হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ হোল- সালাহ্

সালাতের উদ্দেশ্য কী? বিশ্বনবী আল্লাহর নির্দেশে যে উম্মাহ, জাতি গঠন কোরলেন যে জাতিটাকে একটা জাতি না বোলে একটা সামরিক বাহিনী বলাই সঠিক হয়, সেই জাতির আকীদাতে সালাতের উদ্দেশ্য ও অর্থ সঠিক ছিলো; অর্থাৎ সেই জাতির, সেই বাহিনীর একজন হোতে গেলে যে চরিত্রের প্রয়োজন সেই চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ হোচ্ছে এই সালাহ্। সালাহ্ সম্বন্ধে এই সঠিক আকীদা চালু ছিলো যত দিন এই বাহিনী নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ কোরে গেছে; অর্থাৎ রসুলের পর ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত। তারপর এই উম্মাহর শাসকরা আল্লাহর আদেশ ও সাবধান বাণী ভুলে যেয়ে যখন সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ কোরে মো’মেন মোজাহেদের প্রাণ, সম্পদ ও রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত বিশাল এলাকা অন্যান্য রাজা-বাদশাদের মত ভোগ কোরতে বসলেন, আলেমরা, পন্ডিতরা কোরানের আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কোরতে যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে খাতা কলম নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, আর তাসাওয়াফপন্থীরা অস্ত্র ফেলে দিয়ে তসবিহ নিয়ে নফ্স্ পরিষ্কার কোরতে হুজরায়, খানকায় ঢুকলেন তখন স্বভাবতই প্রয়োজন হোয়ে পড়লো নবীর শেখানো এই দীনের আকীদার কতকগুলি পরিবর্ত্তন করা। তাদের মনে রোইলনা যে তারাই বোলেছেন যে আকীদা সঠিক না হোলে, ভুল হোলে ঈমান, আমল, কিছুরই আর অর্থ থাকে না। পরিবর্ত্তন করাও হোল এবং ঐ পরিবর্ত্তনের ফলে এই সামরিক দীন পৃথিবীর অন্যান্য অসামরিক দীনের পর্যায়ে পর্যবসিত হোল অর্থাৎ খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, ইহুদী, জৈন ইত্যাদি বহু দীনের (ধর্মের) মতো আরেকটি ধর্মে পরিণত হোল যেটার উদ্দেশ্য এবাদত, পূজা, উপাসনা কোরে আত্মার চর্চা করা; রসুল যে সুশৃংখল, মৃত্যুভয়হীন দুর্ধর্ষ যোদ্ধার চরিত্রের সৃষ্টি কোরেছিলেন তার বদলে ষড়রিপুজয়ী ভীরু কাপুরুষ সাত্ত্বিকের দল তৈরী করা। সুতরাং অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রশিক্ষণ সালাহ্ বদলে হোয়ে গেলো এবাদত, উপাসনা, ধ্যান করা, রসুলের সুন্নাহ তাঁর ১০ বছরে ১০৭ টি যুদ্ধ থেকে বদলে হোয়ে গেলো দাড়ি রাখা, গোফ ছাটা, দাঁত মেসওয়াক করা, মিষ্টি খাওয়া, কুলুখ নেয়া, খানকায় ঢুকে তসবিহ জপা, মোরাকাবা, মোশাহেদা করা ইত্যাদি। এ বিষয়ে সম্যক ধারণার জন্য আমার লেখা “এ ইসলাম ইসলামই নয়” বইটি পড়া প্রয়োজন।
আশ্চর্য লাগে, সালাতের উদ্দেশ্যকে কী কোরে অন্যান্য ধর্মের উপাসনার সাথে এক কোরে ফেলা হোল, কারণ অন্যান্য ধর্মের উপাসনার পদ্ধতিগুলো থেকে সালাতের প্রক্রিয়া পদ্ধতি শুধু ভিন্ন নয়, একেবারে বিপরীত। অন্যান্য ধর্মের পদ্ধতিগুলো অন্তর্মূখী, জড়; কোনটা পদ্মাসনে বোসে চোখ বন্ধ কোরে ধ্যান করা, কোনটা জোড় হাতে হাটু গেড়ে বোসে চোখ বন্ধ কোরে স্রষ্টাকে ধ্যান করা, কোনটা সংসার ত্যাগ কোরে বনে যেয়ে সাধনা করা, কোনটা নির্জন স্থানে বা বদ্ধ ঘরে স্থির হোয়ে বসে প্রভুর ধ্যান করা ইত্যাদি নানা প্রকারের; আর সালাতে সবাই একত্র হোয়ে সোজা লাইন কোরে দাঁড়িয়ে শরীর, মেরুদ-, ঘাড় দৃঢ়ভাবে লোহার রডের মত অনমনীয় রেখে নেতার আদেশের (তকবীর) সঙ্গে সঙ্গে রুকু, সাজদা, সালাম ইত্যাদি করা। এই বিপরীতমুখী দু’টি জিনিসকে, যেটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে বিপরীত, সে দুু’টোকে একই জিনিস মনে করা কী কোরে সম্ভব! কিন্তু আবার চিন্তা কোরলে আশ্চর্য লাগে না; কারণ জেহাদ ত্যাগ কোরলে আল্লাহ যে শাস্তি দেবেন বোলে সাবধান কোরেছেন তা হোল কঠিন শাস্তি ও আমাদের বহি®কৃত, বিতাড়িত, কোরে অন্য জাতিকে মনোনীত করা। জেহাদ ত্যাগ করার ফলে আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মোসলেম বোলে পরিচিত এই জাতিকে কঠিন শাস্তি দিয়ে অন্য জাতি অর্থাৎ ইউরোপের খ্রীস্টান জাতিগুলিকে এই জাতির প্রভু বানিয়ে দিলেন। তাঁর “কঠিন শাস্তির” মধ্যে বহুবিধ শাস্তির মধ্যে এও একটা যে জাতির সাধারণ জ্ঞানও লোপ পাবে। তাই হোয়েছে; নইলে সামরিক বাহিনীর প্যারেড, কুচকাওয়াজের মত একটা কাজকে অন্যান্য ধর্মের স্থবির উপাসনার সঙ্গে এক কোরে ফেলা কী কোরে সম্ভব!
কেতাল অর্থাৎ যুদ্ধকে যেমন আল্লাহ ফরদে আইন কোরে দিয়েছেন (সুরা বাকারা- ২১৬), তেমনি আল্লাহ সালাহ্-কেও ফরদে আইন কোরে দিয়েছেন আমাদের জন্য। কারণ যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ছাড়া অসম্ভব। কিন্তু সালাতের প্রশিক্ষণ শুধু আমাদের যুদ্ধ শেখায় না, সালাহ্ চারিত্রিক, দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক বহু প্রকারের শিক্ষা দেয় যদিও যুদ্ধের প্রশিক্ষণটাই প্রথম ও মুখ্য। সালাতের দৃশ্য পৃথিবীতে আর একটি মাত্র দৃশ্যের সঙ্গে মিলে, আর কিছুর সাথেই মিলে না, আর সেটি হোচ্ছে পৃথিবীর যে কোন সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের সঙ্গে। এই সাদৃশ্য এতই প্রকট যে বর্ত্তমানের এই প্রায়ান্ধ ইসলামের দৃষ্টিতেও তা ধরা পড়ে। যেমন ডিগ্রী ইসলামিক ষ্টাডিজের (Degree Islamic Studies) তৃতীয় প্রত্রের অনুশীলনের ৬ষ্ঠ প্রশ্নের ১৮নং উত্তরে লেখা হোচ্ছে “মসজিদ নেতৃত্ব ও নেতার আনুগত্যের শিক্ষা দেয়: মসজিদ নেতৃত্ব ও আনুগত্যের এক অনুপম শিক্ষা কেন্দ্র। মসজিদ সব মুসুল্লীর একই এমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে উঠাবসা দৃশ্য দেখে মনে হয় তারা একজন সেনাপতির নির্দেশে কুচকাওয়াজে লিপ্ত। এখানেই নেতার প্রতি অকৃতিম আনুগত্য ও নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের উত্তম সবক বিদ্যমান।” এই মিল স্বাভাবিক, কারণ দুু’টোরই উদ্দেশ্য এক- ‘যুদ্ধ’। শুধু তফাৎ এই যে কেন যুদ্ধ? পৃথিবীর সব সামরিক বাহিনীগুলির প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হোচ্ছে তাদের ভৌগলিক রাষ্ট্রগুলির রক্ষা এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রয়োজনে অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ কোরে দখল করা; আর এই উম্মতে মোহাম্মদীর প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন কার্যকর কোরে মানব জাতির মধ্যেকার সমস্ত অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, অশান্তি, রক্তপাত দূর কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা কোরে এবলিসের চ্যালেঞ্জে তাকে পরাজিত কোরে আল্লাহকে জয়ী করা। উদ্দেশ্যের মধ্যে আসমান-যমীন তফাৎ থাকলেও প্রক্রিয়া দুু’টোরই এক- প্রশিক্ষণ। আকীদার বিকৃতির কারণে সালাহ্-কে শুধু একটি এবাদত, একটি আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া হিসাবে নেয়া যে কতখানি আহাম্মুকী তার কয়েকটি কারণ পেশ কোরছি।
১। আত্মশুদ্ধির জন্য প্রয়োজন পাহাড়-পর্বতের গুহায় না হয় হুজরায়-খানকায় অন্ততপক্ষে কোন নির্জন স্থান, যেখানে স্থির হোয়ে বোসে, চোখ বন্ধ কোরে মন নিবিষ্ট কোরে, একাগ্রচিত্ত হোয়ে আল্লাহর ধ্যান করা। সালাতের প্রক্রিয়া এর প্রত্যেকটারই একেবারে বিপরীত। নির্জন স্থানে না হোয়ে সালাতের জন্য স্থান নির্দ্ধারণ আল্লাহ কোরেছেন জামাতে, জনসমাবেশে এবং সে সমাবেশ যত বড় হবে তত সওয়াব, তত পূন্য; অর্থাৎ একেবারে বিপরীত। একা সালাহ্ কায়েম করা শুধুমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে জামাতে যোগদান সম্ভব নয়; এবং তাও ঐ প্রশিক্ষণের অভ্যাস ঠিক রাখার উদ্দেশ্যে।
২। লাইন কোরে দাঁড়াতে হবে এবং সে লাইন হোতে হবে ধনুকের ছিলার মত সোজা, ধনুকের ছিলার চেয়ে সোজা আর কোন জিনিস নেই, হোতে পারে না। লাইন যদি ধনুকের ছিলার মত সোজা না হয় তবে যারা সালাহ্ পড়ছে তাদের ঘাড়, মুখ আল্লাহ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেবেন (শাস্তি হিসাবে) [হাদীস- নোমান বিন বশীর (রাঃ) থেকে মোসলেম এবং আবু মাসউদ আল আনসারী (রাঃ) থেকে মোসলেম, মেশকাত]। সালাতের লাইন ধনুকের ছিলার মত সোজা করার জন্য আল্লাহর রসুলের অনেকগুলি হাদীস আছে।
ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন কোরেও দুই তিন রাকাত সালাহ্ কায়েম করার পর অর্থাৎ দু’ তিন বার ওঠাবসা করার পর ঐ সোজা লাইন আঁকা-বাঁকা হোয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে এবং অনেক সময় হয়ও। এটা যাতে না হয় সালাতের শেষ পর্যন্ত যেন লাইন একদম শুরুর মতই সোজা থাকে সে জন্য রসুলের দেয়া নিয়ম হোচ্ছে এই যে লাইন ধনুকের ছিলার মত সোজা কোরে সালাহ্ আরম্ভ করা থেকে শেষ পর্যন্ত ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি (বুড়া আংগুল) এক স্থানে নিবদ্ধ রাখতে হবে শুধু ডান পায়ের। অর্থাৎ সালাতের আরম্ভের সময় ডান পায়ের বুড়া আংগুল যে জায়গায় থাকবে সেখান থেকে একচুল নড়বে না মাটিতে খোটা গাড়লে যেমন খোটা আর সেখান থেকে নড়ে না, তেমনি সালাতের ওঠাবসার সময়ও বুড়া আংগুল খোটার মত এক জায়গায় নিবদ্ধ রাখতে হবে। তাহোলেই সালাতের সোজা লাইন আর একটুকুও আকাবাকা হবে না। এটা কোরতে হবে প্রত্যেক মুসুল্লীর, মোজাহিদের। যার বুড়া আংগুল খোটার মত এক জায়গায় নিবদ্ধ থাকবে না সে লাইন থেকে হয় সামনে না হয় পেছনে সরে যাবে, এবং লাইন আঁকাবাঁকা হোয়ে যাবে এবং শাস্তি হিসাবে আল্লাহ ঐ সব মুসুল্লীদের ঘাড়, মাথা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেবেন।
৩। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- পিঠ এমনভাবে সোজা কোরে দাঁড়াবে যাতে সমস্ত হাড়ের গাইটগুলি (গ্রন্থী, joint) আপন আপন জায়গায় বোসে যায় [রেফায়াহ বিন রা’ফে বিন মালেক (রাঃ) থেকে এমাম ইবনে হিব্বান, এমাম মাহমুদ]। রুকুতে যেয়ে দুই হাত দিয়ে হাটু এমনভাবে ধোরবে যেমন কোরে বাজপাখী শিকার ধরে এবং মাজা থেকে মাথা পর্যন্ত একদম এক লাইনে থাকবে, মাথা ঐ সরলরেখা থেকে উঁচুও হবে না, নীচুও হতে পারবে না [আবু হুমায়েদ সাঈদী (রাঃ) থেকে- আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাযাহ এবং আয়েশা (রাঃ) থেকে মোসলেম]।
৪। আল্লাহর রসুল এরশাদ কোরেছেন যে- যে ব্যক্তি রুকু হতে দাঁড়িয়ে পিঠ সোজা করে না, আল্লাহ তাঁহার সালাতের প্রতি দৃষ্টিপাতও করেন না [আবু হোরায়রা (রাঃ)]। আল্লাহর রসুল শরীর, পিঠ ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একদম সোজা রাখা সম্বন্ধে এতবার বোলেছেন যে তা থেকে এর গুরুত্ব বোঝা যায়। কিন্তু বর্ত্তমানের প্রচলিত সালাতে, যাকে নামায বলা হয়, এর কোন গুরুত্বই নেই। শরীর পিঠ ইত্যাদিকে রডের মত সোজা রাখার জন্য আল্লাহর রসুল যে প্রক্রিয়াটার ওপর জোর দিয়েছেন তা হোল, সমস্ত হাড়ের গ্রন্থীগুলি (joint) আপন আপন জায়গায় সোজা হোয়ে বোসে যায়। কেউ যদি নিজের পিঠের, মেরুদন্ডের জোড়া, গাইটগুলি আপন আপন জায়গায় বসিয়ে দেয় তবে অবশ্যই তার পিঠ নিজে থেকেই রডের মত সোজা হোয়ে যাবে, তেমনি তার ঘাড়ও সোজা হোয়ে যাবে। বাহুর কনুই জয়েন্ট যখন যথাস্থানে বসিয়ে দেবে তখন দুই বাহু একদম সোজা হোয়ে যাবে এবং রুকুতে ও বসা অবস্থায় দুই হাত যখন হাটুর ওপর স্থাপন করা হবে তখন দুই বাহু একেবারে রডের মত সোজা হোয়ে যাবে। এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এই কঠিন সোজা অবস্থাই আল্লাহ ও তাঁর রসুল মুসুল্লীর সালাতে চান। শরীরের গ্রন্থী, গাইট (joint) গুলিকে যথাস্থানে শক্তভাবে বসাবার ব্যাপারে এত বিভিন্ন হাদীস আছে যে সবগুলি পূর্ণভাবে উল্লেখ কোরতে গেলে এই বই অনেক বড় হোয়ে যাবে। কাজেই এখানে আমি শুধু তাদের নামগুলি এখানে উল্লেখ কোরছি। তারা হলেনÑ রেফায়াহ বিন রা’ফে বিন মালেক থেকে এমাম ইবনে হিকাম, এমাম মাহমুদ; আবু দাউদ, বায়হাকী; হাকীম; বোখারী; মোসলেম; আবু হোরায়রা; আলী বিন শায়বান থেকে ইবনে মাযাহ; আনাস থেকে আবু দাউদ; দারেমী, হাকিম, শাফিয়ী।
৫। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- হে মুসুল্লীগণ শোন, যে ব্যক্তি রুকু ও সাজদাতে মেরুদ- সোজা কোরবে না তাহার সালাহ্ হবে না [আলী বিন শায়বান (রাঃ) থেকে ইবনে মাযাহ]। সাজদা অবস্থায় পিঠের মেরুদ- একদম সোজা এবং পায়ের আংগুলগুলি কেবলামুখী কোরে রাখতে হবে। রুকতে দুই হাত সোজা কোরে দুই হাটুর ওপর দৃঢ়ভাবে রাখতে হবে এবং পিঠ সোজা রাখতে হবে [আবু হুমায়েদ সাঈদী (রাঃ) থেকে- বোখারী, আবু দাউদ, তিরিমিযি, ইবনে মাযাহ]।
৬। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- লাইন সোজা কর (ধনুকের ছিলার মত), সোজা হয়ে দাঁড়াও, তোমাদের ঘাড়সমূহকে সোজা রাখ [আনাস (রাঃ) থেকে- আবু দাউদ]।
৭। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- লাইন সোজা কর, তোমাদের বাহুমূল (কাঁধ) সম পর্যায়ে রাখ, ফাঁকসমূহ পূর্ণ কর [ইবনে উমর (রাঃ) থেকে আবু দাউদ]।
ইসলামের প্রকৃত সালাহ্ যে কতখানি সামরিক শৃংখলা (Military Discipline) শেখায় তা ফুটে ওঠে এর নিষেধগুলির মধ্যে।
১। সাজদার স্থান থেকে ফুঁ দিয়ে ধুলাবালি সরানো বা সেখান থেকে পাথর কুচি বা কাঁকর হাত দিয়ে সরানো নিষেধ [উম্মে সালমাহ (রাঃ) ও আবু যর গেফারী (রাঃ) থেকে আহমদ তিরমিযি, আবু দাউদ নেসায়ী ও ইবনে মাযাহ]।
২। চোখ বন্ধ কোরে রাখা, এদিক ওদিক তাকানো, কাপড় বা মাথার চুল ঠিকঠাক করা জায়েজ নয় (বোখারী)।
