অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে সাংস্কৃতিক জাগরণে যশোরে ‘মাটি’র আলোচনা সভা

ধর্মের নামে অপব্যাখ্যা ও আকাশ সংস্কৃতির লাগামহীন আগ্রাসনে যখন যুবসমাজ দিশেহারা এবং সমাজে নৈতিক অবক্ষয় প্রকট, তখন সুস্থ ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এক নবজাগরণ সৃষ্টির প্রত্যয়ী আহ্বান জানালো মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ।গতকাল শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্রাচ্য আকাদেমির ওবায়দুল বারী হলে “সংস্কৃতি চর্চার হাত ধরে আসুক নবজাগরণ” শীর্ষক এক প্রাণবন্ত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই আহ্বান জানানো হয়।

এদিন বিকেল গড়াতেই অনুষ্ঠানস্থল লোকারণ্য হতে শুরু করে। মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সদস্য, স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী, লেখক, কবি, সাংবাদিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই এই স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি এক উৎসবমুখর এবং আশাব্যঞ্জক পরিবেশের সৃষ্টি করে।

মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেযবুত তওহীদের খুলনা বিভাগীয় সভাপতি তানভীর আহমেদ। হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান মিলনের সঞ্চালনায় এবং মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর জেলা সভাপতি ফিরোজ মেহেদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট ও প্রাচ্য সংঘের প্রতিষ্ঠাতা বেনজিন খান, মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পরিচালক মেজবা উল ইসলাম, বিশিষ্ট গীতিকার আশরাফুল হোসেন এবং একতা সংগীত একাডেমির পরিচালক সোহেল আহমেদসহ আরও অনেকে।

মূল প্রবন্ধে তানভীর আহমেদ বলেন, “একটি গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধর্মের খণ্ডিত ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে গান-বাজনা, শিল্প-সাহিত্যসহ সকল প্রকার সৃজনশীল চর্চাকে হারাম ফতোয়া দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এর ফলে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে এক কৃত্রিম বিভেদ তৈরি করা হয়েছে যা আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।” তিনি ইসলামের প্রকৃত দর্শন তুলে ধরে বলেন, “ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যা কিছু সত্য, সুন্দর, শাশ্বত এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত, ইসলাম তাকে সর্বদা উৎসাহিত করে। অশ্লীলতা, উগ্রবাদ, বেহায়াপনা ও যা কিছু মানুষকে অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে, কেবল সেগুলোই ইসলামে কঠোরভাবে বর্জনীয়।”

সংস্কৃতির শক্তি ও এর বর্তমান সংকট তুলে ধরে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “সংস্কৃতি কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয় এটি জাতি গঠনের, মানুষের চিন্তাকে পরিশুদ্ধ করার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজ ধর্মহীন, বাণিজ্যিক ও কুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছে, সমাজে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নৈতিকতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।”

এই সংকট থেকে উত্তরণের পথনির্দেশ করে তিনি বলেন, “জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। তওহীদভিত্তিক একটি গণমুখী ও মানবিক সংস্কৃতির ধারা নির্মাণ করতে হবে যা হবে সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। যে সংস্কৃতি মানুষকে সত্য, ন্যায়, সাম্য ও ঐক্যের কথা বলবে; জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে প্রেরণা যোগাবে। আমাদের শিল্পী ও সাহিত্যিকদের লেখনী, গান, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে মানবতার মুক্তির এই বার্তা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে হবে।”

আলোচনা সভা শেষে এক মনোজ্ঞ ও উদ্দীপনামূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে শিল্পীরা তাদের পরিবেশনার মাধ্যমে দেশাত্মবোধ ও গণজাগরণের চেতনাকে মূর্ত করে তোলেন। শিহরণ জাগানো গান, জ্বালাময়ী কবিতা আবৃত্তি এবং সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে নির্মিত একটি নাটিকা উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রতিটি পরিবেশনাই ছিল যেন অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক শৈল্পিক প্রতিরোধ।

অনুষ্ঠানে দেশের সকল শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের এই মহতী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। এই সাংস্কৃতিক জাগরণ যেন একটি টেকসই সামাজিক পরিবর্তনে রূপ নিতে পারে এবং একটি শান্তিময় ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় সেই আহ্বান জানান বক্তারা।