কাজী আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ:
হেযবুত তওহীদের একজন শুভাকাক্সক্ষীর দাওয়াতে এবারের ঈদের জামাত পালনের সুযোগ হয়েছে ঢাকা মহানগর হেযবুত তওহীদের আয়োজনে ব্যতিক্রমধর্মী ঈদগাহ ময়দানে। সেই অভিজ্ঞতাই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
দিনটি ছিল ঈদের দিন, ভোর সাড়ে চারচায় ঘুম ভেঙে যায়। সকালে উঠেই ঈদের জামাতে যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে নিলাম। ছিলাম বাসবোতে, সেখান থেকে গন্তব্য উত্তরা। পৌঁছালাম সকাল সাড়ে ছয়টায়।
ঈদগাহ ময়দান সবসময়ই কিছুটা সাজানো-গোছানো থাকে, তবে এই মাঠে এসে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল তা হলো শৃঙ্খলা ও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্তরিক উপস্থিতি। নারী, পুরুষ, শিশু সকলেই শান্তভাবে আলাদা আলাদা লাইনে ঈদগাহে প্রবেশ করছে। লাইনে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা তল্লাশির সময় দেখলাম, একজন শৃঙ্খলা কর্মী খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনার ব্যাগে কী আছে জানতে পারি?” আমি ব্যাগ খুলে দেখালাম, এক আত্মীয়ের জন্য উপহার ছিল। তিনি মুচকি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, যান।” নিরাপত্তা বজায় থাকল সেই সাথে তাদের আন্তরিক ব্যবহার। নিরাপত্তার নামে কোনো কর্কশ ব্যবহার চোখে পড়ল না।
ময়দানের ভেতরে প্রবেশ করেও লাইন ভঙ্গ হলো না। একটু এগিয়ে যেতেই একজন উঠতি বয়সি যুবক বলল, “আঙ্কেল, জুতোজোড়া এখানে রেখে ভেতরে প্রবেশ করুন।” তাকিয়ে দেখলাম, সুশৃঙ্খলভাবে তারা মুসল্লিদের জুতোগুলো মাঠের এক কোণে সাজিয়ে রাখছে। মনে হলো, জীবনে এই প্রথম ঈদগাহ ময়দানে জুতা বাইরে রেখে গেলাম। কিন্তু মনে জুতা চুরির এতটুকু ভয় জাগ্রত হলো না।
ঢাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে যখন-তখন বৃষ্টি হচ্ছে। ঈদের দিনও বৃষ্টির আশঙ্কা ছিল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কর্তৃপক্ষ পুরো ঈদগাহ ময়দানজুড়ে ত্রিপলযুক্ত প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করেছেন। ভেতরে প্রবেশের সময় চোখ আটকে গেল- হাজার হাজার মহিলা মুসল্লিকে দেখে। প্যান্ডেলের ভেতরে আলাদা করে একটি বিরাট অংশ হাঁটু সমান উচ্চতায় ঘেরা হয়েছে, যেন মহিলারা ইমামকে দূর থেকে দেখতে পারেন এবং খুতবা শুনতে পারেন। পুরুষদের পেছনেই মহিলাদের বসার স্থান। কিন্তু মাঝখানে কোনো পর্দা ছিল না। শালীন পোশাকে সম্ভবত হাজার খানেক মহিলা মুসল্লির উপস্থিতি সত্যিই চোখে পড়ার মতো। কিন্তু মহিলাদের প্রতি পুরুষ মুসল্লিদের বিশেষ কোনো আগ্রহ, ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকানো বা অসদাচরণের দৃশ্য চোখে পড়ে নি।
সূর্যের আলো ফোটার পর থেকেই একটু ভ্যাপসা গরম লাগছিল। প্যান্ডেলের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় ফ্যান বসানো থাকলেও মুসল্লিদের শরীরের গরম যুক্ত হয়ে পরিবেশটাকে আরেকটু গরম করে তুলেছিল। কিন্তু ফ্যানের বাতাসের প্রত্যাশায় কাউকেই বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ফ্যানের কাছে বসার জন্য ব্যতিব্যস্ত হতে দেখলাম না। বরং সবাই এক একটি কাতার শেষ হলে অন্য আরেকটি নতুন কাতার তৈরি করে সুশৃঙ্খলভাবে বসছিলেন।
অধিকাংশ মুসল্লিই জায়নামাজ আনেননি। কিন্তু মাটিতে বিছানো ত্রিপলেও কোনো ধূলাবালি ছিল না। আমি একটি কাতারের ডান কর্ণারে গিয়ে বসলাম। বসার সময় মনে হলো- আমার পা ভাঙা নিচে বসে থাকতে কষ্ট হবে। তাই আশপাশে তাকিয়ে একজন শৃঙ্খলা কর্মীকে বললাম, “ভাইজান, আমার পায়ে একটু সমস্যা, একটা চেয়ারের ব্যবস্থা করা যায় কি?” তিনি মুচকি হেসে বললেন, “একটু অপেক্ষা করুন, আমি ব্যবস্থা করছি।” কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে একটি সাদা পরিষ্কার চেয়ার দেওয়া হলো। আমি এক কর্নারে বসে ইমাম সাহেবের কথা শুনতে থাকলাম। আরও কয়েকজন আমার সামনে বা পেছনে চেয়ারে বসা ছিলেন আর সকলের চেয়ার একেবারে ডান দিকের কর্নারে শৃঙ্খলা অনুযায়ী সেট করে দেওয়া হয়েছে। যেন পেছনের মুসুল্লীদের ইমাম সাহেবকে দেখতে অসুবিধা না হয়।
