হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

জান্নাতি ফেরকা: মৃতপ্রায় জাতির একমাত্র ভরসা

মোহাম্মদ আসাদ আলী

ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে কী কী ঘটবে- এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর রসুল এই উম্মাহকে সাবধান করে গেছেন। এইসব সাবধানবাণীর মধ্যে কিছু আছে এমন যে তা থেকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, যেমন- দাজ্জাল, কেয়ামত, ইয়াজুজ মাজুজ ইত্যাদি সংক্রান্ত হাদীসের বর্ণনাগুলো; আর কিছু এমন আছে যা থেকে শুধু মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উম্মাহর ভবিষ্যৎ বলতে গিয়ে তেমনি একটি সাবধান বাণী দিয়েছিলেন আল্লাহর রসুল। তিনি বলেন, ‘‘বনি ইসরাইলরা (ইহুদিরা) বাহাত্তর ফেরকায় (ভাগে) বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। এর একটি ভাগ ছাড়া বাকি সবই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।” সাহাবারা প্রশ্ন করলেন-“ইয়া রসুলাল্লাহ! সেই একমাত্র জান্নাতি ফেরকা কোনটি?” তিনি জবাব দিলেন-“যার উপর আমি ও আমার সঙ্গীরা (আসহাব) আছি।’’

আজ পৃথিবীময় মুসলিম জাতির বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থাই প্রমাণ করে রসুলের ঐ ভবিষ্যদ্বাণী কতখানি সত্য হয়েছে। এই জাতি বর্তমানে শিয়া, সুন্নি, শাফেয়ী, হাম্বলী, আহলে হাদীস ইত্যাদি ফেরকা-মাজহাব ও নানাবিধ তরিকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে যাদের সবাই দাবি করে একমাত্র তাদের ফেরকাই সঠিক ইসলামে আছে আর অন্যরা পথভ্রষ্ট। কিন্তু আল্লাহর রসুল বলে গেলেন- না, তারা যতই নিজেদেরকে জান্নাতি ফেরকা ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করুক একমাত্র জান্নাতি ফেরকা সেটাই যেটার উপর তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এর দ্বারা আল্লাহর রসুল মানদণ্ড ঠিক করে দিলেন যে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা যেভাবে ইসলাম বুঝেছেন ও নিজেদের জীবনে চর্চা করেছেন সেটাই কেবল মুসলমানদের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়, অন্য কারোটা নয়। যেমন উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমীয়, ওসমানীয়, পাঠান, মোগলরা কীভাবে ইসলামের চর্চা করল, আলেম মুফতি মোহাদ্দীস মাওলানা বুজুর্গদের মধ্যে কে কী বললেন সেগুলো এই দ্বীনের মানদণ্ড হতে পারে না। কাজেই ওগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সঠিক দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো ফেরকা, কোনো দল, কোন মাজহাব বা কোনো তরিকা দাবি করে যে, একমাত্র তাদের আকীদাই সঠিক, তাদের কর্মপন্থাই সঠিক কর্মপন্থা, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, তারা ঠিক সেইভাবে ইসলামকে বুঝেছেন যেভাবে আল্লাহর রসুল ও তাঁর সঙ্গীরা বুঝেছিলেন এবং তারা সেটাই করছেন যেটা আল্লাহর রসুল ও তাঁর সঙ্গীরা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি কী ছিল?

রসুলাল্লাহর সমগ্র জীবনকে এক দৃষ্টিতে দেখলে কী পাওয়া যায়?

আল্লাহর রসুল যখন নব্যুয়ত লাভ করলেন তখন আরবের অবস্থা ছিল এই যে, জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত পশ্চাদপদ একটি জনসংখ্যা, যারা সর্বদা নিজেরা নিজেরা অনৈক্য-সংঘাতে লিপ্ত থাকত, কাঠ-পাথরের মূর্তি বানিয়ে পূজা করত, আর হুকুম মান্য করত ঐসব দেব-দেবীর পুরোহিত তথা ধর্মব্যবসায়ী কোরাইশ নেতাদের। এই পুরোহিতদের কাছে এমন কোনো মানদণ্ড ছিল না যেটার ভিত্তিতে জনগণকে পরিচালিত করতে পারে। তাদের শাসন ছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতির, ফলে অন্যায় অবিচার রক্তপাতে নিমজ্জিত হয়েছিল পুরো জনগোষ্ঠী। এই অবস্থায় আল্লাহর রসুল যা করলেন তা হচ্ছে-

