হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

তাবুকের অভিযান ও উম্মাহর কাঙ্ক্ষিত চরিত্র

এমামুয্যামান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী

আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে প্রেরণ করলেন হেদায়াহ ও সত্যদীন দিয়ে যাতে তিনি সে দীনকে অন্য সমস্ত দীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন (সুরা ফাতাহ- ২৮)। তিনি রসুলকে এ দীন বা জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে একমাত্র প্রক্রিয়া (Process) দিলেন তা হচ্ছে সর্বাত্মক সংগ্রাম। এত প্রক্রিয়া থাকতে আল্লাহ শুধু এই একটি প্রক্রিয়াকেই কেন নির্বাচন করলেন? এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ মানুষের মনস্তাত্বিক দিক সমূহ সম্পর্কে ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। তাই তিনি জানেন যে এই মানুষের দেহের-মনের ভিতরে শক্তিশালী শয়তানকে প্রবেশ করার অনুমতি দেবার পর খুব কম সংখ্যক মানুষই রসুলের কথার উপর বিবেক, বুদ্ধি, যুক্তি ব্যবহার করে দীনের এই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে রসুলের (স.) ঐ আহ্বানকে মেনে নিয়ে এই দীন গ্রহণ করবে। কাজেই তিনি তার রসুলকে (স.) নির্দেশ দিলেন সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে এই কাজ করার। তাঁর এই আদেশ কোর’আনের বহু জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এরই উপর ভিত্তি করে রসুল ঘোষণা করলেন, “আমি আদিষ্ট হয়েছি সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত মানবজাতি এক আল্লাহকে সর্বময় প্রভু হিসেবে স্বীকার করে এবং আমাকে তার প্রেরিত বলে মেনে নেয়।”

এখানে একটি বিষয়ে পরিস্কার ধারণা রাখতে হবে যে, যে সর্বত্র সংগ্রামের আদেশ দেয়া হয়েছে সেই আদেশ বাস্তবায়ন করার আগে অবশ্যই এমন একটি জাতি গঠন করতে হবে যে জাতির সর্ব প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হবে মৃত্যু ভয়হীন, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। যে জাতি সমস্ত কিছু ভুলে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে হবে অনঢ় (হানিফ), ঐক্য হবে ইস্পাত, সবরে (অটলভাবে অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা চালাতে) হবে অদম্য। এর যে কোনটির অভাবে সাফল্য আসবে না। কারণ উদ্দেশ্য, লক্ষ্য অতি বিরাট- সমস্ত মানবজাতির উপর এই জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা। আল্লাহর রসুলের (স.) জীবনীর দিকে এক নজর দিলেও এ সত্য প্রকট হয়ে ওঠে যে তাঁর জাতিটিকে, উম্মাহকে, একটি ধণ-প্রাণ উৎসর্গকারী মৃত্যুভয়হীন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, সংগ্রামী, জাতি রূপে গঠন করাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা। মাত্র তিনশ’ তের জন যোদ্ধা নিয়ে তাঁর প্রথম যুদ্ধ থেকে শুরু করে পরবর্তী যুদ্ধ গুলোতে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তাঁর জীবনের শেষ অভিযান তাবুকে তাঁর বাহিনীতে যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ালো ত্রিশ হাজার। তদানিন্তন আরবের জনসংখ্যার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এটা একটা বিরাট সংখ্যা। অর্থাৎ ঐ অনুপাতে এই বাংলাদেশে একটি বাহিনী দাঁড় করালে তার সংখ্যা হবে ষাট (৬০) লক্ষ যোদ্ধার। রসুল তাঁর প্রথম ও শেষ যুদ্ধের মাঝখানে সাতাশটি যুদ্ধে নিজে নেতৃত্ব দিলেও তিনি জানতেন এই শেষ দীন প্রতিষ্ঠার যে মহান দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে তা তাঁর এক জীবনে সম্ভব নয়। তাই তিনি পরবর্তীগুলোতে অন্য আসহাবদের হাতে বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন যাতে করে নতুন নেতৃত্ব, নতুন সেনাপতি সৃষ্টি করা যায়, যারা তাঁর পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর এই মহান দায়িত্ব, এ দুর্বার সংগ্রাম পালনের উপযুক্ত হবে।

