ওবায়দুল হক বাদল:
যারা ইসলামের ইতিহাস পড়েছেন তারা ভালোভাবেই জানেন- রসুল (সা.) ছিলেন এমন একজন যোদ্ধা নবী, যিনি মাত্র ১০ বছরে ৭৮টা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি আরব উপদ্বীপের সাড়ে বারো লক্ষ বর্গমাইল এলাকা বিজয় করেছিলেন। তিনি যে জাতিটা তৈরি করেছিলেন সেটাও ছিল দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা জাতি। যারা তৎকালীন পরাশক্তি (সুপার পাওয়ার) রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যকে একইসাথে আক্রমণ করে তুলার মতো উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক এলাকা বিজয় করেছিলেন।
ঐ জাতির সদস্যদেরকে যখন প্রশ্ন করা হতো- তোমরা কী চাও? তারা বলতেন- ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটুখানি খাবার, আর লজ্জা নিবারণের জন্য এক প্রস্ত কাপড় ছাড়া আমাদের আর কিছুই চাই না। আমরা তো বেঁচেই আছি আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করার জন্য। প্রশ্ন হলো- কেন? কেন রসুল (সা.) এরকম একটা দুর্ধর্ষ সামরিক জাতি সৃষ্টি করেছিলেন? কেন পবিত্র কোর’আনের শত শত আয়াত শুধু যুদ্ধ সংক্রান্ত? কেন রসুল (সা.) এর হাদিসগ্রন্থগুলোর বড় অংশজুড়ে থাকে শুধু যুদ্ধের হাদিস? কেন রসুল (সা.) এর সিরাতগ্রন্থের পাতায় পাতায় শোভা পায় শুধুই যুদ্ধের বিবরণ? কেন এই যুদ্ধ? পাঠক, আজকের লেখায় অতি সংক্ষেপে আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর জানার চেষ্টা করব যে- রসুল (সা.) কেন এমন একটা সামরিক জাতি সৃষ্টি করেছিলেন?
বর্তমানে আমাদের সমাজে যে ইসলামটা চলছে, মানে আমাদের মসজিদ মাদ্রাসা দরগা মাজার কিংবা ওয়াজ মাহফিলে যে ইসলামটা অনুশীলন করা হচ্ছে, এই ইসলামের মাধ্যমে মোটামুটি তিন ক্যাটাগরির মানুষ তৈরি হচ্ছে। যেমন মাদ্রাসার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছেন মুফতী মাওলানা, দরগা মাজার ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে পীরের মুরিদ, এবং ইসলামী দল বা ইসলামী রাজনীতির মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি ভোটার। কিন্তু রসুল (সা.) এর ইসলামের ইতিহাস দেখুন- ঐ ইসলাম থেকে মুফতী মাওলানাও তৈরি হত না, পীরের মুরিদও তৈরি হত না, এমনকি ইসলামী দলের ভোটারও তৈরি হত না। ঐ ইসলাম থেকে শুধু এবং শুধুমাত্র তৈরি হত যোদ্ধা বা সৈনিক। আপনি সাহাবীদের ইতিহাস পড়ুন। দেখতে পাবেন রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের প্রত্যেকের জীবন কেটেছে রণাঙ্গনে। নারী থেকে পুরুষ, যুবক থেকে বৃদ্ধ, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত রণাঙ্গনে ছুটে যেতেন রসুল (সা.) এর সঙ্গী হয়ে। এক কথায় পুরো উম্মাহটাই ছিল এক দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী। প্রশ্ন হলো, সেই সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য কী ছিল?