৩। ঐ ধনুকের ছিলার মত লাইনে দাঁড়াতে হবে একজন সৈনিকের মত শরীর, পিঠ, মেরুদ-, ও ঘাড় শক্ত, সোজা কোরে। পিঠ, মেরুদ- ও ঘাড় যদি সোজা, একই সরলরেখায় না থাকে তবে সালাহ্ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নষ্ট হবে। হাই তোলা যথাসম্ভব রোধ কোরবে [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে তিরমিযি]।
৪। চোখের দৃষ্টি নির্দিষ্ট স্থানে নিবদ্ধ রাখতে হবে, নড়াচড়া করা যাবে না। চোখ খুলে রাখতে হবে, বন্ধ করা যাবে না।
৫। সালাতের জন্য টুপী পরিধান করা বা পাগড়ী বাঁধা প্রয়োজনীয় নয় (বোখারী)।
৬। দাঁড়াবার সময় দু’পায়ে সমান ভর রাখতে হবে, কোন এক পায়ে বেশী ভর দেয়া যাবে না।
৭। সালাহ্ দ্রুত হতে হবে।
৮। আল্লাহর রসুল উচ্চস্বরে সালাতের তকবির দিতেন [আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে- বোখারী]। তিনি তকবির বলার সময় স্বর উচ্চ কোরতেন যাতে সব মোকতাদিরা শুনতে পায় আহমদ, হাকিম ও যাহাবী।
৯। সালাতের প্রত্যেক রোকন অর্থাৎ রুকু, সাজদা, কওমা ইত্যাদি ধীরে আদায় কোরতে হবে, না হোলে সালাহ্ হবে না (বোখারী)।
এখানে বুঝতে হবে যে সালাতের রোকনগুলি ধীরে আদায় করার অর্থ কি? এ ব্যাপারে বর্ত্তমান মোসলেম বোলে পরিচিত জনসংখ্যার মধ্যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। প্রচলিত ধারণা হোচ্ছে এই যে ধীরে ধীরে নড়াচড়া, ওঠবোস কোরতে হবে। মোটেই তা নয়। যেহেতু মূলত সালাহ্ সামরিক প্রশিক্ষণ সেহেতু এর চলন (Movement) দ্রুত হোতে বাধ্য। হাদীসের ধীর শব্দ প্রযোজ্য হোচ্ছে ঐ দ্রুত চলনের মধ্যকার সময়ের, অর্থাৎ রুকুতে যাবার সময় দ্রুত, কিন্তু রুকুতে অর্থাৎ রুকু অবস্থায় যথেষ্ট সময়ক্ষেপণ করা। রুকু থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়ান অবস্থায় যথেষ্ট সময় দেরী করা, দ্রুত সাজদায় যেয়ে সাজদায় যথেষ্ট সময় দেয়া, সাজদা থেকে দ্রুত উঠে বসা অবস্থায় বেশ খানিকক্ষণ সময় দিয়ে তারপর আবার সাজদায় যাওয়া, এবং দ্রুত যাওয়া, কিন্তু সাজদায় যেয়ে সাজদা অবস্থায় বেশ সময় দেয়া ইত্যাদি।
আমার কথার প্রমাণ এই সহীহ হাদীসটি আল্লাহর রসুল যখন ‘সামিআল্লাহু লেমান হামিদাহ’ বোলে রুকু থেকে সোজা হোয়ে দাঁড়াতেন তখন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন যে আমরা মনে কোরতাম যে তিনি সাজদায় যাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছেন এবং এক সাজদার পর বসা অবস্থায় এতক্ষণ দেরী কোরতেন যে আমরা মনে কোরতাম যে তিনি দ্বিতীয় সাজদার কথা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বোলে দ্বিতীয় সাজদায় যেতেন [আনাস (রাঃ) থেকে- বোখারী, মোসলেম, আহমদ]।
বর্ত্তমানে বিকৃত ইসলামে যে সালাহ্ পড়া হয় দ্রুত চলনের বদলে আধা-মরা, দুর্বল ধীর গতি এবং ঐ দাঁড়ান ও বসা অবস্থায় ধীরের বদলে কোন সময়ই দেয়া হয় না। অর্থাৎ বিশ্বনবীর শেখানো ও তাঁর নিজের কায়েম করা সালাতের ঠিক বিপরীত।
এমামের তকবিরের জন্য সতর্ক, তৎপর হোয়ে থাকা ও তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে জামাতের সকলের সঙ্গে একত্রিতভাবে, একসাথে রুকুতে যাওয়া, এ’তেদাল করা, সাজদায় যাওয়া, সালাম ফেরান ইত্যাদি করা; যেমন ভাবে প্যারেড, কুচকাওয়াজের সময় সামরিক বাহিনীর সৈনিকেরা সার্জেন্ট মেজরের (Sergeant-major) আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রিত ভাবে মার্চ করে, ডাইনে বামে ঘুরে, দাঁড়ায়, বসে, দৌঁড়ায়। সঠিক, পূর্ণভাবে সালাহ্ কায়েম কোরতে গেলে ১০০ টিরও বেশী ছোট বড় নিয়ম পদ্ধতি পালন কোরতে হয়। সবগুলো না কোরলেও অন্তত চৌদ্দটি ফরদ, চৌদ্দটি ওয়াজেব, সাতাশটি সুন্নত আর বারটি মোস্তাহাব খেয়াল রেখে, সেগুলি সঠিক ও পূর্ণ ভাবে পালন কোরে সালাহ্ কায়েম কোরতে গেলে বর্ত্তমানে সালাতে যে ধ্যানের কথা বলা হয় তা কতখানি সম্ভব? এদিকে আল্লাহর রসুল বোলেছেন যে তোমরা পূর্ণভাবে সালাহ্ কায়েম কর, কারণ আল্লাহ পূর্ণ ব্যতিত সালাহ্ কবুল করেন না [আবু হোরায়রা (রাঃ)]।
সাধারণ জ্ঞানেই (Common sense) বোঝা যায় যে, সালাতের এতগুলি নিয়ম কানুন পালন কোরে যে ধ্যান বর্ত্তমানের ইসলাম দাবী করে তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আমার এ কথায় যিনি একমত হবেন না তিনি মেহেরবানী কোরে ঐ নিবিষ্টতা অর্থাৎ ধ্যান নিয়ে চার রাকাত সালাহ্ পড়তে চেষ্টা কোরে দেখতে পারেন- দেখবেন সালাতে ভুল হোয়ে যাবে।
ওজু কোরে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হবার পর সালাতের প্রথম কাজ হোল কাবার দিকে মুখ কোরে দাঁড়ানো। কেন? আল্লাহকে স্মরণ (যেক্র) কোরতে কাবার দিকে মুখ কোরে দাঁড়াতে হবে কেন? কাবা আল্লাহর ঘর বোলে? আল্লাহতো সর্বত্র আছেন, আমাদের প্রত্যেকের ঘাড়ের রগের চেয়েও যিনি নিকটে আছেন (কোরান- সুরা কাফ ১৬) তাঁকে স্মরণ করার জন্য হাজার হাজার মাইল দূরে তাঁর ঘরের দিকে মুখ করার প্রয়োজন কি? উদ্দেশ্য হোচ্ছে ঐক্য; মতের ঐক্য, উদ্দেশ্যের ঐক্য, লক্ষ্যের ঐক্য, আকীদার ঐক্য। একদল লোক যদি একত্র হোয়ে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানের দিকে রওনা হয়, তবে যতক্ষণ তাদের ঐ গন্তব্যস্থানের কথা মনে থাকবে ততক্ষণ তারা একত্রিত থাকবে, একত্রিতভাবেই পথ চোলতে থাকবে, কোন বাধা আসলে একত্রিত হোয়েই তা প্রতিহত কোরবে, একত্রিত হোয়েই বাধা অপসারণ কোরবে। কিন্তু মধ্য পথে যদি তারা হঠাৎ সবাই গন্তব্যস্থানের কথা ভুলে যায় তবে অবশ্যম্ভাবীরূপে তারা আর ঐক্যবদ্ধ, একত্রিত থাকবে না, এক এক জন এক এক দিকে ছড়িয়ে যাবে, দল আর দল থাকবে না।
আল্লাহ-রসুলের দেয়া উদ্দেশ্য লক্ষ্য, আকীদা ভুলে যাবার ফলে সালাহ্-কে অন্যান্য ধর্মের মত উপাসনায় পরিণত করার ফলে এই উম্মাহ আজ আর ঐক্যবদ্ধ নেই, হাজার ভাগে বিভক্ত। আজ এই উম্মাহ শুধু শারীরিকভাবে একই দিকে, কাবার দিকে মুখ কোরে দাঁড়ায়; মানসিকভাবে বিভিন্ন মযহাবে, ফেরকায়; আত্মিকভাবে বিভিন্ন তরিকায়; রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ভৌগলিক রাষ্ট্রে ও রাজনৈতিক দলে বিভক্ত। সালাতের ঐ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আকীদার ঐক্য হারিয়ে যাবার ফলে এই জাতি আজ শক্তিহীন কাজেই অন্য জাতি দ্বারা পরাজিত লান্ছিত, অপমানিত। আল্লাহ বোলেছেন তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হোয়ো না (সুরা আল-এমরান ১০৩)।
কাবার দিকে মুখ করার পর দ্বিতীয় কাজ হোল লাইন কোরে দাঁড়ানো। শুধু কাবার দিকে মুখ করা নয়, লাইন কোরে দাঁড়ানো। কেন? আল্লাহকে স্মরণ কোরতে, তাঁর যেক্র কোরতে, ধ্যান কোরতে, লাইন কোরতে হবে কেন? তাঁর যেক্র করার সাথে লাইন করার কী সম্পর্ক? একই দিকে মুখ কোরে ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন কোরে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য ঐক্য ও শৃংখলার প্রশিক্ষণ।
সালাতে তারপরের কাজ এমামের (নেতার) তকবিরের (আদেশের) সঙ্গে সঙ্গে আমল (কাজ) করা; সকলে একত্রে, একই সাথে রুকুতে যাওয়া, এমামের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সোজা হোয়ে দাঁড়ানো, সাজদায় যাওয়া, সালাম করা ইত্যাদি। এ হোল আনুগত্য ও আদেশ পালন করার প্রশিক্ষণ এবং এই আনুগত্য ও আদেশ পালন, সকলে একত্রে, ঐক্যবদ্ধভাবে। কেউ যদি এমামের আনুগত্য কোরেও রুকু, সাজদা ইত্যাদি করে কিন্তু সকলের সঙ্গে একসঙ্গে না কোরে আগে বা নিজের ইচ্ছামত বেশী পরে করে তবে তার সালাহ্ হবে না। এমাম যদি রুকু বা সাজদায় যেয়ে একঘণ্টা থাকেন তবে প্রত্যেক মোকতাদীকে তাই থাকতে হবে, নইলে তার সালাহ্ হবে না। এটা কী শেখায়? এটা কি ধ্যান করা শেখায়? অবশ্যই নয়; এটা শেখায় শর্ত্তহীন আনুগত্য, আদেশ পালন। রুকু, সেজদা করায় এমাম যদি আদেশের ধারাবাহিকতায় একটু ভুল করে তাহোলে মুসুল্লীরা আল্লাহু আকবার বলে লোকমা দিয়ে এমামকে বুঝিয়ে দেন, এমাম সাথে সাথে সাজদায়ে সহু করে আবার আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেন।
আল্লাহ সালাহ্-কে ফরদে আইন কোরে দিয়েছেন। যদিও সালাতের মূল ও মুখ্য উদ্দেশ্য হোচ্ছে সামরিক, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ কিন্তু এতেই সালাহ্ সীমিত নয়। পেছনে বোলে এসেছি সালাতের মধ্যে শারীরিক, চারিত্রিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আল্লাহ রেখে দিয়েছেন। সালাতের সারিতে দাঁড়ানো বিশালদেহী শক্তিশালী লোকটি তার পাশে দাঁড়ানো ছোট, দুর্বল লোকটির প্রতি কোন অবজ্ঞার ভাব রাখতে পারবে না, কারণ দু’জনেই দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে যিনি দু’জনেরই স্রষ্টা, দু’জনেরই প্রভু। তাকে ভাবতে হবে, কে জানে হয়ত এই ছোট দুর্বল লোকটিই আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে প্রিয়। অনুরূপভাবে মহাপন্ডিত, আলেমের পাশে দাঁড়ানো নিরক্ষর লোকটি, কোটিপতির পাশে দাঁড়ানো দরিদ্র লোকটি, অতি সুন্দর লোকটির পাশে দাঁড়ানো বিশ্রী লোকটি, সবাই তাদের প্রভুর সামনে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়ানো, সবাই তাঁর কাছে সমান, সবাই তাঁরই উপাসক। কেউ জানেনা এদের মধ্যে কার সালাহ্ আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়; গ্রহণযোগ্য। সালাহ্ এই মনোভাব মুসুল্লীদের মধ্যে তৈরী করে। যদি মুসুল্লীদের মধ্যে এই মনোভাব প্রতিষ্ঠিত, কায়েম না হয় তাদের সালাহ্ ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সালাতের পূর্ণ প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত।
একটি বিশিষ্ট চরিত্রের বহু মানুষ তৈরী করার জন্য সালাহ্ একটি ছাঁচ্ (Mould)। এই ছাঁচে ফেলে যে চরিত্র সৃষ্টি হবে তা হবে দৃঢ়, সুশৃংখল, নেতার আদেশে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাহীন, সংকল্পের কঠিনতায় তারা ইস্পাতের চেয়েও শান্ দেওয়া মরনজয়ী যোদ্ধা আর সেই সঙ্গে কোমলতায়, ব্যবহারে মাধুর্যে ভরপুর। এই কথাটাই আল্লাহ বোলছেন সুরা ফাতাহর শেষ আয়াতে। বোলছেন- মোহাম্মদ আল্লাহর রসুল; যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের (শত্রুর) প্রতি কঠোর, কঠিন আর নিজেদের মধ্যে তারা দয়ামায়া, সহমর্মিতায় পূর্ণ। তাদের দেখবে তারা রুকু কোরছে, সাজদা কোরছে (সালাহ্ কায়েম কোরছে)। অর্থাৎ আল্লাহ বোলছেন সঠিক ও পূর্ণভাবে যারা সালাহ্ কায়েম কোরবে তারা হবে শত্রুর (কাফের, মোশরেক) জন্য দুর্ধর্ষ, ভয়ংকর যোদ্ধা আর নিজেদের মধ্যে মায়াময়, সহমর্মী, ভাই বন্ধু। বর্ত্তমানে যে পৃথিবীময় সালাহ্ পড়া হয় এই সালাহ্ কি এ চরিত্রের মানুষ তৈরী কোরছে? অবশ্যই নয়; বরং ঠিক উল্টোটাই কোরছে। বর্ত্তমানের সালাহ্ যে চরিত্রের জাতি সৃষ্টি কোরছে তা শত্রু দেখে ভীত, শত্রুর কাছে পরাজিত, লান্ছিত, শত্রুর অবজ্ঞার পাত্র, আর নিজেদের মধ্যে হিংসা, ঈর্ষা, অনৈক্য আর বিভেদ ও সংঘর্ষে লিপ্ত। শুধু তাই নয় তারা নিজের জাতির চেয়ে শত্রুর প্রতি বেশী অনুগত, বেশী হীনমন্যতায় পূর্ণ।
শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, চারিত্রিক উন্নতির ব্যবস্থা থাকলেও সালাতের মুখ্য ও মূল উদ্দেশ্য হোচ্ছে সুশৃংখল, নেতার আদেশ পালনে আগুনে ঝাঁপ দিতে তৈরী দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় যোদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি। আমার এই বক্তব্যের প্রমাণ আল্লাহর রসুলের কয়েকটি হাদীস। তিনি বোলেছেন-ইসলাম একটি ঘর। এই ঘরের থাম, খুঁটি, স্তম্ভ হোচ্ছে সালাহ্; আর ছাদ হোচ্ছে জেহাদ [হাদীস- মুয়ায (রাঃ) থেকে আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত] মনে রাখতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কথা আমাদের কথার মত নয়। তাদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দ ভেবে, ওজন কোরে বলা। আল্লাহর রসুল ইসলামকে বেশ কয়েকটি হাদীসেই ঘরের সঙ্গে তুলনা কোরেছেন প্রকৃত ইসলাম কি তা উদাহরণ দিয়ে আমাদের বোঝাবার জন্য। ঘর মানুষ তৈরী করে কেন? অবশ্যই সেখানে থাকার জন্য, রোদ, বৃষ্টি থেকে বেঁচে ঘরের ভেতরে বসবাস করার জন্য, তাই নয় কি? রোদ-বৃষ্টি থেকে আমাদের বাঁচায় কিসে? ঘরের ভিত্তি? নাকি ঘরের থাম, খুঁটি? নাকি ছাদ? অবশ্যই ঘরের ছাদ। অর্থাৎ ঘর তৈরীর আসল উদ্দেশ্যই হোচ্ছে ছাদ তৈরী। কিন্তু থাম, খুঁটি স্তম্ভ ছাড়া ছাদকে ওপরে ধোরে রাখা যাবে না আর ঘরের ভিত্তি যদি শক্ত তওহীদের ওপর না হয় তবে তা ধ্বসে পোড়বে। কাজেই ঐ খাম, খুঁটির প্রয়োজন। ঘরের খাম, খুঁটি তৈরী কোরেও যদি ওপরে ছাদ তৈরী না করা হয় তবে সেই ঘরে বসবাস করা যাবে না। হীরা-মতি বসানো, সোনা-রূপার তৈরী খাম-খুঁটি অর্থহীন হোয়ে যাবে, আজ যেমন হোচ্ছে পৃথিবীময়। আজ থাম-খুঁটি তৈরীকেই যথেষ্ট মনে কোরে সালাহ্-ই পড়া হোচ্ছে আপ্রাণ চেষ্টা কোরে; ওপরে ছাদ তৈরী করার কথা তেরশ’ বছর আগেই ভুলে যাওয়া হোয়েছে। আজকের এই বিকৃত ইসলামের ঘরের বহু থাম, খুঁটি স্তম্ভ আছে, ছাদ নেই; ছাদ নেই বোলেই খ্রীস্টান, ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধের হাতে পরাজয়, লান্ছনা, অপমানরূপে ঝড়, বৃষ্টি, প্রখর রোদ ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ কোরে একে বসবাসের একেবারে অযোগ্য কোরে ফেলেছে। কিন্তু একশ’ পঞ্চাশ কোটির এই জাতির সে বোধ নেই। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কোটি কোটি বাকা-টেরা থাম-খুঁটি আর লক্ষ লক্ষ মসজিদ তৈরী কোরে চোলেছে।
