Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36

রোহিঙ্গা নির্যাতন ও মুসলিম জাতির করণীয়


Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/htmain/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/dynamic-tags/tags/post-featured-image.php on line 36


দক্ষিণে বাংলাদেশের শেষ সীমানা টেকনাফের নাফ নদী। এই নদীটি পেরোলেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি এখন এই রাখাইনে। কারণ ঠিক এই মুহূর্তে সেখানে মানবজাতির ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হচ্ছে। দেশ-কাল সম্পর্কে ন্যূনতম খোঁজ-খবর রাখেন যারা তাদেরকে বলে দিতে হবে না নাফ নদীর ওপারে কী অবর্ণনীয় দুর্দশা নেমে এসেছে সেখানকার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলিমদের জীবনে। বার্মিজ সেনাবাহিনীর পাশবিক আক্রমণ, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের নির্মম চিত্র দেখে তাবৎ পৃথিবীর মানুষ আজ স্তম্ভিত, হতবাক। যথারীতি এবারও এই নির্যাতনের ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশের সীমান্তে।
সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সঙ্কটের সূত্রপাত:
গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে মিয়ানমারের ৯ জন পুলিশ অফিসার নিহত হয়। হামলাকারী কারা তা স্পষ্টভাবে জানা যায় নি। তবে বিগত দিনগুলোতে দেখা গেছে- ‘আরাকান আর্মি’ নামক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের স্বাধীনতাকামী একটি সশস্ত্র সংগঠন প্রায়ই মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে থাকে। সে হিসেবে সাম্প্রতিক হামলাটি তারাই চালিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই সন্ত্রাসী হামলার দায় চাপিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর। এরপর হামলাকারীদের খোঁজে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ এর নাম করে শুরু হয় সেনাবাহিনীর নারকীয় তা-ব। কয়েকদিনের ভেতরেই রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় সেনাবাহিনী। শত শত মানুষকে এক জায়গায় জড় করে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের সামনেই রোহিঙ্গা মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়। এমনকি রেহাই পাচ্ছে না কোলের শিশুরাও। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া তরুণীদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে রাস্তা কিংবা জঙ্গলের ধারে। বাড়িতে আগুন দিয়ে তার মধ্যে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে অবুঝ শিশুদের। গত দুই মাসে নিহত হয়েছে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা। কয়েক হাজার ঘরবাড়ি-মসজিদ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দুই মাসেই নতুন করে উদ্বাস্তু হয়েছে ৪০ হাজার লোক। যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর। ফলে জান বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের সামনে এখন একটাই রাস্তা- নাফ নদী পেরিয়ে কোনোরকম বাংলাদেশে প্রবেশ করা। বিভিন্ন সূত্র মোতাবেক, গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ২২ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কট: বাংলাদেশ জড়িত যেভাবে
বস্তুত রোহিঙ্গাদের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক। রোহিঙ্গারা ধর্মে মুসলমান, আমাদের দেশেরও অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। তারা কথা বলে অনেকটা কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষার মতো করে। ইতিহাসে যখনই এই রোহিঙ্গারা কোনো আধিপত্যবাদী শক্তির নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা বাংলাকেই তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভেবে জানের মায়ায় ছুটে এসেছে বাংলাদেশে। যে শাসকই বাংলা শাসন করুক মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি কেউ নিষ্ঠুর হতে পারেন নি। এই ধারা এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রিত