হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

পবিত্র আশুরা সম্পর্কে বিদ্রোহী কবির লেখা একটি অসামান্য প্রবন্ধ

কাজী নজরুল ইসলাম

ইরানে অনুষ্ঠিত তাজিয়া মিছিলে শিয়াদের মাতমের দৃশ্য

মহররম

ফিরে এসেছে আজ সেই মোর্হরম – সেই নিখিল-মুসলিমের ক্রন্দন-কাৎরানির দিন। কিন্তু সত্য ক’রে আজ কে কেঁদেছে বলতে পার হে মুসলিম? আজ তোমার চোখে অশ্রু নাই। আজ ক্রন্দন-স্মৃতি তোমার উৎসবে পরিণত। তোমার অশ্রু আজ ভণ্ডামি, ক্রন্দন আজ কৃত্রিম কর্কশ চিৎকার। “হায় হাসান, হায় হোসেন!” ব’লে মিথ্যা বীভৎস চিৎকার ক’রে আর মা ফাতেমার পুত্র-শোকাতুর আত্মাকে পীড়িত ক’রে তুলো না। এ ক্রন্দন অভিনয় দেখিয়ে আল্লাহর মুখ আর কালো ক’রে দিও না। তোমাদের ঐ যে উদ্দাম বুক-চাপড়ানির বীভৎসতা, সে ব্যর্থ হয়নি ভীরুর দল! সে-আঘাত আল্লার হাবিব হযরত মোহাম্মাদের (দ.) বুকে গিয়ে বেজেছ। যাঁরা ধর্মের জন্যে, সত্যের জন্যে জান কোরবান করেছেন, আজ সেই শহীদ বীরদের জন্যে ক্রন্দন-অভিনয় ক’রে আর তাঁদের আত্মার অপমান ক’রো না, নৃশংস অভিনেতার দল! তোমার ধর্ম নাই, অস্তিত্ব নাই, তোমার হাতে শমশের নাই, শির নাঙ্গা, তোমার কোর’আন পদদলিত, তোমার গর্দানে গোলামির জিঞ্জীর, যে শির আল্লার আরশ ছাড়া আর কোথাও নত হয় না, সেই শিরকে জোর ক’রে সেজদা করাচ্ছে অত্যাচারী শক্তি- আর তুমি করছ আজ সেই শহীদদের – ধর্মের জন্য স্বাধীনতার জন্য শহীদদের – ‘মাতমের অভিনয়! আফ্সোস মুসলিম! আফ্সোস!!

কোথায় কারবালা-মাতম তা কি দেখেছ, অন্ধ? একবার চোখ খুলে দেখ, দেখবে কোথায় কারবালার দুপুরে মাতম হাহাকার রবে ক্রন্দন ক’রে ফিরেছে। আজ কারবালার হাহাকার ঐ নিখিল নিপীড়িত মুসলিমের বুকের সাহারায়, তোমার অপমান-জর্জরিত অশ্রু-নদীর কুলে কুলে!

মা ফাতেমা আরশের পায়া ধ’রে কাঁদছেন, স্কন্ধে তাঁর হাসানের বিষ-মাখা- নীল পিরান আর হোসেনের খুন-মাখা রক্ত-উত্তরীয়। পুত্র-হারার আকুল ক্রন্দনে খোদার আরশ কেঁপে উঠছে। হে যুগে-যুগে শোক-অভিনেতা মুসলিমের দল! থামাও – থামাও মা ফাতেমার ক্রন্দন – থামাও আল্লার আরশের ভীতি-কম্পন। তোমার স্বাধীনতাকে তোমার সত্যকে তোমার ধর্মকে যে এজিদের বংশধরেরা লাঞ্ছিত নিপীড়িত ক’রছে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের ভূ-অবলুণ্ঠিত শির উচু হ’য়ে উঠুক। তোমার ইসলামকে অক্ষতদেহ উন্নত শির করে রাখ, তোমার স্বাধীনতা তোমার সত্যকে রক্ষা কর, দেখবে পুত্র-শোকাতুরা জননী মা ফাতেমার ক্রন্দন থেমে গিয়েছে, আল্লার আরশের কম্পন থেমেছে। ঐ শোন কাশেমের অতৃপ্ত আত্মা ফরিয়াদ করে ফিরেছে– ‘তৃষ্ণা, তৃষ্ণা!” কে দেবে এ-তৃষ্ণাতুর তরুণকে তৃষ্ণার জল? এ-তৃষ্ণা আবে-জমজম আবে-কাওসারেও মিটবার নয়। এ-কারবালার মরু-দগ্ধ পিয়াসী চায় নিখিল-মুসলিম তরুণের রক্ত, ধর্ম আর স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে প্রাণ-বলিদান। কে আছ অরুণ-খুনের তরুণ শহীদ মুসলিম, কাসেমের এ-তৃষ্ণা এ-ক্রন্দন তিক্ততা মেটাবে?

ঐ শোনো সদ্য স্বামীহারা বালিকা সাকিনার মর্মভেদী ক্রন্দন, সে চায় না তার স্বামী কাসেমের প্রাণ, সে চায় ইসলামের স্বাধীনতা-রক্ষার জন্যে কাসেমের মত বলিদান।

আজ নিখিল মুসলিম-অঙ্গন তোমার কারবালা-প্রান্তরে হে মুসলিম! তার মাঝে আকুল অবিশ্রাম ক্রন্দন গুমরে ফিরছে—“তৃষ্ণা—-তৃষ্ণা!” আল্লাহর পানে তাকাও, রসুলের দিকে চেয়ে দেখ, মা ফাতেমা, হযরত আলীর মাতম শোনো, কাসেমের, সকিনার-অতৃপ্তির আকুল কাঁদন-রণরণি শোনো, কচি শিশু আসগরের তীর-বেঁধা কাঁচা কলিজার খুন-খারাবির কথা স্মরণ কর, আর তোমার কর্তব্য নির্ধারণ কর, হে মুসলিম! মোহররমের খুন-খারাবি আজ তোমার লক্ষ্য স্থির করে দিল।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...