মোহাম্মদ আসাদ আলী:
ধরুন আপনি ঢাকা থেকে সিলেট যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলেন। আপনি জানেন কোন রাস্তা ধরে সিলেট পৌঁছনো যায়। সেই মোতাবেক ভাঙ্গাচোরা কোনো বাসের ছাদে বসেও সিলেট পৌঁছে যেতে পারবেন। কিন্তু মনে করুন আপনি সিলেট পৌঁছনোর সঠিক রাস্তাটাই জানেন না, তাহলে আপনাকে নির্ভর করতে হবে কেবলই অনুমানের উপর। দেখা গেল যদিও আপনি একটি বিলাসবহুল বাসের আরামের আসন পেয়ে গেলেন কিন্তু দিনশেষে বাসটি আপনাকে সিলেট নয়, খুলনায় নিয়ে গেল। তাহলে এই বিলাসবহুল বাস ও আরামের আসন পেয়ে কী লাভ হলো? এ কারণে সঠিক রাস্তা জানা দরকার সবার আগে, তারপর আসে যাত্রাপথের কষ্ট কীভাবে লাঘব হতে পারে সেই বিষয়। ইসলামের বেলায় এই সঠিক রাস্তাটিই হচ্ছে ‘হেদায়াহ’, আর ‘তাকওয়া’ সেই রাস্তায় আরামে ভ্রমণ করা অথবা কষ্টে ভ্রমণ করা।
আপনি বেশি তাকওয়াবান হলে আপনার যাত্রা কম কষ্টদায়ক হবে, আর কম তাকওয়াবান হলে বেশি কষ্টদায়ক হবে, কিন্তু রাস্তা যদি ঠিক থাকে অর্থাৎ হেদায়াতে থাকেন তাহলে শেষ পর্যন্ত হতাশ হতে হবে না। ঠিকই আপনি জান্নাতে পৌঁছতে পারবেন। তাই আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়াহ অর্থাৎ সঠিক রাস্তা দেখিয়েছেন। সেটা হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই এই সাক্ষ্য দেওয়া। যিনি এই সাক্ষ্য দিলেন তিনি জান্নাতের রাস্তায় উঠলেন, এই রাস্তা তাকে পৃথিবীতে শান্তি ও পরকালে জান্নাতে নিয়ে যাবে। আর যিনি এই সাক্ষ্য দিলেন না বা প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি ভুল রাস্তায় উঠলেন। তার দুনিয়া হবে অশান্তিময় আর পরকালে অপেক্ষা করছে যন্ত্রণাময় জাহান্নাম। এখানে হেদায়াত অর্থাৎ সঠিক রাস্তাটাই হচ্ছে প্রধান, তাকওয়া তো তাদের জন্য যারা হেদায়াতে বা সঠিক রাস্তায় চলতে চায়।
একদিন আল্লাহর রসুল বললেন, ‘যে ব্যক্তি বলল আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই সে জান্নাতে যাবে।’ একজন সাহাবী আবু যার (রা.) বললেন, যদি সে চুরি ও ব্যভিচার করে তবুও? আল্লাহর রসুল বললেন তবুও জান্নাতে যাবে। এ কথায় সাহাবী কতটা বিস্মিত হলেন তা বোঝা যায় এ থেকে যে, তিনি বারবার রসুলকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন- চুরি ও ব্যভিচার করার পরও? তখন আল্লাহর রসুল বললেন, হ্যাঁ, সে চুরি করলেও, ব্যাভিচার করলেও, এমনকি আবু যরের নাক কেটে দিলেও। (হাদীস: বোখারী ও মুসলিম) এই হাদীসে আল্লাহর রসুল একজন চোর ও ব্যাভিচারীকেও জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন কারণ সেই ব্যক্তি তওহীদের ঘোষণা দিয়েছে। যতক্ষণ সেই ব্যক্তি তওহীদের স্বীকৃতি দিচ্ছে ততক্ষণ সেই ব্যক্তি ‘হেদায়াতে’ আছে, অর্থাৎ সঠিক রাস্তায় আছে। রিপুর তাড়নায় তার অপরাধে জড়িয়ে পড়াটা হচ্ছে তাকওয়ার ঘাটতি, যা তার মর্যাদার স্তর কমিয়ে দেয়, কিন্তু জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয় না।
বর্তমানে আমাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও আকীদা না বোঝার কারণে এই হাদীসটির প্রকৃত মর্মার্থ অনেকেই বুঝি না। আমরা ইলাহ শব্দের অর্থ করি মাবুদ শব্দ দিয়ে, অর্থাৎ আরবির অনুবাদ আরবি দিয়ে। মাবুদ মানে উপাস্য, ইলাহ মানে যদি উপাস্যই হত তাহলে ইসলামের কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ না হয়ে ‘লা মাবুদ ইল্লাল্লাহ’ হত। প্রকৃতপক্ষে ইলাহ অর্থ হুকুমদাতা, সার্বভৌমত্বের মালিক, যার হুকুম-বিধান ছাড়া অন্য কারো হুকুম-বিধান মানা যাবে না। সে অর্থে যে ব্যক্তি এই সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তার দ্বারা সে কার্যত আল্লাহর দেওয়া দ্বীন, বিধানের পরিপন্থী অন্য সমস্ত হুকুম, বিধান (দ্বীন) অস্বীকার করল। এই ব্যক্তির জন্যই আল্লাহর রসুল বললেন সে জেনা করলেও চুরি করলেও আল্লাহ তাকে জান্নাত দিবেন।