সারা জীবন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা করে এক অজেয় দুর্ধর্ষ সংগ্রামী জাতি সৃষ্টি করার পর বিশ্বনবীর (স.) ইচ্ছা হলো পরীক্ষা করে দেখা যে তাঁর হাতে গড়া এই জাতিটি সত্যিই কি উপযুক্ত হয়েছে তার পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তার সুন্নাহ অনুসরন করার? এই জাতির চরিত্রে কি তিনি সেই দুঃসাহস- আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন শক্তিকে ভয় না করার নির্ভিকতা; নেতার (স.) সুন্নাহ পালনের জন্য বিষয় সম্পত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য স্ত্রী-পুত্র সমস্ত কিছু কোরবান করার মন দুঃসহ কষ্ট সহ্য করার সবর এবং সর্বোপরি শাহাদাতের জন্য আকুল পিপাসা সৃষ্টি করতে পেরেছেন? অর্থাৎ এক কথায় তিনি দেখতে চাইলেন যে তার জীবনের সাধনা সফল হয়েছে কি হয় নি। তাই তিনি ডাক দিলেন তাবুক অভিযানে। তাবুকের অভিযান অন্যান্য অভিযানগুলোর মতো ছিল না। তাবুকের অভিযানের ব্যাপারে অনেকের মতমত হচ্ছে তাবুক আত্মরক্ষামূলক অভিযান ছিল। বলা হয়ে থাকে যে বণিকদের মারফৎ খবর পাওয়া গিয়েছিল যে রোমনরা মুসলিমদের আক্রমণ করার জন্য সমবেত হচ্ছে। যারা ইতিহাসে এই কথা লিখেছেন তারা ঐ বণিকদের কোন নাম পরিচয় দেন নি। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী রসুল (স.) এত কাঁচা লোক ছিলেন না যে তিনি যে অমন একটি উড়ো খবর শুনেই তিনি অস্বাভাবিক গরম, ফসল কাটার সময় ইত্যাদি উপেক্ষা করে বিরাট বাহিনী নিয়ে বের হয়ে পড়বেন। আমরা যদি মোহাম্মদ ইবনে ইসহাকের সিরাতে রসুলাল্লাহ দেখি তবে দেখবো সেখানে রসুলের রোমান আক্রমণ প্রস্তুতির সম্বন্ধে কোন কথাই নেই, বণিকদের সম্বন্ধে ব অক্ষরও নেই। ইবনে ইসহাক লিখেছেন, “রসুলাল্লাহ (স.) জিলহজ থেকে রজব পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করলেন এবং তারপর বাইযানটাইনদের (রোমান) বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য প্রস্তুতির আদেশ দিলেন (সিরাত রসুলাল্লাহ (স.) -মোহাম্মদ বিন ইসহাক, অনুবাদ A. Guillaume,৬০২ পৃ.)।” অর্থাৎ স্পষ্ট যে পৃথিবীতের দীন প্রতিষ্ঠার যে সর্বাত্মক সংগ্রাম (জেহাদ) তা ত্যাগ করার পর, আল্লাহর রসুলের প্রকৃত সুন্নাহ ত্যাগ করে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পর সর্বাত্মক সংগ্রাম (জেহাদ) কে আত্মরক্ষামূলক বলে আখ্যায়িত করার যে মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষোচিত চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল তারই ফলে বণিকদের মিথ্যা বাহানা বহু পরে যোগ করা হয়েছিল এবং ঐ মিথ্যা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। অন্যান্য সকল অভিযান থেকে তাবুকের অভিযান যে যে কারণে ভিন্ন সেগুলো হচ্ছে,

