হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

নবী-রসুলগণ ছিলেন ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার

ধর্মীয় কাজের বিনিময় গ্রহণের বিরুদ্ধে নবী-রসুলগণ সকলেই কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের সত্য প্রচারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের সমাজে বিরাজিত আলেম-পুরোহিত গোষ্ঠীটি। তাদের কাছে ধর্ম ছিল একটি পণ্য, ধর্মবিশ্বাসী আমজনতা ছিল তাদের ক্রেতা আর উপাসনালয়গুলো হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

আমাদের সমাজেও আজ আমরা একই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। টাকা ছাড়া আজ ধর্মের চাকা মোটেও ঘোরে না। ওয়াজ করে টাকা, নামাজ পড়িয়ে টাকা, কোর’আন শিখিয়ে টাকা, কোর’আন পড়ে টাকা, মিলাদ পড়িয়ে টাকা, আজান দিয়ে টাকা, তারাবি পড়িয়ে টাকা, খোতবা দিয়ে টাকা, ফতোয়া দিয়ে টাকা, পীরের দরবারে টাকা, মাজারে টাকা, দোয়া করে টাকা, কবর জেয়ারত, এমন কি জানাজার নামাজটাও আজ বিনা পয়সায় পড়ানো হয় না। এই ধর্মজীবী গোষ্ঠীটি জনগণকে নসিহত করেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করতে, কিন্তু তারা নিজেরা পার্থিব স্বার্থ ছাড়া ইসলামের কোনো একটি কাজ করতেও রাজি নন। ধর্ম তাদের কুক্ষিগত, তারা হয়ে দাঁড়িয়েছে আলস্নাহ ও বান্দার মাঝখানে একটি মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল শ্রেণি। আলস্নাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে এদেরকে আগে সন্তুষ্ট করতে হবে।
বিদায় হজ্বের দিন আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, “আজ যারা এই সমাবেশে উপস্থিত নেই তাদের কাছে যারা উপস্থিত রয়েছ তারা আমার এই কথাগুলো পৌঁছে দেবে।” কথা হচ্ছে এই দায়িত্ব কি উম্মাহ টাকার বিনিময়ে পালন করবে? সত্যের শিক্ষার প্রদানের সঙ্গে কি স্বার্থের সম্পর্ক থাকতে পারে? আল্লাহর রসুল যা কিছু করেছেন তা কি তিনি অর্থের বিনিময়ে করেছেন? নাউজুবিলল্লাহ, কখনও নয়। তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলেছেন আলস্নাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক, বিনিময়, মজুরি বা সম্পদ গ্রহণ করতে আল্লাহর বহু আয়াতে নিষেধ করেছেন। তিনি রসুলাল্লাহ (সা.) কে উদ্দেশ করে বলছেন

(১) তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি করো না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র (সুরা ইউসুফ ১০৪)।
(২) বল! আমি এর জন্য (অর্থাৎ আলস্নাহর দিকে আহ্বান করার জন্য) তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই (সুরা সা’দ ৮৬)।
(৩) …বল! আমি এর (অর্থাৎ দীনের শিক্ষার) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও আতীয়তাজনিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই চাই না (সুরা শুরা ২৩)।
(৪) (হে মোহাম্মদ!) তুমি কি তাদের নিকট কোনো মজুরি চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রেযেকদাতা (সুরা মো’মেনুন ৭২)।
(৫) তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছো যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে? (সুরা তুর ৪০)
(৬) নবী-রসুলগণকে আল্লাহর সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না (সুরা আনআম ৯০)।

এই শেষ আয়াতটি খেয়াল করুন। এখানে আল্লাহর পূর্বের সমত্ম নবী-রসুলগণের ইতিহাস তাঁর শেষ নবীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এবং বলছেন তাঁদের পথ অনুসরণ করতে। সে পথটি কী? সেটি হচ্ছে বিনা মজুরিতে আল্লাহর দীনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। নবী-রসুলরা ধর্মব্যবসাকে হারাম বলে ঘোষণা করায় ধর্মগুরুদের রুজি রোজগার বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সম্মান ও কর্তৃত্ব খোয়ানোরও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। তাই তারা নবী-রসুলদের রজনগণ ও শাসক শ্রেণিকে খেপিয়ে তুলেছেন।
নবী-রসুলগণ সকলেই তাদের জাতির উদ্দেশে একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। তাঁরা সবাই এ কথাটি কেন বলেছেন সেটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এর কারণ হচ্ছে তাঁরা বোঝাতে চাচ্ছেন, তাদের কথা নির্ভেজাল সত্য, হক্, এতে মিথ্যার কোনো মিশ্রণ নেই। কারণ প্রতিটি মিথ্যাই হয় উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, তাতে মানুষের কোনো না কোনো পার্থিব স্বার্থ জড়িত থাকে। আর এই বিনিময় গ্রহণ না করা তাঁদের সত্যতার প্রমাণ। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, মানুষ যার থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে তার কাছে মত্মক অবনত করতে বাধ্য থাকে। কিন্তু আল্লাহ চান মানুষ কেবল তাঁকে ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নোয়াবে না। কিন্তু যারা ধর্মীয় কাজের বিনিময়ে মানুষের থেকে টাকা নেন তারা স্বভাবতই যার নুন খান তার গুণ গাইতে বাধ্য হন। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের আর কোনো বাছবিচার তারা করতে পারেন না। অর্থদাতা সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত হলেও, প্রতারক রাজনৈতিক নেতা হলেও, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর হলেও তার রপ্রতিবাদ করতে পারেন না। বরং দীনের বিধানকে তারা অর্থদাতার চাহিদামাফিক পরিবর্তন করতে দ্বিধা করেন না। এ জন্যই ধর্মব্যবসা হারাম।
এ বিষয়ে নবী-রসুলদের (আ.) বেশ কয়েকজনের ঘোষণা আল্লাহর পবিত্র কোর’আনে উলেস্নখ করেছেন। যেমন:

১. নূহ (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট (সুরা হুদ-২৯)।
২. হুদ (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুদ্ধি (আক্ল) খাটাবে না? (সুরা হুদ-৫১)।
৩. নূহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো কেবল বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে (সুরা শু’আরা ১০৯)।
৪. সালেহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা ১৪৫)।
৫. লুত (আ.) এর ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৬৪)।
৬. নূহ (আ.) এর ঘোষণা: যদি তোমরা আমার কথা না শোনো তাহলে জেনে রাখ, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই নি। আমার প্রতিদান কেবল আল্লাহর নিকট এবং আমাকে মুসলিম (সত্যের প্রতি সমর্পিত) হওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে (সুরা ইউনুস ৭২)।
৭. হুদ (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাচ্ছি না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি এই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা (সুরা শু’আরা ১২৭)।

৮. শোয়েব (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৮০)।
নবী-রসুলগণের এ সংক্রাšত্ম বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে এমন, “তোমরা একমাত্র আলস্নাহকে মান্য করো। আমার কথা শোনো। আমি তোমাদের জাগতিক ও পারলৌকিক শান্তির ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদেরকে পার্থিব অশান্তি থেকে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করতে চাই। তোমরা ভাবছ এতে আমার স্বার্থ কী? না, আমার এ চাওয়ার পেছনে কোনো স্বার্থ নেই। আমাকে কোনো টাকা পয়সা তোমাদের দিতে হবে না। আমার এ কাজের বিনিময় আল্লাহর কাছ থেকে পাব।”
এটা সাধারণ জ্ঞান যে, সকল নবী যখন এই পথে হেঁটেছেন তখন তাঁদের প্রকৃত উম্মতকেও সেই পথেই হাঁটতে হবে। কিন্তু নবীদের বিদায়ের পরে জাতির মধ্যে জন্ম নিয়েছে একটি অকর্মণ্য, কর্মবিমুখ, পরনির্ভরশীল প-িত শ্রেণি যারা আলেম, পুরোহিত, যাজক ইত্যাদি বহুনামে পরিচিত। মুসলমানদের মধ্যে তারা আবার নিজেদেরকে ওরাসাতুল আম্বিয়া, নবীগণের ওয়ারিশ বলে দাবি করেন আর সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ তাদের আরবীয় বেশভূষা দেখে তারা যা বলেন তাকেই ইসলাম বলে নির্বিচারে মেনে নেয়। এ এক জাহেলিয়াত, এ এক মূর্খতা। এই মূর্খতার সুযোগ নিয়েই তারা নবী-রসুলগণের এই পথকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে ধর্মের বিনিময়ে স্বার্থ হাসিল করতে শুরম্ন করেছেন। কোর’আনের হুকুমকে তারা পাল্টে দেওয়ার জন্য ইজমা, কিয়াসের নামে বহু ফতোয়া আবিষ্কার করেছেন, অর্থগ্রহণকে তারা হাদিয়া নাম দিয়ে জায়েজ করে নিতে চাচ্ছেন।

সত্যিই আমরা যদি আমাদের দুনিয়ার জীবনকে শান্তি করার লক্ষ্যে ‘ইসলাম’ অনুসরণ করতে চাই, আমাদেরকে এই ধর্মব্যবসার ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে হবে। আমাদেরকে ধর্মব্যবসায়ীদেরকে অন্ধবিশ্বাস না করে আমাদের প্রত্যেকের ঘাড়ের উপর যে মহামূল্যবান মাথা আর সেই মাথার ভেতর যে অকল্পনীয় ক্ষমতার মগজটি আলস্নাহ দান করেছেন সেটিকে ব্যবহার করতে হবে। যে বিষয়ে আলস্নাহর কোনো কথা আছে তার বিপরীতে আমরা আর কারো কোনো কথাই গ্রাহ্য করতে পারি না তা যত বড় আল্লাহর , শায়েখ বা পীর সাহেবই বলুন না কেন। করলে পথভ্রষ্ট হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর বলেছেন –
“আল্লাহর ও তাঁর রসুল কোন কাজের আদেশ করলে কোন মো’মেন পুরুষ ও মো’মেন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই। যে আল্লাহর ও তাঁর রসুলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয় [সুরা আহযাব ৩৩:৩৬]”

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...