রাষ্ট্রসংস্কার হোক আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে: বরিশালে মতবিনিময় সভায় বক্তারা

প্রতিয়মাণ সংকট থেকে উত্তরণে ‘তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’র প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে হেযবুত তওহীদ। বুধবার (২০ আগস্ট) সকাল ১১টায় বরিশাল প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় সংগঠনটি তাদের প্রস্তাবিত আল্লার হুকুমের ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরে। সভায় সাংবাদিক, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থেকে তাদের মূল্যবান মতামত প্রকাশ করেন।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেযবুত তওহীদের সাহিত্য সম্পাদক রিয়াদুল হাসান। তিনি সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতা হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম রচিত ‘তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ গ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রকাঠামোর ধারণা দেন।

রিয়াদুল হাসান বলেন, “স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে সংবিধানে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, অসংখ্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু জাতির কোনো মৌলিক সংকটের টেকসই সমাধান হয়নি। এর কারণ হলো মানবরচিত জীবনব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা দলের পক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি, যা ইসলামেরও হাজার বছর পুরোনো। অথচ অনেকে কোরআনের বিধানকে ১৪০০ বছরের পুরোনো বলে অচল মনে করেন। ব্রিটিশ আইনের অন্ধ অনুকরণ দেশে মামলার জট বাড়াচ্ছে এবং সমাজে অন্যায়-অবিচারের মাত্রা বেড়েই চলেছে।”

তিনি বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সাথে ইসলামের বিরোধ নাই। ইসলামেও মুসল্লিদের অসন্তুষ্টি নিয়ে কেউ ইমামতি করতে পারে না, ইমাম অবশ্যই মুসল্লিদের সমর্থিত হতে হবে, তাকে নিঃস্বার্থভাবে আনুগত্য করতে হবে। নামাজের নকশাটাই মুসলমান সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত; যেখানে ইমামের আনুগত্য করা, তার প্রতি সমর্পিত হওয়া, তাকে সমর্থন করার শিক্ষা দেয়া হয়। জোর-জবরদস্তি করে আনুগত্য আদায় করা ইসলামের নীতিবিরুদ্ধ।
তিনি আরো বলেন, চলমান গণতান্ত্রিক সিস্টেমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পার্লামেন্টে গিয়ে নিজেরা আইন রচনা করেন। এই জায়গায় মানুষ হয়ে যায় বিধানদাতা। আমাদের কথা হচ্ছে, বিধানদাতা, ইলাহ একমাত্র আল্লাহ। এই বেসিক পার্থক্যটা খুব বাস্তবিক। কার হুকুমে জাতীয় জীবন চলবে, বিধান কোনটা চলবে? এটা বড় প্রশ্ন। কুরআনের উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেন, কুরআনে আল্লাহ বলছেন, তাঁকে পূর্ণাঙ্গরূপে বিশ্বাস করতে। আল্লাহকে আংশিক বিশ্বাস করা, আংশিক মান্য করা হচ্ছে শিরক।

বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথির হেযবুত তওহীদের ঢাকা বিভাগীয় সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রভার গ্রহণ করার পরেই বলেছেন যে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। এবং এই সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিশনও গঠন করা হয়েছে। আমরা হেযবুত তওহীদ গত ৩০ বছর ধরে এই কথাটাই বলে আসছি যে, বর্তমান প্রচলিত যে সিস্টেমে আমাদের রাস্ট্র পরিচালনা করা হচ্ছে সেটা আমাদেরকে শান্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই সিস্টেমটাকে পরিবর্তন করতে হবে। এই সিস্টেম পরিবর্তন না করলে আমরা কখনোই শান্তি পাব না। এই ব্যাপারে বর্তমান সরকার দেশবাসীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যে কোনো মহল থেকে কেউ চাইলে সংস্কারের প্রস্তাবনা দিতে পারবে। সরকারের এই আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা সরকারকে একটা প্রস্তাবনা দিয়েছি। পরবর্তীতে সেই প্রস্তাবনাটিকেই আমরা বই আকারে প্রকাশ করেছি। এবং এই বইটাকে আমরা দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছি। হেযবুত তওহীদ প্রস্তাবিত ‘তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের এই সংকটময় অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে মতামত প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বরিশাল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ৫৩ বছরে এ পর্যন্ত ১৭ বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে কিন্তু আমরা কি স্বাধীন হতে পেরেছি? প্রশ্ন রাখেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা নিজেরাই এখনো স্বাধীন হতে পারিনি। আমরা স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে পারি না, সত্য সংবাদ প্রকাশ করতে গেলে আমাদের কণ্ঠনালী চেপে ধরা হয়। -অভিযোগের সুরে বলেন এই বিশিষ্ট সাংবাদিক।

