হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

কীভাবে ইসলাম যাবে স্বর্ণশিখরে!

রিয়াদুল হাসান

ইরানে অবস্থিত নাসির উল মুলক মসজিদের সম্মুখভাগ। এক সময় মুসলিম জগৎজুড়ে এমন অগণিত স্থাপত্যকলার নিদর্শন স্থাপন করেছিলেন মুসলিম স্থপতিগণ। কিন্তু বর্তমানে গোটা মুসলিম জাতি অন্যান্য জাতির কাছে পরাজিত দাসে পরিণত হয়েছে। হারিয়ে গেছে তাদের সকল সৃজনশীলতা ও সামর্থ্য।

 

ইরানের সিরাজ শহরে অবস্থিত মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন নাসির উল মুলক মসজিদের অভ্যন্তরভাগে বিচরণ করছেন দর্শনার্থীগণ।

রসুলাল্লাহর যে সাহাবীগণ ও সমসাময়িক মুসলিমগণ রসুলাল্লাহর আনীত ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে অর্ধ-বিশ্বজয়ী জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন তারা উচ্চশিক্ষিত হওয়া দূরে থাক নাগরিক জীবন সম্পর্কেও কোনো জ্ঞান রাখতেন না। দুনিয়া সম্পর্কে আরবদের অজ্ঞতা সত্ত্বেও আজ সমগ্র দুনিয়াবাসী তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত এর পেছনে কী রহস্য তা চিন্তা করা আমাদের অত্যবশ্যক। কেননা আমরাও চাই ইসলামকে আবার মানবসভ্যতার স্বর্ণশিখরে নিয়ে যেতে।

উম্মতে মোহাম্মদী যখন জয়ের পর জয়ের মাধ্যমে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের অধিকারী হলো এবং তাদের নাগরিকদেরকে নিজেদের শাসনাধীন করে নিল তখনও তাদের মধ্যে নগর সংস্কৃতির কোনো বোধ জন্মায়নি। বর্ণিত আছে যে, তাদের সম্মুখে মিহি রুটি উপস্থিত করা হলে তারা তাকে নেকড়া বলে ভেবেছিল এবং পারস্যের সাসানি সাম্রাজ্যের বাদশাহ খসরুর রাজভাণ্ডারে কর্পুর (ন্যাপথলিনের মতো একটি রাসায়ানিক পদার্থ যার বহু উপকারী ব্যবহার রয়েছে) পেয়ে তারা তাকে লবণ হিসাবে রুটির মধ্যে ব্যবহার করেছিল যা ছিল পারস্যবাসীদের জন্য কৌতূকপ্রদ। এ প্রকার বহু উদাহরণ বিদ্যমান।

রসুলাল্লাহ যখন বিদায় নেন তখন শিশু নারী বৃদ্ধ মিলিয়ে ঐ জাতির মোট জনসংখা ছিল পাঁচ লক্ষ। ঐতিহাসিকদের মতে এর মধ্যে বড়জোর চল্লিশ জন মানুষ ছিলেন শিক্ষিত অর্থাৎ মোটামুটি লেখাপড়া জানতেন। এক হাজারের উপরে যে সংখ্যা আছে সেটাও অনেকে জানতেন না। কিন্তু তারাই সমগ্র বিশ্বের বুকে একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী এটম বোমার মতো ভেঙে পড়েছিল। তাদের প্রচণ্ড সামরিক শক্তির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু তাদের সেই বিজয়ের ধারাকে তারা অব্যাহত রাখতে পারেন নি। কারণ আল্লাহর রসুল (সা.) তাদের সামনে যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে দিয়ে গিয়েছিলেন তারা ইবলিসের প্ররোচনায় পড়ে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের নেতারা অচিরেই ঐ সকল বিজিত সভ্যতার নগর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল এবং ভোগবিলাসকে আঁকড়ে ধরেছিল। তারা নিজেদেরকে রোমান সিজার ও পারসি খসরুদের মতো ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল এবং চলনে বলনে তাদেরই অনুসরণ করতে আরম্ভ করেছিল। জাতির মধ্যে জন্ম নিয়েছিল আলেম শ্রেণি যারা দীনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করে দিয়েছিল। তারা মাসলা মাসায়েল নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছিল।

তাদের কাজের ফলে জাতি জেহাদ ছেড়ে দিয়ে বুজুর্গ হওয়াকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিল। তাদের উত্তরসূরীদের কাছে জেহাদ অত্যন্ত কষ্টকর ও অপছন্দনীয় কাজ বলে প্রতিভাত হতো। এর চেয়ে ঢের সহজ কাজ ছিল খানকায়, দরগায় বসে আত্মার উৎকর্ষ লাভের রেয়াজত করা। তারা ভুলে গিয়েছিল যে রসুলাল্লাহর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী যদি জেহাদ করে সংগ্রাম করে, রক্ত ও জীবন দিয়ে দীন প্রতিষ্ঠা না করতেন তাহলে তাদের এই আয়েশী জীবন লাভ হতো না। সুতরাং ওটাই ছিল তাদের মুখ্য কর্তব্য।

