হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

নামাজ কেন পড়ছেন?

মোহাম্মদ আসাদ আলী

পৃথিবীতে সর্বমোট কতটা মসজিদ আছে তার নির্ভুল হিসাব পাওয়া যায় না। এক হিসাবে পৃথিবীতে মোট মসজিদের সংখ্যা ৩৬ লাখ (ঞজঞ ডঙজখউ)। এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশে মসজিদ রয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ১২৫টি (ধর্ম-মন্ত্রণালয়)। প্রতিদিন কোটি কোটি মুসলমান এই মসজিদগুলোতে নামাজ আদায় করছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- তাদের অধিকাংশই জানেন না নামাজের উদ্দেশ্য কী?
প্রথমেই বলি নামাজীদেরকে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। মুসলিমদের মধ্যে দু’টো ভাগ আছে- কালচারাল মুসলিম ও প্র্যাকটিসিং মুসলিম। যারা ইসলামকে প্র্যাকটিস করেন না, বাপ-দাদা মুসলিম ছিলেন তাই নিজেকে মুসলিম পরিচয় দেন, তারা হলেন কালচারাল মুসলিম। আর যারা ইসলামের হুকুম আহকাম চর্চা করার চেষ্টা করেন তারা প্র্যাকটিসিং মুসলিম। তাদের সংখ্যা খুব যে বেশি তা নয়। বাংলাদেশে যত মুসলমান আছে, সবাই যদি প্র্যাকটিসিং মুসলমান হতেন, তাহলে প্রত্যেক ওয়াক্তে মসজিদে দাঁড়াবার জায়গা থাকত না। বাস্তবতা হলো অধিকাংশ মসজিদই নামাজের ওয়াক্তে খালি পড়ে থাকে। কারণ মানুষ এখন সর্বান্তকরণে টাকা, সম্পদ, ক্যারিয়ার, ক্ষমতা ইত্যাদির পেছনে ছুটছে। নামাজ পড়ার টাইম কই? যখন কবরে এক পা চলে যাবে, তখন আসবে নামাজের প্রশ্ন!
এই ভোগবাদী রঙিন দুনিয়ার প্রবল আকর্ষণ উপেক্ষা করে যারা আখেরাতের আশায় মসজিদমুখী থাকেন, ঝড়-তুফান মাথায় নিয়ে মসজিদে যান তবু এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেন না, তাদেরকে খাটো করার হিম্মত আমার নেই। কিন্তু আজকের লেখায় আমি কিছু বিষয়ের প্রতি সকলের, বিশেষ করে নামাজী ভাইবোনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য কেবল প্রয়োজনীয় নয়- অনিবার্য হয়ে গেছে।
নামাজের উদ্দেশ্য কী?
অনেকে হয়ত প্রশ্নটা শুনে একটু অবাকই হবেন। বলবেন, নামাজের আবার উদ্দেশ্য কী রে ভাই? আল্লাহ বলেছেন নামাজ পড়তে, নামাজ পড়া ফরজ, তাই নামাজ পড়তে হবে। কেউ হয়ত বলবেন, নামাজ পড়লে সওয়াব হয় তাই নামাজ পড়তে হবে। কিন্তু প্রশ্নটা ওখানেই- আল্লাহ কেনই বা নামাজ পড়তে বলেছেন, আর কেনই বা নামাজ পড়লে সওয়াব হবে? কোনো কারণ তো অবশ্যই থাকতে হবে, তাই নয় কি? আল্লাহ তো অকারণে