হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইব্রাহীমের (আ.) দীনে হানিফ ও মক্কার ধর্মব্যবসা

মোহাম্মদ আসাদ আলী

মক্কার কোরায়েশ বংশ ছিল পুরোহিত বংশ। তখন কাবা শরীফের ভিতরে ও বাইরে সব মিলিয়ে তিনশ’ ষাটটি মূর্তি ছিল যেগুলোর পূজা অর্চনা করার সময় কোরায়েশরা পুরোহিতের কাজ করতো। এই পুরোহিতরা পূজা ছাড়াও সমাজপতির দায়িত্ব পালন করত। রসুলাল্লাহর গোত্রীয় চাচা আমর ইবনুল হাশেম (যে আবু জাহেল হিসাবে পরবর্তীতে পরিচিত হয়) ছিল সে সময়ে আরবের মধ্যে একজন খ্যাতিমান বড় আলেম, পুরোহিত ও গোত্রপতি। সবাই তাকে আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা বলে ডাকত, যেমন আলেমরা নিজেদের নামের আগে লিখে থাকেন আল্লামা (মহাজ্ঞানী, Very high scholar)। কিন্তু যখন আল্লাহর রসুল মানবজাতির উদ্দেশ্যে তওহীদের ডাক দিলেন তখন এই আবুল হাকাম তার জ্ঞানের পরিচয় দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হলো। সে হয়ে দাঁড়াল ইসলামের কট্টর শত্রু (arch-enemy) এবং কুফরের পতাকাবাহী। তার বিরোধিতামূলক কর্মকা- ও শত্রুতা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে রসুলাল্লাহ তাকে “এই উম্মাহর ফেরাউন” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, ‘যে আবু জাহেলকে আবুল হাকাম বলে ডাকবে সে সাংঘাতিক ভুল করবে। তার উচিত হবে এই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা’। কেবল আবু জাহেলই নয়, ইব্রাহিম (আ.) এর আনীত দীনে হানিফের বিকৃতরূপের ধ্বজাধারী মূর্তিপূজক পুরোহিত আলেম শ্রেণির সকলেই ছিল রসুলাল্লাহর ঘোর বিরোধী। রসুলাল্লাহ যাদের মধ্যে আসেন তারা নিজেদেরকে ইব্রাহীম (আ.) এর উম্মাহ বা অনুসারী বলে দাবি করত (সিরাত ইবনে ইসহাক)। তিনি যে দীনটি তাঁর জাতির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন তার নাম আল্লাহ দিয়েছেন দীনে হানিফ অর্থাৎ একাগ্রভাবে শুধু আল্লাহর আনুগত্য করার দীন। এর অনুসারী আরববাসী আল্লাহ বিশ্বাস করত, নামাজ পড়ত, রোজা রাখত, হজ্ব করত, কোরবানি দিত, আল্লাহর নামে কসম খেত, যে কোনো কাজ শুরু করত আল্লাহর নামে।
তথাপি তারা কাফের মোশরেক ছিল কারণ তারা তাদের জাতীয় সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর হুকুম মানতো না, মানতো নিজেদের গোত্রপতি ও ধর্মনেতাদের হুকুম। তারা মূর্তিপূজা করত মূলত দুটো কারণে- আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দেবে এবং তাদের নানাবিধ সমস্যার সমাধান করে দেবে, অর্থাৎ আজকে ঠিক যে দু’টো কারণে মানুষ বিভিন্ন পীরের দরবারে যায়। ইব্রাহীম (আ.) এর আনীত সেই দীনে হানিফ কী করে বিকৃত হলো, কী করে সেখানে ধর্মব্যবসার অনুপ্রবেশ ঘটল সেই ইতিহাস একটু বলে নেওয়া প্রয়োজন, কারণ ধর্মব্যবসায়ী আলেম আর প্রকৃত আলেমের পার্থক্যটি বোঝার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সহায়ক হবে। ইব্রাহীম (আ.) নমরুদ, হামান গংদের কায়েম করে রাখা অন্যায়-অবিচার ও জাহেলিয়াতপূর্ণ সমাজব্যবস্থাকে আল্লাহর সাহায্যে ধ্বংস করে দিয়ে আল্লাহর তওহীদের উপরে ভিত্তি করা নতুন এক সভ্যতা নির্মাণ করেন। তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ মুসলিম জাতির উন্মেষ ঘটান এবং তিনি নিজেও নিজেকে একজন মুসলিম বলেই সাক্ষ্য প্রদান করেন। তাঁকে ঘিরে আল্লাহর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বলে তাঁকে আজীবন বহু কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অবশেষে আল্লাহ তাঁকে মুসলিম জাতির পিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন (কোর’আন: সুরা হজ্ব ৭৮)। আল্লাহর অভিপ্রায় হচ্ছে এক দম্পতি থেকে উদ্ভূত হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া মানবজাতি যেন একটা সময়ে আবার আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক জাতিতে পরিণত হয়। এই মহাপরিকল্পনা পূরণের স্থপতি হলেন ইব্রাহীম (আ.)। তিনি সমগ্র মানবজাতির ঐক্যের সূত্ররূপে তাদের মিলিত হওয়ার জন্য পবিত্র কাবাগৃহকে পুনঃনির্মাণ করলেন।