আল্লাহর রসুলের ঐ হাদীসগুলি থেকে একথা পরিষ্কার যে সালাতের (থাম, খুঁটি, স্তম্ভের) উদ্দেশ্য হোল ছাদকে ওপরে ধোরে রাখা, জেহাদকে কার্যকরী করা। অর্থাৎ জেহাদ, যুদ্ধ কোরে জয়ী হওয়ার জন্য যে চরিত্র প্রয়োজন সেই চরিত্র সৃষ্ট করা; জেহাদের প্রশিক্ষণ। কাজেই জেহাদ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম যদি বাদ দেয়া হয় তবে সালাহ্ অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয়; যেমন যে কোন সামরিক বাহিনী যদি যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয় তবে তাদের প্যারেড, কুচকাওয়াজ করা যেমন অর্থহীন, যেমন ছাদ তৈরী করা না হোলে থাম, খুঁটি অর্থহীন।
ইসলামকে একটি ঘরের সঙ্গে তুলনা কোরলে বোলতে হয় ইসলাম নামক ঘরের ভিত্তি (Foundation) হোল আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদ; খাম-খুঁটি (Pillar) হোল সালাহ্, আর ছাদ (Roof) হোল জেহাদ। থাম-খুঁটির (Pillar) চেয়ে ছাদ (Roof) যে বেশী প্রয়োজনীয় তা আল্লাহর নবী বোলে গেছেন পরিষ্কার কোরে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হোল -দীনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি? তিনি জবাব দিলেন- আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমান; অর্থাৎ তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। আবার জিজ্ঞাসা করা হোল- তারপর কি? তিনি উত্তর দিলেন- আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ [হাদীস- আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে মোসলেম, বোখারী]। ইসলামের ঘরের ভিত্তি যে আল্লাহর তওহীদ তা তিনি আগের হাদীসগুলিতে বলেন নি কারণ তওহীদই যে দীনের ভিত্তি তা এত প্রকট যে তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কোরানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ একথা বহুবার বোলেছেন। তবু দীনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি অর্থাৎ ভিত্তি কি প্রশ্নে জবাবে তিনি তার জবাবে বোললেন- তওহীদ। তাহোলে দাঁড়ালো এই যে দীনুল ইসলামের ঘরের ভিত্তি আল্লাহর তওহীদ, এর থাম-খুঁটি সালাহ্ আর এর ছাদ হোল আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (ঐ তওহীদ এবং তওহীদ ভিত্তিক দীন সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য)।
আল্লাহ ইসলামের যে ঘরটি চৌদ্দশ’ বছর আগে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার ভিত্তি আল্লাহর তওহীদ আজ নেই। আল্লাহর তওহীদ হোল তার সার্বভৌমত্ব; অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, রাষ্ট্র, আইন-কানুন, দ-বিধি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প ইত্যাদি সর্ববিষয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ছাড়া আর কাউকে গ্রহণ না করা; এক কথায় যে কোন বিষয়ে, যেখানে আল্লাহর ও তাঁর রসুলের (কারণ রসুল আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন কথা বলেন নাই- সুরা নজম ৩-৪) কোন বক্তব্য আছে, নির্দেশ আছে সেখানে পৃথিবীর আর কাউকে স্বীকার না করা। এই তওহীদ আজ পৃথিবীর কোথাও নেই। মোসলেম দুনিয়া বোলে, মোসলেম রাষ্ট্র বোলে পরিচিত কোনও রাষ্ট্রেও নেই; অথচ এর নিচে কোন তওহীদও নেই, যে তওহীদ মহান আল্লাহ গ্রহণ কোরবেন। এর নিচে যা আছে, অর্থাৎ আজ মোসলেম দুনিয়ায় যা চোলছে তা শেরক ও কুফর। তারপর সেই ঘরের ছাদ জেহাদও নেই। তাহোলে রোইল কি? রোইল ঘরটার শুধু খাম-খুঁটি এবং সমস্ত জাতি বিকৃত আকীদায় ঐ খাম-খুঁটিকে অর্থাৎ সালাহ্-কে আঁকড়িয়ে ধোরে আছে। যেহেতু তওহীদের দৃঢ় ভিত্তি নেই সেহেতু ঐ খাম-খুটিগুলিও আর খাম-খুটি, স্তম্ভ নেই; ওগুলো ভঙ্গুর, ঠুনকো ও মৃদু আঘাতেই ওগুলো ধ্বসে পড়ে যায়, ওগুলো আর যোদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি কোরতে পারে না।
এই দীনের নেতারা, ওলামা, আল্লামা, ফুকাহা, মোহাদ্দেসিন, মুফাস্সেরিন এরা সবাই একমত যে আকীদা সহীহ অর্থাৎ সঠিক না হোলে ঈমানেরও কোন দাম নেই এবং স্বভাবত ঈমান ভিত্তিক সব আমল অর্থাৎ সালাহ্ (নামায), যাকাহ, হজ্ব, সওম (রোযা) এবং অন্যান্য কোন এবাদতেরই আর দাম নেই, সব অর্থহীন। তাদের এই অভিমতের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু বর্ত্তমানের এই বিকৃত ইসলামে আকীদার অর্থ করা হয় ঈমান। এটা ভুল। আকীদার প্রকৃত অর্থ হোল কোন বিষয় সম্বন্ধে সঠিক ধারণা। কোন জিনিস দিয়ে কী হয়, ওটার উদ্দেশ্য কি, ওটাকে কেন তৈরী করা হোয়েছে তা সঠিক ভাবে বোঝা (এ সম্বন্ধে আমার লেখা ইসলামের প্রকৃত আকীদা বইটি দেখুুন)। সালাহ্ সম্বন্ধে সঠিক আকীদা কি? সঠিক আকীদা পেছনে বোলে এসেছি, এখানে আবার পেশ কোরতে চাই। অত্যন্ত সংক্ষেপে সঠিক আকীদা হোল:
আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে পাঠালেন এই দায়িত্ব দিয়ে যে তিনি যেন আল্লাহর দেয়া হেদায়াহ ও সত্যদীন পৃথিবীর অন্য সব দীনের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন, এবং নিজে এই কথার সাক্ষী রোইলেন (কোরান- সুরা ফাতাহ ২৮)। এই হেদায়াতই হোল তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, সেরাতুল মুস্তাকীম; এবং সত্যদীন হোল ঐ তওহীদের ওপর ভিত্তি করা জীবন-ব্যবস্থা, শরিয়াহ, দীনুল ইসলাম, দীনুল কাইয়্যেমাহ। এই কাজের অর্থাৎ এই সত্যদীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার তরিকা, প্রক্রিয়া অর্থাৎ কোন্ নীতিতে এই কাজ করা হবে তাও আল্লাহ নির্দ্ধারিত কোরে দিলেন এবং সেটা হোল কেতাল, সশস্ত্র সংগ্রাম, যুদ্ধ। প্রশিক্ষণ ছাড়া, চরিত্র গঠন ছাড়া যুদ্ধ কোরে জয়লাভ সম্ভব নয়, খাম-খুঁটি, পিলার ছাড়া ছাদ রাখা সম্ভব নয়, কাজেই সেই চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য নির্দ্ধারিত কোরে দিলেন সালাহ্ এবং এই সালাহ্-কেও ফরদে আইন অবশ্য কর্ত্তব্য, (Must) কোরে দিলেন (সুরা বনি ইসরাঈল ৭৮)।
আজ মোসলেম দুনিয়ায় সালাতের সম্বন্ধে আকীদা কি? সালাহ্ চরিত্র গঠনের মুখ্যত দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় যোদ্ধার চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া; এই আকীদা বদলে একে অন্যান্য ধর্মের মত এবাদতের, উপাসনার শুধু আত্মিক উন্নতির প্রক্রিয়া বোলে মনে করার ফলে আজ সেই যোদ্ধার চরিত্র গঠন তো হয়ই না এমন কি সালাতের বাহ্যিক চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। আল্লাহর রসুলের বহুবারের দেওয়া তাগীদ- সাবধান বাণী- তোমাদের সালাতের লাইন ধনুকের ছিলার মত সোজা কর, নাহোলে আল্লাহ তোমাদের মুখ পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেবেন, তাঁর আদেশ- তোমাদের মেরুদ-, ঘাড় সোজা কোরে সালাতে দাঁড়াও এ সমস্ত কিছুই আজ ভুলে যাওয়া হোয়েছে। এসব হুকুম না মুসুল্লীদের মনে আছে, না এমামদের মনে আছে। কাজেই ঐ সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের সালাহ্ আজ নুব্জ, বাকা লাইনের; বাঁকা পিঠের মুসুল্লী ও এমামদের মরা সালাহ্। আল্লাহ কোরআনে সুরা নেসার ১৪১-১৪২ নং আয়াতে মোনাফেকদের সালাতের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন- মোনাফেকরা শৈথিল্যের সাথে সালাতে দাঁড়ায়। আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘কুসালা’ যার অর্থ সাহস হারিয়ে ফেলা, অলসতা, ঢিলা-ঢালা ভাবে। বর্ত্তমান বিশ্বের মোসলেম নামের এ জাতির সালাতের দিকে তাকালে কুসালা শব্দের অর্থ বুঝতে কারও কষ্ট হবে না। খুশু, খুজুর নামে এ জাতি ‘কুসালা’ শব্দের যথাযথ প্রয়োগ কোরছে। সমস্ত বিশ্বে বর্ত্তমানে এই সাহসহীন সালাহ্-ই চলছে। এই মরা প্রাণহীন সালাতের পক্ষে বলা হয়- খুশু-খুজুর সাথে নামায পড়া উচিত। এই খুশু-খুজু কী? বর্ত্তমানে বলা হয় সমস্ত কিছু থেকে মন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন কোরে আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা হোচ্ছে খুশু-খুজু; অর্থাৎ এক কথায় ধ্যান করা।
প্রশ্ন হোচ্ছে, সালাতে আল্লাহকে ধ্যান করাই যদি উদ্দেশ্য হোয়ে থাকে তবে আল্লাহ সালাতের প্রক্রিয়া, নিয়ম-কানুন এমন কোরে দিলেন কেন যাতে ধ্যান করা অসম্ভব। খুশু-খুজুু অর্থাৎ ধ্যান করাই আল্লাহর উদ্দেশ্য হোলে সালাতের নিয়ম হতো পাহাড়-পর্বতের গুহায়, কিম্বা খানকা বা হুজরায় অথবা অন্ততপক্ষে কোন নির্জন স্থানে ধীর-স্থিরভাবে একাকি বোসে চোখ বন্ধ কোরে মন নিবিষ্ট কোরে আল্লাহর ধ্যান করা। সালাহ্ কি তাই? অবশ্যই নয়, সালাহ্ এর ঠিক উলটো। বহু জনসমাবেশের মধ্যে যেয়ে সেখানে ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন কোরে দাঁড়িয়ে সৈনিকের, যোদ্ধার মত ঘাড়, মেরুদ- লোহার রডের মত সোজা কোরে, এমামের তকবিরের (আদেশের) অপেক্ষায় সতর্ক, তটস্থ, থাকা তারপর তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রে রুকু, সাজদায় যাওয়া, ওঠা, সালাম দেয়া অর্থাৎ এমামের (নেতার) আদেশ পালন করা। সালাতের প্রায় ১১৪ টি নিয়ম-পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য রেখে, সেগুলি যথাযথভাবে পালন কোরে ঐ খুশু-খুজুর সাথে অর্থাৎ ধ্যানের সাথে সালাহ্ সম্পাদন করা যে অসম্ভব তা সাধারণ জ্ঞানেই (Common sense) বোঝা যায়। অথচ ঐ নিয়ম-পদ্ধতি সঠিক ভাবে, যথাযথ ভাবে পালন না কোরে যেমন-তেমন ভাবে সালাহ্ পড়লে তা আল্লাহ গ্রহণ কোরবেন না। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- তোমরা পূর্ণভাবে সালাহ্ কায়েম করো, কেননা আল্লাহ পূর্ণ ব্যতিত সালাহ্ কবুল করেন না [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে]। তিনি আরও বোলেছেন- তোমাদের কাহারও সালাহ্ পূর্ণ (সঠিক) হবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ যেভাবে আদেশ কোরেছেন ঠিক সেইভাবে কায়েম কোরবে (আবু দাউদ)। আল্লাহ-রসুলের আদেশ মোতাবেক সমস্ত নিয়ম-কানুন যথাযথ পালন কোরে অর্থাৎ পূর্ণ সঠিকভাবে সালাহ্ কায়েম কোরলে ঐ খুশু-খুজু, অর্থাৎ বর্ত্তমানে মুসুল্লীরা খুশু-খুজু বোলতে যা বুঝেন তা অসম্ভব। খুশু-খুজুর প্রকৃত উদ্দেশ্য হোচ্ছে- মো’মেন যখন সালাতে দাঁড়াবে তখন তার মন পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হোয়ে একাগ্র হবে সালাতে; সে সমস্ত ক্ষণ সচেতন থাকবে যে সে মহামহীম আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আল্লাহর বিরাটত্ব ও তার নিজের ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে সে থাকবে সর্বদা সচেতন, আর সেই সঙ্গে একাগ্র হোয়ে থাকবে এমামের (নেতার) তকবিরের (আদেশের) প্রতি, সালাহ্ সঠিকভাবে, নিখুঁতভাবে সম্পাদন কোরতে। এই হোল খুশু-খুজু।
কিন্তু এই খুশু-খুজু অর্থাৎ একাগ্রতার মানে এই নয় যে সালাতে দাঁড়াবে নুব্জ, সম্মুখে ঝুকে, মাথা নত কোরে। কারণ যিনি আমাদের সালাহ্ শিখিয়েছেন আল্লাহর রসুল তিনি আদেশ কোরেছেন- সালাতে দাঁড়াবে সোজা হোয়ে, মেরুদ-, ঘাড় সোজা শক্ত কোরে (সৈনিকের মত)। আল্লাহ কোর’আনে বোলছেন- সালাহ্ কায়েম কর আনুগত্যের সাথে (কোরান- সুরা বাকারা ২৩৮), আল্লাহ আবার বোলছেন সালাহ্ কায়েম কর বিনয়ের সাথে (কোরান- সুরা মু’মিনুন ২)। তাঁর রসুুল বোলছেন- সোজা, শক্ত, দৃঢ় ভাবে সালাতে দাঁড়াও। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না কি যে দু’টি আদেশ বিপরীতমুখী? না, মোটেই বিপরীতমুখী নয়; আল্লাহর ও তাঁর রসুলের কথা বিপরীত হোতে পারে না। একটা মানসিক আর অন্যটা দৈহিক। সালাতে মন থাকবে বিনয়ী, নম্র, অনুগত আর দেহ থাকবে লোহার রডের মত দৃঢ়, ঋজু; রুকুতে সাজদায় যেয়েও পিঠ ঘাড় হাত, পা থাকবে সোজা, শক্ত; বিচলন, গতি হবে দ্রুত। এই দুই মিলিয়ে হবে ইসলামের প্রকৃত সালাহ্। মো’মেন যখন সালাতে দাঁড়াবে তখন তার মনের অবস্থা হবে এই রকম যে সে সর্বক্ষণ সচেতন থাকবে যে সে এই বিশাল বিরাট সৃষ্টির স্রষ্টার রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়িয়েছে। কেন দাঁড়িয়েছে? দাঁড়িয়েছে এই জন্য যে সে ঐ মহান স্রষ্টার খলিফা, প্রতিনিধি, এবং খলিফা হিসাবে তার সর্বপ্রধান দায়িত্ব হোচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন, জীবন-ব্যবস্থা কার্যকরী কোরে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, অশান্তি আর রক্তপাত দূর কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। ঐ বিশাল দায়িত্ব পূর্ণ কোরতে গেলে যে চরিত্র প্রয়োজন, যে চরিত্রে সংকল্পের দৃঢ়তা, ঐক্য, শৃংখলা, আনুগত্যের ও হেজরতের সমাহার সেই চরিত্র সৃষ্টির জন্য সে সালাতে দাঁড়িয়েছে। মনের ভেতরে তার থাকবে বিনয়, সসম্মান-ভক্তি (যারা বিনয়-নম্র নিজেদের সালাতে, সুরা মো’মেনুন- ২) আর শারীরিক ভাবে সে দাঁড়াবে আল্লাহর মোজাহেদ (যোদ্ধা), সৈনিকের মত দৃঢ়, লোহার রডের মত সোজা হোয়ে, তটস্থ হোয়ে থাকবে এমামের আদেশের (তকবিরের) অপেক্ষায় এবং আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রে হোয়ে একসঙ্গে দ্রুত সে আদেশ পালন কোরবে (কানেতিন- অনুগত, সুরা বাকারা ২৩৮)। এই হোচ্ছে ইসলামের প্রকৃত সালাহ্। ইসলামের সালাহ্ যে অন্যান্য ধর্মের ধ্যান নয় তার প্রমাণ সালাতের পুরো প্রক্রিয়াটাই। তার মধ্যে বিশেষ কোরে এই নিয়মটি যে সালাতে চোখ বন্ধ করা যাবে না। ধ্যান করতে গেলে তো বটেই, এমন কি কোন বিষয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা কোরতে গেলেও মানুষের চোখ বন্ধ হোয়ে আসে। সেই চোখ বন্ধ করাকে নিষিদ্ধ করার মানে এই নয় কি যে সালাতে ধ্যান করার যায়গা নেই, আছে সজাগতা, অতন্দ্র সতর্কতা?