১. যেকোন অভিযানের প্রস্তুতির সময় রসুল তাঁর অভিযানের গন্তব্য স্থানের কথা পরোক্ষভাবে প্রকাশ করতেন, যারা শুনতো তারা গন্তব্য স্থানের বিপরীত ধারণাই করতো। তিনি এ কাজ করতেন যাতে শত্রুর গোয়েন্দাদের (Intelligence) ধোঁকা দেয়া যায় কারণ শত্রুর মধ্যে ভূল ধারণা সৃষ্টি করা প্রতি যুদ্ধের অবশ্য করণীয় কৌশল। কিন্তু তাবুকের অভিযানের লক্ষ্য ও গন্তব্য স্থানের কথা তিনি প্রথমবারেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিলেন। তৎকালীন সময়ে বায়যানটাইন (রোমান) ও পারস্য সাম্রাজ্য ছিল বর্তমানের আমেরিকা ও রাশিয়ার মত পরাশক্তি, বিশ্বশক্তি। তাদের উভয়ের মাঝে আধিপত্য নিয়ে সংগ্রাম লেগেই থাকতো এবং কখনও রোমানরা জয়ী হতো কখনও বা পারস্য। কিন্তু এদের ব্যাতিরেকে অন্য কোন শক্তির কথা চিন্তাও করা যেত না। ঐ দুই শক্তির একটির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার ঘোষণা দিয়ে রসুল দেখতে চাইলেন তাঁর জাতির মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া ঘটে। তাঁর নির্মিত জাতি এ ঘোষণা শুনে ভয় পায় কিনা। তাঁর ঐ ক্ষুদ্র জাতি এতদিন আরবের ভিতরে আরবদের বিরুদ্ধে লড়েছে কিন্তু এবার তারা যাদের বিরুদ্ধে লড়তে যাচ্ছে তারা আরব নয় রোমান, যাদের আরবরা চিরদিনই ভয় করে এসেছে। এ ভীতির ব্যাপারে আরবরা সচেতন ছিল তার প্রমাণ হলো, ওয়াদিয়া বিন সাবেত প্রমুখ মোনাফেকরা মো’মেনদের এই বলে ভয় দেখালো যে, “তোমরা কি ভেবেছো যে বাইযানটাইনদের (রোমান) সঙ্গে যুদ্ধ করা আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মত? আল্লাহর কসম, আমরা দেখতে পাচ্ছি অতি শীঘ্রই তারা তোমাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলবে (সিরাত রসুলাল্লাহ (স.) -মোহাম্মদ বিন ইসহাক, অনুবাদ A. Guillaume, ৬০২ পৃ.)।” আল্লাহর রসুল জানতেন তাঁর তৈরি করা জাতি শীঘ্রই শুধু রোমান নয়, পারস্যদেরকেও পদানত করবে তাই তিনি প্রকাশ্যভাবে এ অভিযানের কথা প্রকাশ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইলেন যে তাঁর জাতি মানসিকভাবে সেজন্য প্রস্তুত হয়েছে কিনা।

২. আল্লাহর রসুল যখন তাবুক অভিযানের আদেশ করলেন তখন অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি গরম পড়েছিল। এত গরম ও খরা পড়েছিল যে মানুষ অস্থির হয়ে একটু ছায়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। ঐ রকম অসহ্য গরমে জাতি তার কর্তব্য অবহেলা করে কিনা তা পরীক্ষা করাই ছিল আল্লাহর রসুলের (স.) উদ্দেশ্য।

৩. মদিনার প্রধান ফসল হলো খেজুর। রসুল অভিযানের জন্য এমন সময় বেছে নিলেন যখন মদিনার সমস্ত খেজুর বাগানের খেজুর পেকেছে। সেই পাকা খেজুর ঘরে তোলার সময়ে অভিযানের ডাক দেয়ার উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষা করা যে তাঁর জাতি পাকা ফসল রেখে আল্লাহর রাস্তায় প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে কিনা।

