আতাহার হোসাইন:
বর্তমান পৃথিবীতে পশ্চিমা বিশ্বের সৃষ্ট বিদ্যমান বিভাজন নীতি, রাজনৈতিক দলাদলি, ভৌগোলিক স্বার্থচিন্তা বা জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় বিভেদ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে আজ আমরা যখন পৃথিবীকে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত করে অশান্তিতে ভরিয়ে তুলেছি, পরস্পর মারামারি করে দুর্বল হয়ে পড়েছি তখন আমাদের প্রায় সকলের মধ্যেই এই বিভাজন ভুলে একতাবদ্ধ হওয়ার চিন্তা জাগ্রত হচ্ছে। চিন্তাশীল ও সচেতন মানুষের কাছে বিষয়টি অপরিহার্যও হয়ে উঠেছে। কারণ, এভাবে চলা যায় না, এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। এই পরিস্থিতিকে কিছুতেই সভ্যতা বলা যায় না। এটা যান্ত্রিক প্রগতির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দানবীয় ব্যবস্থামাত্র। এই দানবীয় ব্যবস্থার কাছে কারোরই কোন মর্যাদা নেই, অধিকার নেই। এই সভ্যতা একটিমাত্র বোমা মেরে মুহূর্তের মধ্যে ২ লক্ষাধিক মানুষ খুন করতে পারে। তাতে সে একটুও অনুশোচনা করে না, একটুও দুঃখবোধ করে না। বরং নিজেদের শক্তিমত্তায় গর্ববোধ করে এবং কে কার চাইতে বেশি এই ধরনের বোমার মজুদ ঘটাতে পারে তার প্রতিযোগিতা করে। এরা এই ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র ও প্রযুক্তি দ্বারা শক্তি অর্জন করে মানুষকে আতঙ্কের মুখে রেখে আনুগত্য আদায় করে, নিজেদের প্রভুত্ব আদায় করে। অন্যদিকে কেউ যেন শক্তি অর্জন করে তার সমকক্ষ না হতে পারে সে জন্য বাকিদেরকে তারা নিরস্ত্র করার কথা বলে, কথা না শুনলে সব ধরনের অবরোধ আরোপ করে, অবরুদ্ধ করে। এমনকি কেউ শক্তি অর্জন করছে তা জানতে পারলে দূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে কিংবা অন্যের সার্বভৌমত্বের তোয়াক্কা না করে অনুপ্রবেশ করে সেই প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে। বিপরীত দিকে ঐ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলোও অযৌক্তিক ও অহেতুক কিছু বিষয় নিয়ে মতভেদ করে ঐক্যহীনতার স্বাভাবিক ফল হিসেবে দিন দিন দুর্বল থেকে আরো দুর্বল হচ্ছে। ইদানীং বিষয়টি উপলব্ধি করে এরা একে অপরকে ঐক্যের দিকে আহ্বান করছে। বিভাজন সৃষ্টির গোড়া রাজনৈতিক দলগুলো আহ্বান করছে তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে, ধর্মীয় দল ও ফেরকাগুলো আহ্বান করছে অন্য ফেরকা ও মাজহাবগুলোকে, আবার যারা ধর্মনিরপেক্ষ তারাও মতপার্থক্য বিসর্জন দিয়ে অন্যদেরকে মানবতার কল্যাণে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করছে। আপাতত বিষয়টি ইতিবাচক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি মরুভূমির বুকে মরিচিকার মতই ঠেকছে। কারণ, সবাই যে শর্তসাপেক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তারা অপরপক্ষকে ডাকছে তাতে কোনদিনই এই ডাক ফলপ্রসূ হবে। কারণ তারা প্রকৃত অর্থে তারা কেউই ঐক্যের দিকে ডাকছে না, ডাকছে নিজেদের দিকে। অর্থাৎ ‘আমাদের মতবাদ সঠিক, আমাদের মত মেনে নিয়ে আমাদের সাথে এক হও।’ উল্টোদিকে অপরপক্ষও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে তারাই সঠিক। সুতরাং অন্যদের উচিত তাদের সাথে এক হওয়া। নিজেদের বিশ্বাসে ও মতবাদে কোনরূপ ছাড় না দিয়ে অন্যদেরকে যদি তারা কেয়ামত পর্যন্ত ডেকেও যায় তবুও মানবজাতির মধ্যে কাক্সিক্ষত ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে না। মানবজাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদের প্রাচীর এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে, তারা একে অপরকে ঘৃণা, মারা-মারি, কাটা-কাটি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ-বিগ্রহ চালিয়েই যাবে।
