হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

“রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদু আনহু” কারা?

এম আমিনুল ইসলাম:

‘রাদিয়াল্লাহ আনহুম ওয়া রাদু আনহু’ কথাটির অর্থ হলো আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। পবিত্র কোর’আনের বেশ কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ বিশেষ শ্রেণির বান্দাকে উদ্দেশ্য কোরে এই শব্দমালা ব্যবহার কোরছেন, যদিও আমরা শুধু রসুলের সাহাবীদের নামের শেষে বাক্যটি ব্যবহার কোরে থাকি। তবে আসহাবে রসুল ছাড়া আর কারও নামের পরে এই সম্মানসূচক শব্দমালা যোগ করা যাবে না এমন বিধিনিষেধ কেউ দেয় নি। তাহোলে দেখা যাক কোর’আনের আলোকে কী মানদণ্ডে একজন মানুষ ‘রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদু আনহু’ হোতে পারেন। একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সাহাবীদের নামের শেষে এই বাক্যটি উল্লেখ কোরি যে, তারা রসুলের পবিত্র মুখ থেকে তওহীদের আহবান পেয়ে তা গ্রহণ কোরছেন, তাঁর সামনে বোসে ইসলাম শিখছেন, তাঁর সাথে থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কঠিন সংগ্রাম কোরছেন, জীবন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রসুলের আসহাবদের পরবর্তী যুগে যারা রসুলকে না দেখেও আসহাবদের মতো একই রকমভাবে রসুলের অনুসরণ অনুকরণ কোরবেন তাদের নামের পরে কি এই বাক্যটি ব্যবহার করা যাবে না? সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, কোর’আন যেমন কেয়ামত পর্যন্ত সর্বসময়ের জন্য প্রযোজ্য, রসুলাল্লাহ যেমন কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের নবী ঠিক তেমনি কোরআনে বর্ণিত মর্যাদাসূচক যে কোন পদবি এই সময়কালের যে কোন মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে যদি সে মানুষ কোরআনে বর্ণিত শর্ত পুরণ করে থাকেন।
রসুলুল্লাহর সাহাবী আবু ওবায়দা (রাঃ) একদিন তাঁকে প্রশ্ন কোরলেন- “ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা যারা ইসলাম গ্রহণ কোরলাম এবং আপনার সঙ্গে থেকে কঠিন জেহাদ কোরলাম, আমাদের চেয়েও ভাল কোন কেউ আছে? জবাবে তিনি বোললেন-“হ্যাঁ, আছে। আমার পর (ভবিষ্যতে) মানুষ আসবে যারা আমাকে না দেখেও আমাকে বিশ্বাস কোরবে (আবু ওবায়দা (রাঃ) থেকে- আহমদ, মেশকাত)।” প্রশ্নটি কোরছেন আর কেউ নয় বিশিষ্ট সাহাবী আবু ওবায়দা (রাঃ), যিনি নবুয়াতের প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণের পর থেকে প্রতিটি প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বনবীর (সাঃ) সঙ্গে থেকে যুদ্ধ কোরেছেন, ওহুদের যুদ্ধে রসুলাল্লাহ আহত হোলে তাঁকে রক্ষার জন্য ছুটে যান, শিরস্ত্রাণের লোহার আংটা তাঁর পবিত্র মাথায় ঢুকে গেলে যিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে সে আংটা বের কোরতে যেয়ে নিজের একাধিক দাঁত ভেঙ্গে ফেলেন, আল্লাহর রসুল চরম বিশ্বস্ততার প্রমাণ হিসাবে যাকে “উম্মতের আমিন” উপাধিতে ভূষিত করেন, যিনি পরবর্তীকালে সিরিয়ায় প্রেরিত মোসলেম বাহিনীর সেনাপতিরূপে এন্টিয়ক, হিমস, এলেপ্পো, দামেশ্ক ইত্যাদি এলাকা জয় করেন এবং যা সবচেয়ে বড়- আশারায়ে মোবাশশেরার একজন বোলে যাকে রসুলাল্লাহ সুসংবাদ দেন। তার প্রশ্নের জবাবেই শেষ নবী (সাঃ) বোলছেন, “হ্যাঁ, তোমাদের চেয়েও উত্তম মোসলেম ভবিষ্যতে আসবে যারা আমাকে না দেখেও তোমরা যেমন আমাকে বিশ্বাস করছো এমনি কোরেই বিশ্বাস কোরবে।” এই হাদিস মোতাবেক বুঝা যায় ভবিষ্যতে এমন কিছু মানুষ শেষ রসুলের অনুসারী হবেন যারা আবু ওবায়দা (রাঃ) এবং অন্যান্য আসহাবদের চেয়েও উত্তম মোসলেম, কারণ তাদের আকিদা সঠিক হবে, তারা ঠিক আসহাবদের মতোই সংগ্রাম, সশস্ত্র সংগ্রাম কোরবেন দীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য। তফাৎ শুধু এই হবে যে, তাদের সঙ্গে বিশ্বনবীর (সাঃ) এর মতো আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব থাকবে না, সেই পবিত্র উপস্থিতি থাকবে না, সেই বিরাট প্রেরণাদানকারী নেতৃত্ব থাকবে না। ঐ তফাতটুকুর জন্যই তারা আসহাবদের চেয়েও উত্তম মো’মেন, উত্তম মোসলেম, উত্তম উম্মতে মোহাম্মদী।