রসুল (সাঃ) এর বাহিনীর উদ্দেশ্য কী ছিল
যারা ইসলামের শত্রু, ইসলামের কোনোকিছুই যাদের ভালো লাগে না, তারা বলে থাকেন- রসুল (সা.) নাকি পররাজ্য দখলের জন্য ও পরসম্পদ লুট করার জন্য এই দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
যদিও ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। পরসম্পদ লুট করার জন্যই যদি রসুল (সা.) সাহাবীদের নিয়ে এই সামরিক জাতি তৈরি করতেন, তাহলে তিনি যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন তার বিশাল বড় একটা রাজপ্রাসাদ থাকার কথা, এবং প্রাসাদভর্তি রাশি রাশি ধন-ভান্ডার থাকার কথা ছিল। অথচ রসুল (সা.) এর ইন্তেকালের পর তাঁর ছোট্ট কুটিরঘর থেকে কী কী সম্পদ পাওয়া গিয়েছিল খেয়াল করুন- একটি চাটাই, খেজুরের ছাল দিয়ে ভর্তি একটি বালিশ, কয়েকটি মশক, ৯টি তরবারী, ৫টি বর্শা, একটি তীরকোষ, ছয়টি ধনুক, সাতটি লৌহবর্ম, তিনটি যুদ্ধের জোব্বা, একটি কোমরবন্ধ, একটি ঢাল এবং তিনটি পতাকা। (সূত্র: সিরাতুন্নবী- মাওলানা শিবলী নোমানী) আর এ থেকেই প্রমাণিত হয় পার্থিব ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য তাঁর এই সংগ্রাম ছিল না।
আবার দেখুন রসুল (সা.) এর মেয়ের জামাতা ও অন্যতম সাহাবী আলী (রা.) এর সম্পদের তালিকা। তিনি যখন রসুলের কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, তখন রসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন- “হে আলী, তোমার কাছে কী আছে? বিয়েতে কিছু খরচ হবে তো।” আলী (রা.) বললেন- “ইয়া রসুলাল্লাহ, তেমন কিছুই তো নেই, থাকার মধ্যে আছে শুধু একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার ও একটি লোহার বর্ম।” তখন আল্লাহর রসুল আলী (রা.) কে লোহার বর্মটি বিক্রি করে বিয়েতে খরচ করতে বললেন। তবে তরবারি বিক্রি করতে বললেন না, কারণ তরবারি বিক্রি করলে আলী (রা.) আর যুদ্ধ করতে পারতেন না কিন্তু বর্ম ছাড়াও যুদ্ধ করা যায়।
বন্ধুরা খেয়াল করুন- আলী (রা.) কে ছিলেন? তিনি ছিলেন রসুল (সা.) এর অন্যতম সেনা কমান্ডার। তারই ব্যক্তিগত সম্পত্তির যদি এই দশা হয়, তাহলে অন্যদের কী অবস্থা ছিল তা বুঝতে আর বাকি থাকে কী? তার মানে শুধু রসুলই (সা.) নয়, তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরও পার্থিব সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। শুধুই ছিল যুদ্ধের উপকরণ।
পাঠক! এ কেমন যুদ্ধ! তারা একের পর এক যুদ্ধ করছেন, লক্ষ লক্ষ মাইল এলাকা বিজয় করছেন, শাসন করছেন, কিন্তু কোনো সম্পদ লুণ্ঠন করছেন না, অন্যদের মতো সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যও হাসিল করছেন না। তাহলে কীসের লক্ষ্যে এই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনে পড়ে থাকা?
কী সেই হারিয়ে যাওয়া লক্ষ্য?
আসলে তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই- সারা পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠা। আর এই লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন আর কেউ নন- স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিন। পবিত্র কোর’আনের তিনটি আয়াত- তওবা ৩৩, ফাতাহ ২৮ ও সফ ৯। এই তিন আয়াতেই আল্লাহ একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন এবং বলেছেন- ‘আমি রসুলকে হেদায়াহ ও সত্যদ্বীন দিয়ে এই জন্য প্রেরণ করেছি যাতে তিনি অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর আল্লাহর দেওয়া দ্বীনকে জয়যুক্ত করতে পারেন।’ পাঠক- এই আয়াতটি পবিত্র কোর’আনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়াত কেননা এখানেই আল্লাহ তাঁর রসুলের মিশন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তাহলো- সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্য সকল জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেমকে পরাজিত করে আল্লাহর দেওয়া সিস্টেম বা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করলে কী হবে? পৃথিবী থেকে সকল ফেতনা-ফাসাদ নির্মূল হয়ে যাবে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বন্ধ হবে, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা বন্ধ হবে, শাসিতের উপর শাসকের জুলুম বন্ধ হবে, সরলের উপর ধূর্তের প্রতারণা বন্ধ হবে।