তাই বলি, যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসব থেকে মুক্তি পেতে চাই, তবে আমাদেরকে এই প্রকারের শর্তযুক্ত ও হাস্যকর আহ্বান-পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে হবে। কিছু কিছু বিষয়ে নিজেদের মধ্যে ছাড় না দিলেও অন্যদের জন্য ছাড় দিতে হবে। এ জন্য প্রতিটি দলকেই একটি সাধারণ সুবিধাকে কেন্দ্র করে, নিজেদের মধ্যে বিরাজিত অমিলগুলোকে পেছনে ফেলে, মিলগুলোকে সামনে টেনে আনতে হবে। যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আমরা এগিয়ে যাব সেই বিষয়টিতে সবার স্বার্থ থাকতে হবে, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Common Interest. এ লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐক্য, সম্পর্ক নির্ধারণ ও আচরণ করবে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রেখে। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে চিন্তা-ধারায় নিজস্বতা থাকতে পারে, ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে, দেশের মানুষের কষ্ট হবে এমন কাজ কোন পক্ষই করবো না- এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এই কাজে আমরা একে অপরকে সহযোগিতা করব, কেউ ভুল করলে শুধরে দেব। প্রতিপক্ষ আমার ভুল ধরিয়ে দিলে সেটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবো-এমনটাই হতে হবে সবার মানসিকতা।
দুই: জনে জনে অনৈক্য ও মতভেদ, মতভিন্নতা বিদ্যমান ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই বেশি। যারা ধর্ম-কর্মে যত বেশি জড়িত তাদের মধ্যে তত বেশি পার্থক্য, ততবেশি দূরত্ব। এরা কখনো একমত হতে পারে না। প্রতিটি দলেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে মাসলা-মাসায়েলের স্তুপ বিদ্যমান। কথায় আছে, ‘দুইজন আলেম এক খাটে ঘুমাতে পারে না।’ এই অবস্থাটা প্রত্যেক ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ‘সেরাতাল মোস্তাকিম’ খ্যাত ইসলামে সবচেয়ে বেশি।
কিন্তু এদের এই ধরনের অপকর্মের স্বাভাবিক ফল হিসেবে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে হতে এবং সারা পৃথিবী জুড়ে মার খেতে খেতে তারাও এখন নিজেদের মধ্যে ঐক্য কামনা করছেন। কিন্তু তাদের মধ্যেও বাঁধা সেই বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল ও ফতোয়ার পাহাড় এবং ‘নিজেরা সঠিক’ এই ধারণা। স্বাভাবিকভাবেই ছাগ-খুঁটি ছেড়ে এরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। এই শ্রেণিটিও যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্য চায় তাহলে একটি Common Interest এ উপনীত হতে হবে। কে কোন মতবাদ, কোন ফেরকায় বিশ্বাসী, কার এবাদত পদ্ধতি কেমন এইগুলোকে সামনে না এনে শুধুমাত্র যারা নিজেদেরকে আল্লাহ রসুলে বিশ্বাসী ও নিজেদেরকে মুসলিম বলে মানে তাদের সাথেই ঐক্য গড়তে হবে।