এ ছাড়াও মহানবীর (দঃ) বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী থেকে বুঝা যায় তাঁর পরবর্তী উম্মাহ আবার তাঁর আকিদা ফিরে পাবে, আবার হারিয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ফিরে পাবে, আবার উদ্দেশ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া- প্রশিক্ষণের তফাৎ পরিষ্কার বুঝতে পারবে এবং আবার মহানবীর আসহাবদের মতো সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্য নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত পৃথিবীকে আল্লাহর দেয়া শেষ জীবন-ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে এসে পৃথিবীময় ন্যায় বিচার, সম্পদের ন্যায় বন্টন চালু কোরে, সমস্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ রক্তপাত বন্ধ কোরে শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা কোরবে। পৃথিবীতে এমন কোন গৃহ বা তাঁবু থাকবে না যেখানে এই ইসলাম প্রবেশ না কোরবে (মেকদাদ (রাঃ) থেকে আহমদ, মেশকাত)। রসুলাল্লাহকে আল্লাহর দেয়া উপাধি ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’ পূর্ণতা লাভ কোরবে। আল্লাহ যাদের এই বিশাল বিরাট কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিবেন তাদের সম্মানে কি ‘রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদু আনহু’, এই পবিত্র বাক্যটি ব্যবহার করা যাবে না? অথচ রসুলাল্লাহর সাহাবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্ধ পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম কোরেছিলেন। আর পরবর্তী উম্মাহ একই প্রক্রিয়ায় সমগ্র পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম কোরবেন। এই আকিদা থেকে বলা যায় যে, পরবর্তী উম্মাহদের ব্যাপারেও ‘রাদিয়াল্লাহ আনহুম ওয়া রাদু আনহু’, এই পবিত্র বাক্যটি বলা যাবে। এছাড়া পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ যে কয়েকটা গুণের মানুষদের উদ্দেশ্য কোরে এই বাক্যটি বোলছেন পরবর্তীতেও যে বা যারাই এই গুণগুলি অর্জন কোরবেন বা পরিপূর্ণভাবে এইগুণগুলি অনুসরণ কোরবেন তাদের উদ্দেশ্যে এই বাক্যটি সমভাবে প্রযোজ্য হবে। কেননা, আল্লাহর কথা সার্বজনীন, তাঁর নাযেলকৃত এই কোর’আন কেয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানব জাতির জন্য জীবন-বিধান এবং তিনি উত্তম বিচারক।
রাদিয়াল্লাহ আনহুম ওয়া রাদু আনহু কারা:
১. “যাহারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাহারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে তাহাদের পুরস্কারÑ স্থায়ী জান্নাত, যাহার নিুদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তাহারা চিরস্থায়ী হইবে। আল্লাহ তাহাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাহারাও তাঁহাতে সন্তুষ্ট। ইহা তাহার জন্য যে তাহার প্রতিপালককে ভয় করে (বায়্যেনাহ- ৭, ৮)।” ঈমান বোলতে সুরা হুজরাতের ১৫ নং আয়াত মোতাবেক যারা মো’মেন হবে এবং সৎকর্ম বোলতে আল্লাহ যা আদেশ-নিষেধ কোরেছেন তা যারা মেনে চোলবে। আর প্রতিপালককে ভয় করা বোলতে সার্বিক জীবনের প্রত্যেকটি বিষয়ে শুধু আল্লাহকে ভয় কোরবে আর কাউকে নয়। রসুলাল্লাহর আসহাব ওবাদাহ (রা:) রোম সম্রাটের গভর্নরের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু কোরে যেমন বোলেছিলেন যে, “আমরা বেঁচেই আছি যুদ্ধ করার জন্য, দুনিয়ার জীবনে আমাদের এক মুঠো ভাত আর এক প্রস্থ কাপড় ছাড়া আর কিছুই প্রয়োজন নাই, পরকালের জীবনই আমাদের সব।
২. “তুমি পাইবে না আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়, যাহারা ভালবাসে আল্লাহ ও তাঁহার রসুলের বিরুদ্ধচারীদেরকেÑ হউক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাহাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা ইহাদের জ্ঞাতি-গোত্র। ইহাদের অন্তরে আল্লাহ সুদৃঢ় করিয়াছেন ঈমান এবং তাহাদেরকে শক্তিশালী করিয়াছেন তাঁহার পক্ষ হইতে রূহ দ্বারা। তিনি ইহাদিগকে দাখেল করিবেন জান্নাতে, যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেথায় ইহারা স্থায়ী হইবে; আল্লাহ ইহাদের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন এবং ইহারাও তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট, ইহারাই আল্লাহর দল। জানিয়া রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হইবে (মুজাদালা- ২২)।” অর্থাৎ যারা আল্লাহ রসুল এবং আখেরাতে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস কোরবে তাদের ঈমান এতটাই দৃঢ় হবে যে, তারা কোন অবস্থাতেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধাচরণকারীদেরকে ভালবাসবে না, তাদের পক্ষ অবলম্বন কোরবে না। যদিও তারা তাদের নিজের আপন পিতা, পুত্র, ভাই, আত্মীয়-স্বজন হয়।