এদেশে আমরা যত ওয়াজ মাহফিল শুনি, ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের কথার সঙ্গে বাস্তবের কিন্তু কোন মিল নেই। এক কথায় থিউরি এক জিনিস আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। – হতাশা প্রকাশ করে বলেন তিনি।

হেযবুত তওহীদ প্রস্তাবিত ‘তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’র প্রশংসা করে তিনি বলেন, আপনারা যে কঠিন কাজ হাতে নিয়েছেন এটা যদি আপনারা বাস্তবায়ন করতে পারেন তাহলে সেটাকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। আপনারা চেষ্টা করে দেখুন এই অসম্ভব কাজকে আপনারা সম্ভব করতে পারেন কিনা।’

বরিশাল প্রেসক্লাবের কাযনির্বাহী সদস্য ও দৈনিক মতবাদ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়া বলেন, ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আর ওদিকে অ্যামেরিকা স্কুল প্রতিষ্ঠা করল হিন্দুদের জন্য। বাংলাদেশে যতগুলি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে এই দলগুলো এখনো আমেরিকা ইংল্যান্ডের টাকায় চলে, এটা কিন্তু আমরা পরিষ্কার। তারা কিন্তু চায় না কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসুক আবার তারা এটাও চায় না যে তারা একেবারে ডুবে যাক। এদেরকে তারা ইচ্ছা করে বাঁচিয়ে রাখছে কারণ এদেরকে বাঁচিয়ে রাখলে এরা নিজেরাই নিজেরা দ্বন্দ্ব করবে।

তিনি আরো বলেন, একদলে বলে দোয়াল্লিন হবে আর একদল বলে জোয়াল্লিনন হবে। এইতো কয়েক বছর আগেও চরমোনাই তারা জামাত-শিবিরের ঘোর বিরোধী ছিল, কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং শুনতে পাচ্ছি জামাত এবং চরমোনাই একসঙ্গে ঐক্যজোট বেঁধে নির্বাচনে নামবে। তো আমার মূল কথা হচ্ছে, আপনারা যে কাজ হাতে নিয়ে নেমেছেন এটা অনেক বিশাল বড় এক কাজ। তবে আপনাদের এই কাজের সামনে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। দেখুন আপনারা এটাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন কিনা। হেযবুত তওহীদের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানান তিনি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নারী বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ১৪০০ বছর পরে এসে আজও নারীরা নানভাবে হেনস্থা, নিপীড়িত, নির্যাতিত। তারা তাদের ন্যায্য অধিকার, মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলমান সিস্টেমের মধ্যে থেকে যত সংস্কারই হোক না কেন নারীদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না। একমাত্র আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম, তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই নারীদের প্রকৃত অধিকার, মর্যাদা দিতে সক্ষম।

সভায় মতামত প্রকাশ করে বিশেষ অতিথি মিজানুর রহমান প্রিন্স ‘তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা’ প্রস্তাবনার প্রশংসা করে বলেন- আপনাদের কথাগুলো শুনলাম। আপনারা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। প্রতিটি কথা দেশের কল্যাণে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য এবং দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করার তাগিদ দেন তিনি।

সংগঠনটির বরিশাল জেলা সভাপতি লোকমান হোসেনের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত থেকে তাদের মূল্যবান মতামত প্রকাশ করেন বরিশাল প্রেসক্লাবের কাযনির্বাহী সদস্য ও দৈনিক মতবাদ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়া, জাগো নারী পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক গোপাল সরকার প্রমুখ। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি শফিকুল আলম উখবাহ, আঞ্চলিক আমির রুহুল আমিন মৃধা, ঢাকা বিভাগের সহ-সভাপতি আল আমিন সবুজ, বরিশাল মহানগর সভাপতি আরিফ হোসেন প্রমুখ।

বক্তারা আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করে মহানবী (সা.) যেভাবে একটি নিরাপদ ও আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার উদাহরণ তুলে ধরেন। তারই আলোকে একটি তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রনীতি, বিচারব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা, গণমাধ্যম, নারীর মর্যাদা, আইনসভা ও সামাজিক সুরক্ষাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ কীভাবে পরিচালিত হবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে আসে আলোচনায়।

উল্লেখ্য, উক্ত প্রস্তাবনা বিষয়ে সারাদেশে সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা করে আসছে সংগঠনটি।