আলোচনা শুনতে শুনতে খেয়াল করলাম, আগত শিশুরা প্যান্ডেলের মধ্যেই দৌড়াদৌড়ি করছে। কিন্তু কোনো শৃঙ্খলা কর্মীই তাদের থামানোর চেষ্টা করছেন না। আবার শিশুরা এমনভাবে দৌড়াদৌড়ি করছিল কিন্তু কেউ তাতে বিরক্ত বোধ করছে না। বিষয়টা আমার কাছে ভালোই লাগলো। ঈদের দিন শিশুরা ঈদগাহ ময়দানে আনন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণ পর ইমাম সাহেব সকলকে ঈদের সালাহ পড়ার নিয়মগুলো খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন। এরপর তিনি সকলকে লাইন সোজা করতে বললেন। এখানে তিনি তিনটি বিষয় গুরুত্ব দিলেন- ধনুকের ছিলার মত কাতার সোজা করা, দু’জন মুসল্লির ডান-বামের গ্যাপ যেন সমান থাকে এবং সকলের উঠবস যেন একসাথে হয়।
সবাই ইমাম সাহেবের কথা ভালোভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্য আয়ত্ব করে সুশৃঙ্খলভাবে নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন। সালাহ শুরু হলো এবং ছয় তাকবির মেনে শেষ হলো। ঈমাম সাহেবের কোনো ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম না। একটা আলাদা প্রশান্তি অনুভব করলাম। সালাম ফেরানোর পর কেউ তাড়াহুড়ো করে উঠে যায় নি বরং মোনাজাতের অপেক্ষায় যে যেখানে সালাহ আদায় করেছে সেখানেই শৃঙ্খলার সাথে বসে আছে। সুশৃঙ্খলভাবে বসা মুসল্লিদের দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সর্বত্র একটা শৃঙ্খলা, একটা স্থিরতা যেন ছেয়ে আছে।
সালাহর শুরুতে বাংলা খুতবা ও শেষে আরবি খুতবা হলো। আরবি খুতবা শেষে ঢাকা মহানগর হেযবুত তওহীদের সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ বললেন- “আমরা যার পেছনে এতক্ষণ ঈদের সালাহ আদায় করলাম, তিনি এর বিনিময়ে কোনো অর্থ গ্রহণ করেন নি। আলহামদুলিল্লাহ।” বস্তুত: হেযবুত তওহীদের কোনো ইমামই দীনের কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করেন না। এটা আমি অতীতে শুনেছি আজ বাস্তবে দেখলাম। তখন আমার মনে হলো আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন- “অনুসরণ করো তাদের যারা তোমাদের কাছে বিনিময় প্রত্যাশা করে না এবং হেদায়াতে আছে।” (সুরা আল ইমরান, আয়াত ২১)
মোনাজাত শেষ করার পর বাহিরে এসে এক গভীর আনন্দঘন পরিবেশ দেখতে পেলাম। হেযবুত তওহীদের সকল সদস্য-সদস্যারা একে অপরের সাথে আলিঙ্গণ করছে, ‘ঈদ মোবারক’ বলে কোলাকুলি করছে। যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। বাহিরে এসে আমার জুতাজোড়াও যথাস্থানে খুঁজে পেলাম। এত হাজার হাজার মুসুল্লী ভেতরে প্রবেশ করেছে কিন্তু কারও কিছু হারায় নি। এটা আমাকে গভীরভাবে চমকপ্রদ করেছে।
মাঠের পাশেই ছিল সারি সারি টেবিলের ওপর সাজানো বিভিন্ন রকম পসরা। কিন্তু সেখানেও ছিলনা ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা। বাচ্চাদের খেলনা, বাহারি রকম খাবার, আসবাবপত্র নিয়ে সাজানো এসব স্টল। পরিশেষে অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে দিয়ে প্রস্থান করি সেখান থেকে।
সেখানে এমন উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে ঈদের সালাহ আদায় করতে পারবো কখনো ভাবি নি। তাদের অপরিসীম শৃঙ্খলা ও নারী-পুরুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাতে গিয়ে কখন ভুলে গেলাম বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয় ‘বাঙ্গালীরা জাতে বিশৃঙ্খল’ তা একেবারে মিথ্যা। এই জাতিকে দিয়েই সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব। হয়তো সেই প্রচেষ্টাই করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ।
কাজী আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ
বাসাবো, ঢাকা।