ওবায়দুল হক বাদল:
কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামে সংস্কৃতি চর্চার স্বরূপ কী, সুস্থ সংস্কৃতির মানদণ্ড কী, সংস্কৃতি চর্চার নামে অশ্লীলতা যা সভ্য সমাজকে পশ্চাদপদ করছে সে ব্যাপারে করণীয় কী এবং তওহীদ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতা কেমন হবে ইত্যাদি বিষয়ে মুক্ত আলোচনার স্বার্থে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সংস্কারমূলক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ। শনিবার (৩০ আগস্ট) বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক বিভাগ।
‘ইসলাম ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আইনজীবী, সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত থেকে তাদের মূল্যবান মতামত প্রকাশ করেন। বৈঠকে বিভিন্ন আলোচনা, নানামুখি মতামত ও পরামর্শের পাশাপাশি ৭ দফা প্রস্তাব উঠে আসে।
সংগঠনটির ঢাকা বিভাগীয় সভাপতি মাহবুব আলম মাহফুজের সভাপতিত্বে এবং গণমাধ্যম যোগাযোগ সম্পাদক শারমিন সুলতানা চৈতির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেযবুত তওহীদের সাহিত্য সম্পাদক কবি রিয়াদুল হাসান। তিনি বলেন, ইতিহাস থেকে যতগুলো সভ্যতার কথা আমরা জানতে পারি, সবগুলোরই প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে ধর্ম ছিল প্রধান নিয়ামক। আর শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ছিল প্রত্যেক সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ। তাই ধর্ম কখনও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ হতে পারে না, বরং তারা একে অপরের পরিপূরক।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এক শ্রেণির কথিত আলেমরা ঢালাওভাবে সকল শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকে হারাম ফতোয়া দেন। আঞ্চলিক অনেক সংস্কৃতিকেও তারা হারাম বিবেচনা করেন। অনেক সময় এসব ফতোয়া বাস্তবায়ন করার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে হামলাযজ্ঞও চালানো হয়। অথচ বেআইনি হামলা ও হত্যাযজ্ঞকে আল্লাহ স্পষ্টত হারাম করেছেন।
কোরান, হাদীসের উদ্ধৃতি এবং রসুল (সা.) এর জীবনী ও ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, আল্লাহ শুধু অশ্লীলতা, নাফরমানি, আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানের লংঘন এবং আল্লাহর সঙ্গে শেরক করাকে হারাম করেছেন। আরবের তৎকালীন জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র দফ ও তম্বুরা বাজিয়ে সাহাবীরা গান গাইতেন। রসুলও (সা.) গান শুনতেন। রসুল (সা.) মসজিদে নববী নির্মাণের সময় সাহাবীদের সাথে রাজস্ অর্থাৎ কর্মসঙ্গীত গেয়েছেন।
তিনি বলেন, আল্লাহর অবাধ্যতা, অশ্লীলতা ও মিথ্যার বিস্তার না ঘটিয়ে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ করা, নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণ ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় নয়। বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য গাওয়া গান, নাটক, শিল্প-সাহিত্য জেহাদ হিসেবে, এবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল সঙ্গীত। ২০০৪ এ ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানেও আমরা তা-ই দেখেছি। ঠিক তেমনি রসুলাল্লাহর (সা.) যুগে রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে যোদ্ধারা রণসঙ্গীত গাইতেন, উদাত্ত কণ্ঠে সুরে সুরে আবৃত্তি করতেন যুদ্ধের কবিতা। গণসঙ্গীত, রণসঙ্গীত সৈনিকের হৃদয়ে ঝংকার তোলে। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার হিম্মত এনে দেয়।
কাজেই রেনেসাঁ ও গণজাগরণ সৃষ্টির জন্য গান খুবই প্রয়োজনীয় ও কার্যকর মাধ্যম। গান হতে পারে বিপ্লবের ভাষা, মানবতার জয়ধ্বনি, মনের প্রশান্তি, আত্মার খোরাক। সমাজে বিরাজিত অন্যায়, অবিচার, জুলুমের বিরুদ্ধে গান হতে পারে সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। তাই যারা গীতিকার তাদের কর্তব্য হবে কেবল প্রেম-বিরহের গান না লিখে সমাজের সংকটগুলো নিয়ে গান লেখা, কবিতা লেখা। একইভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও যারা মেধাবী তাদের উচিত শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে শান্তিময় সম্প্রীতির সমাজ বিণির্মাণে রেনেসাঁ সৃষ্টির জন্য আত্মনিয়োগ করা।- রিয়াদুল হাসান।
অন্যান্য শিল্পচর্চার ব্যাপারে তিনি বলেন, ইসলামের বৈধ-অবৈধের মূলনীতি মেনে চললে যে কোনো শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাই জাতির জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে। আল্লাহর অবাধ্যতা, অশ্লীলতা ও মিথ্যার বিস্তার না ঘটিয়ে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ করা, নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, শরীর গঠনমূলক খেলাধুলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় নয়।
তিনি কোরআন থেকে সুরা সাবার ১৩ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, মূর্তি তৈরি করে তার উপাসনা করাকে আল্লাহ মুসলমানদের জন্য শিরক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু ভাস্কর্যের সাথে শিরকের সম্পর্ক নেই। যদি থাকত তাহলে নবী সোলায়মান (আ.) ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন না।
ইসলাম কোনো আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশের এক শ্রেণির কথিত আলেমদের দৃষ্টিতে চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন ইত্যাদি আঞ্চলিক উৎসব হারাম। কিন্তু ইসলাম যেমন একটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতিকে আরেকটি অঞ্চলের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয় নি, তেমনি কোনো এলাকার মানুষের আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধও করা হয় নি।
আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) আরবে এসেছেন, তিনি আরবের মানুষ, তাঁর আসহাবগণও আরবের মানুষ। আমাদের দেশের একজন নেতা বাংলাতে কথা বলবেন, বাংলাদেশের পোশাক পরবেন এটাই স্বাভাবিক। তেমনি রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা আরবীয় পোশাক পরেছেন, আরবিতে কথা বলেছেন, আরবীয় খানা-খাদ্য খেয়েছেন। এর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না, যে সারা দুনিয়ার মানুষকেই ঐভাবে আরবিতে কথা বলতে হবে, আরবীয় জোব্বা, পাগড়ি পরিধান করতেই হবে। কারণ যারা তাঁদের বিরোধিতাকারী তারাও একই পোশাক পরেছে, একই প্রকার খাদ্য খেয়েছে। সুতরাং ‘আরবীয় সংস্কৃতি’ মানেই ‘ইসলামী সংস্কৃতি’ নয় -বলেন এই গবেষক।
আরো বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের যুগ্ম সম্পাদক ও নারী বিভাগের প্রধান রুফায়দাহ পন্নী, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র প্রতিবেদক মাইনুল হাসান সোহেল, সাংস্কৃতিক সম্পাদক এমদাদুল হক খান, জাতীয় কবিতা কেন্দ্রের (জাকব) সাধারণ সম্পাদক ও যুগান্তরের সিনিয়র সাংবাদিক লায়ন এড. আলতামাসুল ইসলাম আকন্দ, সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের ডিরেক্টর জেনারেল শামসুল আলম খান, সাবেক মেজর সাব্বির, কবি ও সাহিত্যিক মাহমুদুল হাসান নিজামী, জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় আইনজীবী ফোরামের সহ সভাপতি গোলাম মো. চৌধুরী আলাল, হেযবুত তওহীদের তথ্য সম্পাদক এস এম সামসুল হুদা, গণঅধিকার পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান হোসাইন, শের-এ বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মো. আকবর আলী, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও ঘিওর সরকারি কলেজের প্রফেসর আমির হোসেন, দৈনিক পর্যবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও এ্যাকটিং এডিটর খালেদ মাহমুদ রকি প্রমুখ।
রুফায়দাহ পন্নী তার বক্তব্যে বলেন, হেযবুত তওহীদ প্রস্তাবিত তওহীদ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুস্থ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী ছিলেন মনে প্রাণে সুস্থ সংস্কৃতির ধারক। তাঁকে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ বললেও অত্যুক্তি হবে না। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে রাগসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন তিনি। শুদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশে অনেক অবদান রেখেছেন। তার দেখানো পথে হেযবুত তওহীদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে “মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী” নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্যরা গান-কবিতা রচনা, সুরারোপ, বাদন, পরিবেশন, মিউজিক কম্পোজিশন, স্টুডিও রেকর্ডিং, মিউজিক ভিডিও, নাটক নির্মাণসহ বহুমুখী কাজ করে থাকে যা দেশ ও মানবতার কল্যাণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনে ভূমিকা রাখতে জাতিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে।
বক্তারা মনে করেন, পবিত্র কোর’আন কি গান, বাদ্যযন্ত্র, নাটক, চিত্রকলা, অভিনয় ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে হারাম ঘোষণা করেছে? আল্লাহর রসুলের (সা.) জীবনে কি শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা হয়নি? এই বিষয়ে প্রকৃত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? মূলত শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার বিষয়ে আল্লাহর কিতাব কোর’আন এবং রসুলের (সা.) কথা কী, ইসলামের মানদণ্ড কী তা প্রতিটি সংস্কৃতিবান এবং সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের সামনে খোলাসা করার সময় এসেছে।
বক্তারা তাদের মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন পরামর্শ দেন এবং শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে ধর্মীয় অপব্যখ্যার নিরসন চেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে মানুষের সামনে সত্য উদ্ভাসিত করার এই প্রয়াসকে স্বাগত জানান।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মেজবাউল ইসলাম, আন্তঃধর্মীয় যোগাযোগ সম্পাদক ইলা ইয়াসমিন প্রমুখ।
গোলটেবিল বৈঠকে প্রস্তাব
- সারাদেশে এই সংক্রান্ত আলোচনার জন্য জেলা, বিভাগ ও উপজেলা পর্যায়ে মতবিনিময় সভা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করা।
- সচেতন সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও ব্যক্তিত্বদের নিয়ে ঐক্য সংগঠন গঠন করা।
- উগ্রবাদ, ধর্মান্ধতা বিরোধী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর লেখা, প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র প্রকাশ করা।
- প্রতি ৩ মাস পর পর এই সংক্রান্ত লেখা সম্বলিত একটি পত্রিকা/জার্নাল বের করা।
- শিল্পী-সাহিত্যিকদের শুদ্ধ শিল্পচর্চার কার্যক্রমকে কেউ যেন ব্যাহত করতে না পারে সেই জন্য সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি পেশ করা।
- ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যেন সংস্কৃতি চর্চার পথ রুদ্ধ করতে না পারে সেজন্য সঠিক ব্যাখ্যা সম্বলিত পুস্তিকা ও বই বের করা।
- অনলাইন প্লাটফর্মকে কাজে লাগানোর জন্য সাহসী বক্তাদের বক্তব্য ধারণ করে প্রচারের ব্যবস্থা করা।