৪. এবারের গন্তব্যস্থল বহুদূর। এ নবগঠিত জাতি এতদিন আরবের মধ্যেই যুদ্ধ করেছে, বাইরে যায় নি। এবার বিশ্বনবী আরবের গণ্ডী ছেড়ে বাইরে বেরোবার আহ্বান করলেন, উদ্দেশ্য-ভবিষ্যতের কাজের জন্য অর্থাৎ দীনকে সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার স্বদেশ থেকে বেরিয়ে যাবার প্রথম স্বাদ জাতিকে দেয়া। এ শিক্ষার ফলে পরবর্তীতে শতকরা আশিজন লোক স্বদেশে ফিরেন নি তাদের নেতার সুন্নাহ পালন করতে গিয়ে। যে সব দুর্বলচেতা লোক এই দূরত্বের ভয়ে তাবুক অভিযানে যোগ দেন নি তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ কোর’আনে বলছেন, “এটা যদি কাছাকাছি কোন অভিযান হতো এবং পথ সংক্ষিপ্ত হতো তবে তারা তোমার (নবীর) অনুসরণ করতো কিন্তু ঐ দূরযাত্রা তাদের উপর ভারী হয়ে গিয়েছিল (সুরা তওবা ৪২)।”

৫. এ অভিযানে রসুল সবাইকে যার যা সামর্থ আছে সেই মোতাবেক ঐ অভিযানে সাহায্য করতে আহ্বান করলেন। এর আগে কোন অভিযানে রসুল যার যা আছে সব কিছু দিয়ে সাহায্য করার আহ্বান করেননি। এর উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষা করে দেখা যে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে তাঁর জাতি পার্থিব সব কিছু কোরবান করার জন্য কতখানি প্রস্তুত হয়েছে।

৬. অন্যান্য অভিযানগুলি থেকে আরও একটা বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এবার মহানবী (স.) সমস্ত জাতিটাকে অভিযানে বের হবার ডাক দিলেন। উদ্দেশ্য পরীক্ষা করে দেখা যে ভবিষ্যতে যে জাতিকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য দেশ ত্যাগ করতে হবে, যে জাতিকে পৃথিবীময় প্রবর্তন করে মানবজাতির মধ্যে ন্যায়-বিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠা করে, ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয় করতে হবে সে জাতি প্রস্তুত হয়েছে কিনা। এই দায়িত্ব থেকে যে কেউ মুক্তি পাবে না তার প্রমাণ এই যে, যে তিনজন প্রকৃত মো’মেন ঐ প্রচণ্ড গরমের জন্য নিজেদের গাফেলতির জন্য যাব-যাচ্ছি করে তাবুক অভিযানে যোগ দেন নাই এবং যেজন্য আল্লাহ তাদের পঞ্চাশ দিন একঘরে অর্থাৎ মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কার করে মর্মান্তিক শাস্তি দিলেন সেই তিনজনের মধ্যে একজন হেলাল বিন উমাইয়া (রা.) ছিলেন বৃদ্ধ, এবং এতখানি বৃদ্ধ যে তাকে খেদমতের জন্য একজন কেউ না থাকলে চলে না এবং এজন্য তার স্ত্রীকে আল্লাহর রসুলের (স.) কাছ থেকে ঐ খেদমতের বিশেষ (Special) অনুমতি নিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের তিনজনকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহর রসুলের কর্মজীবনের শেষ দিকে তাবুক অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন যে তাঁর সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল কী হয়েছে? দেখা গেলো- বিশ্বনবীর (স.) কর্মবহুল জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল একটি অপরাজেয় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি সৃষ্টি করা। কারণ শেষ জীবনে তিনি সফল কি সফল নন তা পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি পরীক্ষা নিলেন জাতি একটি বিশ্বশক্তির সম্মুখীন হবার মত নির্ভীক ও দুঃসাহসী হয়েছে কিনা; দুঃসহ গরম ও সুদূর পথ তাদের বিচলিত করতে পারে কিনা; কঠোর পরিশ্রমের ফসলকে আল্লাহর রাস্তায় হেলায় পরিত্যাগ করতে পারে কিনা; আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক সংগ্রামে তাদের পার্থিব সম্পদ দান করতে পারে কিনা এবং সর্বোপরি আল্লাহর রাস্তায় চূড়ান্ত পুরস্কার লাভের জন্য আগ্রহী হয়েছে কিনা। তাবুকের পরীক্ষায় দেখা গেলো আল্লাহর রসুলের জীবনের সাধনা সফল হয়েছে। কারণ সমস্ত জাতি থেকে মাত্র আশী জনের মত দুর্বলচেতা ও মোনফেক তাবুক অভিযানে যোগ দেয়নি, ঐ তিনজন প্রকৃত মো’মেন ছাড়া। অর্থাৎ শতকরা মাত্র ০.২৬ জন মানুষ অভিযানে যোগ দেয়নি। ধরতে গেলে শতকরা একশ জন, সম্পূর্ণ জাতিটাই বিশ্বনবীর ডাকে শত্রু বিশ্বশক্তি ও নিজেরা কত দুর্বল জেনেও নিজেদের পার্থিব সম্পদ অভিযানের প্রস্তুতির জন্য দান করে পাকা ফসল পরিত্যাগ করে অসহ্য গরমের মধ্যে মরুভূমির বুকের উপর দিয়ে বহু দূরের যাত্রায় নিজেদের প্রাণ কোরবান করার জন্য রওয়ানা হয়ে গেলো। মানবজাতির ইতিহাসে এমন নেতা আর কখনও জন্মাননি যিনি মাত্র তেইশ বছরে, প্রকৃত পক্ষে দশ বছরে একটি উপেক্ষিত, অবহেলিত চরম দরিদ্র, বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে এমন রূপান্তর করতে পেরেছেন।