সালাহ্ শুধু যে ধ্যান নয়, প্রকৃতপক্ষে ধ্যানের ঠিক বিপরীত তার পক্ষে কয়েকটি কারণ পেশ কোরছি। ১) সালাহ্ শব্দের আভিধানিক অর্থ হোচ্ছে কোন বাঁকা-টেরা পদার্থ, জিনিসকে আগুনে পুড়িয়ে, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোন কাজের জিনিস তৈরী করা; আর ধ্যান হোচ্ছে নিষ্ক্রিয় হোয়ে গভীর চিন্তা করা। ২) সালাহ্ গতিশীল (Dynamic); ধ্যান স্থিতিশীল, স্থবির (Static)। ৩) তাকবিরের (Command) আনুগত্য কোরতে হয়; ধ্যানে Command এর কোন স্থানই নেই। ৪) দলবদ্ধভাবে কায়েম কোরতে হয়; ধ্যান একা একা কোরতে হয়। ৫) সালাতে চুড়ান্ত সচেতন ও সতর্ক অবস্থায় থাকতে (Alert) হয়; ধ্যানে ঠিক বিপরীত অর্থাৎ নিথর, অচেতন হোয়ে যেতে হয়। ৬) সালাহ্ ঠিক মত কায়েম কোরতে হোলে ১০০টির বেশী নিয়ম কানুন মনে রেখে তা পালন কোরতে হয়; ধ্যানে কোন নিয়ম কানুন নেই। ৭) সালাতে চোখ বন্ধ রাখা যাবে না; চোখ বন্ধ না কোরে ধ্যান প্রায় অসম্ভব। ৮) সালাহ্ সক্রিয় (active); ধ্যান নিষ্ক্রিয় (Inactive)। ৯) অন্ধকারে সালাহ হয় না, পক্ষান্তরে অন্ধকারই ধ্যানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, ১০) সালাহ্ প্রচ- গতিশীল, দুর্বার, বিশ্বজয়ী, মৃত্যুভয়হীন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তৈরী করে; ধ্যান দুনিয়া বিমুখ, অন্তর্মুখী রিপুজয়ী সুফি দরবেশ তৈরী করে।
যদি কাউকে বলা হয় তুমি জনাকীর্ণ রাজপথে দৌঁড়াবে আর সেই সঙ্গে ধ্যান কোরবে তাহোলে ব্যাপরটা কি রকম হবে? এটা যেমন হাস্যকর তেমনি হাস্যকর কাউকে বলা যে তুমি সালাহ্ কায়েম কোরবে এবং সেই সঙ্গে ধ্যানও কোরবে। কারণ দৌঁড়াবার সময় যেমন চোখ খোলা রেখে, কোথায় পা ফেলছে তা দেখে, রাস্তার গাড়ি ঘোড়া দেখে দৌঁড়াতে হবে, তখন ধ্যান অসম্ভব, তেমনি সালাতের সময়ও সালাতের ১১৪টি নিয়ম কানুন মনে রেখে, রাকাতের হিসাব রেখে সেগুলি পালন করার সাথে ধ্যান করাও অসম্ভব। সুতরাং সালাহ্ ও ধ্যান বিপরীতমুখী দু’টি কাজ যা একত্রে অসম্ভব। অথচ সালাহ্ সম্বন্ধে আকীদার বিকৃতিতে একে অন্যান্য ধর্মের উপাসনার সাথে এক করার চেষ্টায় এই অসম্ভব আকীদাই আজ মোসলেম হবার দাবীবার এই জনসংখ্যার আকীদা। সালাহ্র উদ্দেশ্য কি, এ ব্যাপারে আকীদার বিকৃতির পর থেকে গত কয়েক শতাব্দী থেকে মোসলেম নামের এই জনসংখ্যাটি দৌঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান করার আপ্রাণ চেষ্টা কোরছে এবং ফলে তাদের না দৌঁড় হোচ্ছে না ধ্যান করা হোচ্ছে।
সালাহ ও ধ্যান পরস্পর বিপরীত এ কথার মানে এই নয় যে এর মাধ্যমে সালাহর আধ্যাত্মিক দিক অস্বীকার করা হোচ্ছে। যেখানে সারা জীবনের ধ্যান ও তাসাউফ সাধনা একজন সুফীকে জীবন ত্যাগ কোরতে শেখায় না সেখানে সালাহ এমন এক আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ যা সালাহ কায়েমকারীকে এমন মৃত্যুভয়হীন দুর্ধর্ষ যোদ্ধায় পরিণত করে যে, সে নির্দ্বীধায় আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর কলেমা প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন ও সম্পদ বিসর্জন দেওয়ার জন্য পস্তুত হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বর্তমান মোসলেম বলে পরিচিত এ জনগোষ্ঠীর প-িতগণ সালাহকে সামরিক প্রশিক্ষণ হিসাবে তো মানেই না বরং তারা সালাহকে যে ধ্যান বোলে প্রচার করে তারা সেই ধ্যানও করে না অর্থাৎ ওরা ট্রেনিংও করে না আবার ধ্যানও করে না। তাদের কোনটাই হয় না। কারণ ধ্যান করলে তো অসংখ্য রিপুজয়ী সুফী দরবেশ তৈরী হতো, সেক্ষেত্রে অপরাধ, অন্যায়, অবিচার কিছুটা হলেও তো কমত। তাও হয়নি। বরং তাদের নামায আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় সুরা নিসার ১৪২-১৪৩ নং আয়াত যেখানে আল্লাহ বলছেন “নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুতঃ তিনি তাহাদিগকে উহার শাস্তি দেন আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যের সাথে দাাঁড়ায় কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তাহারা অল্পই স্মরণ করে; তারা থাকে দোটানায় দোদুল্যমান, না এ দিকে, না ওদিকে। আল্লাহ যাহাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তাহার জন্য কখনও কোন পথ পাইবে না।”

সালাতের আত্মিক ভাগ
প্রাসঙ্গিক কারণে সালাহর আত্মিক বিষয়টি সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। সালাতের আত্মা হোচ্ছে যেকরাল্লা, আল্লাহর যেকর করা। যেকর মানে কি? যেকর অর্থ কোন কিছুকে স্মরণ করা, মনে করা। যেমন আপনি আপনার সন্তানের কথা মনে কোরলেন, আপনার বন্ধু বিদেশে আছে, আপনি তার কথা মনে কোরলেন, মানেই আপনি তাদের যেকর কোরলেন। এভাবে আপনি আল্লাহকে মনে কোরলেন মানেই আপনি আল্লাহর যেকর কোরলেন। অর্থাৎ সালাতের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহকে মনে রাখা অর্থাৎ আল্লাহকে যেকর করা এটাই হোল সালাতের আত্মিক ভাগ।
এখন প্রশ্ন হোচ্ছে–আল্লাহকে মনে কোরব কী রূপে, কী ভাবে? প্রথমে মনে কোরতে হবে যাঁর সামনে দাঁড়ানো হোয়েছে তিনি অসীম। অসীম কি? মানুষ সীমিত, ক্ষুদ্র, তার পক্ষে অসীমকে ধারণ করা অসম্ভব। তিনি যেমন অসীম তাঁর সিফতগুলিও তেমনই অসীম। তিনি অসীম রহমান, অসীম রহিম, অসীম রব, অসীম খালেক (স্রষ্টা) ইত্যাদি তাঁর যতো সিফত আছে তাঁর মতোই তাঁর প্রত্যেকটি সিফত অসীম। সালাতে তাহরীম বাঁধার পর এবং কোর’আনের সূরা আবৃত্তি করার পর রুকুতে যেয়ে অর্থাৎ তাঁর কাছে মাথা নত কোরে মনে কোরতে হবে তিনি আযম; অর্থাৎ বিশাল বিরাট, যে বিরাটত্বের, বিশালতার কোন সীমা নেই। এবং এই বিরাট এবং বিশালতা সোবহান অর্থাৎ চুড়ান্ত ত্রুটিহীন, দোষহীন এবং নিখুঁত, যাঁর চেয়ে ত্রুটিহীন এবং নিখুঁত কোন কিছু হয় না। আর মুসল্লী সেই বিশালতার সামনে অতি-অতি ক্ষুদ্র এবং তাঁর সামনে অবনত। তারপর সামি আল্লাহু লেমান হামীদা বোলে দাঁড়াতে হয়, অর্থাৎ মুসল্লী যে তাঁর হামদ ঘোষণা কোরল আল্লাহ তা শুনলেন। অতঃপর সেজদাহ। সেজদায় গিয়ে বোলবে সোবহানা রাব্বি আল আ’লা। আ’লা অর্থ উচ্চতম, অসীম উচ্চ, যে উচ্চতার সীমা নেই এবং এই অসীম উচ্চতা সোবহান অর্থাৎ চুড়ান্ত ত্রুটিহীন, দোষহীন এবং নিখুঁত। মুসল্লী তাঁর সামনে অতি অতি নিচু এবং তাঁর পায়ে সেজদাহ-অবনত। এই অসীম বিশালতা এবং এই অসীম উচ্চতার একত্রিত রূপ আল্লাহু আকবার অর্থাৎ আল্লাহ অতি বড়। এই বড়ত্ব উচ্চতা ও বিশালতা উভয় দিক থেকে। এই বড়ত্বেরও কোন সীমা নেই। আল্লাহর এই রূপকে সর্বক্ষণ মনে রেখে সালাহ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কায়েম করাই হোল সালাতে আল্লাহর যেকর, যেকরাল্লাহ।
মুসল্লী যখন রুকুতে গেল তখন তার অবস্থা মোসলেম। এবং যখন সেজদায় গেল তখন সে মো’মেন। মোসলেম হোল যে আল্লাহর সকল হুকুম, বিধানকে সসম্মানে তাসলিম কোরে নেয়। যখন মুসল্লী রুকুতে গেল সে আল্লাহর বিরাটত্বের কাছে নিজের ক্ষুদ্রতাকে সমর্পণ কোরল, তাই তখন সে মোসলেম। আর যখন সে সেজদায় গেল, তখন সে তার সমস্ত সত্ত্বাকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ কোরল। এটা মো’মেনের অবস্থা। এ বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য এখানে একটি নকশা দেওয়া হোল।

salah
সালাতের রুকুতে, সেজদায় যাওয়ার সময় এবং অন্য সকল চলন (Movement) এ যখন আল্লাহু আকবর বলা হয় তখন আল্লারর এই বিরাটত্ব, আযমত ও উচ্চতা সবকিছুই এর মধ্যে চোলে আসে। এই সম্পূর্ণটা মিলিয়েই আল্লাহু আকবার। আল্লাহর এই রূপকে মনে রাখাই হোল সালাতে আল্লাহর যেকর অর্থাৎ যেকরাল্লাহ।

যারা আল্লাহর রসুলের পদতলে বোসে ইসলাম শিখেছিলেন এবং তাঁর হাতে বায়াত নেবার পর বহু বছর তার সঙ্গে দিনে পাঁচবার সালাহ্ কায়েম কোরেছেন তাদের অন্যতম এবং দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ) বিন খাত্তাবের আকীদায় সালাহ্ কী ছিলো? একদিন মো’মেন মোজাহেদদের সালাহ্ পর্যবেক্ষণ করার সময় তিনি দেখলেন একজন ঠিকই দৃঢ় এবং সোজাভাবে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু তার মাথাটা খানিকটা সামনের দিকে ঝোঁকানো। ওমর (রাঃ) ঐ মোজাহিদের মাথা ধোরে উঁচু, সোজা কোরে দিলেন এবং তারপর তার মাথায় মৃদু আঘাত কোরে বোললেন খুশু এখানে নয়, বোলে তার বুকে আংগুল রেখে বোললেন- খুশু এখানে।
সামরিক বাহিনীর প্যারেডের সঙ্গে সালাতের মিল শুধু এটুকুই নয় আরও আছে। আল্লাহ কোরানে আদেশ কোরেছেন যে তোমরা সর্বদা মস্জীদে যেতে উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ পরে যাবে (কোরান সুরা আরাফ আয়াত ৩১)। শব্দ ব্যবহার কোরেছেন ‘যিনত’, যার অর্থ জাক-জমকপূর্ণ, চাকচিক্যময়। যিনত অর্থ অলংকারও (কোরান সুরা নুর আয়াত ৩১)। মস্জীদে যে সব কারণে যেতে হয় তার মধ্যে মুখ্য কারণ সালাহ্ কায়েম করা। অর্থাৎ আল্লাহ আদেশ কোরেছেন সালাতে দাঁড়াতে তোমরা জাক-জমকপূর্ণ কাপড়-চোপড়, পরিচ্ছদ পোরে নেবে। প্রশ্ন হোচ্ছে এবাদত করার জন্য, আল্লাহর সামনে বিনীত, বিনয়-নম্র হোয়ে দাঁড়াবার জন্য অমন সাজ-সজ্জা করার আদেশ কেন?
যে কারণে একটি সামরিক বাহিনীর প্যারেড, কুচকাওয়াজ করার সময় তাদের পোশাক পরিচ্ছদ অর্থাৎ ইউনিফর্ম একই রকম, ইস্ত্রি করা পরিষ্কার হওয়া বাধ্যতামূলক, ঠিক সেই কারণেই মস্জীদে সালাতের সময় জাক-জমকপূর্ণ পোশাক পরার জন্য আল্লাহর এই হুকুম। বর্ত্তমানে সামরিক বাহিনীগুলি জাতির মধ্যে থেকে বেছে বেছে লোক নিয়ে গঠন করা হয়, কাজেই তাদের জন্য একই রকম পোশাক অর্থাৎ ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হয়। কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদী সম্পূর্ণ জাতিটাই একটা সামরিক বাহিনী; যে কথা পেছনে বোলে এসেছি। এর পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব সৈনিক, প্রত্যেকে মোজাহেদ। এদের সবাইকে একই পোশাক পরার আদেশ দেওয়া বাস্তব সম্মত নয়। তাই আল্লাহ তা না দিয়ে যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব উত্তম, জাক-জমকপূর্ণ পোশাক পরে সালাতের, মো’মেনদের কুচকাওয়াজ করার আদেশ দিয়েছেন।
সালাতের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আকীদা আজ বিকৃত হোয়ে যাওয়ার ফলে এ জাতির লোকেরা যেমন আঁকাবাঁকা লাইনে মাথা নিচু কোরে; নুব্জ হোয়ে দাঁড়িয়ে যেন-তেন ভাবে সালাতের অনুষ্ঠান করে, তেমনি একই কারণে সাধারণ বাজে কাপড় পরে সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। এরাই আবার বিয়ে-সাদী এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে তাদের সবচেয়ে ভালো পোশাক পরিচ্ছদ পরে। আল্লাহর রসুলের সময় উম্মতে মোহাম্মদী যে সালাতের পোশাক সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ আমরা পাই হাদীসে রাসুলে। আল্লাহর রসুল বোলেছেন সামর্থ্য থাকলে তোমরা জুমার সালাতের জন্য একজোড়া আলাদা কাপড় রাখবে, কাজের কাপড় ব্যাতিত [আবদুল্লাহ বিন সালিম (রাঃ) থেকে ইবনে মাজাহ, মেশকাত]। তিনি আরও হুকুম কোরেছেন তোমরা সালাহ্ কায়েম করতে অবশ্যই দু’টো কাপড় পরিধান কোরবে (ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে এমাম তাহাভী, মেশকাত)। এক ব্যক্তি আল্লাহর রসুলের কাছে এসে একটি কাপড় পরে সালাহ্ কায়েম করা বিষয়ে জিজ্ঞাসা কোরলে তিনি বোললেন তোমাদের প্রত্যেকের কি দু’টো কোরে কাপড় রাখার সামর্থ্য আছে? [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বোখারী]। অর্থাৎ যাদের দু’টো কাপড় রাখার সামর্থ্য আছে তারা যেন দু’টো কাপড় রাখে এবং ঐ বিশেষ কাপড় পোরে সালাহ্ কায়েম করে।
১. একদা হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) পুরাতন কম্বলে শরীর আবৃত কোরে পথে বের হোলে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা কোরলো, এই ছেড়া কম্বলটি ছাড়া আপনার কি আর কোন পোশাক ছিল না? তিনি জবাব দিলেন, থাকলে অবশ্যই তুমি তা আমার পরিধানে দেখতে পেতে। লোকটি বললো- তা কি কোরে হয়, মাত্র দুই/তিন দিন আগেই আমি আপনার পরনে অতি উত্তম এক জোড়া পোশাক দেখেছি। আবু যর (রাঃ) বোললেন, সেটা আমি একজন অভাবী লোককে দিয়ে দিয়েছি। লোকটি মন্তব্য কোরলো, আল্লাহর শপথ! এই দুনিয়ার বুকে আপনার চাইতে অভাবী কোন লোক থাকতে পারে বোলে আমার ধারণা ছিল না। হযরত আবু যর (রাঃ) জবাব দিলেন, হতভাগা! আমার শরীরেতো একটি কম্বল আছে, সেই লোকটির হয়তো তাও ছিল না। শুন, এই পোশাকটির অতিরিক্ত সালাহ্ কায়েম করার মত একটি ‘আবা’ও আমার ঘরে রক্ষিত আছে। আমার কয়েকটি ছাগী আছে, যেগুলি দুধ দেয়। বাহনের জন্য একটি গাধা আছে। কাজকর্ম কোরবার মত একটি বাঁদী আছে। এরপরেও কি আমি অভাবী? আমার তো ভয় হয়, কেয়ামতের দিন এই সম্পদরাশির হিসাব দিতে গিয়েই আমি না অপারগ হয়ে পড়ি। [বিপ্লবী সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ)- মুহিউদ্দিন খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ]।
২. মহানবী (সাঃ) বোলেছেন- তোমাদের কাহারও পক্ষে ইহা আপত্তির বিষয় নয় যে, যদি তাহার সামর্থ্য থাকে জুমার দিনের জন্য একজোড়া পৃথক কাপড় রাখবে কাজের কাপড় ব্যতিত [আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) থেকে ইবনে মাজাহ, মেশকাত]।
৩. এক ব্যক্তি রাসুল (রাঃ) এর কাছে এসে একটি কাপড় পরে সালাহ্ কায়েম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কোরলো। রাসুলুল্লাহ বোললেন, তোমাদের প্রক্যেকের কি দু’টো কোরে কাপড় রাখার সামর্থ্য আছে? [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে- বোখারী]
হাদীস গুলোতে দু’টো কাপড় রাখার অর্থ হোচ্ছে নবী করিমের সময় আরবদের আর্থিক অবস্থা ছিলো অতি করুণ। সমস্ত পৃথিবীতে এত দরিদ্র আর কোন জনসমষ্টি ছিলো কিনা সন্দেহ। অধিকাংশ লোকেরই পরিধানে থাকতো একটি কাপড় কম্বল বা চাদর মাত্র যা দিয়ে তারা শরীরের ঊর্দ্ধাংশ ও নিম্নাংশ আংশিক ভাবে ঢেকে রাখতেন। শরীরের উর্দ্ধাংশ ও নিম্নাংশের জন্য আলাদা আলাদা কাপড় পরা সম্ভব ছিলো শুধু আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছলদের পক্ষে। এজন্যই রসুলুল্লাহ আদেশ কোরেছেন যাদের জন্য সম্ভব তারা যেন দু’টো কাপড়, অর্থাৎ উর্দ্ধাঙ্গের জন্য একটি ও নিম্নাঙ্গের জন্য আরেকটি কাপড় সালাতের সময় পরে নেয়, অর্থাৎ যে যতখানি পারে ‘যিনত’ সাজ-সজ্জা, জাক-জমক প্রকাশ করে। পরে যখন উম্মতে মোহাম্মদী জেহাদ ও কেতালের (সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের) মাধ্যমে অর্দ্ধেক পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করে তখন আরবের ঐ চরম দারিদ্র্য শেষ হোয়ে প্রাচুর্যে ভরে যায় এবং তখন আল্লাহর আদেশ সালাতে ‘যিনত’ প্রদর্শন পুরোপুরি অর্থবহ হয়।
