হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইসলামের বিকৃত আকিদা-প্রকৃত আকিদা

মনিরুয্যামান

নামাজ নয় সালাহ, রোযা নয় সওম, খোদা নয় আল্লাহ
এ উপমহাদেশে সালাতের বদলে নামাজ, সওমের বদলে রোযা, মালায়েকের বদলে ফেরেশতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে আমরা এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে সালাহ, সওম, মালায়েক ইত্যাদি বললে অনেকে বুঝিই না সালাহ কী, সওম কী বা মালায়েক কী। অথচ কোরআনে কোথাও নামাজ, রোযা, ফেরেশতা বা খোদা শব্দ নেই, কারণ কোরআন আরবি ভাষায় আর নামাজ-রোযা-খোদা ইত্যাদি হলো পার্শি অর্থাৎ ইরানি ভাষা। ইরান তথা পারস্য সাম্রাজ্য উম্মতে মোহাম্মদীর দ্বারা বিজিত হলে প্রায় সমগ্র ইরানি জাতিটিই ঢালাওভাবে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। ঢালাওভাবে ইসলামে প্রবেশ করার কারণে ইসলামের প্রকৃত আকিদা সম্পর্কে তাদের ধারণা পরিষ্কার ছিল না। তারা অগ্নিউপাসক থাকাকালীন আগুন উপাসনাকে নামাজ পড়া বলতো, সালাহ-কে তারা নামাজ বলতে শুরু করল, তাদের অগ্নি-উপাসনার ধর্মে উপবাস ছিল, তারা সওমকে রোজা অর্থাৎ উপবাস বলতে লাগলো, মুসলিমকে তারা পার্শি ভাষায় মুসলমান, নবী-রসুলদের পয়গম্বর, জান্নাহ-কে বেহেশত, জাহান্নামকে দোযখ, মালায়েকদের ফেরেশতা এমন কি মহান আল্লাহর নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে খোদা ইত্যাদিতে ভাষান্তর করে ফেললো। তারপর মুসলিম জাতি যখন ভারতে প্রবেশ করে এখানে রাজত্ব করতে শুরু করল তখন যেহেতু তাদের ভাষা পার্শি ছিল সেহেতু এই উপমহাদেশে ঐ পার্শি শব্দগুলির প্রচলন হয়ে গেলো। এই পার্শি শব্দগুলো ইসলামের অন্যতম বিধান নামাজ, রোযা ইত্যাদির প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করতে সক্ষম নয় বিধায় আমাদের উচিত হবে আল্লাহ আল কোর’আনে যেসকল শব্দ ব্যবহার করেছেন সেগুলোকে গ্রহণ ও প্রয়োগ করা।
সালাহর উদ্দেশ্য
সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায়, অবিচার, রক্তপাত, যুদ্ধ, সংঘাত তথা অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা উম্মতে মোহাম্মদীর লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার জন্যই আল্লাহ জিহাদের (সর্বাত্মক সংগ্রাম) নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর এই সংগ্রামের জন্য যে চরিত্র দরকার সেই চরিত্র সৃষ্টির প্রশিক্ষণ, ছাঁচ (ডাইস) হচ্ছে সালাহ।
সওমের উদ্দেশ্য
সওম শব্দের অর্থ সংযম (Self Control)। সালাতের মতো সওমের উদ্দেশ্যও জাতির সংগ্রামী চরিত্র সৃষ্টি করা। ভোগ-বিলাসিতার পরিবর্তে সওম সংযমের শিক্ষা প্রদান করে, আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি করে। যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো বিপদ-আপদকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করার শিক্ষাও সওম থেকে পাওয়া যায়।
হজ্বের উদ্দেশ্য
বর্তমানে বিকৃত আকিদায় ‘হজ্ব’কে স¤পূর্ণরূপে একটি আধ্যাÍিক ব্যাপার, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করার পথ বলে মনে করা হয়। কিন্তু হজ্বের প্রকৃত আকিদা সেটা নয়। এই শেষ দ্বীনের অন্যান্য সব বিষয়ের মতো হজও ভারসাম্যপূর্ণ। এতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ইত্যাদির যেমন অংশ আছে তেমনি আÍার উন্নতির, পরিচ্ছন্নতারও অংশ আছে, এর যে কোন একটির গুরুত্ব কমিয়ে দিলেই আর সেই ভারসাম্য থাকবে না।
ইসলামে সমষ্টির তুলনায় ব্যক্তি গৌণ। এ কারণেই আল্লাহ দিনে পাঁচবার জামাতে সালাহ কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই জামাতে সালাতেরই বৃহত্তর সংস্করণ হজ। জামাতে সালাতের উদ্দেশ্য- মুসলিম পাঁচ বার তাদের স্থানীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদে একত্র হবে, তাদের স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নিবে, তারপর স্থানীয় ইমামের নেতৃত্বে তার সমাধান করবে এবং সপ্তাহে একদিন বৃহত্তর এলাকার জামে মসজিদে জুমার সালাতে একত্রিত হয়ে একই কাজ করবে; ঠিক তেমনই বছরে একবার আরাফাতের ময়দানে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমদের নেতৃস্থানীয়রা একত্র হয়ে জাতির সমস্ত সমস্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি সর্বরকম সমস্যা, বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে যে উপায়ে সেটাই হলো হজ্ব। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায় থেকে ক্রমশও বৃহত্তর পর্যায়ে বিকাশ করতে করতে জাতি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু মক্কায় একত্রিত হবে। একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার এর চেয়ে অপূর্ব সুন্দর প্রক্রিয়া আর কী হতে পারে?