ইব্রাহীম (আ.) এর প্রতিষ্ঠিত দীনের অধীনে শত শত বছর মানুষ শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বাস করেছে। তিনি জীবনভর ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এক আল্লাহর হুকুমের ছায়াতলে সমবেত করতে। যিনি ছিলেন ঐক্যের প্রতীক সেই ইব্রাহীম (আ.) এর অনুসারীরা কয়েক শতাব্দী যেতে না যেতেই হাজারো গোত্রে উপগোত্রে ভাগ হয়ে গেল। তারা বহু অপসংস্কৃতি ধর্মের নামে চালু করে দিল আর আল্লাহর সান্নিধ্যলাভের উদ্দেশে সেই অপসংস্কৃতিগুলোর চর্চা হতে লাগল। উপসনাপদ্ধতি বিকৃত হয়ে গেল। তিনি তাঁর জাতির চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণস্বরূপ সালাহ (নামাজ) শিক্ষা দিয়েছিলেন। সেই সালাতকে হাততালি আর শিস বাজানোয় পর্যবসিত করল (কোর’আন: সুরা আনফাল ৩৫)। তিনি বায়তুল্লাহ শরীফে হজ্বের প্রবর্তন করেন। কিন্তু সেই হজ্বের নামে তাঁরই বংশধরেরা শুরু করল ধর্মব্যবসা। তারা উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফের প্রবর্তন করল। ইব্রাহীম (আ.) কি জাতিকে এহেন অসভ্যতা শিক্ষা দিয়েছিলেন? অসম্ভব। তিনি নমরুদের মন্দিরে রক্ষিত মূর্তি ভেঙে প্রমাণ করেছিলেন যে, এই কাঠ পাথরের মূর্তির সামনে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব আল্লাহর রূহধারী মানুষ প্রণত হতে পারে না, অথচ তাঁর বংশধর ও উম্মাহ দাবিদারেরা কাবা প্রাঙ্গণে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে সেগুলোর পূজা আরাধনা প্রচলন করেছিল। এই ৩৬০ টি মূর্তির মধ্যে ইব্রাহীম (আ.) এর মূর্তিও ছিল। একেক গোত্র একেক দেবদেবীকে তাদের গোত্রীয় উপাস্য বলে মানতো। আর এদের সবার কাছ থেকেই কাবার পুরোহিত মোতোয়াল্লি হিসাবে পাওনা-গ-া বুঝে নিত কোরায়েশ বংশীয়রা। এই ধর্মব্যবসাই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। কাবা প্রাঙ্গনে চলতো জুয়া আর লটারির মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণের খেলা। পুরোহিতরা যা বলত তাই দীনে হানিফ অর্থাৎ ইব্রাহীমের (আ.) ধর্মমত হিসাবে মানুষ স্বীকার ও বিশ্বাস করে নিত। অল্প কিছু মানুষ কেবল বুঝত এগুলো ইব্রাহীমের (আ.) দীনের প্রথা নয়, কিন্তু সমাজকে ইব্রাহীমের (আ.) সঠিক দীনের উপর ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় বা পথ তাদের জানা ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অন্ধত্ব আর ধর্মব্যবসায়ীদের প্রভাবের সামনে তারা ছিল নিরুপায়। এভাবে তাদের কাছে ধর্ম একটি বিরাট লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।
কিন্তু আল্লাহর শেষ রসুল এসে যখন তাদের এই ধর্মের নামে চালু করে দেওয়া অধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন, তখন যেন তা ঐ সমাজের কায়েমী স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত করল। তিনি একটা কথাই বলেছিলেন, তোমাদের কারো কর্তৃত্ব আর চলবে না, শুধু আল্লাহর হুকুম চলবে। কলেমা, তওহীদের এই মর্মবাণী বুঝতে পেরে গোত্রপতি ও ধর্মব্যবসায়ীদের মাথা খারাপ হয়ে গেল। তারা বহুবিধ অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডা চালিয়ে রসুলের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কে দিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ হয় নি, যদিও রসুলকেও ইব্রাহীমের (আ.) মতোই বহু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। রসুলাল্লাহ আরবের গোত্রপ্রথা ভেঙে এক আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে আবার জাতিগঠন করতে শুরু করলেন। তিনি কাবাকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসাকে দীনে হানিফ মোতাবেক অবৈধ বলে ঘোষণা করলেন। তারাই সম্মিলিতভাবে তাঁকে ও তাঁর সাহাবীদেরকে নির্মম নির্যাতন করে সত্যকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিদূরিত করে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করল। এভাবে আরবের ঐ সময়ের মানুষগুলো স্পষ্টত দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল আল্লাহর তওহীদ গ্রহণ করল। তারা হলো মো’মেন। অপর দল তওহীদ প্রত্যাখ্যান করে পূর্বের জাহেলিয়াতকেই ধারণ করে হলো কাফের। যারা মো’মেন হলেন তারা প্রকৃত ইসলামের জ্ঞান লাভ করলেন এবং প্রকৃত ইসলামকে মানবজীবনে কার্যকর করার জন্য নিজেদের জীবন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করলেন আল্লাহর দৃষ্টিতে তারাই হলেন সত্যনিষ্ঠ আলেম বা হক্কানি আলেম। কিন্তু সেই জাহেলি সমাজের চোখে জ্ঞানী বলে পরিচিত ব্যক্তিরা যারা তওহীদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল এবং তাদের বিকৃত দীনকে আঁকড়ে ধরে রেখে তা দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করে চলছিল তাদেরকে আমরা বলতে পারি ধর্মব্যবসায়ী আলেম। আবু জাহেল হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
এ কথা আমাদের নয়, স্বয়ং আল্লাহর কথা। তিনি বলেন, আল্ল­াহ সাক্ষ্য দেন এবং মালায়েকগণ ও জ্ঞানী (আলেম) ব্যক্তিগণও সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই (কোর’আন: সুরা ইমরান ১৮)। আল্লাহর এই কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যারা আল্লাহর তওহীদের সাক্ষ্য দেয় তারা আলেম। কিন্তু যারা তওহীদের সাক্ষ্য দেবে না, তারা যত আরবি ভাষাই জানুক, ইসলামের এ মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত জানুক তারা আল্লাহর কথা মোতাবেক আলেম নয়। এর বাস্তব উদাহরণ পাশ্চাত্যের সেই খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ বা ওরিয়েন্টালিস্টগণ যারা ইসলামের উপরে হাজার হাজার বই লিখেছেন, কোর’আন ও হাদিসের অগাধ পা-িত্য অর্জন করেছেন, আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত প্রাচীন কেতাবগুলোকে তারাই প্রথমে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। সেই ইংরেজি থেকে তাদের অধীন দাসজাতিগুলোকে তারা যার যার মাতৃভাষায় তাদের মনমত ‘ইসলাম’ শিক্ষা দিয়েছে। এর জন্য তারা ভারতবর্ষে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তার সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ প্রিন্সিপাল পদটি অধিকার করেছিল প্রায় আশি বছর। আরবি ভাষা জানা, ইসলামের ইতিহাস, মাসলা-মাসায়েল জানাই যদি আলেমের সংজ্ঞা হয় তাহলে তাদের চেয়ে বড় আলেম মুসলমানদের মধ্যে কয়জন আছে সন্দেহ। কিন্তু তাদেরকে তো আলেম বলে কেউই স্বীকৃতি দেবে না, স্বভাবতই, কারণ তারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান আনে নি। তাদের এলেম হাসিলের উদ্দেশ্য ছিল অন্য।
যাহোক, যে কথা বলছিলাম, রসুলাল্লাহর আহ্বানে সমাজের যে নিরক্ষর, সাধারণ শ্রেণির মানুষগুলো যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ক্রীতদাস, কুলি-মজুর, চাষী, বেদুইন, মেষ আর উটের রাখাল। তারা যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং স্বয়ং আল্লাহর রসুলের কাছ থেকে ইসলামের আকিদা শিক্ষা করলেন, তারা হয়ে দাঁড়ালেন একেকজন নক্ষত্রসদৃশ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব [হাদিস: ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বায়হাকী], তারাই হলেন সত্যিকারের আলেম। ইসলাম সম্পর্কে তাদের থেকে কি কারও পক্ষে বেশি জানা সম্ভব? নিশ্চয় নয়। তাদের কাছ থেকেই পরবর্তী যুগের মানুষ ইসলাম শিক্ষা করেছেন। প্রায় নিরক্ষর সেই সাহাবীদের পবিত্র জীবনী পড়েই আজকে বহু মানুষ আল্লামা, মুফতি, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, শায়েখ, বুজুর্গানে দীন হচ্ছেন, নামের আগে রেলগাড়ির মতো দীর্ঘ টাইটেল ব্যবহার করছেন কিন্তু সেই সাহাবীরা কেউই নামের আগে আলেম, আল্লামা, মাওলানা, মুফতি জাতীয় খেতাব ব্যবহার করেন নি। যে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে ‘আলেম বা জ্ঞানী’ বলে পরিচয় দেয় তার চেয়ে মূর্খ, অজ্ঞ, নির্বোধ বোধহয় আর কেউ হতে পারে না।

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ফেসবুক: ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...