বর্তমানে আমরা যারা নিজেদের উম্মতে মোহাম্মদী মনে করে নানা রকম সওয়াব উপার্জনে ব্যস্ত আছি তাদের উচিত তাবুক অভিযানে গমনকারী সেই জাতিটির সাথে নিজেদের তুলনা করা। তুলনা করলে দেখা যাবে আমরা এক তো নয়ই বরং সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী দুটো জাতি। আমরা যে সওয়াব কামাইয়ের জন্য ব্যস্ত রয়েছি এবং প্রকৃত সওয়াব কি তা রসুলের একটি কাজ থেকে সু-স্পষ্ট হয়ে উঠে। আল্লাহর রসুল (স.) একদিন একজন লোকের জানাযা পড়তে আসলেন। যখন মৃত ব্যক্তিকে রাখা হলো তখন ওমর বিন খাত্তাব (রা.) বললেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! এর জানাযা পড়বেন না, এ লোকটি একজন ফাজের।” তখন মহানবী (স.) সমবেত জনতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ এই লোককে ইসলামের কোন কাজ করতে দেখেছো?” একজন লোক বললেন, “হ্যাঁ   রসুলাল্লাহ! ইনি কোন অভিযানে অর্ধেক রাত্রি প্রহরা দিয়েছেন।” এই শুনে রসুলাল্লাহ (স.) ঐ লোকের জানাযায় নামায পড়ালেন এবং দাফন করার পর কবরের উপর মাটি ছিটালেন। তারপর (মৃত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে) বললেন, “তোমার সঙ্গী-সাথীরা ভাবছে তুমি আগুনের সঙ্গী (জাহান্নামী)। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি জান্নাতের অধিবাসী। হে ওমর! নিশ্চয়ই তোমাকে মানুষের কাজ সম্বদ্ধে প্রশ্ন করা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন করা হবে অন্তর্নিহিত চরিত্র সম্বন্ধে (ইবনে আ’য়েয (রা.) থেকে- বায়হাকি, মেশকাত)।” লক্ষ্য করুন, ওমর (রা.) লোকটিকে ফাজের বললেন যার আভিধানিক অর্থ হলো কাজকর্ম খারাপ, গুনাহগার, এক কথায় দুস্কৃতকারী। কিন্তু তবুও এক রাত্রি সামরিক ছাউনী পাহারা দেয়ার জন্য আল্লাহর রসুল তার জানাজাও পড়লেন এবং সকলের সামনে প্রকাশ্যে জান্নাতী হিসেবে ঘোষণা করলেন। আজ আমরা গোনাহ ও সওয়াবের যে হিসেব করি সে হিসেবে রসুলাল্লাহর (স.) কাজ অবশ্যই বিপরীত। গোনাহগার দুশ্চরিত্র হওয়া সত্বেও ঐ মৃত লোকটির একটি কাজে বোঝা গেল যে সে রসুলের যে সংগ্রামী জাতি সৃষ্টি করেছিলেন সে তাতে বিশ্বাসী ছিল, তাতে অংশ নিয়েছিলো এবং প্রহরা দেয়ার সামান্য কাজ হলেও সে করেছিল। এ দীনের প্রকৃত কাজে সে অংশগ্রহণ করেছে ও এর ফলেই আল্লাহ তাকে জান্নাত দিবেন।