রয়েছে যারা বিগত দশকগুলোতে রাখাইনে প্রবল নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। পরবর্তীতে মিয়ানমার সরকার আর তাদেরকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয় নি। বাংলাদেশে আশ্রিত এই লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের নিয়ে বর্তমানে এমনিতেই বাংলাদেশ নানামুখী সমস্যার মুখে আছে। দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকে জঙ্গিবাদী কর্মকা-ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, কেউ মাদকব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ছে, কেউ অবৈধভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদেশে গিয়ে তাদের কেউ যখন অপরাধমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হয় তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপেক্ষাও করা যায় না, আবার এভাবে চলতে দেওয়াও যায় না। এরই মধ্যে পুনরায় হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থাৎ সমাধান হবে কি, সঙ্কট ক্রমশই আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকার ও রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগ সম্প্রদায়ের দাবি হলো- রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা ‘বহিরাগত’ ‘বিদেশি’ ইত্যাদি। মিয়ানমার সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলে দিয়েছে- এরা বাঙালি। অথচ ‘রোহিঙ্গা’ জাতিটি ভাষাভিত্তিক স্বতন্ত্র একটি জাতিগোষ্ঠী, আরাকানে যাদের ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি। তারা বাঙালি নয়, তারা রোহিঙ্গা। এই হাজার বছরের ইতিহাসকে অস্বীকার করে রাখাইনে সরকারি বাহিনী যে নারকীয় তা-ব শুরু করেছে তার উদ্দেশ্য আর কিছু নয় রোহিঙ্গাদেরকে আরাকান ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যেতে বাধ্য করা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এখন খোলাখুলিভাবেই বলছে রাখাইনে এখন যা চলছে তা জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ অভিযান (Ethnic cleansing) ছাড়া কিছু নয়।
এখন বাংলাদেশ কী করবে? দুই ধরনের মতামত চড়াও আছে। একদল জাতীয় স্বার্থকে বড় করে দেখছেন। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করুক তা তারা চান না। এ ইস্যুটিকে এড়িয়ে যাওয়াকেই তারা সমীচীন মনে করছেন। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনায় বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি করে চলেছে। তাদের মধ্যে অনেকে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমানা খুলে দেওয়ার পক্ষে, কারণ রোহিঙ্গারা মুসলমান। মুসলমান না হয়ে অন্য কোনো ধর্মের লোক হলে হয়ত তাদের মতামত অন্যরকম হতে পারতো। যাহোক- বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয় তবে তা মিয়ানমার সরকারের অন্যায় দূরভিসন্ধিই বাস্তবায়িত হবার সুযোগ করে দিবে। তখন রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে যতক্ষণ না তারা সবাই রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসে। অন্যদিকে সীমান্ত বন্ধ করে রাখাও অস্বস্তিকর, অমানবিক। একটি জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হবে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হবে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে, ক্ষেত-খামার জ্বালিয়ে দেওয়া হবে, ধন-সম্পদ লুট করে নেওয়া হবে, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হবে, অতঃপর তারা যখন আশ্রয়ের আশায় আমাদের সীমান্তে পাড়ি জমাবে তখন আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ঐ নিপীড়িত মানুষগুলোর আর্তনাদ উপেক্ষা করে পুনরায় ঐ নরপশুদের কাছেই ফেরত পাঠাবে, নদীতে ভাসিয়ে দিবে, অবুঝ শিশুর মরদেহ পানিতে ভাসবে- এ তো হতে পারে না। তাহলে কী করণীয়? হ্যাঁ, করণীয় আছে। সেটা বলার জন্যই এই লেখাটির অবতারণা। কিন্তু তার আগে আসুন জেনে নেই রাখাইনে আজকের এই হতভাগা রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
কারা এই রোহিঙ্গা?
