ওবায়দুল হক বাদল:
রাজধানীতে হেযবুত তওহীদের উদ্যোগে ‘আগ্রাসন থেকে মুসলমানদের রক্ষার উপায় তওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার (৪ জুলাই) সকাল ১০ টায় রাজধানীর ইন্সটিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে (আইডিইবি) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হেযবুত তওহীদ ঢাকা মহানগর।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২০০ কোটি। মোট ৫৭টি দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদেরও বিশাল ভাণ্ডার মুসলিমদের দখলে। এত বিশাল ভূখণ্ড, এত সংখ্যা ও এত ধন-সম্পদ থাকার পরও আমরা মুসলমানরাই এখন পৃথিবীর সবচাইতে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত গোলাম জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, আফগানিস্তানসহ একের পর এক মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।’
‘মাত্র ২ কোটি ইহুদির সামনে যেন অসহায় হয়ে পড়েছে ২০০ কোটি মুসলমান ও তাদের ৫৭টি রাষ্ট্র। গত দুই বছরে দখলদার ইসরায়েলিদের হামলায় অন্তত এক লক্ষ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি নারী ও শিশু। মিয়ানমারের মুসলমানরাও গণহত্যার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু।’
মুসলমানদের এই দুর্দশার কারণ হিসেবে মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘অখণ্ড মুসলিমরা আজ ৫৭ ভাগে বিভক্ত। ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতির মধ্যে আজ গড়ে উঠেছে শিয়া, সুন্নি, হানাফি হাম্বলি, মাজহাবী, লা-মাজহাবী ইত্যাদি হাজারও বিভাজনের দেয়াল। শত্রুর আঘাতে যদি একজন মুসলমান মারা যায়, তো নিজেরা মারামারি করে মারা যায় দুইজন। অথচ আল্লার নির্দেশ ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হওয়ার, সমগ্র মুসলিম ঐক্যবদ্ধ থাকার। -বলেন হেযবুত তওহীদের এই নেতা।
তিনি আরো বলেন, ২০০ কোটির মুসলমান জাতি আজ ২ কোটির ইহুদির হাতে মার খাচ্ছে। একটা দেশ ধ্বংস করে দিয়ে পরবর্তী আরেকটা দেশকে টার্গেট করা হচ্ছে। শিয়া-সুন্নী, ফেরকা-মাজহাব আর খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত মুসলিম বিশ্ব চেয়ে চেয়ে দেখছে। প্যারালাইজড মৃত প্রায় এই জাতিকে ঈমানের চেতনায় জাগতে হবে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নয়তো কেউ বাঁচবে না Ñহুশিয়ারি উচ্চারণ করেন হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম।
বাংলাদেশকে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, মিয়ানমার, ইরানে যা ঘটেছে বাংলাদেশেও তা ঘটানোর পাঁয়তারা বহুদিন যাবৎ চলছে। আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই মানচিত্রের উপর আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান সবারই লোলুপ দৃষ্টি। এখানে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারা সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়ে যাবে এবং নিজেদের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে পারবে। -মন্তব্য করেন তিনি।
উত্তরণের উপায় তুলে ধরে হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘দেশ রক্ষায় আমাদের প্রধান প্রস্তুতি হতে পারত জাতীয় ঐক্য। কিন্তু এই হানাহানির রাজনীতি আমাদের ঐক্যের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যেভাবে পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন। অর্থাৎ সীসাগলানো প্রাচীরের ন্যায় ঐক্য। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এক নেতার নেতৃত্বে। এই ঐক্যের ভিত্তি হবে তওহীদ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লার হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না’।
নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই সহস্রাধিক কর্মীর উপস্থিতিতে হলরুম পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সকাল ১০ টায় পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। তেলাওয়াত করেন হেযবুত তওহীদের সদস্য ক্বারি আসাদ আলী। নওশীন আমিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ঢাকা মহানগরীর আমির ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ।
দুপুর ১ টায় অনুষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। দুপুরে নামাজ ও লাঞ্চের পরে দ্বিতীয় অধিবেশনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। এরপর হেযবুত তওহীদের নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে একটি প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।
দ্বিতীয় অধিবেশনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের প্রধান উপদেষ্টা খাদিজা খাতুন, আন্তার্জাতিক প্রচার বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান, নারী বিষয়ক সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক উম্মুত তিজান মাখদুমা পন্নী, তথ্য সম্পাদক এস এম সামছুল হুদা প্রমুখ।
