়শুনা করে মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করেন। তিনি দরিদ্র রোগীদের থেকে কখনোই ফি নিতেন না, অসংখ্য রোগীকে তিনি নিয়মিতভাবে ফি ছাড়াই চিকিৎসা করেছেন। টাঙ্গাইলে কলেরা রোগের মহামারীর সময় অধিকাংশ মানুষ যখন ভয়ে রোগীদের কাছে যেত না, তিনি তাদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করেছেন, হাজার হাজার মানুষকে প্রতিষেধক ইনজেকশান দিয়েছেন। ১৯৬৩ সনে মা ও শিশুদের সুচিকিৎসার জন্য তিনি করটিয়ায় হায়দার আলী রেডক্রস ম্যাটার্নিটি এ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সনে প্রতিবন্ধী শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সা’দত আলী খান পন্নী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।

সা’দত আলী খান পন্নী ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী) শিশুদেরকে যত্নসহকারে শিক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষকগণ।

রাজনৈতিক জীবন:

মাননীয় এমামুয্যামানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই সে আমলে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর চাচাতো ভাই জনাব খুররম খান পন্নী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের চীপ হুইপ এবং একজন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। চাচাতো ভাই হুমায়ন খান পন্নী পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার ছিলেন। খুররম খান পন্নীর পুত্র দ্বিতীয় ওয়াজেদ আলী খান পন্নী বাংলাদেশ সরকারের উপমন্ত্রী ছিলেন। এমামুয্যামানের মায়ের মামা সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পর এমামুয্যামান আর রাজনৈতিক অঙ্গনে আসবেন না বলে সিদ্ধান্ত করলেও পবিারের সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ববর্গের অনুরোধে দীর্ঘ এক যুগ পরে তিনি রাজনীতির অঙ্গনে ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সনে টাঙ্গাইল-বাসাইল নির্বাচনী আসনে অনুষ্ঠিত একটি উপনির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র পদপ্রার্থী হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেকেই চেয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ মওলানা ভাসানীকে দিয়ে ক্যাম্পেইন করাতে, কিন্তু মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘সেলিমের বিপক্ষে আমি ভোট চাইতে পারব না, চাইলেও লাভ হবে না। কারণ তাঁর বিপক্ষে তোমরা কেউ জিততে পারবে না।’ বাস্তবেও তা-ই হয়েছিল। বিপক্ষীয় মোট ছয়জন অভিজ্ঞ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত করে তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য (এম.পি.) নির্বাচিত হন।

অসামান্য ব্যক্তিত্ব, সততা, নিষ্ঠা, ওয়াদারক্ষা, নিঃস্বার্থ জনসেবা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঋজু অবস্থানের কারণে সর্বকনিষ্ঠ এমপি হয়েও তিনি প্রবীণ রাজনীতিকদের সমীহ অর্জন করেছিলেন। এমপি হয়ে তিনি নিজ এলাকার শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ইত্যাদি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করেন যার বিবরণ সরকারি গেজেটে সংরক্ষিত আছে। ১৯৬৪ সালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম-হিন্দু, বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছিল এবং অবাধে চলছিল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। রাজনীতিক স্বার্থহাসিলের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার এ দাঙ্গাকে উৎসাহিত করে। এমামুয্যামান এমপি হয়েও সরকারের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোয় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত কাজ করেন।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রীকে টাঙ্গাইল পরিদর্শনে নিয়ে আসেন নির্বাচিত আইন পরিষদ সদস্য (এমপি) এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী।

মুক্তিযুদ্ধে পন্নী পরিবারের ভূমিকা:

বাংলার জমিনে পন্নী পরিবারের ইতিহাস ৫০০ বছর পুরনো। সুলতানী যুগ, মুঘল আমল ও ব্রিটিশ আমল সব সময়েই তাঁরা ছিলেন এ অঞ্চলের সবচাইতে প্রভাবশালী ও উদ্যোগী পরিবার। নিজ এলাকার মানুষের কাছে তাঁরা ছিলেন অভিভাবকের মতো, তাদের একমাত্র নির্ভরশীলতা ও আশ্রয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন পাক হানাদার বাহিনী সারা দেশে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করল এবং গণহত্যা শুরু করল তখন এমামুয্যামানের বাবা-মা’সহ পরিবারের অনেকেই করটিয়াতে ছিলেন। গ্রামবাসীরা ছুটে এসে তাদেরকে অনুরোধ করেছেন যেন তারা এই বিপদের সময় তাদের পাশে থাকেন এবং তাদেরকে রক্ষা করেন। পাকিস্তান আর্মি বাংলাদেশের প্রত্যেক এলাকা গিয়ে সেখানকার অর্থশালী, সম্ভ্রান্ত ও জমিদার পরিবারগুলোর উপর গিয়ে চড়াও হতো। করটিয়াতেও তার ব্যতিক্রমন হয় নি। পাকবাহিনী এসে করটিয়া জমিদার বাড়িকেই তাদের ক্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করার জন্য একপ্রকার দখল করে নেয় এবং পরিবারের সবাইকে নজরবন্দী করে রাখে। এরই মধ্যে এমামুযযামান ও তাঁর বাবা পাকবাহিনীকে অনুরোধ-উপরোধ করে বহু হিন্দু ও মুসলিম গ্রামবাসীর জীবন বাঁচিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এমামুযযামানের পরিবারের অস্ত্রাগারের বহু অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন।

এমামুযযামানের ছোট বোন আমেনা পন্নী যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষারত ছিলেন। ২৫ মার্চের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের কাহিনীর সংবাদ পাওয়ামাত্র তিনি সানফ্রান্সিসকো এবং আশপাশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ২৮ মার্চ তাঁরা দল বেঁধে পাকিস্তান কনস্যুলেট ভবনের সামনে বিক্ষোভ করলেন। কিন্তু পুলিশের প্রচণ্ড বাধার মুখে তারা কনস্যুলেট ভবনে ঢুকতে ব্যর্থ হন। উপায়ন্তর না দেখে আমেনা পন্নী চরম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে কনস্যুলেট ভবনের উঁচু প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিতরে চলে যান এবং সামনের পতাকাদণ্ড থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলে সেখানে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই মহীয়সী নারী ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন শহরে ঘুরে এসব এলাকায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য ওষুধ জোগাড় করতেন এবং লন্ডন ও ভারত হয়ে সেই ওষুধগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এসে পৌঁছাত। শুধু তাই নয়, তিনি ইংল্যান্ড-আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে প্রায় হাজার তিনেক চিঠি লিখেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেন। এসব অর্থ তিনি মুক্তিসংগ্রামে জড়িত ব্যক্তিদের কল্যাণে ব্যয় করেন (স্মরণীয়া-বরণীয়া- দৈনিক যায়যায়দিন, তারিখ: ১৮ মার্চ ২০১৯)। তিনি মহিলা সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সদস্যা ছিলেন। মেহেরুন্নেসা মেরী বিরচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রন্থে তাঁর বীরত্বব্যাঞ্জক ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তহবিল সংগ্রহে নিউইয়র্কে যে গানের আয়োজন হয়েছিল, বিখ্যাত সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের পহেলা অগাস্টের সেই আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন পপ সঙ্গীতের তৎকালীন সুপারস্টার বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, এরিক ক্ল্যাপটন, রবি শঙ্কর, কমলা চক্রবর্তী, আল্লা রাখা এবং আলী আকবর খানের মত কিংবদন্তী তারকারা।

এমামুযযামানের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ খুররম খান পন্নী ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কূটনীতিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম সামরিক আগ্রাসনের বিরোধিতা করে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় করেছেন। (বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিকের অবদান উপেক্ষিত -বাংলা নিউজ ২৪.কম, ২৫ মার্চ ২০১৮, Khurram Panni Defects to Bangladesh – The Daily Star, 13 September 2021)।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...