মিয়ানমার সরকারের দাবি হচ্ছে রোহিঙ্গারা রাখাইনের কোনো ঐতিহ্যবাহী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়, তারা সম্পূর্ণ বহিরাগত একটি জনগোষ্ঠী যারা ব্রিটিশ শাসনামলে রাখাইনে বসতি গড়ে তুলেছিল। এটা নির্ঘাত একটি অপপ্রচার। দশকের পর দশক ধরে এই অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এত জোরেশোরে চালানো হয়েছে যে, ইতিহাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ অনেকেই তা বিশ্বাসও করে ফেলেছেন। এটা দুঃখজনক। বর্তমানে রাখাইন মিয়ানমারের একটি প্রদেশ হলেও রোহিঙ্গাদের এই আবাসভূমি এক কালে ছিল স্বাধীন-স্বতন্ত্র রাজ্য। এই রাজ্যটিকে আরাকানও বলা হয়ে থাকে। আরাকানে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। এতদঞ্চলে প্রথম ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে অষ্টম-নবম শতাব্দীতে। তখন আরাকান শাসন করত চন্দ্র বংশীয় হিন্দু রাজারা। এই বংশের রাজধানী ছিল উজালী, বাংলা সাহিত্যে যা বৈশালী নামে পরিচিত। এ বংশের উপাখ্যান রাদ জা-তুয়েতে নি¤œরূপ একটি আখ্যান উল্লেখ আছে- কথিত আছে, ‘‘এ বংশের রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্ব কালে কয়েকটি বাণিজ্য বহর রামব্রী দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙ্গে পড়ে। জাহাজের আরবীয় আরোহীরা তীরে এসে ভিড়লে রাজা তাদের উন্নততর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করান। আরবীয় মুসলমানগণ স্থানীয় রমণীদের বিয়ে করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।’’ জনশ্রুতি আছে, আরবীয় মুসলমানেরা ভাসতে ভাসতে কুলে ভিড়লে ‘রহম’ ‘রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। রহম অর্থ দয়া করা। কিন্তু জনগণ মনে করে এরা রহম জাতির লোক। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোয়াং এবং রোয়াং থেকে রোহাংগ, রোসাঙ্গ ও রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করে।
১৪০৬ সালে বার্মার রাজা আরাকান আক্রমণ করে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। সেখানে তিনি ইসলামী সভ্যতার সাথে পরিচিত হন এবং প্রবলভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। ২৪ বছর তিনি গৌড়ে কাটিয়েছিলেন। এরপর গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ নরমিখলার সাহায্যে ৫০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলার সাথে জালালুদ্দিন শাহ’র চুক্তি হয়েছিল যে, বর্মিজদের হাত থেকে মুক্ত করে দিলে নরমিখলার শাসনাধীন আরাকান গৌড়ের করদ রাজ্য হিসেবে থাকবে। সে মোতাবেক নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন ১৪৩০ সালে। তিনি যে রাজবংশের পত্তন করেন সেটাই ইতিহাসের ম্রাউক-উ রাজবংশ নামে সুপরিচিত। যে ৫০ হাজার সৈন্য নরমিখলার হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য আরাকানে পাঠানো হয়েছিল তারা আর গৌড়ে ফিরে যায় নি, আরাকানেই ম্রাউক-উ রাজবংশের অধীনে চাকরি গ্রহণ করে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করে। গৌড়ের করদ রাজ্য হিসেবে ম্রাউক-উ রাজবংশ ১৪৩০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫৩০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান শাসন করে। এরপর ১৫৩০ সাল থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসিত হয়। এই সুদীর্ঘকাল (শেষের দিকে কয়েক বছর বাদ দিলে) আরাকান ম্রাউক-উ রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। এ সময়ে প্রত্যেক রাজা নিজেদের বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নাম ব্যবহার করেছেন। ফারসি সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হয়। গৌড়ের মুসলমানদের অনুকরণে মুদ্রা প্রথার প্রবর্তন হয়। মুদ্রার একপিঠে রাজার মুসলিম নাম ও অভিষেক কাল এবং অপরপিঠে মুসলমানদের কলেমা আরবি হরফে লেখা হয়। রাজার সৈন্যবাহিনীতে অফিসার থেকে সৈনিক পর্যন্ত প্রায় সবাইকে মুসলমানদের মধ্য থেকে ভর্তি করানো হতো। মন্ত্রী পরিষদের অধিকাংশই মুসলমান ছিল। কাজী নিয়োগ করে বিচারকার্য পরিচালিত হতো। অপর এক রাজা সেলিম শাহ বার্মার মলমিন থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিরাট ভূ-ভাগ দখল করে দিল্লীর মোগলদের অনুকরণে নিজেকে বাদশাহ উপাধীতে ভূষিত করেন। নিঃসন্দেহে তদানিন্তন শ্রেষ্ঠ সভ্যতা তথা মুসলিম আচার-আচরণ অনুকরণে এসে আরাকানের সমাজ জীবন পরিচালিত হয়েছে সুদীর্ঘ প্রায় চারশ’ বছরকাল। আরাকানের বাংলা সাহিত্যে এই রাজ্যকে রোসাঙ্গ রাজ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে। অনেকে ধারণা করেন রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং> রোয়াং> রোয়াইঙ্গিয়া> রোহিঙ্গা। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, আজকের রোহিঙ্গারাই ইতিহাস প্রসিদ্ধ রোসাঙ্গ সভ্যতার ধারক-বাহক। তবে এটা ভুললে চলবে না যে, নানা জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই রোহিঙ্গা জাতি।
ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া আরাকান দখল করে নেয়। আরাকানীরা প্রথমে বর্মীদের স্বাগত জানালেও অচীরেই তাদের ভুল ভাঙ্গে। বর্মিজরা আরাকানের বৌদ্ধ, মুসলিম, উপজাতি নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের উপর এমন নির্যাতন চালাতে থাকে যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ আরাকান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এই উদ্বাস্তুদেরকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। বৌদ্ধ মগ সম্প্রদায় ও মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। এদের মধ্যে মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সাথে চট্টগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক থাকায় তারা চট্টগ্রামে লোকালয়ে গিয়ে বসবাস শুরু করে। অন্যদিকে মগরা পার্বত্য এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে থেকে স্বাধীনতার আশায় বর্মি বাহিনীর বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা পরিচালনা করতে থাকে।
এদিকে ব্রিটিশরা তখন বাংলা দখল করে নিয়েছে। একদিকে বাংলায় চলছিল ব্রিটিশ আগ্রাসন, আর আরাকানে (রাখাইন) চলছিল বার্মিজদের আগ্রাসন। এই উভয় আধিপত্যবাদী শক্তির গ্যাড়াকলে পড়ে আরাকানীরা আর স্বাধীনতা ফিরে পায় নি। বরং ১৮২৬ সালে বর্মিদের হটিয়ে ব্রিটিশরাই আরাকান দখল করে নেয় এবং আরও পরে ১৮৮৫ সালে বৃটিশরা সমগ্র বার্মাই দখল করে নেয়। যখন এটা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, আরাকানীদের নিকট ভবিষ্যতে স্বাধীনতা ফিরে পাবার কোনোই সম্ভাবনা নেই এবং বৃটিশ শাসনামলে আরাকানের অরাজকতা অনেকাংশে দূর হয়েছে, কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে, তখন রোহিঙ্গা-মগ-উপজাতি নির্বিশেষে যারা বর্মি বাহিনীর অত্যাচারে একদা আরাকান ছেড়ে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছিল তারা পুনরায় তাদের পৈত্রিক নিবাসে ফিরে যেতে থাকে। স্বভাবতই স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া রোহিঙ্গা মুসলমানেরাও আরাকানে ফিরে গিয়ে নতুনভাবে বসতি গড়ে তোলে। মনে রাখতে হবে- এই রোহিঙ্গারা কিন্তু অভিবাসী হিসেবে আরাকানে যায় নি, তারা ছিল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকারী জনগোষ্ঠী, আরাকান তথা রাখাইনে যাদের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো, যারা কিনা আরাকানী সভ্যতার (রোসাঙ্গ সভ্যতা) প্রধান ধারক ও বাহক।
বৃটিশরা চলে যাবার সময় আরাকানকে তুলে দিয়ে যায় সেই বর্মীদের হাতেই যাদের হাতে তখনও আরাকানের নিরীহ মানুষের রক্তের দাগ লেগে আছে। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। দেড় শতাব্দী পরে এসে আরাকানের মুসলিমদের প্রতি পুনরায় নির্যাতনের খড়গ নেমে এল। ১৯৪৮ সালের সংবিধানে মিয়ানমার সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল। সেখানে বেসামরিক প্রশাসন চালু ছিল ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। তারপর সেনা-অভ্যুত্থান ঘটে। তখন সেনা শাসকেরাও ১৯৪৮ সালের সংবিধান মেনে নেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের নতুন সংবিধান অনুযায়ী, সামরিক শাসকেরা মুসলমানদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ১৯৮২ সালে চালু হয় নতুন নাগরিকত্ব আইন। আর তাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব খারিজ করে দেয়া হয়। অনেক সংখ্যালঘু উপজাতিকে জাতিগতভাবে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও আরাকানের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ‘রোহিঙ্গা’ নামক জাতিটির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়। মিয়ানমারে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিই এখন নিষিদ্ধ!
