হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জাতি পথ হারাল যেভাবে – মোহাম্মদ আসাদ আলী

A Syrian refugee carrying children, walks in Turkey, in Akcakale, southeastern Turkey, as he and others flee intense fighting in northern Syria between Kurdish fighters and Islamic State militants, Monday, June 15, 2015. The flow of refugees came as Syrian Kurdish fighters closed in on the outskirts of a strategic Islamic State-held town on the Turkish border. (AP Photo/Lefteris Pitarakis)

আজ থেকে অনেক যুগ আগেই মুসলিম জাতির করুণ দুর্দশা দেখে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-

‘বাহিরের দিকে যত মরিয়াছি ভিতরের দিকে তত
গুণতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু ছাগলের মত।’

একদিকে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস করে দেবার বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র, আরেকদিকে মুসলিম জাতির নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দলাদলি মারামারির ফলে এই যে মুসলিম জাতির অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাওয়া- এই অবস্থা রাতারাতি তৈরি হয় নি, হঠাৎ করে একটি জাতির এত অধঃপতন হয়ে যায় না। দীর্ঘদিনের পচনক্রিয়া একটু একটু করে জাতিকে এই রূঢ় বাস্তবতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আফসোসের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম জাতির এত করুণ দুর্দশা দেখে বিদ্রোহী কবি যতই বিচলিত হয়ে থাকুন না কেন, এই জাতির আলেমদের, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নেতাদের, শিক্ষিত-অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে কিন্তু চিন্তার বালাই নেই। তাদেরকে কে বলে দেবে সারা বিশ্বে আজ তাদের অবস্থান কোথায়?
যারা ছিল শাসক জাতি, গত কয়েক শতাব্দি থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামরিক, অর্থনৈতিক শক্তি সবদিক দিয়ে তারা এখন শাসিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। যারা ছিল অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়’র স্থলে, তারাই কয়েক শতাব্দী ধরে পশ্চিমাদের অনুসরণ ও অনুকরণের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তারা অন্যদের বস্তুবাদি আদর্শ মেনে নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে চলা অর্থনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক সঙ্কট, যুদ্ধ-মহাযুদ্ধ রক্তপাত বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যে জাতির উপর ছিল সেই জাতি আজ নিজেরা নিজেরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের জালে এতটাই আবদ্ধ হয়েছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে করতে আকাশের মত বিশাল ইসলামকে তারা এতটাই সংকীর্ণ করে ফেলেছে, সার্বজনীনতা ভুলে কূপমণ্ডূক হয়েছে যেখান থেকে বেরিয়ে এসে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কোনো মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সে চেষ্টাও যদি থাকত তবু না হয় শান্তনা পাওয়া যেত, তাও তো নেই। দিনকে দিন তারা কেবল নিজেদের বিভেদের নালাকেই প্রশস্ত করে যাচ্ছে। পরিহাসের এখানেই শেষ নয়।
ওয়াজের মৌসুম এলে এই দ্বীনের আলেমরা একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে ওয়াজ করতে থাকেন। শত শত কর্মঘণ্টা ব্যয় করে অসাধারণ প্রতিভা খরচ করে শিয়ারা সুন্নিদের বিরুদ্ধে, সুন্নিরা শিয়াদের বিরুদ্ধে, মাজহাবীরা লা মাজহাবীদের বিরুদ্ধে, লা মাজহাবীরা মাজহাবীদের বিরুদ্ধে, পীরপন্থীরা শরিয়াপন্থীদের বিরুদ্ধে, শরিয়াপন্থীরা পীরপন্থীদের বিরুদ্ধে, আহলে হাদীস আহলে কুরানের বিরুদ্ধে, আহলে কুরান আহলে হাদিসের বিরুদ্ধে, কওমীরা আলীয়াদের বিরুদ্ধে, আলীয়ারা কওমীদের বিরুদ্ধে- এইভাবে এই জাতির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভাগ উপভাগ একে অপরের বিরুদ্ধে ওয়াজ করে যাচ্ছে, ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনে জাল হাদীসের রেফারেন্স তুলে ধরছে, কোর’আনের আয়াতের ইচ্ছেমত ব্যাখ্যা করছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। অথচ তাদেরকে তৈরি করা হয়েছিল একটা জাতি হিসেবে শিরক ও কুফরকে ঘায়েল করার জন্য, শত্রুকে পরাজিত করে সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য, সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নাই।
এক আলেমের মাথাব্যথা আরেক আলেমকে নিয়ে, এক দলের মাথাব্যথা আরেক দলকে নিয়ে, এক ফেরকার মাথাব্যথা আরেক ফেরকাকে নিয়ে, এক পীরের মাথাব্যথা আরেক পীরকে নিয়ে, কিন্তু পৃথিবীময় অশান্তির দাবানল জ্বলছে সে নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, এ নিয়ে কোনো ওয়াজ নেই, মাহফিল নেই, ওরস নেই, ইজতেমা নেই। পৃথিবীর সকল অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, হানাহানি, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে ধর্মীয় নেতাদের এই যে কেবল বিদ্বেষের চর্চা করে যাওয়া- এই বিদ্বেষ কিন্তু ছড়িয়ে পড়ছে তাদের অনুসারীদের মধ্যে অর্থাৎ জনগণের মধ্যেও। এক সময় সেই বিদ্বেষ থেকে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, রূপ নিচ্ছে দাঙ্গা-হাঙ্গামায়। বাগাদাদে, আলেপ্পোয়, আলেকজান্দ্রিয়ায়, লাহোরে নিজেরা নিজেরা বহু দাঙ্গা এই জাতি করেছে। আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পরে আমরা দেখেছি এক পীরের অনুসারিরা আরেক পীরের অনুসারীদের হামলা পাল্টা হামলা করে রক্তাক্ত করেছে, আহত-নিহত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ভয়ংকর বিদ্বেষের চর্চা জাতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর পথে অন্যতম অন্তরায়। প্রশ্ন হচ্ছে- এক আল্লাহ, এক রসুল, এক কিতাবের অনুসারী অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্যে এত মতভেদ, এত শত্রুতা, এত ঘৃণা ও বিদ্বেষ কেন তৈরি হলো? পাঠকদেরকে সে ইতিহাস জানতে হবে।