যারা এখনও এ শেষ দীনের প্রকৃত যে কাজ অর্থাৎ ঈমান বা তওহীদের পরই জেহাদ, সর্বাত্মক সংগ্রামকে মূল হিসেবে না নিয়ে এবং সেই মোতাবেক কাজ না করে সওয়াব কামাবার চেষ্টায় আছেন তারা কামাতে থাকুন, কেয়ামতের দিন তারা দেখবেন তাদের স্থান কোথায় হয়- জান্নাতে না জাহান্নামে। বিশ্বনবী (স.) ও তাঁর উম্মাহর উপর আল্লাহ যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে দায়িত্ব পালনের জন্য যে চরিত্র প্রয়োজন, তাঁকে অবশ্যই সে চরিত্রের মানুষ ও জাতি গঠন করার চেষ্টা করতে হয়েছে, তাই নয় কী? এবং ইতিহাস সাক্ষী তিনি সফল হয়েছিলেন যেমন সফল মানবজাতির মধ্যে কেউ হতে পারে নি। তিনি যে চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন সেটা কী চরিত্র? এর জবাব আমরা পাই তাঁর মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে। তাঁর অতি আদরের মেয়ে, জান্নাতের রাণী, ফাতেমা (রা.) এ বিয়ে দিলেন তাঁর সাহাবা আলীর (রা.) সঙ্গে। এটা স্পষ্ট যে তিনি তাঁর উম্মাহর যে চরিত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন আলীর (রা.) এর মধ্যে সে চরিত্র পরিপূর্ণভাবে বিকাশ হয়েছিল নয়তো তিনি তার সাথে মা ফাতেমা (রা.) এর বিবাহ দিতেন না। তো বিয়ে ঠিক হবার পর আলী (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন তার কাছে কী আছে যেহেতু বিয়েতে কিছু খরচ হবে। আলী (রা.) জবাব দিলেন টাকা পয়সা কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে একটি ঘোড়া, একটি তলোয়ার ও একটি লোহার বর্ম। লক্ষ্য করুণ একটি মানুষের পার্থিব সম্পদ বলতে আছে একটি ঘোড়া, একটি তরবারি আর বর্ম। তিনটিই সামরিক অভিযানের উপকরণ ও এ ছাড়া তার আর কিছুই নেই। আলীর (রা.) বিয়ের বহু পরে এই প্রকৃত উম্মতে মোহম্মদী যখন তাদের উপর আল্লাহর ও রসুলের (স.) অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে করতে সুদূর মিসরে যেয়ে পৌঁছেছিল তখনও তাদের একজন উবায়দা (রা.) খ্রিষ্টান শাসনকর্তাকে বলেছিলেন- আমরা (উম্মতে মোহাম্মদী) বেঁচেই আছি শুধু জেহাদ করার জন্য। এ দুনিয়াতে শুধু বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া আর গায়ে পড়ার কাপড় ছাড়া আমরা আর কিছুই চাই না। আমাদের জন্য ঐ দুনিয়া (পরকাল)। এই হলো প্রকৃত মো’মেন, মুসলিম আর উম্মতে মোহাম্মদীর সঠিক আকীদা।