’৪৭ পরবর্তী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা:
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় বিশ্বের সবচাইতে নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। রোহিঙ্গারা সরকারি অনুমতি ছাড়া কোথাও ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের উপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাদের জমি জবর-দখল করা, জোর-পূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা ইত্যাদি নিত্যদিনের ঘটনা। ১৯৭৮ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর ‘নাগামান’ অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ (২,০০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল ‘প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে সব বিদেশি অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা’। কিন্তু কার্যত এই সেনা অভিযানের টার্গেট বানানো হয় রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে। ১৯৯১-৯২ সালে একটি দাঙ্গায় পুনরায় প্রায় আড়াই লক্ষ (২,৫০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। তারা জানায় রোহিঙ্গাদের বার্মায় বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। এছাড়া হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের স্বীকার হতে হয়। রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে হত।
প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করে আসছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দেওয়ার কাজটি মিয়ানমারের সামরিক সরকার বরাবরই করে এসেছে। ২০১২ সালে রাখাইনের উগ্রবাদী একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতে নির্বিচারে মুসলিমদের গণহত্যার দিনগুলোতে সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা সারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে। দাঙ্গায় রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পানি ছিটানোর মতো করে পেট্রল ছিটিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থী নেতারা, যারা বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন তারাও রোহিঙ্গাদের বার্মার জনগণ হিসেবে স্বীকার করেন না। রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও নির্মূলের প্রশ্নে যেন সবাই একাট্টা। আজকে সারা পৃথিবী যখন রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পৈশাচিক গণহত্যা দেখে স্তম্ভিত, তখন মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেত্রী, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি ‘মানবতা’ ‘মানবাধিকার’ আর ‘গণতন্ত্রের’ খোলস ঝেড়ে ফেলে সেনাবাহিনীর পক্ষে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। রাখাইনে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট আর উচ্ছেদ-অভিযান নাকি সেনাবাহিনী নিয়ম মেনেই করছে! হায়রে মানবতা! হায়রে মানবাধিকার!
রাখাইনে বৌদ্ধ-মুসলিম
সাম্প্রদায়িকতার গোড়া কোথায়?
