হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

অদৃশ্য ধনভাণ্ডারের মালিক ছিলেন মাননীয় এমামুযযামান

মোহাম্মদ রিয়াদুল হাসান:

সম্পদ দুই প্রকার। জাগতিক সম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ। জাগতিক সম্পদ যার আছে সে দান কোরতে পারে, না থাকলে দান কোরতে পারে না। তেমনি আত্মিক সম্পদ যার আছে সে দান কোরতে পারে, যার নেই সে দিতেও পারে না, তার কাছ থেকে কেউ নিতেও পারে না। মাননীয় এমামুযযামান তাঁর জাগতিক সম্পদ সব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে বোলতে গেলে নিঃস্ব অবস্থায় আল্লাহর সাক্ষাতে চোলে গেছেন। তাঁকে আল্লাহ দান কোরেছিলেন এক অদৃশ্য ধনভাণ্ডার, আধ্যাত্মিক সম্পদের ধনভাণ্ডার। এমামুযযামানের  সততা, ওয়াদা, আমানতদারী, আতিথেয়তা, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, একাগ্রতা, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, উদারতা, দানশীলতা, সাহসিকতা, আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কল, পাহাড়ের মতো অটলতা সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন এমন এক মহামানব যাঁর সংস্পর্শে যেই এসেছে, সেই জান্নাতের শান্তি লাভ কোরেছে। কিন্তু তাদের ক’জন সেই ধনভাণ্ডার থেকে অমূল্য সম্পদ আহরণ কোরতে পেরেছে?এমামুযযামানের  কাছে গচ্ছিত অদৃশ্য ধনভাণ্ডার থেকে যে সম্পদগুলি আমরা নিতে পারি নি, কিন্তু দেখেছি সেগুলির পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা কোরব।

