হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

যাদের হওয়ার কথা শ্রেষ্ঠ জাতি

মো. মশিউর রহমান

আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে মানবজাতিকে এই দীন প্রদান করেছেন সেই উদ্দেশ্যই এখন বদলে গেছে। মানব সৃষ্টির প্রারম্ভের ঘটনাগুলির মধ্যে ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। আল্লাহ যখন পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসাবে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিবিশিষ্ট একটি নতুন সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন সকল মালায়েক মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছিল যে, “তোমার প্রশংসা ও গুণকীর্তণ করার জন্য আমরাই কি যথেষ্ট নই। তোমার এই সৃষ্টি পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ (অন্যায়-অশান্তি) ও সাফাকুদ্দিমা (রক্তপাত, যুদ্ধ বিগ্রহ) করবে (সুরা বাকারা- ৩০)। আল্লাহ তাদের এই মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও আদম (আ.) কে সৃষ্টি করলেন। এরপর আল্লাহ তাঁর নিজের রূহ আদমের (আ.) ভিতরে ফুঁকে দিলেন এবং সকল মালায়েককে আদমের খেদমতে নিয়োজিত করলেন। প্রত্যেকেই তারা আদমকে (আ.) সিজদা করার মাধ্যমে আল্লাহর এই হুকুমের আনুগত্য করলো এবং আদমের সেবায় নিয়োজিত হলো। কিন্তু ইবলিস আল্লাহর এই হুকুমকে অন্যায্য ঘোষণা করে আদমকে সিজদা করা থেকে বিরত রইলো। ফলে আল্লাহ ইবলিসকে তার সম্মানজনক অবস্থান থেকে বিতাড়িত (রাজীম) করলেন এবং অভিশাপ দিলেন। ইবলিসও তখন আল্লাহর কাছে অবকাশ চেয়ে নিল এবং আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিল যে সে বিভিন্ন প্রকার প্ররোচনা দিয়ে অধিকাংশ মানুষকেই আল্লাহর হেদায়াত (দিক নির্দেশনা), সরল পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে এবং প্রমাণ করবে যে মানুষ তার চাইতে নিকৃষ্ট সৃষ্টি।

আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, তিনি প্রতি যুগে প্রতি জনপদে তাঁর নবী রসুল পাঠিয়ে হেদায়াহ ও দীন প্রেরণ করবেন। সেটাকে অনুসরণ করলেই তারা দুনিয়াতে একটি শান্তিময় ও প্রগতিশীল সমাজে বসবাস করতে পারবে। সেখানে থাকবে না কোন ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ অন্যায়, অশান্তি, যুলুম, রক্তপাত, যুদ্ধ, ক্রন্দন, হতাশা অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে মালায়েকরা মানবজাতিকে নিয়ে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল সেগুলি থাকবে না। পাশাপাশি ইবলিসের সঙ্গে করা চ্যালেঞ্জে আল্লাহ বিজয়ী হবেন। এজন্যই ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে শান্তি, এই নামকরণ আল্লাহ করেছেন এই জন্য যে, এই দীন, জীবন যাপন পদ্ধতি পৃথিবীর যে অংশে প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সেখানে অশান্তির লেশও থাকবে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই দীনের আকীদা বা উদ্দেশ্য হলো, সমস্ত জীবন ব্যবস্থার উপর একে সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবনের সর্ব অঙ্গন থেকে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত অর্থাৎ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজ করাই হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত করা, আর খেলাফত করাই হলো প্রকৃত ইবাদত। এখন মুসলিম দাবিদার জাতির সামনে থেকে দীনের এই উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে, তারা কেবল নামাজ, রোজা, হজ করাকেই ইবাদত হিসাবে ধরে নিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা করছে। পৃথিবীতে সেই ইবাদত কোন শান্তি আনতে পারছে কি পারছে না, তা ভেবেও দেখছে না, যেন সমাজের শান্তি অশান্তির সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, ইবাদতেরও কোন সম্পর্ক নেই। অথচ আজ দীনের উদ্দেশ্য করা হয়েছে আখিরাতের পূজি হিসাবে সওয়াব অর্জন করা যেন মিজানের পরিমাপে পূণ্যের পাল্লা ভারি হয় আর পদ্ধতি করা হয়েছে উপাসনা। উদ্দেশ্য ভুল হলে আর কোন কিছুরই কোন মানে থাকে না।

অথচ আল্লাহর দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, এই দীন অনুসরণের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শান্তি এবং অনুসরণ না করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে অশান্তি। তাই যেখানে শান্তি নেই, আমরা বলতে পারি সেখানে ইসলাম নেই।