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মগ জাতিগোষ্ঠীর একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক অংশ দশকের পর দশক ধরে শত্রুতা করে আসছে, আর বরাবরই তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। মগ-রোহিঙ্গা সম্পর্কে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢালার কাজটি করেছিল ব্রিটিশরা, অনেকটা ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির মতোই। এ সম্পর্কে অধ্যাপক এন.এম. হাবিব উল্লাহ তাঁর ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘‘বার্মা বর্মীদের জন্য (ইঁৎসধ ভড়ৎ ঃযব ইঁৎসবংব)’’ কিন্তু ব্রিটিশ সরকার একে প্রচার করে ‘‘বার্মা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মীদের জন্য (ইঁৎসধ ভড়ৎ ঃযব ইঁফফযরংঃ ইঁৎসবংব)’’। একই সাথে বৃটিশ সরকার এও প্রচার করল ‘‘বার্মার মুসলমানেরা হলো বহিরাগত (ইঁৎসবংব গঁংষরসং ধৎব ভড়ৎবরমহ রসসরমৎধহঃং ড়ৎ কধষধং)’’। বৃটিশ সরকারের এই নীতি মুসলমানদের নিরাপত্তা বিঘিœত করে তোলে, যা অতীতে কখনো ছিল না।’’
প্রকৃতপক্ষে বৃটিশ সরকারই সুকৌশলে মুসলমানবিরোধী এই সাম্প্রদায়িক চেতনা বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ফলে বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে একটি বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অব্যাহতভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৩০ সালের বর্মী-ভারতীয় দ্বন্দ্ব, ১৯৩৮ সালের বৌদ্ধ-মুসলিম দাঙ্গা, ১৯৪২ সালে আরাকানে নৃশংস রোহিঙ্গা হত্যা ইত্যাদি বৃটিশ সরকারের সৃষ্ট বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িকতারই পরিণতি।
এখন করণীয় কী?
আমরা যদি মনে করি রোহিঙ্গা সঙ্গট কেবল রোহিঙ্গাদের একার সমস্যা তাহলে ভুল হবে। মুসলিমদের উপর অকথ্য নির্যাতন কোথায় হচ্ছে না? সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে। রাখাইন থেকে কাশ্মীর, জিনজিয়াং থেকে ফিলিস্তিন- সবখানেই জাতিগত পরিচয়ে মুসলিমরা আজ নির্যাতনের শিকার। আজও আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মাটি সিক্ত হয়ে আছে মুসলিমদের রক্তে। এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রায় ৬ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু, যাদের প্রায় সবাই মুসলিম। রোহিঙ্গা নির্যাতন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, পৃথিবীময় চলা মুসলিম নির্যাতনেরই অংশমাত্র। সব একই সূত্রে গাঁথা। আসলে বিপদ কেবল রোহিঙ্গাদের নয়, বিপদ আমাদের সবার, বিশ্বের ১৬০ কোটি মুসলিম নামক জনসংখ্যার। সুতরাং আমাদেরকে সমস্যার গোড়ায় প্রবেশ করতে হবে। জানতে হবে কেন এই বিপর্যয়। কোথায় পথ হারিয়েছি আমরা। সমাধান কোন পথে।
বিশ্বের কোথাও মুসলিমদের উপর নির্যাতন হলেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়। ফিলিস্তিনে ইজরাইল গণহত্যা চালালে অন্যান্য মুসলিম দেশে ইজরাইলের দূতাবাস ঘেরাও করা হয়। বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে উত্তেজিত মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে, নিজেদেরই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ করে হতাহত হয়। এসব করে ধর্মানুভূতির প্রকাশ ঘটানো যায় বটে, কিন্তু প্রতিকার আসে না। আবার দেখা যায় একটি দেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মুসলিম সংখ্যালঘুরা হত্যাকা-ের শিকার হলে তার প্রতিশোধস্বরূপ আরেক দেশে উত্তেজিত মুসলিমরা ঐ ধর্মের মানুষের উপর হামলা চালায়। ভারতে মুসলিম নির্যাতিত হলে বাংলাদেশে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয়। মিয়ানমারে মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা হয়। এতে মুসলিমদের কোনো লাভ হয় কি? হয় না, হবার কথাও নয়। এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা আসলে মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতকেই সুসংহত করে।