জাতির উত্থান-পতন:

১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রসুল অক্লান্ত সংগ্রাম করে একটি জাতি তৈরি করলেন এবং জাতির একটি মহান লক্ষ্য ঠিক করে দিলেন। সেই লক্ষ্যটা ছিল পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। রসুল চলে যাওয়ার পর তাঁর হাতে গড়া জাতিটি নেতার অর্পিত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে একদেহ একপ্রাণ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেল এবং মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধেক দুনিয়ায় ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা, শান্তি আনয়ন করল।
কিন্তু এরপর ঘটল মহাদুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ততদিনে একজন একজন করে রসুলের আসহাবরা ইহকাল ছেড়েছেন। এই সময়ে যাদের দায়িত্ব ছিল বাকি পৃথিবীতেও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া তারা তাদের লক্ষ্য ভুলে গেল। জাতির নেতারা ভোগ-বিলাসিতার রাজত্ব শুরু করল। একদল মানুষ আত্মার ঘসামাজা করে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে মনোনিবেশ করল। আরেকদল বসল কোর’আন-হাদীস, ফিকাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে। শাসক শ্রেণির আনুকুল্য লাভ করে তারা দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে লাগল এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের কাজের ফলে অর্থাৎ দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে জাতির মধ্যে মতভেদ জন্ম নিল। একজন পদ্ধতি এক ধরনের মতামত দিলেন, আরেকজন অন্য ধরনের মতামত দিলেন। উভয়েরই অনুসারী জুটে গেল এবং এভাবে যতই দ্বীনের অতি বিশ্লেষণ হতে লাগল, ততই মতভেদ সৃষ্টি হতে লাগল এবং জনসাধারণ সেইসব মতে বিভক্ত হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
আল্লাহর রসুল জাতির ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঠিক করে দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে, (নেতার আদেশ) শুনবে, পালন করবে, হেজরত করবে এবং সংগ্রাম করবে। যে ব্যক্তি এই ঐক্যবদ্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও সরে যাবে তার গলদেশ থেকে ইসলামের রজ্জু খুলে যাবে, যদি না সে তওবা করে ফিরে আসে (আহমদ ইবনে মাজাহ, বাব উল ইমারত, মেশকাত)’। সংগ্রাম ছেড়ে দেবার পরে দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ আরম্ভ হলে জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হলো, কর্মসূচির প্রথম দফা (ঐক্যবদ্ধ হও) থেকেই জাতি বেরিয়ে গেল। এরপরের ইতিহাস সহজ-সরল পথ (সেরাতুল মোস্তাকীম) থেকে ও রসুলের নির্দেশিত কর্মসূচির ঐক্যবন্ধনী থেকে জাতির এক বিঘত নয়, যোজন যোজন মাইল পথ দূরে সরে যাবার ইতিহাস। সেই যোজন মাইল দূরে অবস্থান করে আজ জাতির প্রত্যেকটি ভাগ, প্রত্যেকটি দল-উপদল তাদের নিজেদের জায়গাটিকে সঠিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টায় বিভোর হয়ে আছে, কিন্তু কেউ যে তারা তওহীদে নেই, আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্যে নেই, কেউ যে তারা মো’মেন নেই সেটা বোঝার বোধশক্তিও কারো অবশিষ্ট নেই। তাতে অবশ্য অনিবার্য পরিণতি এড়ানো যাচ্ছে না। অনৈক্য সৃষ্টি করে দুর্বল হয়ে পড়া ও আল্লাহর অবাধ্য হবার ইহকালীন ফল হয়েছে দুনিয়াজোড়া লাঞ্ছনা, অপমান, দুর্গতি, উদ্বাস্তুকরণ, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি এবং পরকালে অপেক্ষা করছে জাহান্নাম।
