হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দাসত্বপ্রথা নিয়ে ইসলামবিদ্বেষী অপবাদের খন্ড

ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের উপর যে অপবাদগুলি আরোপ করে থাকে তার মধ্যে একটি বড় অপবাদ হচ্ছে, ইসলামে নাকি দাসপ্রথাকে উৎসাহিত করা হয়েছে, এখানে যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাসরূপে এবং যুদ্ধবন্দিনীদের যৌনদাসীরূপে ব্যবহার করা যায়। এই ধারণাটি এত সর্বব্যাপী যে ইসলামের আলেমরাও এই ধারণাকেই অনেকাংশে মেনে নিয়েছেন, তারা বিষয়টি অস্বীকার করতে পারেন না কারণ ইসলামবিদ্বেষীরা পবিত্র কোর’আনের বেশ কিছু আয়াত তাদের বক্তব্যের পক্ষে উল্লেখ করেন এবং দেখিয়ে দেন যে, সত্যিই ইসলামে দাসপ্রথা আছে এবং ‘গনিমত হিসাবে প্রাপ্ত দাসীদেরকে’ উপপত্নীরূপে ব্যবহার করার অনুমতিও রয়েছে। তাদের এইসব যুক্তির উপযুক্ত জবাব দিতে ব্যর্থ আলেমরা ইসলামের অবমাননায় ক্ষুণ্ণ হয়ে দুর্বল কণ্ঠে বলার চেষ্টা করেন যে, হ্যাঁ, দাসপ্রথা আছে বটে, কিন্তু তাদেরকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে সেগুলি আইয়ামে জাহেলিয়াতের চেয়ে অনেক বেশি। আসলে বিষয়টি তা নয়, প্রকৃত সত্য হলো, ইসলামে জোরপূর্বক শ্রমব্যবস্থা বা দাস ব্যবস্থাই নেই, তাই দাসদের অধিকার দেওয়ার প্রসঙ্গও আসে না। অধিকার দেওয়ার কথা সেবকদের, দাসদের তো মুক্ত করেই দিতে বলা হয়েছে। আমরা এই ভুল ধারণাটি ভেঙ্গে দিয়ে এ প্রসঙ্গে প্রকৃত ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিটি তুলে ধরতে চাই। প্রচলিত কোর’আনে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কয়েকটি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আরবি-বাংলা অভিধান মোতাবেক সেই পরিভাষাগুলির সঠিক অর্থগুলি এখানে দেয়া হলো।

(১) রাকাবাত: ক্রীতদাস, ঘাড়ে দড়ি বাঁধা (১০৪৭ পৃ: ১ম খন্ড) সুতরাং সরল অর্থে রাকাবাত হচ্ছে ক্রীতদাস যার কোনো স্বাধীনতা থাকে না। তাকে জোরপূর্ব কাজে লাগানো হয়, বা এমন ব্যবস্থা কায়েম করা হয় যে, সে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাসত্বের শৃঙ্খল পরতে বাধ্য হয়।

(২) মালাকাত আয়মান: মালাকাত অর্থ: মানুষের ভিতরগত গুণ বা যোগ্যতা, প্রতিভা, আমি তার পূর্ণ মালিক (৮৪২ পৃ: ২য় খন্ড), আর আয়মান অর্থ: ডানদিক, সৌভাগ্য, শক্তি, সামর্থ্য (১১০১ পৃ: ২য় খন্ড)। সুতরাং মালাকাত আয়মান অর্থ যারা ন্যায়সঙ্গতভাবে, স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের ভিতরকার গুণ, যোগ্যতা, প্রতিভা সবকিছু সহকারে সামর্থ্যবানের অধিকারভুক্ত হয়। অনুবাদকরা কেউ কেউ একে অনুবাদ করেছেন, ‘তোমাদের ডান হস্ত যাদেরকে অধিকার করিয়াছে’। এই অনুবাদ পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে না, স্বেচ্ছায় আনুগত্য স্বীকারের ধারণাটি এতে অনুপস্থিত থাকে।

(৩) আব্দ: দাস, ক্রীতদাস, গোলাম, উপাসক, সেবক, বান্দা, চাকর, দাসত্বে নিষ্ঠাবান দাস, যার পিতামাতাও দাস, বংশগত চাকর, নির্ভেজাল চাকর। এই শব্দটি আল্লাহ মানুষের ক্ষেত্রে বহুবার ব্যবহার করেছেন।

(৪) আমাতু: দাসী, বাঁদি, পরিচারিকা।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, কোর’আনের অনুবাদকরা আল্লাহর ব্যবহৃত এই সবগুলি শব্দেরই প্রায় একই অনুবাদ করেছেন শুধুমাত্র ‘দাস-দাসী’। এটা নিঃসন্দেহে ভুল অনুবাদ, কারণ সবগুলি শব্দের যদি একই অর্থ হতো, তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আলাদা আলাদা শব্দ ব্যবহার না করে একটি শব্দই ব্যবহার করতেন। এবার কোর’আনের এ সংক্রান্ত আয়াতগুলি লক্ষ করি। এখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকৃত কোর’আনের অনুবাদ উল্লেখ করা হয়েছে।

১. পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোনো পূণ্য নাই; কিন্তু পূণ্য আছে কেহ আল্লাহ, পরকাল, মালায়েকগণ, সমস্ত কেতাব এবং নবীগণে ঈমান আনয়ন করিলে এবং আল্লাহ প্রেমে আত্মীয় স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করিলে, সালাহ কায়েম করিলে ও যাকাত প্রধান করিলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়া তাহা পূর্ণ করিলে, অর্থ সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম সংকটে ধৈর্য ধারণ করিলে। ইহারাই তাহারা যাহারা সত্যপরায়ণ এবং ইহারাই মোত্তাকী (বাকারা- ১৭৭)।শিক্ষা: এ আয়াতে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে রাকাবাত। যখন দাস ক্রয় বিক্রয় প্রচলিত ছিল সেই যুগে দাসদের কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর এই আয়াতে মো’মেনদের উৎসাহিত করছেন। আবু বকর (রা.) সহ আরও অনেক সাহাবী কাফেরদের কাছ থেকে দাসদের ক্রয় করে নিয়ে আযাদ করে দিয়েছেন, বেলাল (রা.) ছিলেন সেই মুক্তদাসদের অন্যতম যিনি ছিলেন রসুলাল্লাহ সার্বক্ষণিক সহচর এবং যাকে রসুলালস্নাহ মোয়াজ্জেন হিসাবে সম্মানিত করেছিলেন। কাজেই যেখানে দাসদের মুক্ত করে দেওয়াকে পুণ্যের কাজ বলা হয়, সেই দাসদেরকে আবার মো’মেনদের অধীনস্থ করে রাখার কথা আলস্নাহ বলতে পারেন না।

২. মোশরেক নারীকে ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা বিবাহ করিও না। মোশরেক নারী তোমাদিগকে মুগ্ধ করিলেও, নিশ্চয়ই মো’মেন কৃতদাসী তাহা অপেক্ষা উত্তম। ঈমান না আনা পর্যন্ত মোশরেক পুরুষ সহিত তোমরা বিবাহ দিও না, মোশরেক পুরুষ তোমাদিগকে মুুুুুুুুগ্ধ করিলেও, মো’মেন কৃতদাস তাহা অপেক্ষা উত্তম (বাকারা- ২২১)।

শিক্ষা: এ আয়াতে আল্লাহর ‘আমাতু মো’মেনাতুন’, ‘আবদে মো’মেন’ শব্দ দু’টি ব্যবহার করেছেন যার অর্থ মো’মেন কৃতদাসী এবং মো’মেন কৃতদাস। অনেকে তখনও রসুলাল্লাহর প্রতি ঈমান এনে মো’মেন মো’মেনা হয়েছিলেন কিন্তু কাফেরদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হন নি। এই সব বন্দীদের সম্মান ও মর্যাদা মোশরেকদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। এমন কি মো’মেনদের সমাজেও যারা পরিচারক-পরিচারিকা বা সেবকের কাজ করে থাকে মোশরেক বিয়ে করা থেকে তাদেরকে বিয়ে করা উত্তম। উপরন্তু, এ আয়াতে আলস্নাহ উক্ত পরিচারিকাদেরকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন, উপপত্নি হিসাবে গ্রহণ করতে বলেন নি।

৩. তোমরা আল্লাহর এবাদত করিবে ও কোনো কিছুকে তাঁহার শরিক করিবে না; এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করিবে। নিশ্চয়ই আলস্নাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে (নিসা- ৩৬)।

শিক্ষা: আল্লাহর এক্ষেত্রে শব্দ ব্যবহার করেছেন মালাকাত আয়মান যার অর্থ যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের মন প্রাণ মো’মেনের সেবায় সমর্পিত করেছেন। এই ব্যক্তি আর ক্রীতদাস কি এক তাৎপর্য বহন করে? মালাকাত আয়মান তার এই সেবাকর্মে নিয়োজিত থাকা বা না থাকার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীন।

৪. যাহারা নিজেদের স্ত্রীগণের সহিত জেহার (নিজের স্ত্রীকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা) করে এবং পরে উহাদের উক্তি প্রত্যাহার করে, তবে একে অপরকে স্পর্শ করিবার পূর্বে একটি দাস মুক্ত করিতে হইবে, ইহা দ্বারা তোমাদিগকে উপদেশ দেওয়া যাইতেছে। তোমরা যাহা কর আলস্নাহ তাহার খবর রাখেন (সুরা মুজাদালা- ৩)। [আরও দেখুন সুরা বালাদ- ১৩, ১৪, সুরা নেসা- ৯২, সুরা মায়েদা- ৮৯]