প্রকৃত তওহীদ ও জেহাদ অর্থাৎ মো’মেন হবার আল্লাহর দেয়া সংজ্ঞা (সুরা হুজরাত- ১৫) থেকে বিচ্যুত, আল্লাহর অভিশপ্ত (লা’নত প্রাপ্ত) এই জাতিকে সালাতের উদ্দেশ্য বোঝাবার চেষ্টায় ইতিহাস (তা’রিখ) ও হাদীস থেকে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাঃ) বিন খাত্তাবের উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি চাবুক হাতে মুসুল্লীদের লাইনের মধ্য দিয়ে হাটতেন এবং কাউকে ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন থেকে বা অন্য কোন বিচ্যুতি দেখলে এবং চাবুক দিয়ে আঘাত করতেন। যারা সালাহ্, তাদের ভাষায় নামাযের উদ্দেশ্য ধ্যান করা মনে করেন (এবং এই আকীদাই মোসলেম দুনিয়ায় আজ সর্বব্যাপী), তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- চাবুক মেরে কি মানুষকে ধ্যান করানো যায়? ওমরের (রাঃ) কাজ কি সৈন্য বাহিনীর প্যারেডের সার্জেন্ট মেজরের (Serjeant Major) কাজের সাথে মিলে না, যে প্যারেডের প্রশিক্ষণে ভুল ত্রুটি হোলে গালি দেয়, পিটায়? আর প্রথম সারির আসহাব, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা জানতেন না সালাহ্ ধ্যান করার জন্য নাকি সামরিক প্রশিক্ষণ? আল্লাহর লা’নতের ফলে এ জাতির সাধারণ জ্ঞান (Common sense) পর্যন্ত লোপ পেয়েছে।
আল্লাহ কোরানের সর্বত্র আছেন, আমাদের প্রত্যেকের ঘাড়ের রগের চেয়েও যিনি নিকটে আছেন (কোরান- সুরা কাফ ১৬) তাঁকে স্মরণ করার জন্য হাজার হাজার মাইল দূরে তাঁর ঘরের দিকে মুখ করার প্রয়োজন কি? উদ্দেশ্য হোচ্ছে ঐক্য; মতের ঐক্য, উদ্দেশ্যের ঐক্য, লক্ষ্যের ঐক্য, আকীদার ঐক্য। একদল লোক যদি একত্র হোয়ে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানের দিকে রওনা হয়, তবে যতক্ষণ তাদের ঐ গন্তব্যস্থানের কথা মনে থাকবে ততক্ষণ তারা একত্রিত থাকবে, একত্রিতভাবেই পথ চোলতে থাকবে, কোন বাধা আসলে একত্রিত হোয়েই তা প্রতিহত কোরবে, একত্রিত হোয়েই বাধা অপসারণ কোরবে। কিন্তু মধ্য পথে যদি তারা হঠাৎ সবাই গন্তব্যস্থানের কথা ভুলে যায় তবে অবশ্যম্ভাবীরূপে তারা আর ঐক্যবদ্ধ, একত্রিত থাকবে না, এক এক জন এক এক দিকে ছড়িয়ে যাবে, দল আর দল থাকবে না।
আল্লাহ-রসুলের দেয়া উদ্দেশ্য লক্ষ্য, আকীদা ভুলে যাবার ফলে সালাহ্-কে অন্যান্য ধর্মের মত উপাসনায় পরিণত করার ফলে এই উম্মাহ আজ আর ঐক্যবদ্ধ নেই, হাজার ভাগে বিভক্ত। আজ এই উম্মাহ শুধু শারীরিকভাবে একই দিকে, কাবার দিকে মুখ কোরে দাঁড়ায়; মানসিকভাবে বিভিন্ন মযহাবে, ফেরকায়; আত্মিকভাবে বিভিন্ন তরিকায়; রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ভৌগলিক রাষ্ট্রে ও রাজনৈতিক দলে বিভক্ত। সালাতের ঐ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আকীদার ঐক্য হারিয়ে যাবার ফলে এই জাতি আজ শক্তিহীন কাজেই অন্য জাতি দ্বারা পরাজিত লান্ছিত, অপমানিত। আল্লাহ বোলেছেন তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হোয়ো না (সুরা আল-এমরান ১০৩)।
কাবার দিকে মুখ করার পর দ্বিতীয় কাজ হোল লাইন কোরে দাঁড়ানো। শুধু কাবার দিকে মুখ করা নয়, লাইন কোরে দাঁড়ানো। কেন? আল্লাহকে স্মরণ কোরতে, তাঁর যেক্র কোরতে, ধ্যান কোরতে, লাইন কোরতে হবে কেন? তাঁর যেক্র করার সাথে লাইন করার কী সম্পর্ক? একই দিকে মুখ কোরে ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন কোরে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য ঐক্য ও শৃংখলার প্রশিক্ষণ।
সালাতে তারপরের কাজ এমামের (নেতার) তকবিরের (আদেশের) সঙ্গে সঙ্গে আমল (কাজ) করা; সকলে একত্রে, একই সাথে রুকুতে যাওয়া, এমামের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সোজা হোয়ে দাঁড়ানো, সাজদায় যাওয়া, সালাম করা ইত্যাদি। এ হোল আনুগত্য ও আদেশ পালন করার প্রশিক্ষণ এবং এই আনুগত্য ও আদেশ পালন, সকলে একত্রে, ঐক্যবদ্ধভাবে। কেউ যদি এমামের আনুগত্য কোরেও রুকু, সাজদা ইত্যাদি করে কিন্তু সকলের সঙ্গে একসঙ্গে না কোরে আগে বা নিজের ইচ্ছামত বেশী পরে করে তবে তার সালাহ্ হবে না। এমাম যদি রুকু বা সাজদায় যেয়ে একঘণ্টা থাকেন তবে প্রত্যেক মোকতাদীকে তাই থাকতে হবে, নইলে তার সালাহ্ হবে না। এটা কী শেখায়? এটা কি ধ্যান করা শেখায়? অবশ্যই নয়; এটা শেখায় শর্ত্তহীন আনুগত্য, আদেশ পালন। রুকু, সেজদা করায় এমাম যদি আদেশের ধারাবাহিকতায় একটু ভুল করে তাহোলে মুসুল্লীরা আল্লাহু আকবার বলে লোকমা দিয়ে এমামকে বুঝিয়ে দেন, এমাম সাথে সাথে সাজদায়ে সহু করে আবার আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেন।
আল্লাহ সালাহ্-কে ফরদে আইন কোরে দিয়েছেন। যদিও সালাতের মূল ও মুখ্য উদ্দেশ্য হোচ্ছে সামরিক, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ কিন্তু এতেই সালাহ্ সীমিত নয়। পেছনে বোলে এসেছি সালাতের মধ্যে শারীরিক, চারিত্রিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আল্লাহ রেখে দিয়েছেন। সালাতের সারিতে দাঁড়ানো বিশালদেহী শক্তিশালী লোকটি তার পাশে দাঁড়ানো ছোট, দুর্বল লোকটির প্রতি কোন অবজ্ঞার ভাব রাখতে পারবে না, কারণ দু’জনেই দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে যিনি দু’জনেরই স্রষ্টা, দু’জনেরই প্রভু। তাকে ভাবতে হবে, কে জানে হয়ত এই ছোট দুর্বল লোকটিই আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে প্রিয়। অনুরূপভাবে মহাপন্ডিত, আলেমের পাশে দাঁড়ানো নিরক্ষর লোকটি, কোটিপতির পাশে দাঁড়ানো দরিদ্র লোকটি, অতি সুন্দর লোকটির পাশে দাঁড়ানো বিশ্রী লোকটি, সবাই তাদের প্রভুর সামনে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়ানো, সবাই তাঁর কাছে সমান, সবাই তাঁরই উপাসক। কেউ জানেনা এদের মধ্যে কার সালাহ্ আল্লাহর কাছে বেশী প্রিয়; গ্রহণযোগ্য। সালাহ্ এই মনোভাব মুসুল্লীদের মধ্যে তৈরী করে। যদি মুসুল্লীদের মধ্যে এই মনোভাব প্রতিষ্ঠিত, কায়েম না হয় তাদের সালাহ্ ক্ষতিগ্রস্ত, তারা সালাতের পূর্ণ প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত।
একটি বিশিষ্ট চরিত্রের বহু মানুষ তৈরী করার জন্য সালাহ্ একটি ছাঁচ্ (Mould)। এই ছাঁচে ফেলে যে চরিত্র সৃষ্টি হবে তা হবে দৃঢ়, সুশৃংখল, নেতার আদেশে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাহীন, সংকল্পের কঠিনতায় তারা ইস্পাতের চেয়েও শান্ দেওয়া মরনজয়ী যোদ্ধা আর সেই সঙ্গে কোমলতায়, ব্যবহারে মাধুর্যে ভরপুর। এই কথাটাই আল্লাহ বোলছেন সুরা ফাতাহর শেষ আয়াতে। বোলছেন- মোহাম্মদ আল্লাহর রসুল; যারা তাঁর সাথে আছে তারা কাফেরদের (শত্রুর) প্রতি কঠোর, কঠিন আর নিজেদের মধ্যে তারা দয়ামায়া, সহমর্মিতায় পূর্ণ। তাদের দেখবে তারা রুকু কোরছে, সাজদা কোরছে (সালাহ্ কায়েম কোরছে)। অর্থাৎ আল্লাহ বোলছেন সঠিক ও পূর্ণভাবে যারা সালাহ্ কায়েম কোরবে তারা হবে শত্রুর (কাফের, মোশরেক) জন্য দুর্ধর্ষ, ভয়ংকর যোদ্ধা আর নিজেদের মধ্যে মায়াময়, সহমর্মী, ভাই বন্ধু। বর্ত্তমানে যে পৃথিবীময় সালাহ্ পড়া হয় এই সালাহ্ কি এ চরিত্রের মানুষ তৈরী কোরছে? অবশ্যই নয়; বরং ঠিক উল্টোটাই কোরছে। বর্ত্তমানের সালাহ্ যে চরিত্রের জাতি সৃষ্টি কোরছে তা শত্রু দেখে ভীত, শত্রুর কাছে পরাজিত, লান্ছিত, শত্রুর অবজ্ঞার পাত্র, আর নিজেদের মধ্যে হিংসা, ঈর্ষা, অনৈক্য আর বিভেদ ও সংঘর্ষে লিপ্ত। শুধু তাই নয় তারা নিজের জাতির চেয়ে শত্রুর প্রতি বেশী অনুগত, বেশী হীনমন্যতায় পূর্ণ।
শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, চারিত্রিক উন্নতির ব্যবস্থা থাকলেও সালাতের মুখ্য ও মূল উদ্দেশ্য হোচ্ছে সুশৃংখল, নেতার আদেশ পালনে আগুনে ঝাঁপ দিতে তৈরী দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় যোদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি। আমার এই বক্তব্যের প্রমাণ আল্লাহর রসুলের কয়েকটি হাদীস। তিনি বোলেছেন- ইসলাম একটি ঘর। এই ঘরের থাম, খুঁটি, স্তম্ভ হোচ্ছে সালাহ্; আর ছাদ হোচ্ছে জেহাদ [হাদীস- মুয়ায (রাঃ) থেকে আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত] মনে রাখতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কথা আমাদের কথার মত নয়। তাদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি শব্দ ভেবে, ওজন কোরে বলা। আল্লাহর রসুল ইসলামকে বেশ কয়েকটি হাদীসেই ঘরের সঙ্গে তুলনা কোরেছেন প্রকৃত ইসলাম কি তা উদাহরণ দিয়ে আমাদের বোঝাবার জন্য। ঘর মানুষ তৈরী করে কেন? অবশ্যই সেখানে থাকার জন্য, রোদ, বৃষ্টি থেকে বেঁচে ঘরের ভেতরে বসবাস করার জন্য, তাই নয় কি? রোদ-বৃষ্টি থেকে আমাদের বাঁচায় কিসে? ঘরের ভিত্তি? নাকি ঘরের থাম, খুঁটি? নাকি ছাদ? অবশ্যই ঘরের ছাদ। অর্থাৎ ঘর তৈরীর আসল উদ্দেশ্যই হোচ্ছে ছাদ তৈরী। কিন্তু থাম, খুঁটি স্তম্ভ ছাড়া ছাদকে ওপরে ধোরে রাখা যাবে না আর ঘরের ভিত্তি যদি শক্ত তওহীদের ওপর না হয় তবে তা ধ্বসে পোড়বে। কাজেই ঐ খাম, খুঁটির প্রয়োজন। ঘরের খাম, খুঁটি তৈরী কোরেও যদি ওপরে ছাদ তৈরী না করা হয় তবে সেই ঘরে বসবাস করা যাবে না। হীরা-মতি বসানো, সোনা-রূপার তৈরী খাম-খুঁটি অর্থহীন হোয়ে যাবে, আজ যেমন হোচ্ছে পৃথিবীময়। আজ থাম-খুঁটি তৈরীকেই যথেষ্ট মনে কোরে সালাহ্-ই পড়া হোচ্ছে আপ্রাণ চেষ্টা কোরে; ওপরে ছাদ তৈরী করার কথা তেরশ’ বছর আগেই ভুলে যাওয়া হোয়েছে। আজকের এই বিকৃত ইসলামের ঘরের বহু থাম, খুঁটি স্তম্ভ আছে, ছাদ নেই; ছাদ নেই বোলেই খ্রীস্টান, ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধের হাতে পরাজয়, লান্ছনা, অপমানরূপে ঝড়, বৃষ্টি, প্রখর রোদ ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ কোরে একে বসবাসের একেবারে অযোগ্য কোরে ফেলেছে। কিন্তু একশ’ পঞ্চাশ কোটির এই জাতির সে বোধ নেই। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কোটি কোটি বাকা-টেরা থাম-খুঁটি আর লক্ষ লক্ষ মসজিদ তৈরী কোরে চোলেছে।
আল্লাহর রসুলের ঐ হাদীসগুলি থেকে একথা পরিষ্কার যে সালাতের (থাম, খুঁটি, স্তম্ভের) উদ্দেশ্য হোল ছাদকে ওপরে ধোরে রাখা, জেহাদকে কার্যকরী করা। অর্থাৎ জেহাদ, যুদ্ধ কোরে জয়ী হওয়ার জন্য যে চরিত্র প্রয়োজন সেই চরিত্র সৃষ্ট করা; জেহাদের প্রশিক্ষণ। কাজেই জেহাদ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম যদি বাদ দেয়া হয় তবে সালাহ্ অর্থহীন, অপ্রয়োজনীয়; যেমন যে কোন সামরিক বাহিনী যদি যুদ্ধ করা ছেড়ে দেয় তবে তাদের প্যারেড, কুচকাওয়াজ করা যেমন অর্থহীন, যেমন ছাদ তৈরী করা না হোলে থাম, খুঁটি অর্থহীন।
ইসলামকে একটি ঘরের সঙ্গে তুলনা কোরলে বোলতে হয় ইসলাম নামক ঘরের ভিত্তি (Foundation) হোল আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদ; খাম-খুঁটি (Pillar) হোল সালাহ্, আর ছাদ (Roof) হোল জেহাদ। থাম-খুঁটির (Pillar) চেয়ে ছাদ (Roof) যে বেশী প্রয়োজনীয় তা আল্লাহর নবী বোলে গেছেন পরিষ্কার কোরে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হোল -দীনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি? তিনি জবাব দিলেন- আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ওপর ঈমান; অর্থাৎ তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। আবার জিজ্ঞাসা করা হোল- তারপর কি? তিনি উত্তর দিলেন- আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ [হাদীস- আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে মোসলেম, বোখারী]। ইসলামের ঘরের ভিত্তি যে আল্লাহর তওহীদ তা তিনি আগের হাদীসগুলিতে বলেন নি কারণ তওহীদই যে দীনের ভিত্তি তা এত প্রকট যে তা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কোরানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ একথা বহুবার বোলেছেন। তবু দীনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি অর্থাৎ ভিত্তি কি প্রশ্নে জবাবে তিনি তার জবাবে বোললেন- তওহীদ। তাহোলে দাঁড়ালো এই যে দীনুল ইসলামের ঘরের ভিত্তি আল্লাহর তওহীদ, এর থাম-খুঁটি সালাহ্ আর এর ছাদ হোল আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (ঐ তওহীদ এবং তওহীদ ভিত্তিক দীন সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য)।
আল্লাহ ইসলামের যে ঘরটি চৌদ্দশ’ বছর আগে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার ভিত্তি আল্লাহর তওহীদ আজ নেই। আল্লাহর তওহীদ হোল তার সার্বভৌমত্ব; অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, রাষ্ট্র, আইন-কানুন, দ-বিধি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প ইত্যাদি সর্ববিষয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ছাড়া আর কাউকে গ্রহণ না করা; এক কথায় যে কোন বিষয়ে, যেখানে আল্লাহর ও তাঁর রসুলের (কারণ রসুল আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন কথা বলেন নাই- সুরা নজম ৩-৪) কোন বক্তব্য আছে, নির্দেশ আছে সেখানে পৃথিবীর আর কাউকে স্বীকার না করা। এই তওহীদ আজ পৃথিবীর কোথাও নেই। মোসলেম দুনিয়া বোলে, মোসলেম রাষ্ট্র বোলে পরিচিত কোনও রাষ্ট্রেও নেই; অথচ এর নিচে কোন তওহীদও নেই, যে তওহীদ মহান আল্লাহ গ্রহণ কোরবেন। এর নিচে যা আছে, অর্থাৎ আজ মোসলেম দুনিয়ায় যা চোলছে তা শেরক ও কুফর। তারপর সেই ঘরের ছাদ জেহাদও নেই। তাহোলে রোইল কি? রোইল ঘরটার শুধু খাম-খুঁটি এবং সমস্ত জাতি বিকৃত আকীদায় ঐ খাম-খুঁটিকে অর্থাৎ সালাহ্-কে আঁকড়িয়ে ধোরে আছে। যেহেতু তওহীদের দৃঢ় ভিত্তি নেই সেহেতু ঐ খাম-খুটিগুলিও আর খাম-খুটি, স্তম্ভ নেই; ওগুলো ভঙ্গুর, ঠুনকো ও মৃদু আঘাতেই ওগুলো ধ্বসে পড়ে যায়, ওগুলো আর যোদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি কোরতে পারে না।
এই দীনের নেতারা, ওলামা, আল্লামা, ফুকাহা, মোহাদ্দেসিন, মুফাস্সেরিন এরা সবাই একমত যে আকীদা সহীহ অর্থাৎ সঠিক না হোলে ঈমানেরও কোন দাম নেই এবং স্বভাবত ঈমান ভিত্তিক সব আমল অর্থাৎ সালাহ্ (নামায), যাকাহ, হজ্ব, সওম (রোযা) এবং অন্যান্য কোন এবাদতেরই আর দাম নেই, সব অর্থহীন। তাদের এই অভিমতের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু বর্ত্তমানের এই বিকৃত ইসলামে আকীদার অর্থ করা হয় ঈমান। এটা ভুল। আকীদার প্রকৃত অর্থ হোল কোন বিষয় সম্বন্ধে সঠিক ধারণা। কোন জিনিস দিয়ে কী হয়, ওটার উদ্দেশ্য কি, ওটাকে কেন তৈরী করা হোয়েছে তা সঠিক ভাবে বোঝা (এ সম্বন্ধে আমার লেখা ইসলামের প্রকৃত আকীদা বইটি দেখুুন)। সালাহ্ সম্বন্ধে সঠিক আকীদা কি? সঠিক আকীদা পেছনে বোলে এসেছি, এখানে আবার পেশ কোরতে চাই। অত্যন্ত সংক্ষেপে সঠিক আকীদা হোল:
আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে পাঠালেন এই দায়িত্ব দিয়ে যে তিনি যেন আল্লাহর দেয়া হেদায়াহ ও সত্যদীন পৃথিবীর অন্য সব দীনের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন, এবং নিজে এই কথার সাক্ষী রোইলেন (কোরান- সুরা ফাতাহ ২৮)। এই হেদায়াতই হোল তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, সেরাতুল মুস্তাকীম; এবং সত্যদীন হোল ঐ তওহীদের ওপর ভিত্তি করা জীবন-ব্যবস্থা, শরিয়াহ, দীনুল ইসলাম, দীনুল কাইয়্যেমাহ। এই কাজের অর্থাৎ এই সত্যদীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার তরিকা, প্রক্রিয়া অর্থাৎ কোন্ নীতিতে এই কাজ করা হবে তাও আল্লাহ নির্দ্ধারিত কোরে দিলেন এবং সেটা হোল কেতাল, সশস্ত্র সংগ্রাম, যুদ্ধ। প্রশিক্ষণ ছাড়া, চরিত্র গঠন ছাড়া যুদ্ধ কোরে জয়লাভ সম্ভব নয়, খাম-খুঁটি, পিলার ছাড়া ছাদ রাখা সম্ভব নয়, কাজেই সেই চরিত্র গঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য নির্দ্ধারিত কোরে দিলেন সালাহ্ এবং এই সালাহ্-কেও ফরদে আইন অবশ্য কর্ত্তব্য, (Must) কোরে দিলেন (সুরা বনি ইসরাঈল ৭৮)।
