রিয়াদুল হাসান
পৃথিবীর মানুষ আজ বিক্ষুদ্ধ। বাইরে যত সফলতার অহংকার থাকুক মনের গভীরে মানুষ আজ দেউলিয়া, দিশাহারা। যে কোনো দিনের সংবাদপত্র খুলুন, দেখবেন পৃথিবীময় অশান্তি, ক্রোধ, রক্তারক্তি, অন্যায়, অবিচার আর হাহাকারের বর্ণনা। রাষ্ট্রগতভাবে যুদ্ধ, দলগতভাবে হানাহানি, ব্যক্তিগতভাবে সংঘাত আর রক্তারক্তির হৃদয়বিদারী বর্ণনা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে, বিশেষ করে যে সব দেশ পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতাকে গ্রহণ করেছে, সেগুলোতে প্রতি বছর খুন, জখম, ডাকাতি, ধর্ষণ, বোমাবাজি আর অপহরণের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। এমন কি বেগুনাহ, নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত এই মানুষরূপী শয়তানদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এক দিক দিয়ে মানুষ যেমন বিজ্ঞানের শিখরে উঠছে অন্য দিক দিয়ে ঠিক তেমনি ভাবে সে সব রকমের অন্যায়ের চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে। মানুষের আত্মা আজ ত্রাহী সুরে চিৎকার করছে কেন? কেন মানুষ তার জ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রগতিকে মনুষ্যত্বের উন্নতির পরিবর্তে তাকে অবনতির গভীর অতলে নিয়ে যাচ্ছে? শুধু বিংশ শতাব্দীতে সে যত মানুষের প্রাণ হত্যা করেছে, গত দশ শতাব্দীর সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহে তার ভগ্নাংশও করে নি। শুধু হত্যা নয়, অন্যায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে তার পূর্ব পুরুষদের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। আত্মার এই নিদারুণ পতনের সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রযুক্তির ধ্বংসকারী শক্তির যোগের পরিণতি চিন্তা করে মানুষ আজ শিউরে উঠছে। এই অবস্থা প্রমাণ করছে যে মানব জাতি আজ পর্যন্ত এমন একটা জীবনব্যবস্থা তার নিজের জন্য সৃষ্টি বা প্রণয়ন করতে পারে নি যেটা পালন করলে যান্ত্রিক উন্নতি সত্ত্বেও মানুষ এই পৃথিবীতে শান্তিতে বাস করতে পারে।
তাহলে উপায় কী? মানুষের ভবিষ্যৎ নিদারুণ পরিণতিকে এড়াবার পথ কী?
পথ আছে, উপায় আছে। কিন্তু সে পথ গ্রহণ করার সময় খুব বেশি নেই। যে পথে চললে, যে জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করলে মানুষ জাতি অপ্রতিরোধ্যভাবে তার আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাবে না, তার বুদ্ধি ও মনের, দেহের ও আত্মার এমন একটা সুষ্ঠু, ভারসাম্য মিশ্রণ দেবে যা তাকে দু’দিকেই উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবে; সেই পথ হলো আল্লাহর দেওয়া সত্যজীবনব্যবস্থা।
আল্লাহর রসুল বলেন, প্রত্যেক মানব শিশু জন্ম নেয় ফেতরাত অর্থাৎ প্রকৃতির উপর অতঃপর তার বাবা মা তাকে ইহুদি, খৃস্টান অথবা জরোথুস্ট্রিয়ান বানিয়ে ফেলে [আবু হোরায়রা রা. থেকে বোখারী]। একইভাবে কখনও কোনো মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে চোর, ডাকাত বা দুর্নীতিবাজ হয়ে জন্ম নেয় না, সমাজকাঠামোই তাদেরকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি করতে যান তাদের অনেকেই এই অভিপ্রায় নিয়ে যান না যে ইচ্ছা মতো ঘুষ খাবেন। যারা ব্যবসা করতে যান তারাও নিশ্চয়ই পণ্যে ভেজাল দেওয়ার নিয়তে ব্যবসা করতে যান না; কিন্তু এক সময় তাকে অসততার বাজারে টিকে থাকার জন্য সততা বিসর্জন দিতে হয়। রাজনীতিতে যারা যান তারাও হয়তো এই মানসিকতা নিয়ে যান না যে দুর্নীতি করবেন, সন্ত্রাসী লালন করবেন, জনগণের সম্পদ লুট করবেন, বিদেশে টাকা পাচার করবেন। তাহলে কেন মানুষগুলো অবধারিতভাবে সততা হারিয়ে দুর্নীতিবাজ, ওয়াদা খেলাফকারী হয়ে যায়, সন্ত্রাসী, মিথ্যাবাদী, মানুষের সম্পদ লুণ্ঠনকারী হয়ে যান? যে ছাত্ররা শিক্ষাগুরুর পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিত, শিক্ষককে দেবতুল্য জ্ঞান করত, সেই ছাত্ররাই এখন কেন শিক্ষককে মারধোর করে? যে ছাত্রদের শিক্ষা অর্জন করে মানবসেবার জন্য আত্মনিয়োগ করার কথা, সেই ছাত্ররা টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী, বোমাবাজি, ছাত্রাবাসের আধিপত্য নিয়ে পরস্পরকে খুন করে, রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসী হিসাবে ভাড়া খাটে। এই সব প্রশ্নের একটাই জবাব, প্রচলিত সিস্টেমই তাদেরকে এমন বানায়। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাদা মাটির ন্যায়। এই কাদামাটিকে যে ডাইসের মধ্যে ফেলা হবে, কাদা মাটি সেই ডাইসের রূপ বা আকৃতি ধারণ করবে। একইভাবে সমাজব্যবস্থাও এমন একটি সিস্টেম যা মানুষকে নিজস্ব কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলে। ধরুন, কোনো চালক যদি চেষ্টা করে একটা গাড়িকে সোজা চালাতে, কিন্তু রাস্তাটা যদি বাঁকা হয় তবে সে শত ইচ্ছা করেও সোজা চালাতে পারবে না। চালাতে গেলে সে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। একইভাবে যদি রাস্তা সোজা থাকে তাহলে সে চাইলেও আঁকা-বাঁকা হয়ে চলতে পারবে না, রাস্তাই তাকে সোজা চলতে বাধ্য করবে। সুতরাং ত্র“টিপূর্ণ সিস্টেমের মধ্যে বসবাস করে শত চাইলেও আপনি ভাল থাকতে পারবেন না। তাহলে এই অনিবার্য অধঃপতন থেকে বাঁচার উপায় কী?