দু’টি পাথর
২০০১ সনের কোন এক সময়। নারায়ণগঞ্জে আল্লাহর তওহীদের বালাগ দেওয়ার সময় স্থানীয় ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাদের অপপ্রচারে প্ররোচিত কতিপয় সন্ত্রাসীর আক্রমণের শিকার হই। আহত অবস্থায় আমরা কয়েকজন ঢাকা চোলে আসি। তখন আমি এমামুযযামানের বাসায় বেশ কিছুদিন ছিলাম। তাঁর চিকিৎসায় আমি যখন একটু সুস্থ হোয়ে উঠেছি, একদিন সকালে কোন একজন মোজাহেদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ৭ নম্বর সেক্টরের ভেতরের দিকে চোলে গিয়েছি। সেখানে একটি বাড়ি তৈরি হোচ্ছিল, বাড়ির সামনে ইট বালি পাথর রাখা। ছোট বেলা থেকেই আমার গোল পাথর খুব ভালো লাগে। কোথাও সুন্দর পাথর দেখলেই আমি সংগ্রহ কোরতাম, জমিয়ে রাখতাম, পকেটে নিয়ে ঘুরতাম। আমাদের বাড়িতে গেলে হয়তো এখনও দু’একটি পাথর পাওয়া যাবে। তো সেই বাড়ির সামনে আমি কয়েকটি সুন্দর সুন্দর আকৃতির মসৃণ পাথর দেখতে পেলাম এবং নিয়ে আসলাম।
ঐ দিন বা তার পরদিন আমি এমামুযযামানের  সঙ্গে ক্লিনিকে গিয়েছি। বিকাল বেলায় যখন চেম্বার শেষে এমামুযযামান আমাদের সঙ্গে কথা বোলছেন, তখন দেখলাম এমামুযযামানের টেবিলে পেপার ওয়েট নেই, কাগজপত্র উড়ে যাচ্ছে। এমামুযযামান তাঁর সহকারী রাশেদ ভাইকে বোললেন পেপার ওয়েট কেনার জন্য। তখন আমি আমার পকেট থেকে দুইটা পাথর বের কোরে এমামুযযামানকে দিয়ে বোললাম, ‘এইগুলি দিয়ে পেপার ওয়েটের কাজ চালানো যাবে।’ এমামুযযামান মনোযোগ দিয়ে সেগুলি দেখলেন, তারপর জিজ্ঞেস কোরলেন, ‘কোথায় পেয়েছ এগুলি?’ আমি বোললাম, ‘একটি বাড়ির কন্সট্রাকশানের কাজ চোলছিল। তার সামনে ইট বালি পাথর রেখেছে, সেখান থেকে এনেছি’। এমাম বোললেন, ‘তারমানে তো এগুলির মালিক আছে। তুমি কি জিজ্ঞেস কোরে এনেছো?’ এমন প্রশ্নও যে উঠতে পারে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। রাস্তার পাশ থেকে প্রায় মূল্যহীন দু’টো পাথর শখ কোরে এনেছি তাও জিজ্ঞেস কোরে আনতে হবে, আমি এতটা ভাবিই নি। আমি বোললাম, ‘না, কাউকে বোলে আনি নাই তো।’
তখন তিনি আব্দুল কাদের জিলানী (র:) এর বাবার একটি ঘটনা বোললেন। ভদ্রলোক একদিন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় একটি নদীর তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলেন। একসময় তিনি দেখতে পেলেন একটি সুস্বাদু ফল নদীর পানিতে ভেসে ভেসে আসছে। তিনি আল্লাহর শোকর আদায় কোরে সেটাকে পানি থেকে তুলে আহার কোরলেন। অর্দ্ধেকটা খাওয়ার পরই তার মনে চিন্তার উদয় হোল, আচ্ছা আমি যে এই ফলটা খেলাম, এই ফলতো কোন বাগানে হোয়েছে, সুতরাং এর মালিক আছে। আমি তো তার কাছে অনুমতি না নিয়েই খেয়ে ফেলছি। এটা তো আমার খাওয়া অনুচিৎ হোচ্ছে। এই ভেবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া বন্ধ কোরে দিলেন এবং নদীর উজানের দিকে হাঁটতে লাগলেন। যেহেতু ফলটি গাছ থেকে নদীতে পড়েছে, সুতরাং অবশ্যই নদীর তীর ধোরে এগুলেই সেই বাগানের সন্ধান মিলবে। বহু পথ হেঁটে তিনি সেই বাগানের সন্ধান লাভ কোরলেন এবং বাগানের মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরে বিনা অনুমতিতে তার বাগানের ফল ভক্ষণ করার জন্য ক্ষমা চাইলেন।
এই উদাহরণ দিয়ে এমামুযযামান আমাকে বোললেন, ‘পাথরগুলি তুমি যেখান থেকে এনেছো, সেইখানে রেখে আসবে।’ আমি খুবই লজ্জিত হোলাম এবং বোললাম, ‘জ্বি এমামুযযামান’।