একবার কল্পনা করুন তো। সারা পৃথিবীর মানুষ সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেছে। সকল অন্যায় অবিচার নির্মূল হয়ে গেছে। একজন নেতার নেতৃত্বে পুরো মানবজাতি আল্লাহর হুকুম বিধান মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে এবং শান্তিতে বসবাস করছে। বিষয়টা কল্পনা করাও কত কঠিন- তাই না? অথচ আপনি যা কল্পনাও করতে পারছেন না, সেটাই বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ছিল আল্লাহর রসুলের। আল্লাহর রসুল ভালোভাবেই জানতেন- এই মিশন এক বৈপ্লবিক মিশন। সারা পৃথিবীতে আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যাবতীয় অন্যায় অবিচার নির্মূল করতে হলে অবশ্যই সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রশক্তি অর্জন করতে হবে, আর রাষ্ট্রশক্তি কেউই স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয় না, দিবেও না। ওটা জান দিয়ে মাল দিয়ে লড়াই করেই অর্জন করতে হয়। আর সেজন্যই আল্লাহর রসুলের প্রয়োজন পড়েছিল দুর্ধর্ষ একটি সামরিক জাতির। যাদের নারীরাও হবে যোদ্ধা, পুরুষরাও হবে যোদ্ধা। যাদের কোনো মৃত্যুভয় থাকবে না, বরং রণাঙ্গনে জীবন দেওয়াকেই যারা জীবনের সফলতা জ্ঞান করবে। মূলত এরকম এক দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যা যা করার দরকার, রসুল (সা.) তাই করেছেন পুরো নবুয়্যতি জীবনজুড়ে। তিনি সাহাবীদের নিয়ে একসাথে সালাহ কায়েম করেছেন, সেটারও লক্ষ্য ছিল সামরিক। তিনি সওম করেছেন, হজ্ব করেছেন, যাকাত আদায় করেছেন, কুরআন তেলাওয়াত করেছেন, এক কথায় যা কিছু করেছেন, সবকিছুই ছিল যুদ্ধমুখী (ব্যাটেল ওরিয়েন্টেড)। যদি পাণ্ডিত্য দিয়ে বিজয় অর্জন সম্ভব হতো, তাহলে হয়ত আল্লাহর রসুল সামরিক বাহিনী গঠন না করে বরং মাদ্রাসা স্থাপন করতেন এবং সেখান থেকে মুফতী মাওলানা তৈরির কাজে মনোনিবেশ করতেন। যদি লক্ষ লক্ষ মুরিদ দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতো তাহলে হয়ত আল্লাহর রসুল আরব উপদ্বীপ জুড়ে হাজার হাজার দরগাহ তৈরি করতেন, খানকাহ তৈরি করতেন, আর তাতে আধ্যাত্মিক ছবক দিয়ে লক্ষ লক্ষ মুরিদের দল তৈরি করতেন। কিন্তু আল্লাহর রসুল ওসবের একটাও করেননি। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, নেতৃত্ব দিয়ে, এক দুর্ধর্ষ নির্ভিক সামরিক জাতি হিসেবে তৈরি করেছেন, যেই জাতির প্রত্যেকটা সদস্য ছিল যোদ্ধা। যাদের মধ্যে একজনকেও হয়ত খুজে পাওয়া যেত না যার গায়ে অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল না। যাদের প্রায় ৯০%ই লিখতে ও পড়তেই জানতেন না, কিন্তু জানতেন কীভাবে লড়াই করে শত্রুকে পরাজিত করতে হয়। সেই সামরিক জাতিকে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে নির্দেশ দিয়ে বললেন- ‘কিতাল চালিয়ে যাও যতক্ষণ না ফেতনা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায় (আনফাল: ৩৯)।’ আরও বললেন- ‘তোমাদের কি হল যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য, যারা বলে, হে আমাদের রব! এ জনপদ-যার অধিবাসী যালিম, তা-থেকে আমাদেরকে বের করুন; আর আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কাউকে অভিভাবক করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করুন।’ (নিসা: ৭৫)
কাজেই রসুলের হাতে গড়া সেই উম্মতে মোহাম্মদী জাতি ভালোভাবেই জানতেন এই সংগ্রামের মধ্যেই রয়েছে তাদের সাফল্য ও সার্থকতা। কোনো স্বার্থের লোভে নয়, কোনো ক্ষমতার লোভে নয়, কোনো অর্থের লোভে নয়, কারো প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে নয়, তাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে শুধুই আল্লাহর জন্য, পৃথিবী থেকে ফেতনা নির্মূলের জন্য ও মজলুমদেরকে উদ্ধার করার জন্য। যতদিন পুরো পৃথিবী ন্যায়, শান্তি ও সুবিচারে পরিপূর্ণ না হবে, ততদিন তাদের এই সংগ্রাম বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। সেটা করলে তারা আর মুহাম্মদের জাতি বা উম্মতে মোহাম্মদী থাকতে পারবে না।
পাঠক! সাহাবীরা রসুল (সাঃ) এর মিশন বাস্তবায়নের জন্য জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করেছেন বলেই অর্ধপৃথিবীতে আল্লাহর হুকুম বিধান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং সেই বিশাল এলাকায় বসবাসকারী মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ অকল্পনীয় ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার পেয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন কী করছি?
বর্তমানে সেই সামরিক জাতি কোথায়?