১. তিনি পুরো জনগোষ্ঠীকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যের ডাক দিলেন। ঘোষণা দিলেন আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই, ন্যায় অন্যায়ের মানদণ্ড হবে আল্লাহর হুকুম। বহু নির্যাতন, নিগ্রহ আর অপমানের চড়াই উতরাই অতিক্রম করার পর এক সময় এই মানদণ্ড গৃহীত হলো। সবাই মেনে নিল যে, আল্লাহ যেটাকে জায়েজ করেন সেটা জায়েজ ও যেটা হারাম করেন সেটা হারাম, আল্লাহ যেটাকে সত্য বলেন সেটা সত্য, যেটাকে মিথ্যা বলেন সেটা মিথ্যা। এই সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ হবার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে একের পর এক হুকুম আসতে লাগল আর জাতিটি অক্ষরে অক্ষরে তার বাস্তবায়ন করতে লাগল। তারা মদ খাওয়াকে খারাপ মনে করত না। কিন্তু যেইমাত্র আল্লাহ মদ হারাম করলেন, সবাই নির্দ্বিধায় মদ খাওয়া ছেড়ে দিল, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে উঠল মদের প্রবাহে। আল্লাহ দ্বীনের কাজের বিনিময় নেওয়াকে হারাম করেছেন, তাই রসুলের একজন সাহাবীকেও ইতিহাসে দ্বীনের কাজের বিনিময় নিতে দেখা যায় না। কোর’আনের আয়াত নিয়ে, দ্বীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে চূলচেরা বিশ্লেষণ ও মতভেদ করা হারাম, কেননা এতে জাতির লক্ষ্যচ্যুতি ঘটে ও জাতির ঐক্য নষ্ট হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই রসুলের হাজার হাজার সঙ্গী-সাথীর মধ্যে এমন কাউকে পাই না যিনি কোর’আনের আয়াত নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি করেছেন বা সারাদিন ঘরে বসে বসে কোর’আনের কোনো আয়াতের গুপ্তঅর্থ বের করার চেষ্টা করেছেন, কিংবা দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তৈরি করেছেন। একই কারণে রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের জীবনে আমরা কোনো ফেরকাবাজী দেখি না, শিয়া-সুন্নির টিকিটুকুও খুঁজে পাই না। এক কথায় জাতি ছিল আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ। কেউ শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে রিপুতাড়িত হয়ে যদি কালেভদ্রে আল্লাহর কোনো হুকুম অমান্য করেও ফেলত, অপরাধ করে ফেলত, তার শাস্তিও হত আল্লাহর হুকুম মোতাবেক। ফল হয়েছিল সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার। এমন শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলো একা একজন মেয়ে মানুষ রাতের অন্ধকারে কয়েকশ’ মাইল পথ হেঁটে যেত বন্য জন্তু ছাড়া কোনো ভয় অন্তরে জাগ্রত হত না। স্বচ্ছলতা এমন হয়েছিল মানুষ খাদ্যদ্রব্য নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু গ্রহণ করার লোক ছিল না। এইসবই সম্ভব হয়েছিল আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার ফলে।