অনেকে মোনাজাত করেন যেন আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে মুসলিমদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেন। অথচ আল্লাহ কোর’আনে বলেই দিয়েছেন- আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। (সুরা রাদ: ১১) গত শতাব্দীর মধ্যভাগে ইজরাইল যখন ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করল, তখন থেকেই সারা পৃথিবীর মুসলমানরা ওয়াজ-মাহফিল-ঈদগাহে নিয়মিত মোনাজাত করে আসছে যে, হে আল্লাহ! ইজরাইলকে তুমি ধ্বংস করে দাও। এসব দোয়া-মোনাজাত যে আল্লাহর দরবারে কবুল হয় নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যত মোনাজাত করেছি ইজরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটির আয়তন ততই বেড়েছে। উল্টো ফল হচ্ছে কারণ এসব প্রচেষ্টাহীন দো’য়া।
একইভাবে আমেরিকা যখন ইরাকে হামলা করল লাখ লাখ মানুষ সাদ্দামের বিজয়ের জন্য আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেছিল। এই দোয়া-মোনাজাতেও কাজ হয় নি। তারপর গত এক যুগের মধ্যে একে একে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে চোখের সামনে জ্বলতে দেখেছি আমরা। লাখ লাখ মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। মাইলের পর মাইল গ্রাম উজার করা হয়েছে। শহর-বন্দর ধ্বংস করে মরুর বালুর সাথে একাকার করে ফেলা হয়েছে। লাখ লাখ মুসলিম নারীর ইজ্জত হরণ করা হয়েছে। আমাদের হাজারো দোয়া-মুনাজাতেও এই নির্যাতন বন্ধ হয় নি। আমাদের কোনো বিক্ষোভ, কোনো প্রতিবাদ, কোনো ওজর-আপত্তি-আব্দার মানবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের কর্ণকোটরেও পৌঁছে নি। যখন দেখা গেল অবস্থা এই, আমাদের কোনো প্রতিবাদ, কোনো বিক্ষোভে কাজ হচ্ছে না, পৃথিবীতে মুসলিম নামক জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেললেও তাদের পক্ষে একটা ‘টু’ শব্দ করারও লোক নেই, তখন ‘মরতে যখন হচ্ছেই বীরের মত মরব’ এই চেতনা থেকে অনেক জায়গায় সশস্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা শুরু হলো। আরাকানেও কিন্তু তাই হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে কিছু বিদ্রোহী সংগঠন। তবে প্রচ- দমন-পীড়নের মুখে তাদেরকেও হার মানতে হয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। একই কথা প্রযোজ্য আফগান, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তানসহ সর্বত্র গড়ে ওঠা সশস্ত্র মুসলিম যোদ্ধাদের ক্ষেত্রে। নিঃসন্দেহে ওই পথ ভুল, ধ্বংসাত্মক ও আত্মঘাতী। কিছুদিন আগে আমাদের দেশের কিছু মুসলিম তরুণ জেহাদী জোশে ঢাকায় অন্তত বিশজন বিদেশিকে জবাই করে হত্যা করে। তাদের বক্তব্য অনেকটা এরকম যে, ‘‘সিরিয়া-ইরাকে পশ্চিমারা নিরীহ বেসামরিক মুসলমানদেরকে হত্যা করছে, আমরা তাদের বেসামরিক মানুষ হত্যা করে প্রতিশোধ নিলাম।’’ এই তরুণরা সহজ একটি সত্য অনুধাবন করতে পারল না যে, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ কখনও অন্যায় দিয়ে হয় না।’ ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম। মুসলমানরা ন্যায়বিচার দিবে তাদের পরম শত্রুকেও- এটাই ইসলামের আদর্শ। সে আদর্শ ত্যাগ করে কাপুরুষের মতো নিরীহ মানুষ খুন করতে থাকলে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বন্ধ তো হবেই না, বরং মুসলিমদের প্রতি অন্য ধর্মের মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি হবে এবং এ ধরনের ঘটনায় সা¤্রাজ্যবাদীরা নিরীহ মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করার আরও অজুহাত পেয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা শুরু করেছে তার সূত্রপাত কিন্তু একটি জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করেই। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে এ যাবৎকালে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বন্ধের জন্য কার্যকরী কোনো উপায় অবলম্বন করা যায় নি। আমাদের বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, লেখালেখি, প্রচারণা, লং মার্চ, দোয়া-মুনাজাত, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধ- কিছুতেই কিছু হয় নি। ভাগ্যাহত মুসলিমদের ভাগ্যাকাশে শনির মেঘ ক্রমশই ঘন হচ্ছে। তাহলে উপায়?