রসুলাল্লাহ নিজেই বলেছেন, যে লা ইলাহ ইল্লাহর স্বীকৃতি দেয় সে ব্যক্তি জান্নাতি। এই প্রসঙ্গে বহু হাদীসের উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। কিন্তু এটা এতটাই প্রচলিত যে সবগুলো তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। তাহলে প্রশ্ন হলো, কেউ লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’তে বিশ্বাসী বা স্বীকৃতি দানের পর আমরা কেন খুঁজি সে শিয়া না সুন্নি? কেউ যদি মনে করে সে সঠিক তবে আমি তার বিশ্বাসে বাধ সাধব কেন? কারো বিশ্বাস ও কারো আমলের যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব বা অধিকার কোনটাই আল্লাহ আমাকে দেন নি। তাছাড়া দীনের ব্যাপারে, বিশ্বাসের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি করতে স্বয়ং আল্লাহই নিষেধ করে দিয়েছেন (সুরা বাকারা-২৫৬ )। সেটা সম্ভবও নয়। কেউ যদি কোন আমল করে জান্নাতে চলে যেতে পারবে বলে একান্তই বিশ্বাস করে, তবে সেই তাই করুক। তাতে আমারতো কোন ক্ষতি নেই। তার কল্লা কাটতে যাওয়ার আমার কি দরকার? আর আল্লাহর জান্নাতের আয়োতন এমন সীমিত নয় যে, কিছু বেশি লোক ঢুকে গেলে আমার স্থান সংকুলান হবে না।
আমি যা বিশ্বাস করি, যাকে শ্রদ্ধা করি তাতে আপনি আঘাত করবেন না, আর আপনি যা বিশ্বাস করেন বা শ্রদ্ধা করে তাতে আমি কখনো আঘাত করবো না- কিন্তু উভয়েই আমাদের Common Interest এর ব্যাপারে অটল থাকব। এরপর যদি আমরা সঙ্কট মোকাবেলা করে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারি এবং শান্তিময় পৃথিবী গড়তে পারি তখন নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোর মীমাংসা করে নেওয়া যাবে।
ভালো করে খেয়াল করে দেখুনতো, আল্লাহ যুদ্ধে লিপ্ত মো’মেনদেরকে আদেশ করছেন ধর্মের নামে যারা রাহেব হয়েছে, সংসার ত্যাগ করেছে তাদেরকে সুযোগ পেলেও হত্যা না করতে। কারণ তাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে, তাদের আমলের ব্যাপারে আল্লাহ নিজেই হিসাব নেবেন। একজনের বিশ্বাস ও আমলের হিসাব অন্য জনে দেবে না। এমনকি এই ভার স্বয়ং নবী-রসুলদের উপরেও ছিল না। আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমি আপনাকে দুনিয়াতে দারোগা পুলিশ হিসেবে পাঠাই নি, আপনার কাজ শুধু সুস্পষ্টভাবে সত্য পৌঁছে দেওয়া (সুরা গাশিয়াহ-২১, ২২)। কিন্তু আমরা আজ দীনের ব্যাপারে পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে চাই। কেন এই পথভ্রষ্টতা? কেন আমরা বিচারকের স্থান দখল করতে যাই, যে স্থান আল্লাহর জন্য নির্ধারিত? এই দারোগাগিরি করতে যাওয়াটাই বাড়া-বাড়ি, এটাই সীমালংঘন, আর সীমালংঘনকারীদের স্থান জাহান্নাম (সুরা আন নাবা- ২১-২২)। তাছাড়া অপরের বিশ্বাস ও আমল নিয়ে আমরা এত যে চিন্তিত- আমরা কি নিজেদের পার পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি? আমাদের পার পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় অবলম্বন হচ্ছে আল্লাহর ক্ষমা। আর আল্লাহ যদি অন্যদেরকেও ক্ষমা করে তাঁর জান্নাত দিয়ে দেন তাতে আমার তো আপত্তি থাকার কথা নয়।
স্রষ্টা মানুষের এবাদত-বন্দেগী, পূজা-অর্চনা ইত্যাদির মুখাপেক্ষী নন। তিনি নিজগুণেই মহীয়ান ও গরীয়ান। তবে তিনি বেশি খুশি হন যদি কেউ তাঁর নির্যাতিত, পীড়িত বান্দাকে খুশি করে। এই দিক দিয়ে বিচার করলে তাহাজ্জুদ না পড়ে পীড়িতের সেবা করাতেই লাভ বেশি। কারণ, স্রষ্টা মানুষের কাছে এটাই চান।
ধরুন, আপনি খুব এবাদত-বন্দেগী, উপাসনা করলেন। অন্যদিকে কেউ পীড়িতের সেবা করেই কিন্তু পার পেয়ে যাওয়ার বেশি হকদার। আপনি সেটাই করলেন যা স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। আর অন্যজন তাই করল যা আল্লাহ তাঁর বান্দার কাছে প্রত্যাশা করেন, যা তাঁর দরকার। আল্লাহ এটাও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁকেই ভালোবেসে আতœীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই মুত্তাকী। [সুরা বাকারা: ১৭৭]।