২. কিন্তু আল্লাহর রসুল তো কেবল আরবের জন্য আসেন নি, এসেছেন সমস্ত মানবজাতির জীবনে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ঐ জাতিটিকে ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্যের সমন্বয়ে এমনভাবে গড়ে তুললেন যেন তাঁর অবর্তমানেও জাতিটি তাঁরই মত করে সংগ্রাম করতে থাকে এবং বাকি দুনিয়াতেও আল্লাহর সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার আনয়ন করতে পারে। এজন্য জাতিকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে হয়েছে, অন্তর্মুখী মানুষগুলোকে বহির্মুখী করতে হয়েছে। কোর’আনে আল্লাহ বারবার সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা বলেছেন এবং সংগ্রাম ছাড়লে কঠিন শাস্তি পেতে হবে এই সতর্কবাণীও অনেকবার উচ্চারণ করেছেন, আর রসুল (সা.) হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে হয়। আল্লাহর রহমে এমন একদল নিবেদিতপ্রাণ মানুষ তিনি পেয়েছিলেন যারা কখনই তাঁর সঙ্গ ছাড়েন নি। সর্বাবস্থায় তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার প্রতি অনুগত থেকে নিজেদের জীবনের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন নেতার পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যকে সফল করতে। আর তা করতে গিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, গাছের লতা পাতা খেয়ে, মারধোর খেয়ে, নির্যাতন সহ্য করে, পেটে পাথর বেঁধে থেকে, আত্মীয়-স্বজন-পরিবার-পরিজন-খেত-খামারের মায়া উপেক্ষা করে এবং সবশেষে প্রিয় নেতার পদতলে নিজেদের প্রাণটুকুও উৎসর্গ করার জন্য বারবার যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শত্রুর আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়েছেন, প্রিয় নেতাকে শত্রুর তীর থেকে রক্ষা করতে নিজেদের দেহকে ঢাল বানিয়ে তীরে তীরে সজারুর মত হয়ে গেছেন কিন্তু লক্ষ্য থেকে একচুলও সরে যান নি। এভাবে সমগ্র জাজিরাতুল আরবে সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন রসুল (সা.) আল্লাহর কাছে চলে গেলেন, ইতিহাসে পাই, সেই সময়ে সমগ্র উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটি একসাথে ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, খেত খামার সবকিছু বিসর্জন করে পৃথিবীর বুকে বেরিয়ে পড়ল এবং একইসাথে পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে অর্ধপৃথিবী জয় করে নিল। এই যে উম্মতে মোহাম্মদীর বিস্ফোরণ, এর লক্ষ্য কি ছিল পররাজ্য ও পরসম্পদ

লুট করা? কখনই না। উদ্দেশ্য এই ছাড়া আর কিছুই নয় যে, আল্লাহ তাঁর রসুলকে পৃথিবীময় সত্য প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার আনয়নের যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং সারাজীবন সংগ্রাম করে আরব উপদ্বীপে সত্য প্রতিষ্ঠার পর রসুল (সা.) বাকি পৃথিবীতেও সত্য প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির উপর অর্পন করে গেছেন সেই দায়িত্ব পূরণ করা। হলোও তাই, মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর কর্তৃত্ব লাভ করল এই জাতিটি। এই জাতির সামনে দাঁড়াবার মত কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই তখন। তারা চাইলে এক নিমেষেই বাকি পৃথিবীতেও সত্য প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর-রসুলের অর্পিত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে সক্ষম হত এবং তার ফলে সমস্ত পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অনিরাপত্তা দূর হয়ে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হত। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই জাতির যে, জাতিটি মোটামুটি ৬০/৭০ বছর তাদের লক্ষ্য ঠিক রেখে নেতার অর্পিত দায়িত্ব পালন করার পর এক সময় আল্লাহর রসুলের সঙ্গী-সাথীরা এক এক করে যখন সকলেই পরলোকগত হয়ে যান, তারপর অন্যরা তাদের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে অপরাপর রাজা-বাদশাহদের মত রাজত্ব করতে শুরু করল, ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিল। বিকৃতি ও জাতির পতনের শুরু সেখান থেকেই। এই যে সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়ার মত মহাভুলটি করা হলো, তারই মাশুল দিতে হচ্ছে জাতিকে গত ১৩০০ বছর ধরে নিজেরা নিজেরা অনৈক্য-সংঘাতে লিপ্ত হয়ে এবং অন্য জাতিগুলোর দ্বারা পরাজিত ও গোলামীতে নিমজ্জিত হয়ে।

এতক্ষণে পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আল্লাহর রসুল ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা কীসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। দু’টি বিষয় মাত্র। এক- আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং দুই- রসুল (সা.) এর পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য অর্থাৎ সমস্ত পৃথিবীময় ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করে যাওয়া। ব্যস, এই দুইটি শর্ত যারা পূরণ করতে পারবেন তারাই মো’মেন (হুজরাত- ১৫), তারাই সেই জান্নাতি ফেরকা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু করুণ বাস্তবতা হচ্ছে আজ এই জাতির অবস্থা এই দুইয়ের ধারেকাছেও নেই।