কোনো কাজ করতে বলেন না। পবিত্র কোর’আনে তিনি বলেন- আমি আকাশ, পৃথিবী ও মধ্যবর্তী কোনোকিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি (সুরা সাদ: ২৭)। তার মানে নিশ্চয়ই নামাজেরও কোনো গভীর অর্থ আছে, উদ্দেশ্য আছে, কারণ আছে। যে নামাজের কথা তিনি পবিত্র কোর’আনে ৮০ বারের বেশি উল্লেখ করেছেন, তা অনর্থক হতেই পারে না। তাছাড়া উদ্দেশ্য না বুঝে কোনো কাজ করলে, আমল করলে তার কোনো পুরষ্কার আল্লাহ দিবেন না। ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন- আল্লাহর রসুল (দ.) বললেন- ‘কোন মানুষ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, ওমরা [ইবনে ওমর (রা.) উল্লেখ করছেন যে ঐগুলি তিনি একে একে এমন বলতে লাগলেন যে, মনে হলো কোনো আমলের কথাই তিনি বাদ রাখবেন না] ইত্যাদি সবই করল, কিন্তু কিয়ামতের দিন তার আকলের বেশি তাকে পুরস্কার দেয়া হবে না (আহমদ, মেশকাত)। রসুলাল্লাহ (দ.) শব্দ ব্যবহার করেছেন আকল, যে শব্দটাকে আমরা বাংলায় ব্যবহার করি ‘আক্কেল’ বোলে, অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধি, সাধারণজ্ঞান, যুক্তি ইত্যাদি। অর্থাৎ কোনো কাজের উদ্দেশ্য না বুঝে করলে সেটার কোনো প্রতিদান আল্লাহ দিবেন না। তাহলে মানুষকে বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণিরূপে সৃষ্টি করারই অর্থ থাকে না। প্রশ্ন হলো- তাহলে নামাজের উদ্দেশ্যটা কী?
জবাব পাওয়া যায় মহানবীর একটি হাদিসে। রসুল (সা.) একটি চমৎকার উপমা দিয়ে বলেন, “ইসলাম একটি ঘর, নামাজ তার খুঁটি, আর জিহাদ হলো ছাদ।” (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ) পাঠক খেয়াল করুন, রসুল (সা.) ইসলামের ঘরের খুঁটির সঙ্গে তুলনা করলেন নামাজকে, আর ছাদের সঙ্গে তুলনা করলেন জেহাদকে। একটি ঘরে খুঁটির কাজ কী ও ছাদের কাজ কী? ঘরের প্রধান যে উদ্দেশ্য রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া, সেটা সম্ভব হয় ছাদের কারণে। আর ছাদকে উপরে ধরে রাখার জন্য দরকার হয় খুঁটি। যদি কোনো ঘরে ছাদ না থাকে তাহলে খুঁটির কোনো দরকার নেই। আবার যদি খুঁটি না থাকে তাহলে ছাদ দেওয়া অসম্ভব। রসুল (সা.) জেহাদকে ছাদের সঙ্গে তুলনা করে বোঝালেন ইসলামের মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জেহাদ। আর খুঁটির সাথে নামাজের তুলনা করে বোঝালেন- নামাজের উদ্দেশ্য হলো জেহাদকে সমুন্নত রাখা।
নামাজের আলোচনায় জেহাদের কথা কেন?
