হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইসলাম যেভাবে বদলে দিয়েছিল আরবদের

মোখলেছুর রহমান সুমন:
চব্বিশের গণঅভ্যূত্থানে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলো, তখন আমরা আশা করেছিলাম এবার জনজীবনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, বিভিন্ন অঙ্গনে ইতিবাচক আমূল পরিবর্তন আসবে। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির এমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যা দেখে দেশের মানুষ আগামী দিনে ভালো কিছু পাওয়ার আশা করতে পারে। বরং এই ১০ মাসের ঘটনাপ্রবাহে মানুষ হতাশ হয়েছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে। এক বছর আগে যে ছাত্রনেতারা তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন, যাদের ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হতো, তারা এখন জনপ্রিয়তার তলানিতে নেমে গেছেন। যে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল, এখন তাদের প্রতি অধিকাংশ দল হতাশ ও বিক্ষুব্ধ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার ও আমূল পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত ছিল, তাকে এখন অনেকেই ‘সময়ক্ষেপণের বাহানা’ মনে করছেন। বাস্তবে চেয়ার, পদ-পদবি ও ব্যক্তি পরিবর্তন ছাড়া আপামর মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র আশাও এখন আর মানুষ করে না বা করতে পারছে না। মব সৃষ্টি করে সন্ত্রাস, মানুষের বাড়ি-ঘরে হামলা, বিনা বিচারে মানুষকে পিটিয়ে থেঁতলে দিয়ে তারপর পুলিশে সোপর্দ করা, বদলি বাণিজ্য, সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের পিএস-এপিএসদের অবিশ্বাস্য দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, দেশের স্বাধীনতা-নিরাপত্তা নিয়ে সৃষ্ট ঝুঁকি, দাবি আদায়ের নামে বিশৃঙ্খলা, জনজীবনে ভোগান্তি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম বিরোধ, বিস্তর কাদা ছোড়াছুড়ি সব মিলিয়ে ‘যে লাউ সেই কদু’ অবস্থা।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এই যে এত প্রত্যাশা, তা কী উবে যাবে? মানুষ যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই পড়ে থাকবে?
আমাদের এত সব সমস্যার সমাধানের কথা উঠলেই বলা হয় এ দেশে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। এই দেশে ভোটের অধিকার নেই, মানুষকে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। টকশোতে বসে বক্তারা যখন কথা বলেন, মনে হয়, সব কিছুর সমাধান ওই ভোটবাক্সে বন্দি। এ যেন সেই আলাদিনের চেরাগ, যেখানে ঘষে দিলেই এক দৈত্য বেরিয়ে আসবে আর বলবে, হুকুম করুন মালিক! কিন্তু আসলে কি তাই? এ দেশে কি কখনো অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি? এ দেশে কি ক্ষমতার পালাবদল ঘটেনি?

অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংস্কারের কথা বলে আসছেন। সংস্কার কি এ দেশে ইতিপূর্বে কম হয়েছে? শুধুমাত্র সংবিধানেই সংশোধনী করা হয়েছে ১৭ বার।

আমরা হেযবুত তওহীদ বলছি, ভোটের বাক্সে বা সংস্কারে, কোনোকিছুতেই সমাধান আসবে না। আমরা বলছি, গণতন্ত্র এ দেশের মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি। সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো তন্ত্রমন্ত্র পারবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেবল একটি জায়গায় সকল সমস্যার সমাধানের নিশ্চয়তা আছে। সেটি হলো, আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থাকে কার্যকর করা।

আমরা বলছি, স্রষ্টার দেওয়া শাশ্বত, চিরন্তন, নিখুঁত ও নির্ভুল ব্যবস্থাই পারে মানব সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিতে। আজকের আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, আমিরতন্ত্রসহ যত ব্যবস্থা আছে, তার প্রত্যেকটি যেখানে ব্যর্থ প্রমাণিত, সেখানে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা ইসলাম কতটা সফল ছিল, তার কিছু প্রমাণ আজ আমরা তুলে ধরবো। সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার পর একটি সফল জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের আবেদন কতটুকু, তা মূল্যায়নের দায়িত্ব পাঠকের।

জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা:
ইসলাম আবির্ভাবের আগে আরব সমাজের অবস্থা কতটা বাজে ছিল তা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। সময়টাকে ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াহ’ তথা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তখনকার একটা বড় সমস্যা ছিল এই যে, আরবের মানুষেরা গোত্রে গোত্রে বিভক্ত ছিল, আর গোত্রগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ও রক্তপাতে ডুবে ছিল। আজকে আমরা যেমন রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দলে, আদর্শিকভাবে নানা মতে, ধর্মীয়ভাবে বিভিন্ন ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত এবং এই হাজারটা বিভক্তি নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত, ইসলামপূর্ব আরবেও ঠিক একই অবস্থা ছিল। তাদের গোত্রীয় বিভক্তি এতটাই প্রকট ছিল যে, এক গোত্র অন্য কোনো গোত্রের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা অব্যাহত থাকতো। এক পুরুষ রক্তের বদলা নিতে ব্যর্থ হলে পরের প্রজন্ম সেই বদলা নিতো। কিন্তু ইসলাম এসে সেই দৃশ্য বদলে দিলো। সব ধরনের বিভাজন-বিভক্তি দূর করে আরবদের একটি পরিচয় দাঁড় করালো, আমরা সবাই আল্লাহর সৃষ্টি, আমরা সবাই মানুষ, আমরা ভাই-ভাই। আল্লাহর তওহীদ, লা ইলাহা ইল্লাহ (আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম-বিধান মানি না), এই একটি কথার ওপর তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। একটি ঐক্যহীন বিভক্ত জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠলো ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী মহাজাতি। আমরা বিশ্বাস করি, আজও সমস্ত দলীয়, আদর্শিক বা ফেরকাগত বিভক্তি দূর করা সম্ভব, যদি আমরা ওই একটি কথার ওপর ঐক্যবদ্ধ হই- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না। এর বাইরে দ্বিতীয় কোনো সূত্র দিয়ে আমাদের বর্তমান বিভক্ত জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না।

ক্ষুধা-দারিদ্র্য নির্মূল করে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা:
আরবরা ছিল এক ক্ষুধার্ত জাতি। তাদের চেহারা আর পোশাকে মিশে ছিল ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের ছাপ। কিন্তু যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলো, আল্লাহর দেয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু হলো, তখন আরবদের অর্থনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন চলে এলো। ইসলাম সুদকে হারাম করলো। অন্যদিকে গরীবের হক আদায় করার ব্যাপারে ধনীদেরকে উৎসাহিত করলো। দান-সাদাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করলো। যাকাতকে ফরজ করে দিলো। বেশি নয়, মাত্র এক দশকের মতো এই ব্যবস্থাটি চর্চা (ঢ়ৎধপঃরপব) করার পর দেখা গেল মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়ে গেল। দেখা গেলো, সামর্থ্যবান লোকেরা যাকাতের মাল নিয়ে গরীর মানুষের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু সেই যাকাত গ্রহণ করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা আমাদের মুখের দাবি নয়, বরং ঐতিহাসিক সত্য। ইসলাম মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে যে ভারসাম্য সৃষ্টি করেছিল, ইতিহাসের আরো কোনো তন্ত্র-মন্ত্র সেই নজির স্থাপন করতে পারে নি।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা:
ইসলামী শাসনব্যবস্থায় কতটুকু সুশাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের (রা.) শাসনামলে মিশরের গভর্নর ছিলেন আমর ইবনুল আস (রা.)। একদিন মিশর থেকে সেখানকার একজন অমুসলিম ব্যক্তি মদীনায় এসে খলিফার কাছে নালিশ করলেন, আমর ইবনুল আসের (রা.) এক পুত্র তার প্রতি অন্যায় করেছে। বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরে লোকটি খলিফার কাছে এর বিচার চাইলেন। তৎক্ষণাৎ মিশর থেকে আমর ইবনুল আস (রা.) ও তার পুত্রকে মদীনায় তলব করা হলো। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলো এবং আমর ইবনুল আসের (রা.) পুত্রের শাস্তি ঘোষণা হয়ে গেল। শাস্তি হিসেবে ওই অমুসলিম মিশরীয় লোকটি নিজ হাতে আমরের (রা.) পুত্রকে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করলেন। লোকটি ন্যায়বিচার পেলেন এবং সন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু খলিফা উমর (রা.) সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। উপস্থিত সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, এবার আমর ইবনুল আসকে পেটাও। মিশরীয় লোকটি বিস্মিত হয়ে বললেন, তার তো কোনো অপরাধ নেই, তাকে কেন মারবো? খলিফা ওমর (রা.) বললেন, তারও অপরাধ আছে। প্রথম অপরাধ এই যে, তার ক্ষমতার কারণেই তার পুত্র তোমার প্রতি এই অন্যায় করার সাহস দেখিয়েছে। আর দ্বিতীয় অপরাধ এই যে, তুমি তার কাছে এর বিচার চাইতে সাহস পাও নি, বিচার পেতে তোমাকে মিশর থেকে মদীনায় আসতে হয়েছে। তার মানে সে তার অধীনস্থ লোকদের ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ। মিশরীয় লোকটি বিনয়ের সাথে বলেন, মহামান্য খলিফা, আমি আমার বিচার পেয়ে গেছি, আর কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়।

রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের শাসনামলে ইসলাম কতটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার এরকম উদাহরণ যদি দেয়া হয়, তাহলে এরকম একটি প্রবন্ধ নয়, হাজার পৃষ্ঠার বই লিখেও তা শেষ করা যাবে না। আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়। বরং এই একটি ঘটনা থেকেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ইসলাম কতটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ইসলাম ছিল সর্বোচ্চ সতর্ক। ‘ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে থাকে, আমি ওমর তার জন্য আল্লাহর দরবারে দায়ী থাকবো’, খলিফা ওমরের এই উক্তি আজও ইতিহাস হয়ে আছে। বৃদ্ধ বয়সে তিনি ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য নিজের পিঠে করে আটার বস্তা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই হৃদয়স্পর্শী গল্প শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। শুনতে মনে হয় যেন রূপকথার গল্প, অথচ প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য। বাস্তবেই ইসলাম যে ন্যায়বিচার ও সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, অন্য যে কোনো জীবনব্যবস্থার কাছে তা রূপকথার গল্পই বটে।

সামরিক শক্তিতে আমূল পরিবর্তন:
সামরিক শক্তির কথা যদি বলা হয়, তাহলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে আরবরা সামরিকভাবে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল জাতিগুলোর একটি ছিল। সমসাময়িক বিশ্বের দুই পরাশক্তির নাম ছির পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য। ভুখা-নাঙ্গা আরবরা তাদের দিকে চোখ তুলে কথা বলারও সাহস পেত না। কিন্তু ইসলাম আবির্ভাবের পর আরবরা সামরিক শক্তিতে কতটা র্দুর্ধষ হয়ে ওঠেছিল তা ইতিহাস। আলী (রা.), খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.), কাকা, দেরার এর মতো ইতিহাসের অপরাজেয় সামরিক কমান্ডারদের জন্ম দিয়েছিল ইসলাম। এর ফলাফল হয়েছিল এই, যে রোমান ও পারস্যের ভয়ে আরবরা তটস্থ থাকতো, সেই দুই পরাশক্তিকে পরাজিত করেই তারা মাত্র এক দশকের ব্যবধানে অর্ধপৃথিবীতে ইসলামী খেলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। কোনো সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভ নয়, কোনো পার্থিব লাভ-লোকসানের হিসাব নয়, কেবল একটি আদর্শ, একটি চেতনা কিভাবে একটি দুর্বল ভীতু জাতিকে অপরাজেয় দুর্ধর্ষ জাতিতে রূপান্তিরিত করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত কেবল ইসলাম।

শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসরতা:
রসুল (সা.) এর অগণিত সাহাবীদের মধ্যে মাত্র ৪০ জন পড়াশোনা জানতেন। এই পরিসংখ্যান থেকেই আন্দাজ করা যায় তৎকালীন আরবরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানার্জন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদি ব্যাপারে কতটা পিছিয়ে ছিল। তৎকালীন সভ্য জাতিগুলো তাদেরকে অভিহিত করতো ‘মরুবাসী বর্বর আরব’ হিসেবে।  কিন্তু ইসলাম এসে সেই মূর্খ-বর্বর আরবদেরকে কোথায় নিয়ে গেল? মধ্যযুগে ইউরোপ যখন অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, তখন মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ওঠে বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের বাতিঘর। আপনাকে খুব কষ্ট করতে হবে না, গুগল বা ইউকিপিডিয়ায় ‘মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বের বিজ্ঞানীদের তালিকা’, এই কথাটুকু লিখে সার্চ দিন, কয়েকশ মুসলিম জ্যোতির্বিদ, জীববিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, অর্থনীতিবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, গণিতবিদ, পদার্থবিদ, চিকিৎসাবিদ ও দার্শনিকের তালিকা পাবেন। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, মধ্যযুগে গোটা ইউরোপ, চীন, ভারত তথা বাকি সম্পূর্ণ পৃথিবী মিলিয়েও আপনি এত লম্বা তালিকা তৈরি করতে পারবেন না। হালাকু খান বাগদাদ দখল করার পর সেখানকার সমস্ত লাইব্রেরি ধ্বংস করে দেয়। ঐতিহাসিকদের দাবি, সেই লাইব্রেরিগুলো থেকে বা তার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে কয়টা পাণ্ডুলিপি ইউরোপীয়রা চুরি করেছিল, সেগুলোর ক্রমবর্ধমান বিকাশের মধ্য দিয়েই তারা আজকে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এতদূর নিয়ে এসেছে। ঘটনাটি শতভাগ সত্য হোক, কিংবা আংশিক সত্য হোক, অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করার আগ পর্যন্ত এই শহরটিই ছিল তৎকালীন বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এই আরবদের পরিচয় ছিল ‘মরুবাসী মূর্খ জাতি’।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা:
আজকে যারা নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তারা ইসলামকে নারী প্রগতির অন্তরায় হিসেবে ধারণা করেন। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আর ইসলামের ব্যাপারে এমন ধারণা পোষণ করার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এক শ্রেণির ধর্মবব্যবসায়ীর নারীবিদ্বেষী বক্তব্য। কিন্তু এই ধর্মব্যবসায়ীদের কথা বাদ দিয়ে যদি আল্লাহর রসুল (স.) ও তাঁর সাহাবীদের সময়কার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে দেখা যায়, ওই সময় সমাজের প্রতিটি কাজে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল। তারা মসজিদে যেতেন, পুরুষের পাশাপাশি নামাজে অংশ নিতেন, খুতবা শুনতেন, বাজার ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন, হাসপাতাল পরিচালনা করতেন, এমনকি যুদ্ধের মতো বিপজ্জনক জায়গাতেও তাদের উপস্থিতি ছিল। একজন নারীর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু নারী হওয়ার কারণে তাকে কোনো দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয় নি, রসুল (স.) এর সময় এমনটা কখনো ঘটে নি। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গনে তাদের সরব উপস্থিতি ছিল, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অথচ ইসলামপূর্ব আরবের কথা চিন্তা করুন। সেখানে নারীদের অধিকার বলে কোনো কিছু ছিল না। সমাজে তাদের কোনো মূল্যায়ন ছিল না, পরিবারে কোনো অবস্থান ছিল না। কন্যাসন্তানের জন্ম হলে মায়েরা নিজেদেরকে অপরাধী মনে করতেন। পিতারা মেয়ে সন্তানদেরকে জীবন্ত কবর দিতেন, এমন ঘটনারও বহু নজির পাওয়া যায়। সেই নারীদেরকে কবর থেকে তুলে এনে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার দিয়েছিল! অথচ আজকে আমাদেরকে যারা নারী অধিকারের দীক্ষা দেয়, তাদের দেশে আজ থেকে দুশো বছর আগেও নারীদের ভোট দেয়ার অধিকারটুকুই ছিল না।

বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা:
ইসলামে বিচারব্যবস্থা কতটা নিরপেক্ষ ছিল এবং বিচারকরা কতটা স্বাধীন ছিলেন তার উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা তুলে ধরি। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) তখন মুসলিম জাহানের শাসক। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে মদীনা থেকে ইরাকে গিয়েছিলেন। সেখানকার কুফা শহরের বাজার পরিদর্শনকালে তিনি দেখলেন এক ইহুদি ব্যক্তি একটি বর্ম বিক্রি করছে। বর্মটি দেখে আলী (রা.) এর কাছে খুব পরিচিত মনে হলো। তিনি দেখলেন, এটি সেই বর্ম যা তিনি সিফফিনের যুদ্ধের সময় হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি দাবি করলেন, বর্মটি আমার। তুমি হয়তো সিফফিনের যুদ্ধকালে এটি কুড়িয়ে পেয়েছ, অথবা চুরি করেছ। ইহুদি লোকটি প্রতিবাদ করে বললো, মোটেই না, আমি এর মালিক।

খলিফা আলী (রা.) তখন মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি চাইলে বর্মটি ছিনিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু নিজের ক্ষমতা ব্যবহার না করে তিনি কাজীর দরবারে বিচারপ্রার্থী হলেন। কাজী মহোদয় জিজ্ঞেস করলেন, মহামান্য খলিফা, বর্মটি যে আপনার এ ব্যাপারে কোনো সাক্ষী আছে কি? আলী রাঃ বললেন, আমার পুত্র হাসান ও আমার এক গৃহপরিচারক এ ব্যাপারে সাক্ষী আছে। তারা দুজনেই এই বর্মটি আমাকে ব্যবহার করতে দেখেছে। কাজী জিজ্ঞেস করলেন, এর বাইরে আর কোনো সাক্ষী আছে কি? খলিফা বললেন, না, তারা দুজনে ছাড়া আর কোনো সাক্ষী নেই। কিন্তু সাক্ষী হিসেবে তারাই কি যথেষ্ট নয়?

কাজী বললেন, অন্য যে কারো ব্যাপারে আপনার পুত্র হাসানের একার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। কিন্তু আপনি তার পিতা। পিতার পক্ষে পুত্রের সাক্ষ্য আদালতে আমলযোগ্য নয়। তাছাড়া আপনার গৃহপরিচারকের উপরও আপনার প্রভাব আছে। তাই তার সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য হবে না। কাজী মহোদয় নিজের অপরাগতা প্রকাশ করে বর্মটি ইহুদি ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিলেন। আলীও (রা.) বিষয়টি মেনে নিলেন, যেহেতু এ ব্যাপারে আর কোনো সাক্ষীও ছিল না।

এদিকে ইহুদি লোকটি বর্ম ফিরে পেয়ে বেশ খুশি ছিল। সে বর্মটি নিয়ে আদালত ত্যাগ করে। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর সে ফিরে আসে এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে, সত্যিই এই বর্মটি আমি সিফসিনের যুদ্ধের সময় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আর যথার্থই মহামান্য খলিফা এর মালিক। আমি যখন আদালতের তলব পেয়ে এখানে আসছিলাম, তখন ভাবছিলাম খলিফা হিসেবে তিনি আদালতে বাড়তি সুবিধা পাবেন, আর আমাকে বঞ্চিত করা হবে। কিন্তু ইসলামে যে ন্যায়ের শাসন আজ আমি দেখেছি, তার পর আমি আর মিথ্যা আকঁড়ে রাখতে পারলাম না। আমি এই বর্ম ফিরিয়ে দিচ্ছি, আর এটাও ঘোষণা দিচ্ছি যে, আজ থেকে আমি একজন মুসলিম।