১.  তারা তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ নেই, বরং ভৌগোলিকভাবে অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রে, রাজনৈতিক ভাবে হাজার হাজার দল-উপদলে, আকীদাগতভাবে শিয়া-সুন্নি-হানাফি-হাম্বলী ইত্যাদি শত শত ফেরকা-মাজহাবে, আধ্যাত্মিকভাবে বিভিন্ন তরিকায় বিভক্ত হয়ে আছে। আর সমষ্টিগত জীবন থেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অনেক পূর্বেই প্রত্যাখ্যান করে পাশ্চাত্যের তৈরি হুকুম, ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিয়েছে।

২.  আল্লাহর রসুল জাতিকে যে লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে গেছেন এবং যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সারাজীবন নিজে সংগ্রাম করেছেন এবং তাঁর জাতিকে প্রস্তুত করে গেছেন সেই লক্ষ্যের কথা এখন এদের কারোই মনে নেই।

সুতরাং একটি সিদ্ধান্তই সম্ভব যে, এই হাজারো দল-উপদলে বিভক্ত জাতিটি নিজেদেরকে জান্নাতি ভেবে যতই আত্মতৃপ্তি লাভ করুক, আদতে তারা সকলেই পথভ্রষ্ট। তবে হ্যাঁ, তাদের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেই জান্নাতিরাও, যারা আল্লাহর তওহীদ ও সেই তওহীদ প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীময় ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য- সেই কথা ভুলে যায় নি। আজ তারাই এই মৃত জাতির একমাত্র আশার আলো। তাদেরকে আর বসে থাকা চলবে না। এই মুমূর্ষ জাতিটিকে বাঁচানোর জন্য তাদেরকে মাঠে নামতে হবে। তারপর পথভ্রষ্ট বাহাত্তর ফেরকাকে বলতে হবে- ভাই! তোমাদের মধ্যে মসলা-মাসায়েল নিয়ে যত মতভেদই থাক, তোমরা তো অন্ততঃ এক আল্লাহয়, এক রসুলে আর এক কোর’আনে বিশ্বাস কর। মেহেরবানী করে শুধু এর উপর তোমরা ঐক্যবদ্ধ হও। বাকি যত মতভেদ আছে সেগুলি তোমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ওমনি থাক, আপত্তি নেই, ওগুলি নিয়ে মতান্তর সৃষ্টি কর না। যেখানে আল্লাহর নবী বহুবার বোলেছেন যে আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা (তওহীদ) বলে গ্রহণ করে নিলেই জাহান্নামের আগুন আর স্পর্শ করতে পারবে না, জান্নাতে প্রবেশ করবে, সেখানে অনাব্যশ্যক খুঁিটনাটি নিয়ে মতান্তর করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কতখানি বোকামী, কতখানি নির্বুদ্ধিতা। যে জাতিকে আল্লাহ আদেশ করেছেন সমস্ত মতভেদ ত্যাগ করে সকলে ইস্পাতের মত কঠিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দেয়া রজ্জু অর্থাৎ তার দেয়া জীবন-বিধানকে আঁকড়ে ধরে রাখতে, কোন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় না দিতে, সে জাতি আজ তুচ্ছ খুঁটিনাটি মসলা-মাসায়েলের তর্ক নিয়ে শতধা বিচ্ছিন্ন, আল্লাহর পরিষ্কার সরাসরি আদেশ লংঘনকারী। যে মসলা-মাসায়েল মাকড়শার জালে এই জাতি নিজেকে জড়িয়ে ফেলে স্থবির হয়ে গেছে, অথর্ব হয়ে গেছে, সেই মসলা-মাসায়েল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে বললে এই হতভাগ্য জাতি তা শুনবে না, মানবে না, কারণ আজ মহানবীর প্রকৃত সুন্নাহ পৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে সন্ত্রাস, হানাহানি, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ করার চাইতে দাড়ি, মোচ কতখানি লম্বা হবে তা তাদের কাছে অনেক বেশি দরকারি, অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। কাজেই তাদের বলতে হবে, যার যতটুকু খুশী দাড়ি, মোচ রাখো, যার যে পাশে ইচ্ছা শোও, যার যতটুকু ইচ্ছা টাখনুর উপর পাজামা পর, কিন্তু ওগুলো নিয়ে কোন মতান্তর সৃষ্টি না করে শুধু আল্লাহর ওয়াহদানীয়াতে আর মোহাম্মদ (সা.) এর নবুয়তের উপর একত্র হও, অন্য কোন কথা উত্থাপন কর না। আল্লাহ ও রসূলের উপর দৃঢ় বিশ্বাস ঈমান থাকা সত্ত্বেও আকীদার বিকৃতির ফলে কার্যতঃ শেরক ও কুফরের মধ্যে নিমজ্জিত জাতিকে মনে করিয়ে দিতে হবে দাড়ি, মোচ, পাজামা, নফল এবাদতের কথা বাদ দিন, একেবারে খোদ কোর’আনেরও কোন আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে কোন মতভেদ, মতান্তর কুফর। বলেছেন স্বয়ং রসুলাল্লাহ এবং বলেছেন রাগান্বিত হয়ে। রাগান্বিতের কারণ এই মতভেদই হলো কোন জাতির অনৈক্য ও পরিণামে ধ্বংসের কারণ। শুধু জাতি কেন, যে কোন প্রতিষ্ঠান, সমিতি বা দলকে এমন কি একটা পরিবারকেও ধ্বংস করে দেবার জন্য মতভেদ অনৈক্য যথেষ্ট।