শিক্ষা: শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে রাকাবাত। নিজের স্ত্রীকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা একটি গর্হিত কাজ। এই কাজের জন্য আলস্নাহ কাফফারা ঠিক করলেন একজন রাকাবাত বা ক্রীতদাস মুক্ত করা। পাপ স্খলনের জন্য প্রায়শ্চিত্যরূপে যে কাজটি করার নির্দেশ আলস্নাহ দিচ্ছেন সেই কাজ নিঃসন্দেহে একটি পুণ্যের কাজ। অনেক সাহাবীরই জাহেলি যুগের কেনা ক্রীতদাস ছিল। আল্লাহর অভিপ্রায় হচ্ছে পৃথিবীর সকল মানুষ হবে পরম স্বাধীন, তাই তিনি দাসমুক্তির জন্য মো’মেনদেরকে উৎসাহিত করলেন এবং মুক্তির বিভিন্ন পথ দিলেন, তার মধ্যে কাফফারা একটি। মো’মেন হত্যা করার জন্যও, বৃথা শপথের জন্য দাসমুক্ত (রাকাবাত) করার বিধান আল্লাহর দিয়েছেন।

৫. আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাহাকেও কাহারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছেন। যাহাদিগকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হোইয়াছে তাহারা তাহাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদিগকে নিজেদের জীবনোপকরণ হোইতে এমন কিছু দেয় না যাহাতে উহারা এ বিষয়ে তাহাদের সমান হইয়া যায়। তবে কি উহারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করে? (নাহল- ৭১)

শিক্ষা: আয়াতে ব্যবহৃত “মালাকাত আয়মান” শব্দটির প্রকৃত অর্থ দাস-দাসী নয়, এর অর্থ স্বেচ্ছা-সমর্পিত সেবক। এই সেবকদেরকে দান করার ব্যাপারে কোনোরূপ কার্পণ্য যেন না করা হয় সে বিষয়ে আলস্নাহ মো’মেনদেরকে এ আয়াতে সাবধান করেছেন। এমনভাবে তাদেরকে জীবনোপকরণ থেকে দান করেতে বলেছেন যেন তারাও পার্থিব সম্পদে তার মনিবের সমকক্ষ হয়ে গেলেও কার্পণ্য না করা হয়।

৬. হে মো’মেনগণ! তোমাদিগের মালিকানাধীন দাস-দাসীগণ এবং তোমাদিগের মধ্যে যাহারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় নাই তাহারা যেন তোমাদিগের কক্ষে প্রবেশ করিতে তিন সময়ে অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের সালাতের পূর্বে, দ্বিপ্রহরে যখন তোমরা তোমাদিগের পোশাক খুলিয়া রাখ তখন এবং এশার সালাতের পর; এই তিন সময় তোমাদিগের গোপনীয়তার সময়। এই তিন সময় ব্যতিত অন্য সময়ে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করিলে তোমাদিগের জন্য ও তাহাদের জন্য কোনো দোষ নাই। তোমাদিগের এককে অপরের নিকট তো যাতায়াত করিতেই হয়। এমনি করিয়া আল্লাহর তোমাদিগের নিকট তাঁহার নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন। তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (নূর- ৫৮)।

শিক্ষা: মালাকাত আয়মানরাও মো’মেনদের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ঐ তিন একান্ত গোপনীয়তার (Privacy) সময় ছাড়া সব সময় গৃহের সর্বত্র যাতায়াতের জন্য অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন। এই অধিকার ক্রীতদাসদের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না।
উলেস্নখিত আয়াতগুলি থেকে এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, ইসলামে দাসপ্রথা নেই, যেটা আছে সেটা সম্মতিপূর্বক সেবাদান। আল্লাহর দেওয়া জীবন-ব্যবস্থায় কী অপূর্ব সমন্বয়! একদিকে জাহেলি যুগে যে দাস-দাসীদেরকে জোর করে আনা হয়েছিল অর্থাৎ রাকাবাত, তাদেরকে বিভিন্ন পন্থায় মুক্ত করে দিতে বলা হয়েছে, অপরদিকে মানুষ যেহেতু মানুষের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া চলতে পারবে না, কাজেই যারা স্বেচ্ছায় কারও সেবা দান, শ্রমদান করার জন্য নিয়োজিত হয় (মালাকাত আয়মান), তাদেরকে এমনভাবে জীবনোপকরণ থেকে দান করতে বলা হয়েছে যেন সম্পদে, রেযেকে তার সমান হয়ে গেলেও কার্পণ্য না করা হয়। পৃথিবীর কোনো ব্যবস্থায় এমন অপূর্ব নিয়ম নেই। ক্রীতদাস আর মালাকাত আয়মানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। গলায় দড়ি পরিয়ে বাধ্য করে কাজ করানো, আরেকটি মনপ্রাণ, আত্মা সমস্তকিছু সমর্পণ করে সেবা করা। এই দু’টি শব্দের কি একই অর্থ হতে পারে? সুতরাং যারা কোর’আন অনুবাদ করেছেন তাদের অবশ্যই উচিত ছিল আল্লাহর ব্যবহৃত শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ দিয়ে অনুবাদ করা। তা না করে তারা উভয়টিই দাস হিসাবে অনুবাদ করেছেন। অবশ্য এর পেছনেও একটি সুগভীর কারণ রয়েছে যা বুঝতে হলে এই উম্মাহ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...