তাছাড়া আপনি সারা জীবন খুব এবাদত বন্দেগী করলে তাতে কিন্তু আপনার অহংকার জাগ্রত হতে পারে যে- আমি তো যথেষ্ট আমল করেছি (ইবলিসের মত)! এতে আপনার মধ্যে আল্লাহর করুণা ও কৃপার আশা কমে যেতে পারে। অপরদিকে যে আমল কম করেছে সে নিজেকে সর্বদাই অপরাধী মনে করবে এবং ভাববে আমিতো ছাড়া পাবো না। এ জন্য তার হৃদয়টাই আপনার হৃদয় থেকে বেশি কোমল থাকার সম্ভাবনা বেশি এবং ঐ ব্যক্তিই আল্লার করুণা বেশি পাওয়া হকদার হয়ে যাবেন। বাস্তব ক্ষেত্রেও এমনটাই দেখা যায়। দেখা যায় আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনকারীরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত মনে করায় দান-খয়রাতের ব্যাপারে তারা সাংঘাতিকভাবে কৃপণ। কিন্তু ঠিকই দান-খয়রাতের ব্যাপারে অন্যকে উৎসাহ প্রদান করে থাকেন। নিজেরা দানতো করেই না, বরং ক্ষেত্র বিশেষে নিজেদেরকেই দান-খয়রাত প্রাপ্তির যৌক্তিক দাবিদার মনে করে থাকেন।
তাই বলি, মূলে যেহেতু আমরা এক-সুতরাং এবাদত পদ্ধতিতে একটু আধটু, তাও ফরদের ব্যাপারে নয়, নফল-সুন্নাহর ভিন্নতার দোহাই দিয়ে যদি আমরা অন্যদেরকে দূরে সরিয়ে রাখি তবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আমরা ক্রমশ লাঞ্ছিত হতেই থাকবো, দুর্বল হতেই থাকব। অপরদিকে ঐক্যবদ্ধ খারাপ প্রকৃতির মানুষগুলোর হাতেও আমরা মার খেতে থাকব। আবার সুযোগ পেলে নিজেরাও অন্যদেরকে মারব। সুতরাং এইভাবে ঐক্য সম্ভব নয়।
তিন: আন্তঃধর্মীয় ঐক্য প্রসঙ্গ:
ধর্ম মানেই স্রষ্টার বিধান। স্বাভাবিকভাবেই সকল ধর্মাবলম্বীরাই স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয়ে থাকেন। যে কোন ধর্মের অনুসারীরাই নিজ নিজ ধর্মের আদেশ ও নিষেধের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল। সুতরাং আপনি ধর্মের অনুসারী হয়ে অন্য কোন ধর্মকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করতে পারেন না, যদি তা আপনার বিশ্বাসের দিক থেকে অযৌক্তিকও হয়। আপনি যদি অন্য ধর্মকে হেয় জ্ঞান করতে পারেন তবে অন্যরাও আপনার ধর্মকে হেয় জ্ঞান করবে। এতে করে কখনো মানবজাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে না।
এখানে সবার ঐক্যসূত্র বা Common Interest এর স্থানটি হচ্ছে সব ধর্মের মানুষই স্রষ্টায় বিশ্বাসী এবং বিশ্বাস করে যে তাদের কাছে আসা শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থের হুকুম পালন করলেই মানুষ শান্তি লাভ করবে। সুতরাং তাকে সেটাই পালন করতে দিন না! তা না হলে এখনকার মতই শত্র“তা বজায় থাকবে। কেউই কারো ধর্ম ভালোভাবে পালন করতে পারবে না। দ্বন্দ্ব-সংঘাত বজায় থাকবে। প্রধান প্রধান সবগুলি ধর্মই বিশ্বাস করে যে, মানবজাতি একই দম্পতি থেকে উদ্ভূত। সুতরাং সকল মানুষই সকলের ভাই-বোন। তাহলে আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে কেন ঝগড়া করব? তাছাড়া আমরাতো সকলেই জানি, নিজেদের মধ্যে মারা-মারি, ঝগড়া-বিবাদ করলে তা মহান আল্লাহর সেই অভিপ্রায়- ‘সমস্ত মানবজাতিকে এক জাতিতে পরিণত করা’ বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। ধর্মের নামে এসব করে আমরা স্রষ্টারই অভিপ্রায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছি। যদি তাই হয় তবে আমাদের এবাদত উপাসনা, পূজা-অর্চনা দিয়ে কি হবে? তিনি কি এসবের মুখাপেক্ষী? না, ওসবের কিছুই কিন্তু তাঁর দরকার নেই। তিনি চান মানবজাতির মধ্যে ঐক্য ও শান্তি। তাঁর এ চাওয়ার কারণ আছে। কারণটা হলো, সৃষ্টির শুরু থেকেই মানবজাতির শান্তি অশান্তির প্রশ্নে স্রষ্টা ও ইবলিসের মধ্যে চ্যালেঞ্জ চলছে। এসব বুঝেও যারা নিজেদেরকে ধার্মিক ও শ্রেষ্ঠ দাবি করে, ধর্মের ভেদ টেনে অনৈক্য ও মারামারি বজায় রাখবেন তারা পৃথিবীতে যেমন শান্তিতে থাকতে পারবেন না, তেমনি পরকালেও জান্নাতের ঘ্রাণও পাবেন না।