যদি কোনো সমাজে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয় তার অর্থ ঐ সমাজের মানুষগুলো যাবতীয় অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। ফলে তাদের জাতীয়, সামাজিক, পরিবারিক ও ব্যক্তিজীবন থেকে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ইত্যাদি প্রায় নির্মূল হয়ে যাবে। মানুষ সুযোগ থাকার পরও দুর্নীতি করবে না, অন্যের অধিকার নষ্ট করবে না, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর হবে না। কেননা তাদের চিন্তাধারাতেই পরিবর্তন এসে যাবে। রাস্তা সোজা হলে যেমন গাড়ি বাঁকা হয়ে চলতে পারে না, তেমনি জাতীয় জীবনে ন্যায়-সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যক্তিজীবন স্রোতের বিপরীতে খুব বেশিদিন অন্যায় চালিয়ে যেতে পারে না। তাই চুরি, ব্যাভিচার ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানো পরে, তওহীদ বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নিয়ে মাথা ঘামানো আগে। যে জনগোষ্ঠী অত্যন্ত উৎসাহের সাথে জাহান্নামের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে আগে তাদেরকে জান্নাতের রাস্তা দেখানো দরকার, তারপর ভাবা যাবে ঐ জান্নাতের রাস্তা ধরে তারা হেঁটে যাবে নাকি দৌড়ে যাবে নাকি ঘোড়ায় চেপে যাবে।
আমাদের চোখে ব্যভিচারীর অপরাধটাই বড় আকারে ধরা দেয়, কিন্তু আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করা যে তারচেয়েও বড় অপরাধ তা অনেকেই ভেবে দেখেন না। ধরুন দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ রিপুর কাছে পরাজিত হয়ে ব্যাভিচারে প্রবৃত্ত হলো। এতে সমাজের লাভ-লোকসান খুব বেশি জড়িত নেই। মূল ক্ষতিটা হলো ঐ দু’জনেরই। তাদেরই আত্মা অপবিত্র হলো, নৈতিক পদস্খলন ঘটল। কিন্তু যখন অন্যান্যদের মত ঐ দুইটি মানুষও আল্লাহর তওহীদের ঘোষণা দিল তখন তা থেকে কেবল ওরা নিজেরাই উপকৃত হলো না, পুরো জাতি উপকৃত হলো। যেমন- আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর ভিত্তি করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হলো। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেখানকার মানুষগুলোর অন্তরাত্মাও পরিবর্তিত হয়ে গেল। যে চুরি-ব্যভিচার নিয়ে এতকিছু, সেই অপরাধগুলোও শূন্যের কোঠায় নেমে গেল। আমরা ইসলামের ইতিহাসেই এ কথার প্রমাণ পাই। বিশ্বনবী বললেন, চুরি ও ব্যাভিচার করলেও সে জান্নাতে যাবে যদি সে এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই। এ কথা শুনে কিন্তু লোকজন চুরি ও ব্যাভিচারে মত্ত হয়ে গেল না। বরং ইতিহাস উল্টো কথাটিই বলে, দেখা গেল সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অপরাধ ইত্যাদি নির্ম‚ল হয়ে গেল। মানুষ রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না। স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে নামাজে যেত। যাকাত দেওয়ার জন্য পথে পথে ঘুরত গ্রহণ করার মত কাউকে পেত না। আদালতে মাসের পর মাস অপরাধ সংক্রান্ত কোনো মামলা আসত না। এমনকি মানুষের মানসিক ও আত্মিক পরিবর্তন এই পর্যন্ত হয়েছিল যে, কেউ যদি রিপুর তাড়নায় জেনা/ব্যাভিচার করেও ফেলত এবং তা কারো দৃষ্টিগোচরও হত না, তবু সে ভুল বুঝতে পেরে এতই অনুতপ্ত হত যে, নিজেই নিজের বিচার দাবি করত। এমনই একজন ব্যাভিচারীকে আল্লাহর রসুল ক্ষমা করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে এতই নাছোড়বান্দা ছিল যে, বারবার নিজের বিচার দাবি করতে লাগল। ফলে তাকে দÐ প্রদান করা হলো। এই হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার ফল- মানুষের চরিত্র থেকেই অন্যায় ও পাপ নির্মূল হয়ে যাওয়া, যে পরিবেশ আজকে আমরা হাজারো আইন-কানুন, দণ্ডবিধি প্রনয়ণ করেও তৈরি করতে পারছি না।
আজ কোথাও আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি নেই, তওহীদ প্রতিষ্ঠিত নেই, ফলে ন্যায়, শান্তি, সুবিচারও নেই। মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধিও নেই। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মসজিদ আছে, কোটি কোটি নামাজী আছেন, রোযাদার আছেন, হাজ্বী আছেন। তারা নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন কীভাবে আরও তাকওয়াবান হওয়া যায়, আরও বড় পরহেজগার হওয়া যায়। এভাবে তলাবিহীন ঝুড়ি ভরার মত তওহীদহীন আমল করা হবে বলেই হয়ত আল্লাহর রসুল ঐ কথাগুলো বলেছিলেন। আমরা কবে বুঝব যে, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে, আল্লাহকে কেবল ব্যক্তিজীবনের ইলাহ মনে করে, আর জাতীয় জীবনে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে ইলাহ (হুমকুম-বিধানদাতা) মনে করে আমরা বহু পূর্বেই চুরি ও ব্যভিচারের চাইতেও বড় গুনাহ, ক্ষমার অযোগ্য গুনাহ করে বসে আছি এবং সেই গুনাহের ভারেই আমাদের মুসলিমপ্রধান দেশগুলো একের পর এক মুখ থুবড়ে পড়ছে ঐ পশ্চিমা অপশক্তিগুলোর পায়ের কাছে?