আজকের মুসলিম নামক জাতিটির করুণ অবস্থা দেখে হয়তো অনেকেই ধারণা করতে পারবেন না যে এই জাতি এক সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল। পৃথিবীর অন্যান্য সব জাতি সভয় সম্ভ্রমসহ তাদের পানে তাকিয়ে থাকত। এই পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী জায়গায় শাসন ক্ষমতা এই মুসলিম বলে পরিচিত জাতির হাতে ছিল। তারা ঐ ক্ষমতাবলে ঐ বিশাল এলাকায় আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন পৃথিবীতে সামরিক শক্তিতে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সভ্যতায়, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে, Technology-তে, আর্থিক শক্তিতে এই জাতি সমস্ত পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ছিল; তাদের সামনে দাঁড়াবার, তাদের প্রতিরোধ করার মত কোন শক্তি পৃথিবীতে ছিল না। হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মাহর জন্য দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিশ্রুত অবস্থান। আল্লাহ, এই জাতিকে লক্ষ্য করে, বলছেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি (উম্মাহ) কারণ মানব জাতির মধ্যে থেকে তোমাদিগকে উত্থিত করা হয়েছে এই জন্য যে (তোমরা মানুষকে) সৎকার্য করার আদেশ দান করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত করবে, আল্লাহকে বিশ্বাস করবে (সুরা ইমরান- ১১০)।” অর্থাৎ এই উম্মাহকে মানব জাতির মধ্য থেকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসহ উত্থিত করা হয়েছে মানুষকে অসৎ কাজ (আল্লাহর বিধানের বিরোধী কাজই হলো অসৎ কাজ) থেকে নিবৃত্ত করা ও সৎ কাজ (আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাজই হচ্ছে শুধু সৎকাজ) করার আদেশ করার জন্য এবং এই কাজ করার জন্যই সে জাতি শ্রেষ্ঠ জাতি। আজ এই জাতির অতি পরহেজগার ও বুজুর্গ ব্যক্তিরা ইবাদতের নাম করে আল্লাহর যেকরের নাম করে বা যে কোন ছুতোয় বিরোধিতার ভয়ে, পার্থিব ক্ষতির ভয়ে, যে জন্য তাদের মানব জতির মধ্য থেকে উত্থিত করা সেই কাজ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, সুতরাং তারা আর সেই শ্রেষ্ঠ জাতির মধ্যেই নেই এবং তাদের সব রকম ইবাদত অর্থহীন। কারণ আল্লাহর রসুল সরাসরি বলেছেন, “মানুষ যখন সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার দায়িত্বপালন ত্যাগ করে তখন তার কোন আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না (হাদীস তিরবানী)।”

এইখানে আরও একটি কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। কোর’আনের এই আয়াতে আল্লাহ সৎকাজের জন্য যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটা হলো আদেশ, আরবিতে ‘আমর’। আদেশ তখনই করা যায় যখন যে আদেশকে কাজে পরিণত করা যায়, অর্থাৎ কাজে পরিণত করার শক্তি থাকে, নইলে খুব জোর অনুরোধ করা যায়। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত করার ব্যাপারেও তাই। মানুষকে অর্থাৎ সমাজকে সৎকাজ করার আদেশ এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার শক্তি শুধু রাষ্ট্রের থাকে অন্য কারো নয়। অন্য যে কেউ করতে গেলে তাকে শুধু অনুরোধ বা কাকুতি-মিনতি করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ অনুরোধ শব্দ ব্যবহার করেন নি, করেছেন ‘আমর’ আদেশ অর্থাৎ ঐ কাজ রাষ্ট্র-শক্তি হাতে নিয়ে করতে হবে। উপদেশ ও অনুরোধে যে ও কাজ হবে না তার প্রমাণ বর্তমান মানব সমাজ। এই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ, অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা যে আল্লাহ উপদেশ, অনুরোধের মাধ্যমে করা বোঝান নি তা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কোর’আনের আরেকটি আয়াতে। তিনি বলেছেন- “এরা (মো’মেন) তারা, যাদের আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত (নামায) কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং ন্যায়, সৎ কাজের আদেশ দেয়, এবং অন্যায়, অসৎ কাজ থেকে বিরত করে (সুরা আল হজ- ৪১)।” এখানে লক্ষ্য করুন-মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য আল্লাহ কী পূর্বশর্ত দিচ্ছেন। তিনি বলছেন আমি তাদের পৃথিবীতে (বা পৃথিবীর যে কোন অংশে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার পর, কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে, ন্যায় কাজের আদেশ ও মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা এ দু’টোর কোনটাই সম্ভব নয় রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া অর্থাৎ সর্বাত্মক সংগ্রাম করে জয়ী হয়ে, ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে তবে ঐ ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখা। যারা অনুরোধ উপদেশ কাকুতি-মিনতি করে ঐ কাজ করতে চেষ্টা করছেন, তারা পণ্ডশ্রম করছেন।

যাদের এই শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার কথা সেই জাতির বর্তমান হীনতা ও লাঞ্ছনার বিবরণ পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য আর লিখছি না। শুধু এটুকু বলি, শ্রেষ্ঠত্ব দূরে থাক, এই জাতি এখন অন্য সকলের ঘৃণার বস্তু। সুতরাং তারা যে ১৪০০ বছর আগেই সেই শ্রেষ্ঠ জাতির সদস্য নয় তা বুঝতে সাধারণ জ্ঞানই (Common sense) যথেষ্ট।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...