পাঠক, ১৪০০ বছর আগে আরবে আল্লাহ শেষ নবীকে (সা.) পাঠালেন। আল্লাহ কোনো এলাকায় নবী পাঠালে মিশন নির্ধারণ করে দেন। রসুল (সাঃ) এর মিশন কী ছিল কোর’আনে বলা হয়েছে এভাবে- ‘আমি তাঁকে হেদায়াহ ও সত্যদীন দিয়ে এই জন্য প্রেরণ করেছি যাতে তিনি সেটাকে অন্য সমস্ত দীনের উপর জয়যুক্ত করতে পারেন (ফাতাহ ২৮, তওবা ৩৩, সফ ০৯)। এমন স্পষ্ট আয়াতের পর আর কথা থাকে না। মিশন একদম পরিষ্কার। যে দীন বা জীবনবিধান নিয়ে তাঁর আগমন হয়েছে, সেটাকে বসে বসে পাঠ করা হয়, তাফসীর করা হয়, মুখস্থ করা হয়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় কিন্তু আসল আমল হলো এই জীবনবিধানকে সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা, সেটা করা হয়না।
যখনই প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ আসলো, তখনই আসলো জেহাদের প্রসঙ্গও। কারণ জেহাদ ছাড়া কোনো আদর্শ সারাবিশ্বে প্রতিষ্ঠা করা অকল্পনীয়। যেহেতু জেহাদ ছাড়া সম্ভব নয়, কাজেই ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হিসেবে রাখা হলো জেহাদকে। সবচেয়ে বড় পুরস্কারও রাখা হলো তাদের জন্য যারা জেহাদে প্রাণ বিসর্জন দিবে, অর্থাৎ শহীদ হবে। কোর’আনে তওহীদের পরে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে তাহলো জেহাদ। এমনকি মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেই আল্লাহ জেহাদকে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন- “মো’মেন তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের (সা.) প্রতি ঈমান আনার পর আর সন্দেহ পোষণ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সংগ্রাম) করে, তারাই খাঁটি।” (হুজরাত: ১৫)
সমস্যা হলো, এতবড় মিশন বাস্তবায়ন কারো পক্ষে একজীবনে সম্ভব নয়। রসুল (সা.) তাই দু’টো কাজ করলেন। একদিকে নিজে ৭৮টা যুদ্ধ করলেন, আরেকদিকে একটা দুর্ধর্ষ সামরিক জাতি তৈরি করলেন; যাদেরকে আমরা এখন বলি সাহাবায়ে আজমাইন। সাহাবায়ে আজমাইনরা কিন্তু মুফতি মোহাদ্দিস মুফাসসির ছিলেন না। প্রত্যেকে ছিলেন একেকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, এমনকি তাদের নারী ও শিশুরাও ছিলেন দুঃসাহসী যোদ্ধা। তাদের সামনে তুলোর মতো উড়ে গিয়েছিল তৎকালীন বিশ্বের সুপার পাওয়ার খ্যাত রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য। প্রশ্ন হলো- কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিল? কোন প্রশিক্ষণ পেয়ে সাধারণ আরবরা, যারা কিছুদিন আগেও রোমান পারস্য বাহিনীকে ভয় পেত, অল্প কিছুদিনের ভেতরে বিশ্বের সেরা যোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল?
যাদের সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন- একটা সেনাবাহিনীতে সৈন্যদের প্রশিক্ষণের জন্য কত ধরনের আয়োজন ও ব্যবস্থা রাখতে হয়। সৈন্যদের শারীরিক সুস্থতা থেকে শুরু করে নৈতিকতা, আত্মপ্রত্যয়, সাহস, ক্ষিপ্রতা, একতা, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ইত্যাদি সব বিষয়ে ফিট রাখার জন্য নানাবিধ প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তাহলে সাহাবীদের জীবনে সেই প্রশিক্ষণ কোথায়?
পাঠক, সেই প্রশিক্ষণ হলো নামাজ। নামাজ হলো উম্মতে মোহাম্মদীর এমন এক প্রশিক্ষণ, যা মো’মেনদের শারীরিক, মানসিক, আত্মিক সকল দিক দিয়ে প্রস্তুত করে তুলত। যে মোজাহেদরা যত ভালোভাবে নামাজ আদায় করতেন, তার চরিত্রে জেহাদের গুণ তত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হত, তিনি জেহাদের ময়দানে তত বেশি ভূমিকা রাখতে পারতেন। আর সেজন্যই পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ ৮০ বারের বেশি নামাজের কথা বলেছেন। আর রসুল (সা.) বলেছেন, জেহাদ হলো ইসলাম নামক ঘরের ছাদ, নামাজ হলো খুঁটি।
নামাজ কীভাবে জেহাদের চরিত্র শিক্ষা দেয়?