ভিক্ষুক
আমি এমামুযযামানের চোখের সমস্যা হওয়ার পর থেকে লেখালিখির কাজে সাহায্য কোরতাম। লিখতে বোসলে বাইরে থেকে যখন কোন ভিক্ষুকের ভিক্ষা চাওয়ার আওয়াজ আসতো, আমি অনেক সময় খেয়াল কোরতাম না। কিন্তু এমামুযযামান ঠিকই খেয়াল কোরতেন এবং আলমগীর ভাইকে (চিকিৎসা কাজে এমামের সহকারী) ডাকতেন, “আলমগীর”। আলমগীর ভাই ছুটে আসতেন। এমামুযযামান বোলতেন, “রাস্তায় ভিক্ষা কোরছে ঐ লোকটাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে এসো।” আলমগীর ভাই সঙ্গে সঙ্গে চোলে যেতেন। এভাবে অনেকবার হোয়েছে। এমামুযযামান বোলতেন, “ওরা আল্লাহর নামে সাহায্য চায়।”
অনেক ঘটনার মতো এটাও আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে এমামুযযামান চোলে যাওয়ার পর একদিন একটু বেশি সকালে দরজায় প্রচণ্ড জোরে নক করার শব্দ হোল। একের পর এক নক চোলতেই থাকলো। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, বোধ হয় কোন ভিক্ষুক এসেছে। আমি দরজা খুলে দেখলাম সত্যিই তাই। ভিক্ষুকটা আমার কাছে সাহায্য চাইল। আমি তাকে বিরক্ত সুরে বোললাম, এখন যান, মাফ করেন। তারপরে দরজা লাগিয়ে ফিরে এলাম। একটু পরেই আমার মনে পোড়ল, এমামুযযামান কিভাবে রাস্তায় ভিক্ষুকের আওয়াজ শুনে টাকা পাঠিয়ে দিতেন। আমার খুব মন খারাপ হোয়ে গেল। ভাবলাম, এমামের সঙ্গে এতকাল থেকে তাঁর কাছ থেকে আমি কী নিতে পারলাম। আমরা তো এখনও ভিক্ষুকদের ছদ্মবেশী, ভণ্ড, তাগুত ইত্যাদি মনে কোরে কিছু দিতে দ্বিধা কোরি, খেয়াল কোরি না যে তারা আমাদের কাছে আল্লাহর ওয়াস্তে সাহায্য চায়। নিজের চোখে এমামের এই কাজটি দিনের পর দিন দেখে আমি কতটুকু নিতে পারলাম সেটাই বৃহৎ একটি প্রশ্ন আমার কাছে।

স্বনির্ভরতা
এমামুযযামান নিজের ঘরের লোক ছাড়া অন্য কোন মোজাহেদ মোজাহেদাকে দিয়ে পারতপক্ষে কোন ব্যক্তিগত কাজ করাতেন না। তাঁর এ বৈশিষ্ট্য সবাই জানতো। কোন মিটিং-এ বোসলে ফ্যানের রেগুলেটর বাড়ানো কমানোর জন্যও তিনি নিজেই উঠে যেতেন এবং এমনভাবে সেট কোরতেন যে বাতাসের কোন আওয়াজ না হয়, কিন্তু ঘরও ঠাণ্ডা হয়। তিনি যখন অত্যন্ত অসুস্থ, আমি গিয়েছি কাজ কোরতে। বিছানায় শুয়ে থাকেন, বাথরুমে যেতেও ধোরে নিয়ে যাওয়া লাগে। এমন অবস্থায় তিনি আশে পাশে ঘরের কাউকে খুঁজলেন। আমি জিজ্ঞেস কোরলাম, ‘এমামুযযামান, আপনার কী লাগবে আমাকে বলেন।’ তিনি বোললেন, ‘ফ্যানটা একটু কমিয়ে দাও।’ আমি ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরালাম। তিনি যখন বোললেন ঠিক আছে, তখন রাখলাম। এমামুযযামান বোললেন, ‘যাজাকাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে প্রতিদান দিন)’। আমি ‘শুকরিয়াহ’ বোললাম। এন্তেকালের কিছুদিন আগে, তাঁর শারীরিক অবস্থা তখন আরও খারাপ। তখনও তিনি চাইতেন না অন্যের সাহায্য নিতে। আমি গিয়েছি। তাঁর ভীষণ কাশি, খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। এমামুযযামানের  কাশি আসলে শ্লেষা ফেলার জন্য একটি পাত্র খাটের নিচে রাখা ছিল। তাঁর কাশি দেখে আমি সেটা এগিয়ে দিলাম। তিনি খুবই বিব্রত হোলেন আর এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন ঘরের কেউ আছে কি না দেখার জন্য। এমামের এই অবস্থা দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হল। ব্যক্তিগত কাজে অন্যের সাহায্য নিতে গেলে এখনও আমার সেই দৃশ্য মনে পড়ে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...