চার: ধর্মহীন ও নাস্তিক প্রসঙ্গ:
আগেই বলেছি, আল্লাহ দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করছেন। তিনি কাউকে দুনিয়াতে পুলিশ করেও পাঠান নি। সুতরাং কেউ যদি স্রষ্টার অস্তিত্বের জন্য তাঁর দেওয়া বিভিন্ন লক্ষণ, আলামত দেখেও সন্দিহান থাকে তাহলে তার ব্যাপারে ফয়সালা স্রষ্টার কাছেই। তথাপি আস্তিক এবং নাস্তিকের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অপরকে নি®প্রয়োজনে পীড়ন করতে ভালবাসে। এই ধরনের মানুষগুলো চারিত্রিকভাবেই অপরাধী। অধিকাংশ লোক ঐক্যের পক্ষে থাকলে এরা হালে পানি পাবে না। পাশাপাশি নাস্তিক বা সন্দেহবাদীরাও মানবজাতির মধ্যে অনৈক্য চান এটা কেউ হলফ করে বলতে পারেন না। তারাও নিশ্চয়ই মানুষের মঙ্গলের পক্ষে, কল্যাণের পক্ষে মত দিবেন। সুতরাং মানুষের হিতার্থে তারাও আস্তিকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। মানুষের কল্যাণ, নিজের কল্যাণই আমাদের কমন ইন্টারেস্ট হওয়া উচিৎ।
সুতরাং আমরা দেখিয়ে দিলাম যে, নাস্তিকদের সাথে আস্তিকদের, রাজনৈতিকভাবে দলাদলিতে লিপ্ত দলগুলোর, ধর্মে বিদ্যমান বিভিন্ন মাজহাব ও ফেরকার এবং আন্তঃধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হতে কোন বাধা নেই, যদি সবাই মানুষের কল্যাণকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু এর পরেও যারা ঐক্যের এই ডাক এলে নানা মতপার্থক্যের দোহাই দিয়ে সাড়া না দেবে তারা আসলে শান্তি চান না। তারা ভণ্ড, প্রতারক। তারা ভুয়া মানবতাবাদী, ভুয়া দেশপ্রেমিক, ভুয়া ধার্মিক।
যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী প্রতিষ্ঠিত হেযবুত তওহীদ মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এইভাবেই আহ্বান করে যাচ্ছে। হেযবুত তওহীদ বলছে আপনি যে ফেরকায় আছেন তাতেই থাকুন, যে মতবাদে বিশ্বাস করেন, সেটাই করুন। কিন্তু মুসলিম হিসাবে এক আল্লাহ, এক কোর’আন ও শেষ রসুলের প্রশ্নে সবাই এক হোন। আর অন্য ধর্মাবলম্বীরা যে ধর্মে আছেন সেখানেই থাকুন। আপনাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে না। কিন্তু আমরা যেহেতু একই স্রষ্টার সৃষ্টি এবং একই দম্পত্তি আদম হাওয়ার সন্তান, সুতরাং আসুন আমরা ভাই-ভাই হয়ে সকলে মিলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করি। যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না তাদের ব্যাপারে আমাদের কথা হলো আমাদের মত আপনিও চান মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক, মানুষ শান্তিতে থাকুক। সুতরাং আপনাকে স্রষ্টায় বিশ্বাসী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই, কেবল এ বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে ঝগড়া করবেন না। মানবতার কল্যাণ যদি আপনি চান, সমাজে শান্তি যদি আপনি চান তবে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করি। স্রষ্টা আছেন কি নেই সেটা সময় আসলে অবশ্যই ফায়সালা হবে। আপাতত আসুন আমরা সমগ্র মানবজাতি হেযবুত তওহীদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানবজাতির ঈড়সসড়হ Common Interest শান্তি প্রতিষ্ঠা করি।