৩. “মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে যাহারা প্রথম অগ্রগামী এবং যাহারা নিষ্ঠার সহিত তাহাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাহাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাহারাও তাহাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাহাদের জন্য প্রস্তুত করিয়াছেন জান্নাত, যাহার নিুদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তাহারা চিরস্থায়ী হইবে। ইহা মহাসাফল্য (তওবা- ১০০)।” মক্কা থেকে যারা হেযরত কোরে মদিনায় গিয়েছিলেন এবং মদিনাবাসীদের মধ্যে যারা হেযরতকারীদেরকে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা কোরছেন শুধু তারা নয় বরং যারা এই হেযরত ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন।
৪. “আল্লাহ বলিবেন, ‘এই সেই দিন যে দিন সত্যবাদিগণ তাহাদের সত্যতার জন্য উপকৃত হইবে, তাহাদের জন্য আছে জান্নাত যাহার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তাহারা সেখানে চিরস্থায়ী হইবে; আল্লাহ তাহাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তাহারাও তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট; ইহা মহাসফলতা’ (মায়িদা- ১১৯)।” সত্যবাদীদের উদাহরণ যেমন মেরাজের ঘটনায় আবু বকর (রাঃ), জলন্ত কয়লার উপর শায়িত বেলাল (রাঃ), মিশরে বিশপের মুর্তির নাকের বদলে নিজের নাক কর্তন কোরতে সপে দেয়া মোজাহেদ, ইত্যাদি।
৫. “আল্লাহ তো মো’মেনদের উপর সন্তুষ্ট হইলেন যখন তাহারা বৃক্ষতলে তোমার নিকট বায়আত গ্রহণ করিল, তাহাদের অন্তরে যাহা ছিলো তাহা তিনি অবগত ছিলেন ; তাহাদেরকে তিনি দান করিলেন প্রশান্তি, এবং তাহাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয় ও বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলভ্য সম্পদ, যাহা উহারা হস্তগত করিবে ; আল্লাহতো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (ফাতাহ- ১৮, ১৯)।” বায়আতে রেদওয়ানের শপথের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো রসুলাল্লাহ ওসমান (রাঃ) এর হত্যার বদলা নিবেন বোলে যে শপথ কোরছেন সেই শপথকে রক্ষা কোরতে জীবন উৎসর্গ কোরে তাঁর হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। অন্য অর্থে রসুলাল্লাহর উপর আনীত বিধান প্রতিষ্ঠা করার জেহাদ। এ ধরনের শপথ আসহাবগণ পরবর্তীতেও আরও অনেকবার কোরছেন এবং পরবর্তী উম্মাহও কোরে যাবেন।
নবী রসুল দুনিয়াতে আর আসবেন না, নবুয়তের দরজা বন্ধ হোয়ে গেছে কিন্তু শেষ নবীর নবুয়াতের সময়কাল কেয়ামত পর্যন্ত তাই তাঁর উম্মাহর জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সুযোগও কেয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে। রসুলাল্লাহর সময়কালে যেমন হোয়েছে তাঁর পরবর্তী সময়কাল অর্থাৎ কেয়ামতের আগ পর্যন্তও যারাই একই রকম কর্মসূচীর অধীনে ঐক্যবদ্ধ হোয়ে দুর্ধর্ষ মোজাহেদের চরিত্র অর্জন কোরবেন, একই রকম সততা, ন্যায়, নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার পরিচয় দেবেন, দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একই রকম ত্যাগ স্বীকার কোরবেন তারাও নিঃসন্দেহে সাহাবীদের মতোই রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদু আনহু। তারা আল্লাহর দেওয়া মহাপুরস্কার পেয়ে আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হবেন, সর্বপোরি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কোরবেন। তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ তাদেরকে এমন পুরস্কার দিবেন যে, তাদেরকে স্থায়ীভাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। আল্লাহর এই দান পেয়ে তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট হবেন।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...