পাঠক, বর্তমানে সেই সামরিক জাতির অস্তিত্ব আর নেই। সাহাবীরা পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর এই উম্মাহ দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বন্ধ করে দেয়। ফলে সেই সামরিক জাতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। কীভাবে এতবড় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলো সেই বিস্তারিত আলোচনায় আজ যাচ্ছি না, তবে সেটার ফল কী হলো সেটা সংক্ষেপে বলছি। রসুল (সা.) ও সাহাবীগণ একে একে পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর যখন দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বন্ধ করে দেয়া হলো, অর্থাৎ উম্মাহর আসল কাজটাই যখন বাদ দেওয়া হলো, তখন আর তারা কী করবে? তলোয়ার ফেলে দিয়ে এই উম্মাহর একদল খাতা-কলম নিয়ে কুরআন হাদিসের চুলচেরা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কাজে লেগে পড়লেন, আরেকদল তলোয়ার ফেলে দিয়ে তসবিহ নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করলেন। প্রাকৃতিক সূত্র মোতাবেক এর পরিণতিও সামনে এসে দাঁড়ালো। কুরআন হাদিস নিয়ে ফকিহ, মুফাসসির ও মোহাদ্দিসদের চুলচেরা বিশ্লেষণের ফলে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ তৈরি হতে লাগলো, ফলে জাতির ঐক্য ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল, আর সেই টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া অংশগুলোও যাতে কোনোদিন সংগ্রামের পথে ফেরত যেতে না পারে সেজন্য সুফি দরবেশরা তাদেরকে বোঝালেন আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদই হলো বড় জেহাদ। ব্যাস! দ্বীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ ছেড়ে দিয়ে, ঐক্য নষ্ট করে, এই উম্মাহর সদস্যরা মসজিদে, মাদ্রাসায় ও খানকায় বসে যখন তসবিহ জপায় (তথাকথিত বড় জিহাদ) ব্যস্ত, ঠিক তখন অন্যান্য জাতিগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে ও জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে, সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে এদেরকে দখল করে নিলো। এই জাতি একের পর এক শত্রুর আক্রমণে পরাজিত হতে লাগলো, কিন্তু তখনও সেই পরাজিত জনগোষ্ঠীর সুফি দরবেশরা খানকায় বসে আত্মার বিরুদ্ধে নিরাপদ জেহাদ চালাতে থাকলেন এবং আলেমরা মাদ্রাসায় বসে বাহাস-মুনাজারা চালাতে থাকলেন। গত ১৩০০ বছর ধরে এভাবে চলার পর, আজকের চূড়ান্ত পরিণতি হলো এই যে- আমরা এখন ফুটবলের মতো সারা পৃথিবীতে অন্যান্য জাতিগুলোর লাথি খাচ্ছি, অপমানিত হচ্ছি, গণহত্যার শিকার হচ্ছি, আমাদের শিশুরা বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে, নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, আমাদের দেশগুলো একটার পর একটা মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। একটা ভূখণ্ড রক্ষার সামর্থও আমাদের নাই। যে মানবরচিত দ্বীনকে পরাজিত করে আল্লাহর দেওয়া দ্বীনকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল, সেই মানবরচিত ব্যবস্থা দিয়েই এখন পরিচালিত হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো। আর ব্যক্তিগতভাবে মাথায় টুপি পরে, থুতনিতে কিছু দাড়ি রেখেই আমরা পাক্কা উম্মতে মোহাম্মদী হয়ে যাবার স্বপ্ন দেখছি।
কিন্তু না পাঠক, যতদিন আমরা একজন নেতার পেছনে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুনরায় রসুল (সা.) এর দেয়া মিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ না হবো, ততদিন আর যাই হোক রসুল (সা.) আমাদেরকে তাঁর উম্মত বলে গ্রহণ করবেন না। মনে রাখতে হবে- রসুল (সা.) এর লক্ষ্য অর্জনে যারা সংগ্রাম করবে, একমাত্র তারাই নিজেদেরকে রসুলের উম্মত বলে দাবি করতে পারবে। কেয়ামতের দিন রসুল (সা.) একমাত্র তাদেরকেই তাঁর উম্মত বলে গ্রহণ করবেন। আর আমাদের মতো পাক্কা নামাজী, পাক্কা হাজিসাহেব, ইসলামী দলের ভোটার ও কামেল পীরের মুরিদদেরকে হয়ত বলবেন- আমি আমার সারাজীবন যেই সংগ্রামে ব্যয় করলাম, আমার সাহাবীগণ যে সংগ্রামে তাদের ঘরবাড়ি স্ত্রী পুত্র পরিজন সবকিছু উৎসর্গ করলো, সেই সংগ্রামটাই যখন তোমরা বাদ দিয়েছো, তারপর আর রইলো কী? সুতরাং আমার সুন্নাহ যারা বাদ দিয়েছো, তোমরা আমার কেউ নয়, আমিও তোমাদের কেউ নই।