পাঠক, নামাজ কীভাবে জেহাদের চরিত্র শিক্ষা দেয় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলে আলাদা বই হয়ে যাবে। এই প্রবন্ধে আমরা অতি সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় জানবো। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার মানুষগুলো যখন এক ছাদের নিচে, এক কাতারে, এক আল্লাহর সামনে হাজিরা দিতে দাঁড়াচ্ছেন, তখন তাদের মধ্যে একতার বোধ জাগ্রত হচ্ছে। সালাত যেহেতু একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয় তাই যত কাজই থাকুক, নির্দিষ্ট সময়ে তাদেরকে জামাতে এসে উপস্থিত হতে হয়। এটা তাদেরকে সময়ানুবর্তিতা শেখায়। যে কোনো দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর বদলে সমস্ত মো’মেনরা যখন একদিকে (কাবার দিকে) মুখ করে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন, তখন তাদের মধ্যে লক্ষ্যের ঐক্য ও উদ্দেশ্যের ঐক্য স্থাপিত হচ্ছে। কমান্ডার ছাড়া যেমন সৈন্য যুদ্ধ করতে পারে না, তেমনি ইমাম ছাড়া মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে পারে না। সালাতে একজন ইমামের কমান্ড মোতাবেক যখন সকল মুসল্লি রুকু-সেজদা, ওঠা-বসা করছেন, তখন ইমাম-আমির বা কমান্ডারের আদেশ মেনে চলার শিক্ষা তাদের চরিত্রে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। নামাজের ফরজ, সুন্নত ইত্যাদি যত নিয়ম-কানুন ও ডিসিপ্লিন আছে, যেমন এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো যাবে না, চোখ বন্ধ করা যাবে না, হাত-পা নড়াচড়া করা যাবে না, ইমামের তাকবীরের সঙ্গে সঙ্গে রুকু সেজদা করতে হবে, দেরি করা যাবে না আবার তাড়াহুড়াও করা যাবে না, এসব একত্রিত করলে প্রায় ১১৪ টি বেশি নিয়ম কানুন দাঁড়ায়। এতগুলো আহকাম-আরকান বা নিয়ম মেনে যখন মো’মেনরা সালাত আদায় করবে, তখন তাদের মধ্যে যেমন যে কোনো লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় একাগ্র চিত্ততা প্রতিষ্ঠিত হয় তোমনি তাদের চরিত্রে স্বভাবতই ডিসিপ্লিন মানার গুণগুলো প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে- যা একজন যোদ্ধার জন্য অতি প্রয়োজনীয়।
অথচ, পরিহাসের বিষয় হলো- নামাজ যে আমাদেরকে এতকিছু শেখায়, সেটা আমরা জানিও না, বুঝিও না। যেহেতু নামাজের উদ্দেশ্যই এখন নেই, তাই নামাজের চেহারাও বদলে গেছে। প্রচলিত আকিদায় নামাজকে মনে করা হয় অন্যান্য ধর্মের পূজা-প্রার্থনা-আরাধনা ইত্যাদির মতোই কিছু একটা। এক প্রকার ধ্যানের বিষয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ যদি ধ্যান করানোই উদ্দেশ্য হতো তাহলে নামাজের মধ্যে ১০০’র বেশি নিয়ম কানুন থাকত না। চোখ বন্ধ রেখে ধ্যান করা সহজ নাকি চোখ খোলা রেখে? অবশ্যই চোখ বন্ধ রেখে। কিন্তু নামাজের নিয়ম হলো- চোখ বন্ধ করা যাবে না। তাছাড়া ধ্যানের জন্য নির্জন স্থান উত্তম, কিন্তু নামাজের জন্য নির্দেশ হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জড়ো হয়ে নামাজ আদায় করা। এরপরও নামাজকে ধ্যান মনে করা কীভাবে সম্ভব?
