মোহাম্মদ সাঈদ বিন তারিক
আল কোর’আনে মহান আল্লাহ বলেছেন- “তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও আমলে সালেহ করে, আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে, যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করবেন (সুরা নুর- ৫৫)।”
এই আয়াতে মুমিনদের প্রতি আল্লাহর ওয়াদা হচ্ছে: (১) তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে খেলাফত, কর্তৃত্ব (চড়বিৎ) দান করা হবে। (২) তাদের দীনকে সু-প্রতিষ্ঠিত করা হবে। (৩) ভয়-ভীতির পরিবর্তে নিরাপত্তা (Security & Peace) প্রদান করা হবে। সে আলোকে আজকের মুমিন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী দাবিদার জাতিটির অবস্থান কোথায়? তাদের হাতে কি এই পৃথিবীর কর্তৃত্ব আছে? রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর কর্তৃত্ব তো দূরের কথা বর্তমান মুসলিম নামধারী জাতিটি পৃথিবীর সর্বত্র অন্য সব জাতি দ্বারা পরাজিত, অপমানিত, অবহেলিত, নিগৃহিত এবং প্রতিটি জাতির লাথি খাচ্ছে, সব জাতি তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখছে, তাদের রাষ্ট্রগুলো আক্রমণ কোরে দখল কোরে নিচ্ছে (যদিও প্রকৃত ইসলামে ভৌগোলিক জাতি রাষ্ট্রের কোন ধারণা নেই, সুতরাং তা শিরক)। ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত্র পুরো মুসলিম নামক এই জাতি, আরব অনারব নির্বিশেষে সকলে ভয়ে তাদের পায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মুমিন এর প্রতি আল্লাহর উল্লেখিত অঙ্গীকার থেকে বাস্তবতার দূরত্ব লক্ষ যোজন। সুতরাং যদি আল্লাহ সত্যি অঙ্গীকার রক্ষাকারী হয়ে থাকেন, তাহলে এই জাতি মুমিন হতে পারে না, এবং মুমিন না হওয়ার মানেই মুশরিক এবং কাফের হওয়া। কারণ আল্লাহ মানুষ সৃষ্টিই করেছেন দুই রকম: মুমিন ও কাফের (সুরা তাগাবুন ২)। আর যদি তাদের দাবি অনুযায়ী তারা মুমিন ও মুসলিম হয়ে থাকে, তাহলে অনিবার্যভাবে আল্লাহই ওয়াদা খেলাফকারী সাব্যস্ত হন (নাউযুবেল্লাহ)। কিন্তু আল্লাহর ওয়াদা যে অনিবার্য সত্য তার প্রমাণ- ইতিহাস এবং আল্লাহর ঐ কথা, “যেমন খেলাফত দান করেছিলাম তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে”। একটি নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বিশ্বের মধ্যে দরিদ্রতম আরব জাতি যখন আখেরী নবী মোহাম্মদ (দ:) এর অনুসারী হয়ে মো’মেনে রূপান্তরিত হলো, আল্লাহ ছাড়া সকল কর্তৃত্ব, সকল সার্বভৌমত্বের দাবিদারদের অস্বীকার করলো, ওয়াদা রক্ষাকারী আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর জাতি বানিয়ে দিলেন, তাদের সামনে সারা দুনিয়া সভয়-সম্ভ্রমে লুটিয়ে পড়লো। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে, সামরিক শক্তিতে এক কথায় সর্বদিক দিয়ে সে জাতি পৃথিবীর সকল জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন হয়েছিল। আর আজ ঐ অবস্থার ঠিক বিপরীত। এখন এই জাতিই সিদ্ধান্ত নিক যে, কোনটি সত্য, তাদের দাবি নাকি আল্লাহর ওয়াদা? তারা মুমিন হবার অর্থই হচ্ছে আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করেছেন অথবা তিনি তা পূরণ করতে অক্ষম (নাউযুবেল্লাহ)। নতুবা তারা মুমিন নয়, মুসলিম নয়, অন্য কোন সিদ্ধান্ত অসম্ভব।
পূর্বেই বলেছি- মুমিন না হওয়ার অর্থই হলো কাফের। কিন্তু শুধু এই যুক্তিতেই নয়, আরও অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে যা দ্বারা বর্তমানের মুসলিম নামধারী জাতি যে কার্যত কাফেরে পরিণত হয়েছে তা প্রমাণিত হয়। সে জন্য প্রথমেই আল কোর’আনে উদ্ধৃত কাফেরের সংজ্ঞা মোতাবেক এই জাতির অবস্থান যাচাই করা যাক। আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ যা নাযেল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলোতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবনে তাঁর নাযেল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মুমিন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি সু-সংহত উম্মাহরূপে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশি জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইউরোপিয় খ্রিস্টান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযেলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। ফলশ্র“তিতে তারা ফাসেক (অবাধ্য), জালেম (অন্যায়কারী) এবং কাফেরে (প্রত্যাখ্যানকারী) পরিণত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলোকে অপাংক্তেয় কোরে রেখে তারা ইহুদি-খ্রিস্টানদের আইন-কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন কোরে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।
পৃথিবীর কোথাও, একটি রাষ্ট্রেও আল্লাহর বিধান দিয়ে শাসনকার্য করা হয় না অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য করা হয় না। তবে পশ্চিম এশিয়ার সৌদী আরবে কিছু অপরাধের সাজা শরিয়াহ্র আইন দিয়ে করা হয়। কিন্তু যতদূর জানা যায় সেখানেও আইন সকলের জন্য সমান নয় এবং তাদের রাজা-বাদশাহ-আমীররা পশ্চিমা সভ্যতার নিকৃষ্ট গোলামিতে নিয়োজিত এবং তাদের কথায় ওঠে আর বসে। মুমিন হওয়ার জন্য যে পূর্বশর্ত আল্লাহ দিয়েছেন সেই শর্ত তাদের মধ্যেও অনুপস্থিত। সুতরাং বর্তমানের এই মুমিন দাবিদার জাতিটি প্রকৃতপক্ষে মুমিন হওয়া তো দূরের কথা কার্যত কাফেরে পরিণত হয়েছে- এটা আল কোর’আন দ্বারা স্বীকৃত ও প্রমাণিত।