আজ মোসলেম দুনিয়ায় সালাতের সম্বন্ধে আকীদা কি? সালাহ্ চরিত্র গঠনের মুখ্যত দুর্ধর্ষ, অপরাজেয় যোদ্ধার চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া; এই আকীদা বদলে একে অন্যান্য ধর্মের মত এবাদতের, উপাসনার শুধু আত্মিক উন্নতির প্রক্রিয়া বোলে মনে করার ফলে আজ সেই যোদ্ধার চরিত্র গঠন তো হয়ই না এমন কি সালাতের বাহ্যিক চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। আল্লাহর রসুলের বহুবারের দেওয়া তাগীদ- সাবধান বাণী- তোমাদের সালাতের লাইন ধনুকের ছিলার মত সোজা কর, নাহোলে আল্লাহ তোমাদের মুখ পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেবেন, তাঁর আদেশ- তোমাদের মেরুদ-, ঘাড় সোজা কোরে সালাতে দাঁড়াও এ সমস্ত কিছুই আজ ভুলে যাওয়া হোয়েছে। এসব হুকুম না মুসুল্লীদের মনে আছে, না এমামদের মনে আছে। কাজেই ঐ সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের সালাহ্ আজ নুব্জ, বাকা লাইনের; বাঁকা পিঠের মুসুল্লী ও এমামদের মরা সালাহ্। আল্লাহ কোরআনে সুরা নেসার ১৪১-১৪২ নং আয়াতে মোনাফেকদের সালাতের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন- মোনাফেকরা শৈথিল্যের সাথে সালাতে দাঁড়ায়। আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘কুসালা’ যার অর্থ সাহস হারিয়ে ফেলা, অলসতা, ঢিলা-ঢালা ভাবে। বর্ত্তমান বিশ্বের মোসলেম নামের এ জাতির সালাতের দিকে তাকালে কুসালা শব্দের অর্থ বুঝতে কারও কষ্ট হবে না। খুশু, খুজুর নামে এ জাতি ‘কুসালা’ শব্দের যথাযথ প্রয়োগ কোরছে। সমস্ত বিশ্বে বর্ত্তমানে এই সাহসহীন সালাহ্-ই চলছে। এই মরা প্রাণহীন সালাতের পক্ষে বলা হয়- খুশু-খুজুর সাথে নামায পড়া উচিত। এই খুশু-খুজু কী? বর্ত্তমানে বলা হয় সমস্ত কিছু থেকে মন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন কোরে আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা হোচ্ছে খুশু-খুজু; অর্থাৎ এক কথায় ধ্যান করা।
প্রশ্ন হোচ্ছে, সালাতে আল্লাহকে ধ্যান করাই যদি উদ্দেশ্য হোয়ে থাকে তবে আল্লাহ সালাতের প্রক্রিয়া, নিয়ম-কানুন এমন কোরে দিলেন কেন যাতে ধ্যান করা অসম্ভব। খুশু-খুজুু অর্থাৎ ধ্যান করাই আল্লাহর উদ্দেশ্য হোলে সালাতের নিয়ম হতো পাহাড়-পর্বতের গুহায়, কিম্বা খানকা বা হুজরায় অথবা অন্ততপক্ষে কোন নির্জন স্থানে ধীর-স্থিরভাবে একাকি বোসে চোখ বন্ধ কোরে মন নিবিষ্ট কোরে আল্লাহর ধ্যান করা। সালাহ্ কি তাই? অবশ্যই নয়, সালাহ্ এর ঠিক উলটো। বহু জনসমাবেশের মধ্যে যেয়ে সেখানে ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন কোরে দাঁড়িয়ে সৈনিকের, যোদ্ধার মত ঘাড়, মেরুদ- লোহার রডের মত সোজা কোরে, এমামের তকবিরের (আদেশের) অপেক্ষায় সতর্ক, তটস্থ, থাকা তারপর তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রে রুকু, সাজদায় যাওয়া, ওঠা, সালাম দেয়া অর্থাৎ এমামের (নেতার) আদেশ পালন করা। সালাতের প্রায় ১১৪ টি নিয়ম-পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য রেখে, সেগুলি যথাযথভাবে পালন কোরে ঐ খুশু-খুজুর সাথে অর্থাৎ ধ্যানের সাথে সালাহ্ সম্পাদন করা যে অসম্ভব তা সাধারণ জ্ঞানেই (Common sense) বোঝা যায়। অথচ ঐ নিয়ম-পদ্ধতি সঠিক ভাবে, যথাযথ ভাবে পালন না কোরে যেমন-তেমন ভাবে সালাহ্ পড়লে তা আল্লাহ গ্রহণ কোরবেন না। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- তোমরা পূর্ণভাবে সালাহ্ কায়েম করো, কেননা আল্লাহ পূর্ণ ব্যতিত সালাহ্ কবুল করেন না [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে]। তিনি আরও বোলেছেন- তোমাদের কাহারও সালাহ্ পূর্ণ (সঠিক) হবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ যেভাবে আদেশ কোরেছেন ঠিক সেইভাবে কায়েম কোরবে (আবু দাউদ)। আল্লাহ-রসুলের আদেশ মোতাবেক সমস্ত নিয়ম-কানুন যথাযথ পালন কোরে অর্থাৎ পূর্ণ সঠিকভাবে সালাহ্ কায়েম কোরলে ঐ খুশু-খুজু, অর্থাৎ বর্ত্তমানে মুসুল্লীরা খুশু-খুজু বোলতে যা বুঝেন তা অসম্ভব। খুশু-খুজুর প্রকৃত উদ্দেশ্য হোচ্ছে- মো’মেন যখন সালাতে দাঁড়াবে তখন তার মন পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হোয়ে একাগ্র হবে সালাতে; সে সমস্ত ক্ষণ সচেতন থাকবে যে সে মহামহীম আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আল্লাহর বিরাটত্ব ও তার নিজের ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে সে থাকবে সর্বদা সচেতন, আর সেই সঙ্গে একাগ্র হোয়ে থাকবে এমামের (নেতার) তকবিরের (আদেশের) প্রতি, সালাহ্ সঠিকভাবে, নিখুঁতভাবে সম্পাদন কোরতে। এই হোল খুশু-খুজু।
কিন্তু এই খুশু-খুজু অর্থাৎ একাগ্রতার মানে এই নয় যে সালাতে দাঁড়াবে নুব্জ, সম্মুখে ঝুকে, মাথা নত কোরে। কারণ যিনি আমাদের সালাহ্ শিখিয়েছেন আল্লাহর রসুল তিনি আদেশ কোরেছেন- সালাতে দাঁড়াবে সোজা হোয়ে, মেরুদ-, ঘাড় সোজা শক্ত কোরে (সৈনিকের মত)। আল্লাহ কোরানে বোলছেন- সালাহ্ কায়েম কর আনুগত্যের সাথে (কোরান- সুরা বাকারা ২৩৮), আল্লাহ আবার বোলছেন সালাহ্ কায়েম কর বিনয়ের সাথে (কোরান- সুরা মু’মিনুন ২)। তাঁর রসুুল বোলছেন- সোজা, শক্ত, দৃঢ় ভাবে সালাতে দাঁড়াও। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না কি যে দু’টি আদেশ বিপরীতমুখী? না, মোটেই বিপরীতমুখী নয়; আল্লাহর ও তার রসুলের কথা বিপরীত হোতে পারে না। একটা মানসিক আর অন্যটা দৈহিক। সালাতে মন থাকবে বিনয়ী, নম্র, অনুগত আর দেহ থাকবে লোহার রডের মত দৃঢ়, ঋজু; রুকুতে সাজদায় যেয়েও পিঠ ঘাড় হাত, পা থাকবে সোজা, শক্ত; বিচলন, গতি হবে দ্রুত। এই দুই মিলিয়ে হবে ইসলামের প্রকৃত সালাহ্। মো’মেন যখন সালাতে দাঁড়াবে তখন তার মনের অবস্থা হবে এই রকম যে সে সর্বক্ষণ সচেতন থাকবে যে সে এই বিশাল বিরাট সৃষ্টির স্রষ্টার রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়িয়েছে। কেন দাঁড়িয়েছে? দাঁড়িয়েছে এই জন্য যে সে ঐ মহান স্রষ্টার খলিফা, প্রতিনিধি, এবং খলিফা হিসাবে তার সর্বপ্রধান দায়িত্ব হোচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক দীন, জীবন-ব্যবস্থা কার্যকরী কোরে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, অশান্তি আর রক্তপাত দূর কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। ঐ বিশাল দায়িত্ব পূর্ণ কোরতে গেলে যে চরিত্র প্রয়োজন, যে চরিত্রে সংকল্পের দৃঢ়তা, ঐক্য, শৃংখলা, আনুগত্যের ও হেজরতের সমাহার সেই চরিত্র সৃষ্টির জন্য সে সালাতে দাঁড়িয়েছে। মনের ভেতরে তার থাকবে বিনয়, সসম্মান-ভক্তি (যারা বিনয়-নম্র নিজেদের সালাতে, সুরা মো’মেনুন- ২) আর শারীরিক ভাবে সে দাঁড়াবে আল্লাহর মোজাহেদ (যোদ্ধা), সৈনিকের মত দৃঢ়, লোহার রডের মত সোজা হোয়ে, তটস্থ হোয়ে থাকবে এমামের আদেশের (তকবিরের) অপেক্ষায় এবং আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রে হোয়ে একসঙ্গে দ্রুত সে আদেশ পালন কোরবে (কানেতিন- অনুগত, সুরা বাকারা ২৩৮)। এই হোচ্ছে ইসলামের প্রকৃত সালাহ্। ইসলামের সালাহ্ যে অন্যান্য ধর্মের ধ্যান নয় তার প্রমাণ সালাতের পুরো প্রক্রিয়াটাই। তার মধ্যে বিশেষ কোরে এই নিয়মটি যে সালাতে চোখ বন্ধ করা যাবে না। ধ্যান করতে গেলে তো বটেই, এমন কি কোন বিষয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা কোরতে গেলেও মানুষের চোখ বন্ধ হোয়ে আসে। সেই চোখ বন্ধ করাকে নিষিদ্ধ করার মানে এই নয় কি যে সালাতে ধ্যান করার যায়গা নেই, আছে সজাগতা, অতন্দ্র সতর্কতা?
সালাহ্ শুধু যে ধ্যান নয়, প্রকৃতপক্ষে ধ্যানের ঠিক বিপরীত তার পক্ষে কয়েকটি কারণ পেশ কোরছি। ১) সালাহ্ শব্দের আভিধানিক অর্থ হোচ্ছে কোন বাঁকা-টেরা পদার্থ, জিনিসকে আগুনে পুড়িয়ে, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোন কাজের জিনিস তৈরী করা; আর ধ্যান হোচ্ছে নিষ্ক্রিয় হোয়ে গভীর চিন্তা করা। ২) সালাহ্ গতিশীল (উুহধসরপ); ধ্যান স্থবির (ঝঃধঃরপ)। ৩) তাকবিরের (ঈড়সসধহফ) আনুগত্য কোরতে হয়; ধ্যানে ঈড়সসধহফ এর কোন স্থানই নেই। ৪) দলবদ্ধভাবে কায়েম কোরতে হয়; ধ্যান একা একা কোরতে হয়। ৫) সালাতে সচেতন ও সতর্ক অবস্থায় থাকতে (অষবৎঃ) হয়; ধ্যানে ঠিক বিপরীত নিথর হোয়ে যেতে হয়। ৬) সালাহ্ ঠিক মত কায়েম কোরতে হোলে ১০০টির বেশী নিয়ম কানুন মনে রেখে তা পালন কোরতে হয়; ধ্যানে কোন নিয়ম কানুন নেই। ৭) সালাতে চোখ বন্ধ রাখা যাবে না; চোখ বন্ধ না কোরে ধ্যান প্রায় অসম্ভব। ৮) সালাহ্ সক্রিয় (অপঃরাব); ধ্যান নিষ্ক্রিয় (ওহধপঃরাব)।
যদি কাউকে বলা হয় তুমি দৌঁড়াবে আর সেই সঙ্গে ধ্যান কোরবে তাহোলে ব্যাপরটা কি রকম হবে? এটা যেমন হাস্যকর তেমনি হাস্যকর কাউকে বলা যে তুমি সালাহ্ কায়েম কোরবে এবং সেই সঙ্গে ধ্যানও কোরবে। কারণ দৌঁড়াবার সময় যেমন চোখ খোলা রেখে, কোথায় পা ফেলছে তা দেখে, রাস্তা দেখে দৌঁড়াতে হবে তখন ধ্যান অসম্ভব, তেমনি সালাতের সময়ও সালাতের বহু নিয়ম কানুন মনে রেখে, রাকাতের হিসাব রেখে সেগুলি পালন করার সাথে ধ্যান করাও অসম্ভব। সুতরাং সালাহ্ ও ধ্যান বিপরীতমুখী একত্রে অসম্ভব। অথচ সালাহ্ সম্বন্ধে আকীদার বিকৃতিতে একে অন্যান্য ধর্মের উপাসনার সাথে এক করার চেষ্টায় এই অসম্ভব আকীদাই আজ মোসলেম হবার দাবীবার এই জনসংখ্যার আকীদা। সালাহ্র উদ্দেশ্য কি, এ ব্যাপারে আকীদার বিকৃতির পর থেকে গত কয়েক শতাব্দী থেকে মোসলেম নামের এই জনসংখ্যাটি দৌঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যান করার আপ্রাণ চেষ্টা কোরছে এবং ফলে তাদের না দৌঁড় হোচ্ছে না ধ্যান করা হোচ্ছে।
যারা আল্লাহর রসুলের পদতলে বোসে ইসলাম শিখেছিলেন এবং তাঁর হাতে বায়াত নেবার পর বহু বছর তার সঙ্গে দিনে পাঁচবার সালাহ্ কায়েম কোরেছেন তাদের অন্যতম এবং দ্বিতীয় খলীফা ওমর (রাঃ) বিন খাত্তাবের আকীদায় সালাহ্ কী ছিলো? একদিন মো’মেন মোজাহেদদের সালাহ্ পর্যবেক্ষণ করার সময় তিনি দেখলেন একজন ঠিকই দৃঢ় এবং সোজাভাবে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু তার মাথাটা খানিকটা সামনের দিকে ঝোঁকানো। ওমর (রাঃ) ঐ মোজাহিদের মাথা ধোরে উঁচু, সোজা কোরে দিলেন এবং তারপর তার মাথায় মৃদু আঘাত কোরে বোললেন খুশু এখানে নয়, বোলে তার বুকে আংগুল রেখে বোললেন- খুশু এখানে।
সামরিক বাহিনীর প্যারেডের সঙ্গে সালাতের মিল শুধু এটুকুই নয় আরও আছে। আল্লাহ কোরানে আদেশ কোরেছেন যে তোমরা সর্বদা মস্জীদে যেতে উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ পরে যাবে (কোরান সুরা আরাফ আয়াত ৩১)। শব্দ ব্যবহার কোরেছেন ‘যিনত’, যার অর্থ জাক-জমকপূর্ণ, চাকচিক্যময়। যিনত অর্থ অলংকারও (কোরান সুরা নুর আয়াত ৩১)। মস্জীদে যে সব কারণে যেতে হয় তার মধ্যে মুখ্য কারণ সালাহ্ কায়েম করা। অর্থাৎ আল্লাহ আদেশ কোরেছেন সালাতে দাঁড়াতে তোমরা জাক-জমকপূর্ণ কাপড়-চোপড়, পরিচ্ছদ পোরে নেবে। প্রশ্ন হোচ্ছে এবাদত করার জন্য, আল্লাহর সামনে বিনীত, বিনয়-নম্র হোয়ে দাঁড়াবার জন্য অমন সাজ-সজ্জা করার আদেশ কেন?
যে কারণে একটি সামরিক বাহিনীর প্যারেড, কুচকাওয়াজ করার সময় তাদের পোশাক পরিচ্ছদ অর্থাৎ ইউনিফর্ম একই রকম, ইস্ত্রি করা পরিষ্কার হওয়া বাধ্যতামূলক, ঠিক সেই কারণেই মস্জীদে সালাতের সময় জাক-জমকপূর্ণ পোশাক পরার জন্য আল্লাহর এই হুকুম। বর্ত্তমানে সামরিক বাহিনীগুলি জাতির মধ্যে থেকে বেছে বেছে লোক নিয়ে গঠন করা হয়, কাজেই তাদের জন্য একই রকম পোশাক অর্থাৎ ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হয়। কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদী সম্পূর্ণ জাতিটাই একটা সামরিক বাহিনী; যে কথা পেছনে বোলে এসেছি। এর পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব সৈনিক, প্রত্যেকে মোজাহেদ। এদের সবাইকে একই পোশাক পরার আদেশ দেওয়া বাস্তব সম্মত নয়। তাই আল্লাহ তা না দিয়ে যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব উত্তম, জাক-জমকপূর্ণ পোশাক পরে সালাতের, মো’মেনদের কুচকাওয়াজ করার আদেশ দিয়েছেন।
সালাতের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আকীদা আজ বিকৃত হোয়ে যাওয়ার ফলে এ জাতির লোকেরা যেমন আঁকাবাঁকা লাইনে মাথা নিচু কোরে; নুব্জ হোয়ে দাঁড়িয়ে যেন-তেন ভাবে সালাতের অনুষ্ঠান করে, তেমনি একই কারণে সাধারণ বাজে কাপড় পরে সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। এরাই আবার বিয়ে-সাদী এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে তাদের সবচেয়ে ভালো পোশাক পরিচ্ছদ পরে। আল্লাহর রসুলের সময় উম্মতে মোহাম্মদী যে সালাতের পোশাক সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ আমরা পাই হাদীসে রাসুলে। আল্লাহর রসুল বোলেছেন সামর্থ্য থাকলে তোমরা জুমার সালাতের জন্য একজোড়া আলাদা কাপড় রাখবে, কাজের কাপড় ব্যাতিত [আবদুল্লাহ বিন সালিম (রাঃ) থেকে ইবনে মাজাহ, মেশকাত]। তিনি আরও হুকুম কোরেছেন তোমরা সালাহ্ কায়েম করতে অবশ্যই দু’টো কাপড় পরিধান কোরবে (ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে এমাম তাহাভী, মেশকাত)। এক ব্যক্তি আল্লাহর রসুলের কাছে এসে একটি কাপড় পরে সালাহ্ কায়েম করা বিষয়ে জিজ্ঞাসা কোরলে তিনি বোললেন তোমাদের প্রত্যেকের কি দু’টো কোরে কাপড় রাখার সামর্থ্য আছে? [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বোখারী]। অর্থাৎ যাদের দু’টো কাপড় রাখার সামর্থ্য আছে তারা যেন দু’টো কাপড় রাখে এবং ঐ বিশেষ কাপড় পোরে সালাহ্ কায়েম করে।
১. একদা হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) পুরাতন কম্বলে শরীর আবৃত কোরে পথে বের হোলে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা কোরলো, এই ছেড়া কম্বলটি ছাড়া আপনার কি আর কোন পোশাক ছিল না? তিনি জবাব দিলেন, থাকলে অবশ্যই তুমি তা আমার পরিধানে দেখতে পেতে। লোকটি বললো- তা কি কোরে হয়, মাত্র দুই/তিন দিন আগেই আমি আপনার পরনে অতি উত্তম এক জোড়া পোশাক দেখেছি। আবু যর (রাঃ) বোললেন, সেটা আমি একজন অভাবী লোককে দিয়ে দিয়েছি। লোকটি মন্তব্য কোরলো, আল্লাহর শপথ! এই দুনিয়ার বুকে আপনার চাইতে অভাবী কোন লোক থাকতে পারে বোলে আমার ধারণা ছিল না। হযরত আবু যর (রাঃ) জবাব দিলেন, হতভাগা! আমার শরীরেতো একটি কম্বল আছে, সেই লোকটির হয়তো তাও ছিল না। শুন, এই পোশাকটির অতিরিক্ত সালাহ্ কায়েম করার মত একটি ‘আবা’ও আমার ঘরে রক্ষিত আছে। আমার কয়েকটি ছাগী আছে, যেগুলি দুধ দেয়। বাহনের জন্য একটি গাধা আছে। কাজকর্ম কোরবার মত একটি বাঁদী আছে। এরপরেও কি আমি অভাবী? আমার তো ভয় হয়, কেয়ামতের দিন এই সম্পদরাশির হিসাব দিতে গিয়েই আমি না অপারগ হয়ে পড়ি। [বিপ্লবী সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ)- মুহিউদ্দিন খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ]।