আজ এই চৌদ্দশ বছর পরে জাতি পরাধীনতার শিকল পরে, পাশ্চাত্যের দাসানুদাস হয়ে সেই জেহাদ ছেড়ে দেওয়ার প্রতিফল ভোগ করে চলেছে। কিন্তু সেই বোধ এখনও তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়নি যে তারা আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা হারিয়ে ফেলেছে, তাদের জীবন চলছে আল্লাহর হুকুমের বিপরীত হুকুম দিয়ে। এখনও তারা কোর’আন দেখে, হাদিস দেখে নামাজ রোজা করে চলেছে, খানকায় বসে জিকির করছে, মাদ্রাসায় বসে মাসলা শিখছে কিন্তু মো’মেনের খাতা থেকে আল্লাহ তাদের নাম বাতিল করে দিয়েছেন বহু শতাব্দী আগেই সে বোধ এখনও তাদের আসে নি। একটি মো’মেন জাতি কী করে গায়রুল্লাহর হুকুমে জীবন কাটাতে পারে, কী করে তারা সুদের অর্থনীতি, পাশ্চাত্যের দণ্ডবিধি সব মেনে, কোর’আনের হুকুমগুলোকে বাদ দিয়ে মুসলিম দাবি করতে পারে?

জাতির এই নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতার পেছনে দায়ী কারা? দায়ী সেই শ্রেণিটি যারা এদেরকে বিজাতির দাস হওয়ার পরও মুসলিম বলেই সার্টিফিকেট বা স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে, কুফর ও শেরক করার পরও এই সবক দিয়ে যাচ্ছে যে তোমরা জন্মগতভাবেই মুসলিম। সুতরাং এখন নামাজ পড়ো, রোজা রাখো আর আলেম ওলামাদেরকে নবীর ওয়ারিস মনে করে তাজিম করো, তাহলেই জান্নাত সুনিশ্চিত। এই মিথ্যা আশ্বাস জাতিকে তাদের কুফরী ও শেরকে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। এ কারণেই আল্লাহর রসুল এসে প্রথমেই তাঁর সম্প্রদায়কে তাদের শেরক ও কুফর সম্পর্কে অবগত করেছিলেন এবং সেখান থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আজকে হেযবুত তওহীদ ঠিক সেই কাজটিই করছে। অর্থাৎ শেরক কুফরে নিমজ্জিত মুসলিমসহ সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দানের জন্য এবং আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান করছে। কেননা বর্তমানে মানবজাতি আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ছুঁড়ে ফেলে দাজ্জালের সার্বভৌমত্বকে কবুল করে নিয়েছে। দাজ্জাল অর্থ পাশ্চাত্যে বিকশিত ধর্মহীন বস্তুবাদী প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা যা ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ নামে অভিহিত। তাদের উন্নতি, প্রগতি, শিল্প, কলা, জ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি, চিন্তাপদ্ধতি, জীবনপদ্ধতি সবকিছুকেই শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সেটাই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। পক্ষান্তরে ধর্মকে অসার, কুসংস্কার, পশ্চাৎপদ চিন্তা, মিথ্যা, প্রাচীনকালের উপকথা ইত্যাদি ধারণা মানুষের মনে-মগজে গেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সকল মানবরচিত ব্যবস্থার ব্যর্থতার পরও মানুষ নতুন ও বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ধর্মকে বিবেচনায় নিচ্ছে না। এখানেই প্রচলিত ধর্মের সবচেয়ে বড় পরাজয়, এখানেই ধর্মের কবর রচিত হয়ে গেছে।

এর জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে মানুষের সংকটে ধর্ম কোনো বাস্তব সমাধান পেশ করতেই পারে নি, বরং নিজেই সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ তো প্রচলিত ধর্মকেই ধর্ম বলে দেখতে পাচ্ছে, কেউ এর মধ্যে কোনোরূপ বিসদৃশ কিছু দেখতে পেলেও তার সমাধানও খুঁজতে চাইলে প্রচলিত ধর্মের ধর্মগুরুদের কাছেই খুঁজছে। ধর্ম যে তাদের জীবিকা সেটা তারা ভেবে দেখছে না। কিন্তু দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় ধর্মগুলো সবই তার মৌলিক রূপ হারিয়ে অপব্যাখ্যার কবলে পড়ে বিকৃত হতে হতে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। এখন সেগুলো আর সমাজের কল্যাণে কোনো ভূমিকা রাখার উপযোগী নেই। বড় বড় ধর্মনেতারাও তাই নির্বাচনে দাঁড়ালে দুই শতাংশও ভোট পান না। বিকৃত ধর্মগুলো পরকালের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে কারণ মানুষ পরকাল দেখতে পায় না। তারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ইহকালে আর সেখানে ধর্মের নেতারাই ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারাই অপরের মুখাপেক্ষী হয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। মানুষকে আশার আলো দেখাবে এমন কোনো শিক্ষাও তাদের কাছে নেই। তারা জানেন মসজিদে ঢুকতে হলে কী দোয়া পড়তে হবে, তারা জানেন আরবি বর্ণ কীভাবে পড়তে হবে। মানুষের বাস্তব সংকটের হিসাব নিতে গেলে লক্ষ লক্ষ সংকট ঝাঁক বেঁধে আসে। সেগুলোর কোনো নিদান এদের কাছে নেই। তাহলে মানুষ বাধ্য হয়েই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে মানুষের সার্বভৌমত্ব, পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিষ্টান সভ্যতা দাজ্জালের সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে- এটাই স্বাভাবিক। গত পাঁচশত বছরে এটাই হয়েছে। এখনও তা-ই চলছে। মুসলিমরা একে নিয়তি মেনে নিয়ে অলস বসে আছে ইমাম মাহদির (আ.) জন্য।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...