নামাজের সঙ্গে কুচকাওয়াজের সাদৃশ্য
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ জেহাদকে ফরজ করে দিয়েছেন, সঙ্গে নামাজকেও ফরজ করে দিয়েছেন। কারণ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ছাড়া যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু এই জাতি যখন জেহাদ ছেড়ে দিল এবং নিজেদেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ আবিষ্কার করল, তখন আর জেহাদের প্রশিক্ষণেরও দরকার রইল না। অল্পকিছুদিনের ভেতরেই নামাজের চেহারা পাল্টে ধ্যানের মতো করে ফেলল। এরপরও দৃষ্টিবাণ মানুষ বুঝতে পারেন, যে কোনো মসজিদের নামাজের দৃশ্যের সঙ্গে পৃথিবীর আর একটিমাত্র দৃশ্যের মিল পাওয়া যায় তাহলো সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ। যেমন ডিগ্রী ইসলামিক স্টাডিজের (উবমৎবব ওংষধসরপ ঝঃঁফরবং) তৃতীয় পত্রের অনুশীলনের ৬ষ্ঠ প্রশ্নের ১৮ নং উত্তরে লেখা হচ্ছেÑ “মসজিদ নেতৃত্ব ও নেতার আনুগত্যের শিক্ষা দেয়; মসজিদ নেতৃত্ব ও আনুগত্যের এক অনুপম শিক্ষা কেন্দ্র। মসজিদে সব মুসল্লির একই এমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে উঠাবসার দৃশ্য দেখে মনে হয় তারা একজন সেনাপতির নির্দেশে কুচকাওয়াজে লিপ্ত। এখানেই নেতার প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ও নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের উত্তম সবক বিদ্যমান।”
নামাজের আত্মিক ভাগ
প্রশ্ন আসতে পারে নামাজ কি তাহলে শুধুই সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়? না, নামাজের আরেকটি ভাগ আছে তাহলো আত্মার ভাগ। ইসলামের শরিয়াহ মারেফতের ভারসাম্যের মতোই নামাজও বাহ্যিক ও আত্মিক দুই দিকের ভারসাম্যে পরিপূর্ণ। নামাজের আত্মিক ভাগ হলো যিকর (স্মরণ)। অর্থাৎ মো’মেন নামাজে দাঁড়ানোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর স্মরণে রত থাকবে। মো’মেন যখন নামাজে দাঁড়াবে তখন সে মনে করবে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েছে। সে আল্লাহর সৈনিক। তার মনোভাব হবে এমন- ‘হে আল্লাহ, তুমি তোমার নবীর মাধ্যমে আমাদেরকে যে মহান কাজের দায়িত্ব দিয়েছো, সেই দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে তোমার সামনে দাঁড়িয়েছি। তুমি দয়া করে আমাদেরকে সেই চরিত্র ও শক্তি দান করো যাতে আমরা তোমার রাস্তায় নিজেদের স্ত্রী-পুত্র পরিজন ও সহায়-সম্পদ উৎসর্গ করে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারি।’ সে যখন রুকুতে যাবে তখন সে মনে মনে আল্লাহর অসীম বিশালতার কথা চিন্তা করবে এবং সেই বিশালতার সামনে অকাতরে নিজেকে সমর্পিত করবে। যখন সেজদায় যাবে তখন সে আল্লাহর অসীম উচ্চতা ও নিজের ক্ষুদ্রতার কথা ভাববে এবং আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজের সত্ত্বাকে বিলীন করে দিবে। এভাবে নামাজের প্রতিটা রোকনে আল্লাহর সঙ্গে তার আত্মিক যোগাযোগ ঘটবে, যা তার ঈমানকে আরও শানিত করবে, তাদের রূহকে আল্লাহর সঙ্গে একাত্ম করবে।
জেহাদহীন নামাজ আল্লাহ কবুল করবেন?