এরপর মহানবী (স.) আলীকে (রা.) বললেন আর যখন কিছুই নেই তখন বর্মটি বন্দক দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে এসো। বর্ম কেন? কারণ তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধ সম্ভব নয় আর ঘোড়াও জরুরী নয়তো একজন অশ্বারোহীকে পদাতিক হয়ে যেতে হবে। কিন্তু বর্ম এই দুই উপদান থেকে কম জরুরী যদিও তাতে বিপদের আশংকা থাকে। অর্থাৎ সর্বাত্মক সংগ্রাম যেন কোন অবস্থাতেই বন্ধ না হয়। নিজের জামাতার, আলী (রা.), জীবনের আশংকা বেড়ে গেলেও না।

পৃথিবীখ্যাত প্রিন্সটান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মেরিটাস বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মিঃ ফিলিপ হিট্টি তার বই The Arabs এ মুসলিম জাতির, উম্মতে মোহাম্মদীর অবিশ্বাস্য সামরিক বিজয়ের যে কারণগুলি উল্লেখ করেছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে তিনি লিখেছেন মুসলিমদের মৃতুভয়হীনতা। ইংরেজিতে তিনি শব্দ ব্যবহার করেছেন Utter contempt of death আক্ষরিক শব্দার্থে মৃত্যুর প্রতি চরম অবজ্ঞা। উম্মতে মোহাম্মদীর মৃত্যুর প্রতি এই অবজ্ঞার কথা হিট্টি তার ঐ বইয়ে দুইবার উল্লেখ করেছেন (The Arabs- P.K. Hitti, Gateaway Edition, Chicago, P-35, 58)। এবং তিনি একথাও ঐ সঙ্গে লিখেছেন যে ঐ মৃত্যুভয়হীনতা মৃত্যুর প্রতি ঐ চরম অবজ্ঞা ঐ জাতির মধ্যে সৃষ্টি করেছিল তাদের বিশ্বাস অর্থাৎ ইসলাম।

পরিশেষে আমি এটুকুই বলবো যে আল্লাহর রসুল যে ইসলাম রেখে গিয়েছিলেন সে ইসলাম আর বর্তমান ইসলামে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, বিপরীতমূখী দীন। রসুল তাঁর উম্মাহর ভিতর যে চেতনার সৃষ্টি করেছিলেন সেই চেতনা আজ আর নেই। বর্তমানের মুসলিমদের সম্বন্ধে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের মনোভাব কী তাও পেশ করছি। আল্লাহ বলেন, “যখন কোন সুরায় সর্বাত্মক সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হয় তখন যাদের হৃদয়ের মধ্যে রোগ রয়েছে তাদের অবস্থা এমন হয় যে তারা যেন তখনই অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হবে (সুরা মুহাম্মদ ২০)।” এদের উপর আল্লাহ বহুবার অভিশাপ দিয়েছেন। “মহানবী (স.) তাঁর উম্মাহর ভবিষ্যত বলতে গিয়ে তিনি যখন বললেন তার উম্মাহ শত্রুদের দ্বারা পরাজিত, লাঞ্ছিত-অপমানিত হবে, তাদের গোলামে পরিণত হবে, তখন সাহাবারা প্রশ্ন করলেন, কী কারণে? বিশ্বনবী (রা.) জবাব দিয়েছিলেন তারা তখন মৃত্যুভয়ে ভীত হবে (সওবান (রা.) থেকে- আবু দাউদ, মেশকাত)।” যে ইসলাম মৃত্যুভয়হীন সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য আকুল মো’মেন মোজাহেদ তৈরি করতো সেই ইসলাম আজ মৃত্যুর ভয়ে ভীত কাপুরষ তৈরি করে। দুটির মাঝে কী পরিষ্কার বৈসাদৃশ্য, কী পরিস্কার ফারাক।

 

সম্পাদনায়: মুস্তাফিজ শিহাব

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...