ইসলাম মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জন্য কতটুকু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছিল, বিচারব্যবস্থাকে কতটা স্বাধীনতা দিয়েছিল, মানুষে মানুষে কতটা সাম্য ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, এই ঘটনাটি তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

শাসকের জবাবদিহিতা ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রকাঠামো:
একবার খলিফা ওমর (রা.) বায়তুল মাল থেকে মদীনার সব নাগরিককে কাপড় বিতরণ করলেন। জামা বানাতে গিয়ে দেখা গেল, সবার কাপড় ছোট হয়েছে। কিন্তু জুমার দিনে ওমর (রা.) যখন মসজিদে প্রবেশ করলেন, দেখা গেল তাঁর জামাটি বেশ বড়সড়। বোঝাই যাচ্ছিল, অন্তত দুই টুকরো কাপড় দিয়ে জামাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। খলিফা উমর (রা.) যখন খুতবা দিতে মিম্বরে দাঁড়ালেন তখন একজন সাধারণ মুসল্লি দাঁড়িয়ে বললেন, আমাদেরকে উপদেশ দেয়ার আগে আপনাকে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমাদের সবার জামা যেখানে ছোট হয়েছে, সেখানে আপনার জামা কিভাবে এত বড় হলো? আপনি কি দুই টুকরো কাপড় নিয়েছেন? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আপনি কিভাবে দুই টুকরো কাপড় নিলেন, যেখানে আমরা সবাই পেয়েছি এক টুকরা?

খলিফার পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, আমি বলছি। আব্বাজান খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কোনো নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য তার হয় নি। বায়তুল মাল থেকে যে সামান্য পরিমাণ ভাতা দেয়া হয় তাতে তার খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে বহু বছর ধরে তিনি তালিযুক্ত কাপড় পরছেন। এই অবস্থায বায়তুল মাল থেকে কাপড় পাওয়ার পর আমি আমার ভাগের কাপড়টুকু আমিরুল মুমিনীনকে দিয়েছি, যেন দুই টুকরো কাপড় মিলিয়ে তার জন্য একটা সুন্দর জামা হয়।

ওই মুসল্লি তখন বললেন, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি। এবার আপনি খুতবা দিতে পারেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সামান্য এক টুকরো অতিরিক্ত কাপড়ের জন্যও উমরকে (রা) মুসল্লিদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল, অথচ তিনি তখন অর্ধপৃথিবীর শাসক।

ইসলাম কিভাবে জবাবদিহিতামূলক ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রকাঠামো নিশ্চিত করেছিল, তা এই একটি ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। একইভাবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সমান অধিকার তথা সাম্য প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনে অধিকার বলতে যা বোঝায় তার প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা। অন্যদিকে গণতন্ত্র বলেন, সমাজতন্ত্র বলেন, অন্য সকল জীবনব্যবস্থার সফলতাই বই-পুস্তক বা টকশোর আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য কি জিনিস, সমাজতন্ত্রের তথাকথিত মহান আদর্শ মানুষকে কতটা শান্তি দিতে সক্ষম, তা কখনো চোখে দেখা হয় নি। অথচ ইসলাম তা বাস্তবে করে দেখিয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, সেই সব ব্যর্থ তন্ত্র-মন্ত্রকেই সমাধান হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে বারবার। আর ইসলামকে চৌদ্দশ বছরের পুরাতন ধ্যান-ধারণা আখ্যা দিয়ে খুব সচেতনভাব পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা মনে করি, বর্তমান ব্যর্থ বিশ্বব্যবস্থায় একটি সুখী, সমৃদ্ধ, আধুনিক ও গতিশীল জাতি গঠনে ইসলামের প্রযোজ্যতা ও প্রয়োগযোগ্যতা নতুন করে বিবেচনা করার সময় এসেছে।

[যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭৮৩৫৯৮২২২]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...