যারা সত্য পাওয়ার পরও কুফরীতে ফিরে যায়, তাদের প্রতি আল্লাহ, রসুল এবং মালায়েকদের পক্ষ থেকে লা’নত বর্ষিত হয়। এই জাতি কেবল সত্য পেয়েছে তাই নয়, সত্যের আলোয় অর্ধেক পৃথিবীকে আলোকিত করার পরে তাদের লক্ষ্য ভুলে গেছে এবং কর্মসূচি থেকে বর্হিগত হয়ে ইসলামের ঐক্যবন্ধনীর বাইরে ছিটকে গেছে। তারপরও আল্লাহ প্রায় সহস্র বছর এই জাতিকে সুযোগ দিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও যখন এই জাতি তাদের ভুলে যাওয়া দায়িত্বকে কাঁধে তুলে নিল না, জাতিবিনাশী মতভেদ ফেরকাবাজী ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হলো না, তখন লানতপ্রাপ্ত জাতির ক্ষেত্রে যেমনটা হয় এই জাতিরও ঐ দশা হলো।
কোনো জাতি যখন লানতপ্রাপ্ত হয় তখন তাদের মধ্যে দুইটি বিষয় ঘটে। প্রথমত, বোধশক্তি হারিয়ে যায়, দ্বিতীয়ত, গুরুত্বের অগ্রাধিকার ওলট-পালট হয়ে যায়। তারা মার খায় কিন্তু কেন মার খাচ্ছে তা বোঝে না এবং তাদের কাছে দ্বীনের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হয়ে যায় কম প্রয়োজনীয়, গুরুত্বহীন, আর ছোটখাটো আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো হয়ে যায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই জাতির সেটা হলো। তারা দুনিয়াজোড়া নির্যাতিত হচ্ছে, তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, এক ইঞ্চি জমিনেও আল্লাহর সাহায্য তারা পাচ্ছে না, কিন্তু বোধশক্তি হারিয়ে যাবার কারণে কারো মনে এই প্রাথমিক প্রশ্নটাও জাগছে না যে, আমাদের তো গোলামীর জীবন কাটানোর কথা নয়, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আমাদের হাতে থাকার কথা পৃথিবীর কর্তৃত্ব, আমাদের অভিভাবক হবার কথা আল্লাহ, আমাদের পরাজয় তো হতেই পারে না, তাহলে আমরা কেন দুনিয়াজোড়া মার খাচ্ছি? কেউ এ প্রশ্ন তুলে যদি তাদেরকে সংশোধনের দিকে আহ্বান করে তারা সংশোধনের রাস্তায় তো হাঁটেই না, বরং সমস্ত দল-উপদল সম্মিলিতভাবে ঐ লোকের পেছনে লাগে।
তাদের সামনে যখন তওহীদের ডাক দেওয়া হয় তারা বোয়াল মাছের মত হা করে তাকিয়ে থাকে। যে তওহীদ ইসলামের ভিত্তি, যে তওহীদের ঘোষণা না দিয়ে কেউ এই দ্বীনে প্রবেশ করতে পারে না, সেই তওহীদ কী বস্তু মুসলিম নামধারী এই জাতির অধিকাংশ জনগণ তা জানেই না। মহাগুরুত্বপূর্ণ, অত্যাবশ্যক তওহীদ এদের কাছে গুরুত্বহীন, মূল্যহীন হয়ে গেছে। একইভাবে মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যে আল্লাহ যে সংগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন, যেটা কিনা একটি দেহের রক্ত সঞ্চালনের মতই মহাগুরুত্বপূর্ণ, সেই সংগ্রামেরও কোনো গুরুত্ব এই জাতির কাছে নেই। এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনগুলো? দাড়ি-টুপি, পাগড়ি-পাজামা, ঢিলা-কুলুখ, মেসওয়াক, ডান কাতে শোয়া, খাওয়ার আগে নিমক খাওয়া, খাওয়ার পরে মিষ্টি খাওয়া ইত্যাদি। দ্বীনের যে ব্যাপারগুলোয় আল্লাহর রসুল বারবার সতর্ক করে গেছেন যে, সাবধান! দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, সেই বাড়াবাড়ির কাজটা তারা মহাসমারোহে করে যাচ্ছে, প্রয়োজনে এসব নিয়ে মারামারিও করছে এবং করছে খুব সওয়াবের কাজ মনে করে। এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কী হতে পারে?
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...