উপায় একটাই, আগে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের নিজেদের মধ্যে হাজারো বিভেদের দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ হবে না কেন? সে সুযোগ তো আমরাই দিয়ে রেখেছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমরা নিজেরাই শিয়া-সুন্নিসহ হাজারো ফেরকা-মাজহাবে বিভক্ত হয়ে নিজেদের হাতে নিজেদেরকে হত্যা করে আসছি। এক আল্লাহ, এক রসুলের অনুসারী হয়েও আমরা আজ ধর্মীয়ভাবে হাজারো ফেরকা-মাজহাবে, আধ্যাত্মিকভাবে বিভিন্ন তরিকায়, রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দল-উপদলে ও ভৌগোলিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কাঁঠালের আঠার মত লেগে আছি। শিয়া মরলে সুন্নি খুশি হয়, সুন্নি মরলে শিয়া খুশি হয়। সা¤্রাজ্যবাদীরা শিয়া রাষ্ট্র ধ্বংস করলে সুন্নিরা সহযোগিতা করে, সুন্নি রাষ্ট্র ধ্বংস করলে শিয়া রাষ্ট্র ইন্ধন যোগায়। এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আজ আমাদেরকে সামষ্টিকভাবে মৃত্যুখাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখন শিয়ারও যে পরিণতি, সুন্নিরও তাই। শিয়া মসজিদ যেমন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সুন্নিদের মসজিদও রক্ষা পাচ্ছে না। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কে সরকারি দলের, কে বিরোধী দলের, কে শিয়া কে সুন্নি, কে হানাফি কে শাফেয়ী, কে মাদ্রাসা শিক্ষিত কে সাধারণ মাধ্যমে শিক্ষিত তা আর কেউ শুনতে চায় না। তাদের সবার এখন এক পরিচয়- গৃহহারা, স্বজনহারা, হতভাগা উদ্বাস্তু। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে, মানবতার স্বার্থে, ধর্মের স্বার্থে দল-মত-ফেরকা-মাজহাব নির্বিশেষে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সারা পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি হেযবুত তওহীদের আহ্বান হচ্ছে, ‘‘বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ হোন। অনেক হয়েছে। আর বিভেদের চর্চা করবেন না।’ আমরা কোনো নির্দিষ্ট ফেরকা-মাজহাবে ঐক্যবদ্ধ হতে বলছি না, শিয়াকে সুন্নি হতে বলছি না বা সুন্নিকে শিয়া হতে বলছি না, আওয়ামী লীগকে বিএনপি হতে বলছি না বা বিএনপিকে আওয়ামী লীগ হতে বলছি না, আপনারা যার যার বিশ্বাস ও পছন্দ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের মতো থাকুন, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে এক আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হোন। আমাদেরকে শপথ নিতে হবে আমরা আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকব, একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করব না, ঐক্য নষ্ট হয় এমন কাজ করব না বা এমন কথা বলব না, অন্যায় যে করবে আমরা সবাই তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। কে অন্যায় করল তার চেহারা দেখব না, সে কোন্ ধর্মের কোন্ বর্ণের কোন্ দলের তা দেখব না। কেবল বৌদ্ধরা মুসলিমদের মারলে বিক্ষুব্ধ হব, কিন্তু মুসলিমরা হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দির ধ্বংস করলে চুপ করে থাকব- এটা হবে আরেক অন্যায়। বৌদ্ধরা করুক, হিন্দুরা করুক, মুসলমানরা করুক, আমরা থাকব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ১৬০ কোটি মুসলমান যদি যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তবে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের পূর্বে কোনো যালেম শক্তিকে একশ’বার ভাবতে হবে।