২. মহানবী (সাঃ) বোলেছেন- তোমাদের কাহারও পক্ষে ইহা আপত্তির বিষয় নয় যে, যদি তাহার সামর্থ্য থাকে জুমার দিনের জন্য একজোড়া পৃথক কাপড় রাখবে কাজের কাপড় ব্যতিত [আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) থেকে ইবনে মাজাহ, মেশকাত]।
৩. এক ব্যক্তি রাসুল (রাঃ) এর কাছে এসে একটি কাপড় পরে সালাহ্ কায়েম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কোরলো। রাসুলুল্লাহ বোললেন, তোমাদের প্রক্যেকের কি দু’টো কোরে কাপড় রাখার সামর্থ্য আছে? [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে- বোখারী]
হাদীস গুলোতে দু’টো কাপড় রাখার অর্থ হোচ্ছে নবী করিমের সময় আরবদের আর্থিক অবস্থা ছিলো অতি করুণ। সমস্ত পৃথিবীতে এত দরিদ্র আর কোন জনসমষ্টি ছিলো কিনা সন্দেহ। অধিকাংশ লোকেরই পরিধানে থাকতো একটি কাপড় কম্বল বা চাদর মাত্র যা দিয়ে তারা শরীরের ঊর্দ্ধাংশ ও নিম্নাংশ আংশিক ভাবে ঢেকে রাখতেন। শরীরের উর্দ্ধাংশ ও নিম্নাংশের জন্য আলাদা আলাদা কাপড় পরা সম্ভব ছিলো শুধু আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছলদের পক্ষে। এজন্যই রসুলুল্লাহ আদেশ কোরেছেন যাদের জন্য সম্ভব তারা যেন দু’টো কাপড়, অর্থাৎ উর্দ্ধাঙ্গের জন্য একটি ও নিম্নাঙ্গের জন্য আরেকটি কাপড় সালাতের সময় পরে নেয়, অর্থাৎ যে যতখানি পারে ‘যিনত’ সাজ-সজ্জা, জাক-জমক প্রকাশ করে। পরে যখন উম্মতে মোহাম্মদী জেহাদ ও কেতালের (সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের) মাধ্যমে অর্দ্ধেক পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করে তখন আরবের ঐ চরম দারিদ্র্য শেষ হোয়ে প্রাচুর্যে ভরে যায় এবং তখন আল্লাহর আদেশ সালাতে ‘যিনত’ প্রদর্শন পুরোপুরি অর্থবহ হয়।
প্রকৃত তওহীদ ও জেহাদ অর্থাৎ মো’মেন হবার আল্লাহর দেয়া সংজ্ঞা (সুরা হুজরাত- ১৫) থেকে বিচ্যুত, আল্লাহর অভিশপ্ত (লা’নত প্রাপ্ত) এই জাতিকে সালাতের উদ্দেশ্য বোঝাবার চেষ্টায় ইতিহাস (তা’রিখ) ও হাদীস থেকে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাঃ) বিন খাত্তাবের উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি চাবুক হাতে মুসুল্লীদের লাইনের মধ্য দিয়ে হাটতেন এবং কাউকে ধনুকের ছিলার মত সোজা লাইন থেকে বা অন্য কোন বিচ্যুতি দেখলে এবং চাবুক দিয়ে আঘাত করতেন। যারা সালাহ্, তাদের ভাষায় নামাযের উদ্দেশ্য ধ্যান করা মনে করেন (এবং এই আকীদাই মোসলেম দুনিয়ায় আজ সর্বব্যাপী), তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- চাবুক মেরে কি মানুষকে ধ্যান করানো যায়? ওমরের (রাঃ) কাজ কি সৈন্য বাহিনীর প্যারেডের সার্জেন্ট মেজরের (ঝবৎলবধহঃ গধলড়ৎ) কাজের সাথে মিলে না, যে প্যারেডের প্রশিক্ষণে ভুল ত্রুটি হোলে গালি দেয়, পিটায়? আর প্রথম সারির আসহাব, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা জানতেন না সালাহ্ ধ্যান করার জন্য নাকি সামরিক প্রশিক্ষণ? আল্লাহর লা’নতের ফলে এ জাতির সাধারণ জ্ঞান (ঈড়সসড়হ ংবহংব) পর্যন্ত লোপ পেয়েছে।
আল্লাহ কোরানের সর্বত্র আদেশ কোরেছেন, মো’মেনদের আদেশ কোরেছেন, সালাহ্ কায়েম কর, কোথাও বলেননি সালাহ্ পড় বা সালাহ্ আদায় কর। আল্লাহ সালাহ্ কায়েম করতে কেন বোলেছেন এ নিয়ে আলেম, মুফাস্সিরদের মধ্যে বহু আলোচনা, ব্যাখ্যা হোয়েছে। বেশীর ভাগের ব্যাখ্যা হোচ্ছে- খুব নিয়মিত এবং সময় মত, সালাহ্ পড়া, কোন কাজা না করা। এ ব্যাখ্যা ভুল, কারণ কোন কাজা না কোরে নিয়মিত, এবং সময়মত সালাহ্ পড়েও সালাহ্ কায়েম নাও হোতে পারে। কায়েম শব্দের অর্থ প্রতিষ্ঠা; চিরদিনের জন্য, স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা। সালাহ্ কায়েম করার অর্থ সালাহ্ যা শেখায় যে গুণগুলি তৈরী করে তা মুসুল্লীর চরিত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা; স্থায়ীভাবে গেঁড়ে দেয়া। সালাহ্ যদি মুসুল্লীর চরিত্রে ঐ গুণগুলি তৈরী না করে তবে সারা জীবনে এক ওয়াক্ত সালাহ্ কাজা না কোরলেও সে মুসুল্লীর সালাহ্ কায়েম করা হবে না। প্রশ্ন হোচ্ছে, সালাহ্ কি কি রকম গুণ (Attributes, Quality) তৈরী করে? এর সম্পূর্ণ তালিকা, আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়; কোন মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়, এ সম্ভব শুধু আল্লাহর পক্ষে এবং সম্ভবত আল্লাহর রসুলের পক্ষে। তবে আমি শুধু এইটুকু বোলতে পারি যে দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক, সমস্ত রকমের গুণের অর্জন ও উন্নতির প্রক্রিয়া এই সালাহ্ যদি তা সঠিক আকীদার সঙ্গে এবং সঠিক ভাবে কায়েম করা হয়। তবে এর প্রথম ও সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হোল সেই সব গুণ অর্জন করা যে সব গুণ চরিত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হোলে মো’মেনের ওপর ঈমানের পরই দ্বিতীয় যে দায়িত্ব, যে দায়িত্ব মো’মেন হবার সংজ্ঞার মধ্যেই আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন, [মো’মেন শুধু তারা যারা আল্লাহ ও রসুলের ওপর ঈমান এনেছে তারপর আর কোন সন্দেহ করে না এবং তাদের প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে জেহাদ করে (ঐ তওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য) (কোরান- সুরা হুজরাত ১৫)] অর্থাৎ জেহাদ করা সম্ভব নয়। সে গুণগুলি হোল- ঐক্য, শৃংখলা, এতায়াত (আদেশ পালন) ও হেজরত। এই সামরিক গুণগুলি অর্জনই সালাতের প্রাথমিক উদ্দেশ্য, তার কারণ পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ জেহাদ ও কেতালকে (সশস্ত্র যুদ্ধ) নীতি হিসাবে নির্দ্ধারণ কোরেছেন। ঐ প্রাথমিক গুণগুলি অর্জন ও মুসুল্লীর চরিত্রের মধ্যে তা প্রতিষ্ঠার পর অন্যান্য গুণাবলিও ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই আকীদার সঙ্গে এবং আল্লাহ-রসুল যে ভাবে যে নিয়ম নির্দ্ধারিত কোরে দিয়েছেন ঠিক সেইভাবে আজ পৃথিবীতে সালাহ্ সম্পাদন হয় না বোলেই সালাতের কোন ফল নেই। যে সালাহ্ মুসুল্লীদের চরিত্রে ইস্পাতের মত কঠিন ঐক্য সৃষ্টি করে না, পিঁপড়ার মত শৃংখলা, মালায়েকদের মত আদেশ পালন, আনুগত্য সৃষ্টি করে না, আল্লাহর বিরুদ্ধে যা কিছু আছে সে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, হেজরত করায় না, শাহাদাতের জন্য আকুল আকাঙ্খা জন্মায় না, শত্রুর প্রাণে ত্রাস সৃষ্টিকারী দুর্ধর্ষ মোজাহেদ, যোদ্ধার চরিত্র সৃষ্টি করে না, সে সালাহ্ অর্থহীন, সে সালাতের আনুষ্ঠানিকতা করা না করা সমান।
আল্লাহ মো’মেনদের আদেশ কোরছেন- তোমরা সালাহ্ ও সবরের সাথে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো (বাকারা ১৫৩)। আদেশটি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। এ আদেশের অর্থ বুঝতে গেলে সালাতের সঙ্গে সবরের অর্থও বুঝতে হবে। বর্ত্তমানের বিকৃত ইসলামের ভুল আকীদায় সবরের অর্থ ধৈর্য, সহ্য করা ইত্যাদি। সবর শব্দটি শুনলেই মনে যে আকীদাটা উদয় হয় তা জড়, অসাড়, নিষ্ক্রিয় (চধংংরাব)। অর্থাৎ সবর করা মানে নিষ্ক্রিয়, জড় হোয়ে সব অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার সহ্য করা, কিছু না করা, এমনকি অনেকের কাছে প্রতিবাদ পর্যন্ত না করা। সবর শব্দের প্রকৃত অর্থ, যে অর্থে আল্লাহ তাঁর কোরানে এবং রসুল তাঁর হাদীস ব্যবহার কোরেছেন তা বর্ত্তমানের এই অর্থের ঠিক বিপরীত। প্রচন্ড গতিশীল (উুহধসরপ) ইসলামকেই যেমন আকীদার বিকৃতিতে স্থবির (ঝঃধঃরপ) কোরে ফেলা হোয়েছে তেমনি সবর শব্দের অর্থকেও নিষ্ক্রিয় অর্থে নেয়া হোচ্ছে। সবর শব্দের অর্থ বাংলায় বোঝাতে গেলে বোলতে হয় ‘সংকল্পের দৃঢ়তা’ ইংরাজীতে উবঃবৎসরহবফ চবৎংবাবৎধহপব; কোন উদ্দেশ্য অর্জন কোরতে দৃঢ়ভাবে সমস্ত কিছু সহ্য করা। যত বাধা আসুক, যত বিপদ-আপদ আসুক, যত কষ্ট হোক, বিন্দুমাত্র নিরাশ বা হতাশ না হোয়ে পর্বতের মত অটল থেকে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। জেহাদে, যুদ্ধে এই সবর অবলম্বনেরই আদেশ দিয়েছেন আল্লাহ তাঁর কোরানে এবং বোলেছেন আমি স্বয়ং সাবেরদের (সবর অবলম্বনকারীদের) সাথে আছি (কোরান- সুরা বাকারা ১৫৩)।
এখন একটু চিন্তা কোরলেই বোঝা যাবে আল্লাহ সালাতের এবং সবরের সঙ্গে তাঁর কাছে দোয়া কোরতে বোলছেন কেন? তিনি সালাহ্ ও যাকাতের সঙ্গে, সালাহ্ ও হজের সঙ্গে, সালাহ্ ও সওমের (রোযা) সঙ্গে, কোন কিছুর সাথেই না বোলে সালাহ্ ও সবরের সাথে বোলেছেন কেন? সালাহ্ মো’মেনের চরিত্রের মধ্যে যে অসংখ্য গুণ সৃষ্টি করে তার মধ্যে শুধু প্রাথমিক যে কয়টি, অর্থাৎ ঐক্য, শৃংখলা, আনুগত্য ও হেজরত এই কয়টির সঙ্গে যদি সবরের গুণগুলি অর্থাৎ সংকল্পের দৃঢ়তা, প্রাণ থাকতে নিরাশ, হতাশ, নিরুদ্যম না হোয়ে অটল থেকে পূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি যোগ করা হয় তবে কি দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই যে ব্যক্তি হোক, পরিবার হোক, গোত্র হোক, জাতি হোক যাই হোক, সালাতের সৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী হোয়ে সবরের সঙ্গে সংগ্রাম প্রচেষ্টা কোরলে সে বা তারা অজেয়, অপরাজিত হোয়ে যায়, সফলতা বিজয় তাদের জন্য অবধারিত হোয়ে যায়। তাই আল্লাহ আদেশ কোরেছেন শুধু সালাতের সঙ্গে নয় সালাতের সঙ্গে সবরেরও। আরও বোলেছেন- নিরাশ হোয়ো না, নিরুদ্যম হয়োনা বিজয়ী তোমরা হবেই, যদি তোমরা মো’মেন হও (সুরা আল এমরান- ১৩৯)। অর্থাৎ আমরা যদি সত্যই মো’মেন হই তবে বিজয়ী আমরা হবই এটা আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি।
বর্ত্তমানে মো’মেন বোলে পরিচিত ১৫০ কোটির এই জাতিটি পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জাতির কাছে প্রত্যেক ব্যাপারে পরাজিত, তাদের দ্বারা লান্ছিত, অপমানিত, তাদের দ্বারা নিহত, এদের মেয়েরা তাদের দ্বারা গণধর্ষিতা। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে আল্লাহর কথা যদি সত্য হোয়ে থাকে তবে এই জাতি মো’মেন নয় এবং মো’মেন না হওয়ার অর্থ অবশ্যম্ভাবী মোশরেক, কাফের হওয়া; এবং আল্লাহ অঙ্গীকার কোরেছেন যে তিনি মোশরেক ও কাফেরদের মাফ কোরবেন না (সুরা নেসা- ৪৮, ১১৬, সুরা কাহফ- ১০২, ১০৫, ১০৬)। এই দুনিয়াতে তিনি যেমন মাফ কোরছেন না, অন্যান্য জাতিগুলি দিয়ে নিষ্পেষিত কোরে কঠিন শাস্তি দিচ্ছেন, ঐ দুনিয়াতে এই জাতিকে এর চেয়ে কঠিন শাস্তি দেবেন। আর যদি বর্ত্তমানের মোসলেম বোলে পরিচিত জনসংখ্যাটি তাদের দাবী মোতাবেক মো’মেন হোয়ে থাকে তবে আল্লাহ মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন (নাউজুবেল্লাহ)।
বিকৃত আকীদায় বর্ত্তমানের বিপরীতমুখী ইসলামে সালাহ্কে অন্যান্য ধর্মের উপাসনা, পূজা হিসাবে নেয়ার ফলে আজ এটা আল্লাহর-রসুলের শেখানো সালাহ্ থেকে বিচ্যুত, সুতরাং সালাতের উপকার থেকে বঞ্চিত। সালাহ্ যে ধ্যান, আল্লাহর প্রতি নিবিষ্টতা তা প্রমাণ কোরতে একটা হাদীস উপস্থাপন করা হয়। সেটা হোল- একবার এক যুদ্ধে আলীর (রাঃ) পায়ে একটি তীর বিঁধে যায়। লোকেরা যখন তীরটি টেনে বের করার চেষ্টা করলো তখন তিনি তীব্র ব্যাথায় তাদের তীরটি খুলতে দিলেন না। অথচ তীরটি তার পা থেকে না খুললেই নয়, তাই তারা বিশ্বনবীর কাছে যেয়ে ব্যাপারটা বোললেন। আল্লাহর রসুল শুনে বোললেন- আলী যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন তোমরা তীরটি বের কোরে নিও। এরপর আলী (রাঃ) যখন সালাতে দাঁড়ালেন তখন তার পা থেকে তীরটি টেনে বের কোরে নেয়া হোল, তিনি নড়লেন না, টু শব্দটিও কোরলেন না।
এই ঘটনাকে বর্ত্তমানের বিকৃত আকীদায় নেয়া হয় এইভাবে যে সালাতে দাঁড়ানো অবস্থায় আলী (রাঃ) আল্লাহর চিন্তায় এমন বিভোর হোয়ে যেতেন যে তার বাহ্যজ্ঞান থাকতো না, দুনিয়ায়, চারপাশে কি হোচ্ছে না হোচ্ছে তার তিনি কিছুই জানতেন না, এমন কি যে তীর টেনে বের করার চেষ্টায় তার অসহ্য ব্যাথা লাগতো সে তীর টেনে বের করার ব্যাথাও তিনি অনুভব কোরলেন না। প্রশ্ন হোচ্ছে- সালাতে যদি আলীর (রাঃ) ঐ অবস্থা হয় তাহোলে তিনি এমামের তকবীর শুনতেন কেমন কোরে, সেই তকবীর শুনে রুকু-সাজদায় যেতেন কেমন কোরে, সালাতের একশ’র বেশী নিয়ম-কানুন মোতাবেক সালাহ্ কায়েম কোরতেন কি ভাবে, কয় রাকাত পড়লেন তা মনে রাখতেন কি ভাবে? ধ্যান-মগ্ন হোয়ে বাহ্যজ্ঞানহীন হোয়ে এমন কি শারীরিক ব্যাথা-যন্ত্রণা পর্যন্ত লোপ পেয়ে সালাহ্ কায়েম কি সম্ভব? সামান্য সাধারণ জ্ঞান যার আছে তিনিই বুঝবেন- অসম্ভব। অথচ ঘটনা সম্পূর্ণ সত্য [হযরত আলী- আবুল ফজল, পৃষ্ঠা- ১৩২, চার খলিফার জীবন কথা- আব্দুল আজীজ আল নোমান, পৃষ্ঠা- ১০৫, হযরত আলী (রাঃ)- মাওলানা মুজিবুর রহমান মমতাজুল মোহাদ্দেসীন, পৃষ্ঠা- ৪০৩, আমীরুল মো’মেনিন হযরত আলী (রাঃ)- সাদেক শিবলী জামান, পৃষ্ঠা- ৪৩৮]।
তাহোলে আসল ব্যাপার কি? আসল ব্যাপার হোচ্ছে এই- আলী (রাঃ) ইসলাম কি, ইসলামের সঠিক আকীদা অর্থাৎ এর উদ্দেশ্য কি, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া কি, সালাতের উদ্দেশ্য কি এসবই শিখেছিলেন আর কেউ নয় স্বয়ং আল্লাহর রসুলের কাছ থেকে; কাজেই তার আকীদা অবশ্যই সঠিক ছিলো। সেই সঠিক আকীদা মোতাবেক তিনি জানতেন যে সালাহ্ চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ এবং সামরিক প্রশিক্ষণ; এই প্রশিক্ষনের জন্য দাঁড়ালে, দাঁড়াতে হবে শরীর, মেরুদ-, ঘাড় সোজা কোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে, এমামের তকবিরের সঙ্গে সকলে একত্রে দ্রুত রুকু, এতে’দাল, সাজদা ও সালাম কোরতে হবে। তিনি এও জানতেন যে সালাতে দাঁড়ালে নিজেকে এমনভাবে শৃংখলাবদ্ধভাবে রাখতে হবে যে এদিক ওদিক তাকানো যাবে না, চোখ বন্ধ কোরে রাখা যাবে না, কাপড় বা মাথার চুল সোরে গেলে তা হাত দিয়ে ঠিক করা যাবে না, কাশি বা হাইতোলা যথাসম্ভব রোধ কোরতে হবে, এমন কি সাজদার স্থানে ধূলাবালি বা কপালে ব্যাথা লাগতে পারে এমন পাথর-কুচি বা কাঁকর থাকলেও ফু দিয়ে বা হাত দিয়ে সরানো যাবে না, এক পায়ে একটু বেশী ভর দেওয়া চোলবে না। এর যে কোন একটি কোরলেই সালাহ্ ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট হবে; অর্থাৎ এক কথায় সামরিক শৃংখলা। পা থেকে তীর টেনে বের করার সময় আলীর (রাঃ) নিশ্চয়ই তীব্র ব্যাথা লেগেছিল, কিন্তু তিনি দাঁতে দাঁত চেপে সোজা হোয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সালাহ্ নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত হবার ভয়ে। এই ঘটনাকে আলীর (রাঃ) ধ্যান-মগ্ন হোয়ে সালাহ্ কায়েমের প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপিত করা যায় শুধু সাধারণ জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে লোপ পেলে এবং আল্লাহর লা’নত যাদের ওপর পড়ে তাদের যে সব শাস্তি হয় তার মধ্যে অন্যতম হোল আকল (আক্কেল) অর্থাৎ সাধারণ জ্ঞান (ঈড়সসড়হ ংবহংব) লোপ পাওয়া, তাই হোলে।