মো’মেন
মো’মেন কারা তা আল্লাহ সুরা হুজরাতের ১৫নং আয়াতে পরিষ্কার করে দিয়েছেন – “প্রকৃত মো’মেন শুধু তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে, তারপর (ঈমান আনার পর) আর তাতে কোনো সন্দেহ করে না, এবং তাদের জীবন ও সম্পত্তি দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদ করে” (সুরা হুজরাত ১৫)। অর্থাৎ, আল্লাহর দেয়া মো’মেনের সংজ্ঞায় দু’টি শর্ত দেয়া হলো; প্রথম শর্ত হচ্ছে আল্লাহ ও রসুলের ওপর ঈমান, অর্থাৎ তওহীদ, যার অর্থ হচ্ছে জীবনের সর্বাঙ্গনে সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি যাই হোক না কেন, যে বিষয়ে আল্লাহ বা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য আছে, কোনো আদেশ-নিষেধ আছে সে বিষয়ে আর কাউকে না মানা। দ্বিতীয় শর্ত হলো ঐ তওহীদকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ অর্থাৎ সর্বাত্মক সংগ্রাম করা।
জান্নাত কাদের জন্য?
জান্নাত মো’মেনদের জন্য। কোর’আনে আল্লাহ যত নির্দেশ প্রদান করেছেন, যেমন সালাহ, যাকাত, সওম, হজ্ব ইত্যাদি সব নির্দেশই মো’মেনদের প্রতি। গোনাহ মাফ করা হবে শুধু মো’মেনদের। পৃথিবীর কর্তৃত্বও আল্লাহ কেবল মো’মেনদের হাতে দেয়ার প্রতিশ্র“তি প্রদান করেছেন। (সুরা নুর: ৫৫) তিনি নিজেকে মো’মেনদের ওয়ালী ঘোষণা করেছেন। (বাক্বারা ২৫৭) আমল কবুল হওয়া না হওয়া তাই মো’মেন হওয়া বা না হওয়ার উপর নির্ভরশীল। মো’মেন কারা তার সংজ্ঞা সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে তিনি দিয়ে দিয়েছেন যেটা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। সে সংজ্ঞা অনুযায়ী মো’মেন হবার পূর্বশর্ত হলো- প্রথমত, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব তথা সত্যকে গ্রহণ করা, দ্বিতীয়ত, সেই সত্যকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। যারা এর কোনো একটি শর্ত অপূর্ণ রাখবেন, তারা যতই নামাজ পড়–ন, রোযা রাখুন, হজ্ব করুন না কেন সেসব অর্থহীন। তাদের ব্যক্তিগত এবাদত-উপাসনা তাদেরকে জান্নাতে নিতে পারবে না।
এবাদত
বর্তমানে নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত, জিকির-আজগার, কোর’আন তেলাওয়াত, মিলাদ-মাহফিল ইত্যাদিকে এবাদত বলে মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এবাদত হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত, অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে যেমন সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করছেন, আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষেরও দায়িত্ব হলো পৃথিবীতে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত রাখা। এটাই মানুষের প্রধান কর্তব্য, বড় এবাদত। এ এবাদত করার জন্য তিনি মো’মেনদের নির্দেশ প্রদান করেছেন, বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের জীবন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। (তওবা: ১১১) আল্লাহর পথে নিজেদের জীবন-সম্পদ ব্যয় করাই তাই একজন মো’মেনের প্রধান এবাদত। এখানে আল্লাহর পথ মানে হচ্ছে মানবতার কল্যাণের পথ, মানবজাতির শান্তি বিধানের জন্য সংগ্রাম করা।
উম্মতে মোহাম্মদী
সমস্ত পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়, অশান্তি দূরীভূত করে শান্তি তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ আখেরী নবী, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, এ কাজ কারও একার পক্ষে এক জীবনে করা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর রসুল এমন একটি জাতি গঠন করলেন যারা তাঁর অবর্তমানেও তাঁর দেখানো পথে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালাতে থাকবে। এ জাতিকেই তিনি সম্বোধন করেছেন তাঁর উম্মত, উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে। অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী হচ্ছে এমন এক যোদ্ধা জাতি, যারা বাড়ি-ঘর, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেত-খামার এমনকি মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সারাটা জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। যারা এ সংগ্রাম করবে না, তারা যত বড়ই লেবাসধারী হোক, নামাজ-রোযার ব্যাপারে সচেতন হোক, কোর’আন মুখস্থ করুক, জিকিরে মশগুল থাকুক তারা উম্মতে মোহাম্মদী নয়।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...