মহানবীর সময়ে শিয়া ছিল না, সুন্নী ছিল না, কোন মযহাব কোন ফেরকা ছিল না এ কথা ইতিহাস। তাঁর সময়ে ইসলামে যা ছিল না তেমন কিছু যোগ করা হচ্ছে বেদা’ত এবং বেদা’তের এই সংজ্ঞা সর্বসম্মত। তা হলে সমস্ত মযহাব, সমস্ত ফেরকা বেদা’ত শেরকের সম পর্য্যায়ের গুনাহ, অমার্জনীয় অপরাধ, যে অপরাধ ক্ষমা না করার জন্য আল্লাহ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাজেই জান্নাতী ফেরকার অন্যতম কর্তব্য হবে এই জাতিকে বলা যে আকীদার বিকৃতির ফলে তুমি তওহীদেই নেই। আল্লাহর হুকুম, বিধান প্রত্যাখ্যান করে পাশ্চাত্যের তৈরি ব্যবস্থা নিজেদের জীবনে চাপিয়ে নিয়ে এবং তা থেকে উম্মাহকে সতর্ক না করে শেরকে নিমজ্জিত অবস্থায় আছ, তোমার আবার মযহাব কি? ফেরকা কি? একই সংজ্ঞায় প্রচলিত ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফীবাদের তরিকাগুলিও বেদা’ত। কারণ, বিশ্বনবীর সময় কোন তরিকা ছিলো না, এ কথা সর্বসম্মত ইতিহাস। তার সময়ে যেমন একটি মাত্র জাতি ছিলো, “উম্মতে মোহাম্মদী” তেমনি তরিকাও মাত্র একটিই ছিলো, “তরিকায়ে মোহাম্মদী”। ঐ তরিকা ছিলো সংগ্রামী, জীবন উৎসর্গকারী, বহির্মূখী। আর এখন প্রচলিত বিভিন্ন তরিকাগুলি ঠিক বিপরীতমুখী, অন্তমুর্খী। রসুলের নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় কর্মক্ষেত্র ছিল উন্মুক্ত পৃথিবী। আর বর্তমানের প্রক্রিয়া, তরিকাগুলোর কর্মক্ষেত্র খানকা, হুজরার চার দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ। রসুলের নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় তারাই সবচাইতে বেশি মর্যাদা লাভ করতেন যারা মানবজীবনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যাবতীয় অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে জীবনপণ করে সংগ্রাম করে যেতেন, আর বর্তমানের এই তরিকা-পদ্ধতিতে অন্যায়ের সাথে সামান্যতম সংঘর্ষ তো দূরের কথা, সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনা যেখানে আছে, তা অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে চলতে শেখায়। এক কথায় ঐ তরিকা আর এই তরিকা ঠিক বিপরীতমুখী। একটি পুর্বমূখী অন্যটা পশ্চিম মুখী; একটা উত্তর মুখী অন্যটা দক্ষিণ মুখী।