আলীর (রাঃ) এই ঘটনার সঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না কোরে পারছি না। ইসলামের প্রকৃত সালাহ্ যে কি রকমের চরিত্র সৃষ্টি কোরতো, মো’মেনের চরিত্রের মধ্যে ঐক্য, শৃংখলা, আনুগত্য ও হেজরতের গুণের সঙ্গে সঙ্গে যে কি কঠিন সবরও সৃষ্টি কোরত তার একটা উদাহরণ এই ঘটনাটি।
বনি আউস বিন লাইস গোত্রের গালীব বিন আবদুল্লাহ আল কালবিকে (রাঃ) আল্লাহর রসুল একদল অশ্বারোহী দিয়ে প্রেরণ কোরলেন বনি আল-মুলাওয়াহ গোত্রকে আক্রমণ করার জন্য। ঐ গোত্র তখন আল কাদীদ নামক স্থানে অবস্থান কোরছিলো। এই দলে ইয়াকুব বিন ওতবা আল মুগীরা সানিল (রাঃ) নামে এক সাহাবা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিশ্বনবীর আদেশ ছিলো ঐ গোত্রকে রাত্রে আক্রমণ করার। অশ্বারোহী মোজাহেদ দল সূর্যাস্তের সময় আল কাদীদ উপত্যকায় এসে পৌঁছলো। বনি মুলাওয়াহর অবস্থান ও অন্যান্য খবরাখবরের জন্য ইয়াকুব বিন ওতবাকে (রাঃ) পাঠানো হোল। ঐ গোত্র যে উপত্যকায় অবস্থান কোরছিলো তার পাশেই একটা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে ইয়াকুব (রাঃ) সাবধানে ওদের পর্যবেক্ষণ কোরতে লাগলেন।
এরই মধ্যে ঐ পাহাড়ের কাছেই একটি তাবু থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে চারদিক দেখতে লাগলো এবং হঠাৎ সে ইয়াকুবকে (রাঃ) দেখে ফেললো। কিন্তু সন্ধ্যা এত গাঢ় হোয়ে গিয়েছিলো যে সে বুঝলোনা যে ওটা মানুষ না অন্য কিছু। সে তাবুর ভেতরে তার স্ত্রীকে ডেকে বললো- আমি একটা কিছু দেখতে পাচ্ছি যা দিনে ওখানে দেখি নি। দেখতো কুকুর আমাদের কোন জিনিস ওখানে নিয়ে ফেলেছে কিনা। স্ত্রী তাবুর ভেতরের সব জিনিস খোঁজ কোরে বোললো- না এখানে সব ঠিক আছে। তখন লোকটি তার স্ত্রীকে বোললো- তাহোলে আমার ধনুকটা আর দুু’টো তীর নিয়ে এসো। স্ত্রী তীর-ধনুক নিয়ে এলে লোকটি ইয়াকুবকে (রাঃ) লক্ষ্য কোরে একটি তীর ছুড়লো। তীর এসে ইয়াকুবের (রাঃ) পাঁজড়ে লাগলো। ইয়াকুব (রাঃ) জানেন যে তিনি বিন্দুমাত্র নড়লেই লোকটি বুঝবে যে ওটা কোন মানুষ এবং সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ কোরে তার গোত্রকে সতর্ক কোরে দেবে যে শত্রুপক্ষের কোন লোক গোয়েন্দাগিরি কোরতে এসেছে। ইয়াকুব (রাঃ) অতি সাবধানে না নড়ে একহাত দিয়ে তীরটি পাঁজড় থেকে টেনে বের কোরে রেখে দিলেন। বনি মুলাওয়াহর লোকটি তবুও নিঃসন্দেহ না হোয়ে তার দ্বিতীয় তীরটি ছুড়লো। এবারের তীর ইয়াকুবের (রাঃ) কাঁধে এসে ঢুকলো। এবারও তিনি না নড়ে আস্তে সাবধানে তীরটি টেনে খুলে রাখলেন। এবার ঐ লোকটি তার স্ত্রীকে বোললো আমার দু’টো তীরই ঠিক লেগেছে। ওটা যদি কোন দলের গুপ্তচর বা জীবন্ত কিছু হোতো তবে নিশ্চয় নড়তো। সকালে ঐ তীর দুু’টো পাহাড়ের ওপর থেকে নিয়ে এসো- নইলে আমাদের কুকুর হয়তো কামড়িয়ে নষ্ট কোরবে।
ইয়াকুবের (রাঃ) এই যে অবিশ্বাস্য সহ্যশক্তি, সবর, একটুও না নড়ে নিজের শরীর থেকে দু-দু’টি তীর টেনে বের করা এটা কোথা থেকে এলো? নিঃসন্দেহে এটা সালাতের শিক্ষা, সালাতের প্রশিক্ষণের ফল। ঠিক যে কারণে আল্লাহর রসুল সালাতে দাঁড়ানো অবস্থায় আলীর (রাঃ) পা থেকে তীর টেনে বের কোরতে বোলেছিলেন। অবশ্য আলী (রাঃ) ও ইয়াকুবের (রাঃ) ঐ সহ্যশক্তির পেছনে সালাতের শৃংখলার প্রশিক্ষণ ছাড়াও সঠিক আকীদারও তেজ ছিলো।
যে উদ্দেশ্যে আল্লাহর নবীর জীবনী থেকে এই ঘটনাটা বর্ণনা কোরলাম তা এখানেই শেষ; সালাহ্ কায়েমের ফল। কিন্তু ঘটনাটার বাকি অংশটুকুও বর্ণনা করার লোভ সংবরণ কোরতে পারছি না, যদিও তা প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ ঘটনাটা থেকে সালাতের প্রশিক্ষণ ছাড়াও আরও দু’টি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় জানা যায়। একটি ইসলামের জেহাদ, কেতাল, যুদ্ধ যে আত্মরক্ষামূলক নয় বরং প্রচন্ডভাবে আক্রমণাত্মক এ কথার অকাট্য প্রমাণ এবং দ্বিতীয়টি মো’মেনদের সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব (সুরা রূম ৪৭) একথার সত্যতা।
ঘটনাটার পরের বর্ণনা হোচ্ছে এই যে ইয়াকুবের (রাঃ) ঐ পর্বতসম সবরের ফলে শত্রুপক্ষ মোসলেম বাহিনীর উপস্থিতি সম্বন্ধে অজ্ঞ রোয়ে গেল এবং খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মোজাহেদ বাহিনী সারারাত্রি অপেক্ষা কোরে শেষরাত্রে মুলাওয়াহ গোত্রের ওপর অতর্কিত আক্রমণ কোরে তাদের বেশ কিছু লোক হত্যা কোরে তাদের উট, দুম্বা, ছাগল এবং অন্যান্য সম্পদ নিয়ে রওনা দিলো। কিন্তু ইতিমধ্যেই ঐ গোত্রের লোকজন (গোত্রটি বেশ বড় গোত্র ছিলো) সব একত্র হোয়ে তাদের পিছু নিলো। মোজাহেদ বাহিনীর গতি স্বভাবতই শত্রুর চেয়ে অনেক কম ছিলো কারণ তাদের সঙ্গে বহু উট, ঘোড়া, ছাগল ইত্যাদি ছিলো আর শত্রুদের সঙ্গে এসব কিছুই ছিলোনা এবং অতি শীঘ্রই তারা মোজাহেদের কাছে এসে গেলো। যখন বনি-মুলাওয়াহ গোত্রের অসংখ্য লোক মোজাহেদের ধাওয়া কোরে প্রায় ধোরে ফেলেছে তখন ঐ গোত্র ও তাদের মধ্যে শুধু কুদাইদের ওয়াদি। আরবে নি¤œস্থানকে ওয়াদি বলা হয়। ঠিক এমনি সময় মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই, কোথা থেকে বন্যার মত পানি এসে ওয়াদি ভরে গেলো। বনি-মুলাওয়াহ গোত্রের একটি মানুষও ঐ ঢলের পানি পার হোয়ে ওপারে যেতে পারলো না; তারা অসহায় হোয়ে ওয়াদির এপারে দাঁড়িয়ে রোইল এবং মোজাহেদ বাহিনী সমস্ত টাকা পয়সা, উট, দুম্বা, ঘোড়া, ছাগল ইত্যাদি নিয়ে চোলে গেলো এবং মদিনা পৌঁছে আল্লাহর রসুলের দরবারে পেশ কোরলো (সিরাতে রসুলাল্লাহ, মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক, অনুবাদ অ. এঁরষষধঁসব পৃঃ ৬৬০-৬৬১)।
ইসলামের সঠিক প্রকৃত আকীদার বিকৃতির ফলে ঈমানের, মো’মেন হবার সংজ্ঞার মধ্যেই যে জেহাদের শর্ত্ত; ঈমান আনার পরই যে কাজের স্থান সেই জেহাদকে ত্যাগ করার পর ঐ কাজকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য প্রচার করা আরম্ভ হোল যে ইসলামের জেহাদ, যুদ্ধ শুধু আত্মরক্ষামূলক; ইসলাম আক্রমণাত্মক যুদ্ধ সমর্থন করে না। এই প্রচার ইসলামের আকীদার মর্মমূলে যেয়ে আঘাত কোরলো। ইসলামে জেহাদ, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং কেতাল অর্থাৎ সশস্ত্র যুদ্ধ শুধু আত্মরক্ষামূলক একথা তেরশ’ বছর আগে প্রচার করা শুরু হোয়েছিলো জেহাদ ছেড়ে দেবার কৈফিয়ত হিসাবে যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য। তারপর জেহাদ ত্যাগ করার অমার্জনীয় অপরাধের শাস্তি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদীর হাত থেকে কর্ত্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে ইউরোপের খ্রীস্টান জাতিগুলির হাতে তুলে দিয়ে এই জাতিকে যখন আল্লাহ মো’মেনের গ-ী থেকে বহিষ্কার কোরে পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জাতিগুলির পদাঘাত, লাথীর বস্তুতে পরিণত কোরে দিলেন, আল্লাহর লা’নতের ফলে হীন-মন্যতায় এই জাতির আত্মা পর্যন্ত আপ্লুত হোয়ে গেলো, তখন তারা ঐ কথা পৃথিবীর অন্যান্য জাতিকেও বোলতে শুরু কোরলো। তারা করজোড়ে অন্যান্য জাতিকেও বোলতে লাগলো যে আপনারা যে এই মোসলেম জাতিকে অপবাদ দেন যে আমরা তলোয়ারের জোরে পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কোরেছি, এটা মোটেই সত্য নয়। আমরা অতি নিরীহ গোবেচারা জাতি, আমরা কখনই অন্যকে আক্রমণ কোরি না। এই দেখুন আমাদের হাতে কোন অস্ত্র আছে? দেখুন এ হাতে কোন অস্ত্র নেই; আছে তসবিহ্। তবে নেহায়েৎ যদি কেউ আমাদের আক্রমণ করে তবে আমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা কোরি মাত্র।
যে ঘটনাটার কথা পেছনে উল্লেখ কোরেছি তাতে আল্লাহর রসুল হুকুম দিয়েছিলেন শত্রু গোত্রটাকে রাত্রে আক্রমণ কোরতে, অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থায়। মোজাহেদ দল তাই কোরেছিলেন, বনি-মুলাওয়াহ গোত্রকে ঘুমিয়ে পড়ার সময় দিয়েছিলেন এবং শেষরাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রমণ কোরেছিলেন। আদেশটি ছিলো স্বয়ং আল্লাহর রসুলের। শুধু এই ঘটনাই নয়। নবীর জীবিত অবস্থায় খন্দকের যুদ্ধ ও তার পৃথিবী থেকে চোলে যাবার পর বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে মদিনাকে রক্ষার যুদ্ধ; এই দু’টি ছাড়া আর কোন যুদ্ধই আত্মরক্ষামূলক ছিলো না। এর পর ইসলামের যুদ্ধ, জেহাদ ও কেতালকে আত্মরক্ষামূলক বোলে প্রচার করা কী কোরে সম্ভব! ঐ যুদ্ধ দু’টিও আসলে সম্পূর্ণভাবে আত্মরক্ষামূলক নয়, সামগ্রিক যুদ্ধের মধ্যে কখনও কখনও আক্রমণ প্রতিহত কোরতে হয়, ওটা গোটা যুদ্ধেরই একটা পর্যায়।
অন্য যে শিক্ষা এই ঘটনা থেকে পাই তা হোচ্ছে কোরানে দেয়া আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন। আল্লাহ বোলেছেন- আল্লাহ মো’মেনদের ওয়ালী অর্থাৎ অভিভাবক (কোরান, সুরা আল এমরান ৬৮)। আরও বোলেছেন- মো’মেনদের সাহায্য করা আমার দায়িত্ব (কোরান- সুরা রূম ৪৭)। মোজাহেদ বাহিনীর পেছনে বিপুল সংখ্যক শত্রু তাড়া কোরে প্রায় এসে পড়েছে, তাদের তুলনায় মোজাহেদরা অতি অল্প সংখ্যক, মোজাহেদরা একটা নি¤œভূমি পার হোয়ে ওপারে উঠেছেন, শত্রুরা এপারে এসে গেছে; এমনি সময় মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই আল্লাহর আদেশে হঠাৎ কোথা থেকে বন্যার পানির ঢল এসে ঐ নি¤œভূমি প্লাবিত কোরে দিলো। একটি শত্রুও পার হোতে পারলো না। আল্লাহ তাঁর দায়িত্ব পালন কোরলেন। এ ঘটনাটা আল্লাহর নবী মুসার (আঃ) ঘটনা মনে কোরিয়ে দেয়। মুসার (আঃ) নেতৃত্বে বনি-ইসরাঈলীদের রক্ষা করার জন্য সমুদ্র দু’ভাগ কোরে তাদের পার কোরে দিয়ে শত্রুদের ডুবিয়ে মারার মো’জেজা। সেটা ছিলো নবীর মো’জেজা আর এ ঘটনা শ্রেষ্ঠ নবীর আসহাবদের মো’জেজা, প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর মো’জেজা।
আমরা আবার সালাতে ফিরে যাচ্ছি। পৃথিবীর সব জাতিই বর্ত্তমানে দু’ভাগে বিভক্ত। সামরিক ও বেসামরিক (গরষরঃধৎু ্ ঈরারষরধহ)। বেসামরিক ভাগ সরকার গঠন কোরে নিজেরা আইন-কানুন, দ-বিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি তৈরী কোরে সেই মোতাবেক দেশ শাসন করে অর্থাৎ শেরক ও কুফরী করে, আর সামরিক ভাগ বেসামরিকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হোয়ে সেনা ছাউনীতে থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় দেশকে রক্ষা করার, প্রয়োজনে অর্থাৎ বেসামরিকদের সিদ্ধান্ত হোলে অন্য দেশ-জাতিকে আক্রমণ করার জন্য। বর্ত্তমানে নিজেদের মূল থেকে, আকীদা থেকে, দীন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, আল্লাহ-রসুলের দেখানো দিক নির্দেশনার (হেদায়াহর) বিপরীতমুখে চলমান এই মোসলেম জাতিও অন্যদের অনুকরণে ঐ দু’ভাগে বিভক্ত। কিন্তু আল্লাহর শেষ নবী যে জাতি গঠন কোরলেন, যার নাম উম্মতে মোহাম্মদী, এটার মধ্যে কোন ভাগ নেই; সম্পূর্ণ জাতিটাই সামরিক। এ জাতির সর্বোচ্চ নেতা থেকে নি¤œতম মানুষটি পর্যন্ত প্রত্যেকে মোজাহেদ, যোদ্ধা। যে যোদ্ধা নয় এ জাতিতে, এই উম্মাহতে তার স্থান নেই। এ জাতিতে নির্বাচিত সংসদ (চধৎষরধসবহঃ) নেই কারণ আইন তৈরীর কোন প্রয়োজন নেই; আল্লাহর দেয়া আইন-কানুন দ-বিধি, অর্থনীতি সমস্তই মজুদ আছে; এবং আছে শুধু এমাম এবং এমামের নিযুক্ত স্থানীয় আমীররা (ঈড়সসধহফবৎং) আল্লাহর ঐ আইন কানুন, দ-বিধি, অর্থনীতি ইত্যাদি অর্থাৎ দীনুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত কার্যকরী রাখার জন্য। এক কথায় সমস্ত জাতিটি একটি সামরিক বাহিনী, নারী-পুরুষ প্রত্যেকে এক একটি সৈনিক, মোজাহেদ, যোদ্ধা। এই সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ হোল সালাহ্।
বর্ত্তমানে পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশ-জাতিগুলিতে যে বেসামরিক ও সামরিক (ঈরারষ ্ গরষরঃধৎু) বিভক্তি আছে তাতে বেসামরিক ভাগের প্রধান থাকেন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী এবং সামরিক ভাগের প্রধান থাকেন- প্রধান সেনাপতি (ঈড়সসধহফবৎ রহ ঈযরবভ)। বেসামরিক লোকজন যখন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর সামনে যায় তখন তারা সম্মুখে ঝুঁকে, জুবুথুবু, নুব্জ হোয়ে সম্মান প্রদর্শন করে; আর অন্য ভাগের সৈনিকেরা যখন প্রধান সেনাপতির সামনে যায় তখন সে লোহার রডের মত পিঠ, ঘাড় সোজা কোরে দৃপ্তপদে খট্ খট্ কোরে সেনাপতির সামনে যায় এবং যেয়ে তড়াক কোরে স্যালুট করে এবং সোজা হোয়ে দাঁড়িয়ে আদেশের অপেক্ষা করে এবং আদেশ হোলে প্রাণদিয়ে তা পালন করে। এই উম্মতে মোহাম্মদীতে যেহেতু ঐ বিভক্তি নেই, সম্পূর্ণ জাতিটাই সামরিক, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী নেই, আছে শুধু এমাম (ঈড়সসধহফবৎ রহ ঈযরবভ) এবং আমীরগণ, (আমীর শব্দের আক্ষরিক অর্থই হোল আদেশদাতা, (ঈড়সসধহফবৎ) সেহেতু তার সালাহ্র হবে সৈনিক, যোদ্ধার মত।
বেসামরিক লোকজন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী সামনে যেয়ে জুবু থুবু, নুব্জ নত হোয়ে সালাম দেয় কিন্তু ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের প্রয়োজনে প্রেসিডেন্টের বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচারণ করে তাদের গদী থেকে অপসারণের চেষ্টা করে; কিন্তু যে সৈনিকরা দৃপ্তপদে সেনাপতির সামনে যেয়ে সোজা হোয়ে মাথা উঁচু কোরে সালাম দেয়, তারা কখনও সেনাপতির কোন আদেশের বিরুদ্ধে তো যায়ই না, তার আদেশের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ইসলামে প্রকৃত সালাহ্ কেমন তা সহীহ হাদীসগুলি থেকে সংগ্রহ কোরলেই পরিষ্কার হোয়ে যায় যে বর্ত্তমানে অন্যান্য ধর্মের অনুকরণে গোঁজামিল দেবার চেষ্টায় সালাতের যে চেহারা হোয়েছে তা প্রকৃত সালাহ্ থেকে কতদূর। এই হাদীসগুলি একত্র কোরলে দেখা যায় যে সঠিক এবং সম্পূর্ণভাবে সালাহ্ আদায় কোরলে একশ’রও বেশী নিয়ম-কানুন লক্ষ্য রেখে, সেগুলি যথাযথভাবে পালন কোরতে হয়। ইসলামের প্রকৃত সালাতে যতগুলি নিয়ম-কানুন কঠিন ভাবে পালন করতে হয় পৃথিবীর কোনও সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজেও ততগুলি নিয়ম-কানুন পালন কোরতে হয় না। আল্লাহর রসুল বোলেছেন- তোমরা সালাহ্ পূর্ণভাবে কায়েম কর, কারণ আল্লাহ পূর্ণ ব্যাতিত সালাহ্ কবুল করেন না [হাদীস- আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে]। এই নিয়ম-কানুনের, পদ্ধতির অনেকগুলি বর্ত্তমানে যে নামায পড়া হয় তার মধ্যেই চালু আছে, যেমন শরীর পাক থাকা, নামাযের জায়গা পাক থাকা, কাবার দিক মুখ কোরে দাঁড়ানো ইত্যাদি সাধারণ নিয়ম-কানুন যে গুলো না হোলে নামাযের আর কিছুই থাকে না। কিন্তু সালাতের মধ্যে যে সব নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি সালাহ্কে সামরিক রূপ দেয় সেগুলিকে বাদ দেয়া হোয়েছে, সালাতের প্রাণকেই ছিনিয়ে নেয়া হোয়েছে। কাজেই এখানে শুধু সেই নিয়ম-কানুনগুলি উল্লেখ কোরবো।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...