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানবজাতি যেন সুখে, শান্তিতে থাকতে পারে, সমৃদ্ধশালী জীবন গড়তে পারে এজন্য যুগে যুগে স্রষ্টা প্রতিটি জনপদে পথ প্রদর্শক অর্থাৎ নবী এবং রসুলগণকে পাঠান। তাঁদের কাজই ছিল মানবজাতিকে একটি নিখুঁত সিস্টেমের সন্ধান দেওয়া। সেই সিস্টেম প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় অনাবিল সুখ, শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা। মানুষ যখন স্রষ্টার দেয়া সেই জীবনব্যবস্থাকে বিকৃত করে ফেলে তখন তারা পতিত হয় চরম অন্যায় অশান্তিতে। আল্লাহ আবার সেই জাতিকে অন্যায় অশান্তি থেকে মুক্তির জন্য সঠিক সিস্টেমসহ নবী রসুল প্রেরণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪০০ বছর আগে আরবের অন্ধকার যুগে আল্লাহ পাঠালেন মহাসত্যের আলোকবর্তিকা, বিশ্বজাহানের রহমত, খাতেমুন নাবীয়্যিন মোহাম্মদ (দ:) কে। তাঁর উপর দায়িত্ব সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন, দীনুল হক প্রতিষ্ঠা যার মাধ্যমে অন্যায়, অশান্তি, অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যাবে এবং মানুষ একটি সুখি সমৃদ্ধ প্রগতিশীল পৃথিবীতে বসবাস করতে পারবে। রসুলাল্লাহ, তাঁর আসহাবগণ এবং তাঁদের পরবর্তী মুমিনরা পার্থিব সবকিছু কোরবান করে কঠোর ও সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধ দুনিয়ায় স্রষ্টার দেয়া সেই নিখুঁত জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করলেন। ফলে মানুষের জীবন এবং সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হলো। একজন যুবতী সারা গায়ে অলঙ্কার পরে একা শত শত মাইল পথ ভ্রমণ করতে পারত, তার মনে কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হতো না। মানুষ রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না। আদালতগুলিতে মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসতো না, এমন কি বহুক্ষেত্রে অপরাধী নিজেই বিচারকের কাছে এসে অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি প্রার্থনা করত, উকিল বা সাক্ষী কিছুরই প্রয়োজন পড়তো না। অর্থনৈতিক মুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, দান অথবা যাকাতের টাকা গ্রহণ করার কেউ ছিল না। শাসক শাসনকার্যকে ইবাদত মনে করত, আর জনগণের সম্পদকে মনে করত পবিত্র আমানত। প্রতিটি মানুষ আল্লাহর দেয়া সিস্টেমে বাস করার ফলে সত্যবাদীতা, আমানতদারী, পরোপকার, মেহমানদারী, উদারতা, ত্যাগ, দানশীলতা, ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষাদানকে মনে করত ইবাদত, আর সমাজে শিক্ষকের সম্মান ছিল পিতার মতো। নারীরা পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার সাথে জাতীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে যে কোনো ভূমিকা রাখতে পারত। স্রষ্টার দেয়া সেই সিস্টেম সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব বিবাদ, মারামারি, কাটাকাটিতে নিমজ্জিত সমাজের মানুষগুলিকে সোনার মানুষে রূপান্তরিত করল। শুধু সমাজটিই সুন্দর হলো না, জাহেলি যুগে যারা নিজের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত তারা হয়ে গেল একেকজন সোনার মানুষ।
বর্তমানে বিরাজিত সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার থেকে যদি মুক্তি চাই তবে আবারও সেই হারিয়ে যাওয়া শান্তিময় সিস্টেমটি মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া বিকল্প পথ আছে কি?