ছাদবিহীন খুঁটির কোনো উপকারিতা বা উপযোগিতা আছে কি? নেই। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সমস্ত খুঁটির উদ্দেশ্য ছাদকে ধরে রাখা। তেমনি নামাজের উদ্দেশ্য জেহাদকে সমুন্নত রাখা, মো’মেনকে জেহাদের জন্য প্রয়োজনীয় চরিত্র দান করা। যার জেহাদ করার নিয়ত নাই, তার নামাজ ঐ ছাদবিহীন খুঁটির মত। কেউ যদি বলে আমি সামরিক বাহিনীতে ভর্তি হবো, দিনে পাঁচবার বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিব, শুধু তাই নয় বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রতিদিন বহুবার নিজ উদ্যোগে একাকী প্রশিক্ষণ নিব, নিয়মিত কুচকাওয়াজ করব, প্রশিক্ষণ-বিষয়ক যত বই-পুস্তক আছে তা নিয়ে রাতদিন গবেষণা করব, শুধু একটাই শর্ত- যুদ্ধ করব না, তাহলে তাকে কি সৈন্য হিসেবে গ্রহণ করা হবে? হবে না। তাকে ঘাড় ধরে ব্যারাক থেকে বের করে দেওয়া হবে। কিন্তু একই কাজ আমরা বর্তমানে করছি। আমরা দিনে পাঁচবার বড় বড় মসজিদে ফরজ নামাজ আদায় করছি, ফরজ নামাজ ছাড়াও সুন্নত, বেতের, নফল, তারাবিহ, তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছি, বাজার থেকে নামাজ শিক্ষার বই কিনে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করছি যাতে নামাজের কোনো নিয়ম কানুনে ভুল না হয়ে যায়, এমনকি হুজুরদের কাছে প্রশ্ন করছি হাতে নেলপলিশ থাকলে নামাজ হবে কিনা, অথচ যেই জেহাদের চরিত্র তৈরির জন্য আল্লাহ নামাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেই জেহাদ করি না। এমনকি আমাদের চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে জেহাদ করার কোনো রেকর্ড নাই। তাহলে আমাদের এই নামাজের কী মূল্য আছে আল্লাহর কাছে? তিনি কি আমাদের এই জেহাদবিহীন নামাজ কবুল করবেন? আলোচনা আর দীর্ঘ না করে এ পর্যন্ত আমরা যা জানলাম তার একটা সার-সংক্ষেপ দিয়ে ইতি টানছি। আশা করি পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হবে।

বিশ্বনবীর মিশন ছিল সারা বিশ্বে আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান প্রতিষ্ঠা করে শান্তি আনয়ন করা। এই বিশাল দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়া হিসেবে আল্লাহ নির্ধারণ করেন জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। জেহাদ করার জন্য প্রশিক্ষণ লাগে। আল্লাহ সোবাহান, তিনি জেহাদ করতে বলবেন কিন্তু জেহাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা দিবেন না তা হতে পারে না। প্রশিক্ষণ হিসেবে আল্লাহ দিলেন সালাত, সওম ইত্যাদি আমল। নামাজ সাহাবীদেরকে বিশ্বের সর্বশেষ্ঠ, অপরাজেয়, দুর্ধর্ষ যোদ্ধায় পরিণত করেছিল। সাহাবীরা অর্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ বড় জেহাদ এই মতবাদের জন্ম দিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাদ দেয়। কোনো বিষয় বা বস্তুর উদ্দেশ্য হারিয়ে গেলে সেটার আর কিছু থাকে না। জেহাদের জন্য নামাজ। যখন জেহাদই বন্ধ হয়ে গেল তখন নামাজ প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হলো। পরবর্তীতে নামাজ হয়ে গেল ধ্যান। বর্তমানে নামাজ পড়া হচ্ছে কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জানেন না নামাজের উদ্দেশ্য কী। তারা নামাজকে অন্যান্য ধর্মের পূজা-উপাসনা-প্রার্থনার মতোই কিছু একটা মনে করেন। যদিও নামাজের সঙ্গে ওসব ধ্যান বা প্রার্থনার কোনো মিল নেই। যেহেতু নামাজের উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়া হয়েছে, কাজেই বর্তমানের নামাজ আর খালিদ, দেরার, মুসান্নার (রা.) মতো বীর যোদ্ধা তৈরি করতে পারছে না। মুসলিম উম্মাহ সহজেই শত্রুর কাছে পরাজিত হচ্ছে, গোলামি করছে। এখন পুনরায় মুসলিম উম্মাহকে নামাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে হবে এবং নামাজের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে একজন ইমামের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ও সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
[লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]

 

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...