মুসলমানদের লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের কারণ বর্ণনা করে বিশেষ অতিথি রুফায়দাহ পন্নী বলেন, ইসলামের প্রকৃত আকিদা হলো সমগ্র মুসলিম জাতি হবে এক অখণ্ড সত্তা, জাতির নেতা (ইমাম) হবেন একজন। জাতি হুকুম মানবে তথা একমাত্র আনুগত্য করবে আল্লাহর। ঐক্যের এই চেতনা ও সূত্র হারিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠী যখন ভৌগোলিকভাবে ৫৭টি রাষ্ট্রে, রাজনৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী-ধর্মভিত্তিক ইত্যাদি বিভিন্ন দলে-উপদলে-মার্কায়, ধর্মীয়ভাবে শিয়া-সুন্নি, হানাফি-হাম্বলি, মাজহাবি-লা মাজহাবি ইত্যাদি ফেরকা-মাজহাবে ও আধ্যাত্মিকভাবে চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, কাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত হয়ে গেছে, তখনই এই জাতি সমস্ত শক্তি হারিয়ে একটি বিশৃঙ্খল, ঐক্যহীন, দুর্বল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। ফলে শত্রুরা খুব সহজেই সামরিক শক্তিবলে তাদেরকে পরাজিত করতে পারছে। আমরা যখন ব্রিটিশদের কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হই তখন তারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তাদের তৈরি একটি বিকৃত বিপরীতমুখী ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে। যার ফল এখন আমরা ভোগ করছি।
বক্তারা বলেন, পরিসংখ্যান মোতাবেক ইহুদিদের চাইতে আমরা মুসলিমরা সংখ্যায় ১০০ গুণ বেশি। কিন্তু ঐ ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হওয়ার পর আজ তারা ঐক্যবদ্ধ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। পক্ষান্তরে আমরা ঐক্যহীন, নেতৃত্বহীন, আদর্শহীন, সামরিক শক্তি, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি থেকে তাদের তুলনায় লক্ষ মাইল পিছিয়ে। সুতরাং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই ওরা বিজয়ী হচ্ছে, আমরা হচ্ছি পরাজিত। এটাকে আমরা আমাদের পরাজয়ের জাগতিক কারণ বলতে পারি। তবে এর বাইরে আরেকটি আধ্যাত্মিক কারণও আছে, যা এই জাতির কপালে পরাজয়ের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বক্তারা আরো বলেন, পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন- তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসুলের আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো তোমাদের উলিল আমরের। এখানে “উলিল আমর” হচ্ছেন জাতির আদেশদানের অধিকারী কর্তৃপক্ষ বা নেতা। এতদিন আমাদেরকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে ও আগামীতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে- তারা তো আল্লাহর বিধানই চায় না। তারা পশ্চিমা ব্যবস্থার প্রতিনিধি। সুতরাং তারা উলিল আমর হবার যোগ্য নয়। তাদের বাইরে এমন একজন নেতা আমাদের প্রয়োজন যিনি জাতিকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে ডাকবেন, আল্লাহর বিধানকে প্রতিষ্ঠা করবেন ও জাতিকে রক্ষার জন্য জেহাদে নেতৃত্বে দিবেন। তিনি হবেন মো’মেনদের জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় অঙ্গনের কর্তৃপক্ষ। আলহামদুলিল্লাহ আমরা হেযবুত তওহীদ সেই নেতা সেই উলিল আমর পেয়েছি। আমরা হাজার হাজার মো’মেন-মো’মেনা হেযবুত তওহীদের মাননীয় ইমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের হাতে বায়াত নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি যে আদেশ দিচ্ছেন আমরা তা শুনছি ও আনুগত্য করছি। তাঁর নেতৃত্বে তওহীদভিত্তিক জীবনব্যবস্থা অনুসরণের চর্চা আমরা ইতোমধ্যেই যথাসম্ভব শুরু করেছি এবং প্রচলিত বিকৃত ইসলাম থেকে আমরা হিজরত করেছি। পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর দীন মানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, কারণ রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত নেই। কিন্তু সেটাকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করার জন্য মাননীয় ইমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে আমরা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি।
অনুষ্ঠানে প্রায় দেড় শত মানুষ হেযবুত তওহীদের আদর্শের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। তারা হেযবুত তওহীদের এই আদর্শ ধারণ করে জাতির কাছে তা পৌঁছে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ক সম্পাদক হারিসুর রহমান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক সাইফুর রহমান, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আতিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির আলামিন সবুজ, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির
ফরিদ উদ্দিন রাব্বানি, কেন্দ্রীয় নারী বিভাগের সহ-সম্পাদক আয়েশা সিদ্দিকা প্রমুখ।