সুতরাং জান্নাতী ফেরকার কোন মানুষকে যদি বাহাত্তর ফেরকার কেউ প্রশ্ন করে আপনি শিয়া না সুন্নি, না আহলে সুন্নাত আল জামাত, না আহলে হাদীস, হানাফী না শাফেয়ী, না মালেকী, না হাম্বলী, না অন্য কিছু? তবে তার জবাব হবে- ভাই! আমি ওসবের কোনটাই নই। আমি তো শুধু প্রাণপণে চেষ্টা করছি মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মদী হতে। একটা বিল্ডিং, ইমারতের মধ্যে প্রবেশ করলে তবে তো প্রশ্ন আসতে পারে আমি কোন কামরায় আছি? আমরা ইসলামের ইমারতের মধ্যেই নেই, কোন কামরায় থাকি সে প্রশ্ন তো অবান্তর! তোমাদের প্রায়ান্ধ দৃষ্টিতে তোমরা দেখতে পাচ্ছ না সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো জঙ্গিবাদী তাণ্ডবকে ওসিলা ধরে তোমাদের দেশগুলো একটার পর একটা ধ্বংস করে দিচ্ছে, লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে, তোমরা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব করে নিঃশেষ হয়ে গেলেও তাদের কাছে শিয়াও যা, সুন্নিও তা, উভয়কেই ধ্বংস করতে উদ্যত তারা। আর যাদের দুনিয়া এমন লাঞ্ছনাময়, তাদের আখেরাত সুখময় হবে কী করে?

জান্নাতী ফেরকার অন্যতম কর্তব্য হবে মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাকে প্রশ্ন করা যে, আল্লাহর রসূলের (দ:) সঙ্গে সর্বদা থেকে, তার সঙ্গে প্রতিটি সংগ্রামে সঙ্গী হয়ে সরাসরি তার কাছে থেকে যারা ইসলাম কি, তা শিখেছিলেন, তারাই ঠিক ইসলাম শিখেছিলেন, না আজকের মওলানা, মওলবী, পীর-মাশায়েখরা যে ইসলাম এই জাতিকে শেখান এই ইসলাম ঠিক? নিশ্চয়ই রসুলের সঙ্গী-সাথীদের ইসলামই প্রকৃত ইসলাম। আল্লাহর রসুলের সাহাবীরা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দিয়ে ইসলামে প্রবেশ করার পর অর্থাৎ তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার পর থেকে তাদের সারাটি জীবন কেবল একটি কাজেই ব্যয় করেছেন, সেটা হচ্ছে সংগ্রাম, পৃথিবীময় ন্যায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ব্যস, এই দুইটি ঠিক থাকলে আর কোনোকিছুই কাউকে জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না। এমনকি চুরি, ব্যাভিচারের মত বড় বড় অপরাধও জান্নাত থেকে ফেরাতে পারবে না এ কথা আল্লাহর রসুল নিজে বলে গেছেন। কাজেই এসো, ব্যক্তিগত জীবনের ছোটখাটো বিষয়কে ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ রেখে জাতীয় স্বার্থে আমরা কেবল দুইটি শর্তে ঐক্যবদ্ধ হই, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না এবং ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থেকে যাবতীয় অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাব। তবেই আমরা হব উম্মতে মোহাম্মদী।

জান্নাতি ফেরকার এই দায়িত্ব বড় কঠিন। বাধা আসবে চতুর্দিক থেকে। মারধোর, অপমান, বিদ্রুপ, হয়রানি, নির্যাতন অনেক কিছুই সইতে হবে। কিন্তু তাতে হতাশ হওয়া চলবে না, নিরুৎসাহিত হওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, আল্লাহর সাহায্য তাদের জন্যই, কেননা তারাই এই জাতির শেষ ভরসা, মৃতপ্রায় জাতির আশার আলো। দিনশেষে বিজয়ের হাসি তাদেরই প্রাপ্ত হবে ইনশা’আল্লাহ।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...