হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

“মাথাব্যথা? নো টেনশান। মাথাটা কেটে ফেলুন”

রিয়াদুল হাসান

আমরা সবাই জানি রসুলাল্লাহ নারীদেরকে সমাজের সকল কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। তিনি নারীদেরকে নিয়ে যুদ্ধে গেছেন, মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজে পুরুষদের সঙ্গে নারীদের অংশগ্রহণকেও নিশ্চিত করেছেন। মদিনায় যুদ্ধাহত সাহবিদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যে হাসপাতালের প্রধান ছিলেন একজন নারী যার নাম রুফায়দাহ (রা.)। উম্মে শেফা (রা.) ছিলেন মদিনার বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। জাহেলিয়াতের যুগে মোশরেকরা কাবায় হজ্ব করার সময় নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে ক্বাবা তাওয়াফ করত। কিন্তু রসুলাল্লাহ যে হজ্বের নিয়ম প্রবর্তন করলেন সেখানে নারী-পুরুষ একত্রেই হজ্বের সকল আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করে। ঈদ, জুমা, হজ্ব এগুলো হলো মুসলিম জাতির সামষ্টিক কর্মকা- যেখানে খলিফার পক্ষ থেকে জাতির উদ্দেশে দিক নির্দেশনা প্রদান করা হতো। এগুলো হলো রাষ্ট্রীয় এবাদত, যেখানে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত আছে কেবল সেখানেই ঈদ, জুমা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি পালন করার নির্দেশ। যেখানে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই সেখানে এগুলো পালন করার অর্থ ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়তে চাওয়া। আজ সারা বিশ্বে মুসলিম জনগোষ্ঠী সেটাই করছে। আল্লাহ ঋতুবতী নারীদেরকে সালাহ কায়েম করা থেকে ছাড় দিয়েছেন, কিন্তু জুমা বা ঈদের জামাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেননি। রসুল বলেছেন, “ঋতুকালীন অবস্থাতেও মেয়েরা নামাজের স্থানে যাবে। তারা সালাহ কায়েম করবে না কিন্তু বক্তব্য শুনবে। সালাহ শেষে মোনাজাতেও অংশ নেবে”। অর্থাৎ তিনি জাতির এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে কোনো অবস্থাতেই, কোনো অজুহাতেই সামষ্টিক সামাজিক কর্মকা- থেকে পশ্চাৎপদ হতে দেননি। যুদ্ধের মতো সংকটময় ঘটনাবলিতেও তিনি নারীদেরকে কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরি। মেয়েরা কেবল যে রসদ সরবরাহ করেছে তা-ই নয়, তারা ঢাল-তলোয়ার, বর্শা হাতে লড়াই পর্যন্ত করেছেন, বিরুদ্ধপক্ষের সৈন্যদের কুপোকাত করেছেন।
নারীরা জ্ঞানচর্চাতেও পিছিয়ে ছিলেন না। আম্মা আয়েশা (রা.) তাঁর অধিকাংশ সময় কোর’আন অধ্যয়নে ব্যয় করতেন। তিনি ছিলেন রসুলাল্লাহর তিনজন কোর’আন মুখস্থকারী স্ত্রীদের একজন। সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের তালিকা তাঁর অবস্থান দ্বিতীয়। তিনি মোট ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেন। হাফসা বিনতে ওমর ও উম্মে সালামাও (রা.) ছিলেন বিপুল জ্ঞানের অধিকারী যাদের কাছ থেকে পরবর্তী প্রজন্ম ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও জ্ঞানী নারী হচ্ছেন উম্মে দারদা আল সুগরাহ। তিনি ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রসুলাল্লাহর বাণীসমূহ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং সে সময়ের অনেক প্রসিদ্ধ জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। এদেরই একজন হলেন হাসান বসরি যিনি ছিলেন একজন বিচারক। প্রথিতযশা ফকিহ মোহাম্মদ ইবনে শিরিন ও মদিনার বিচারক আবু বকর ইবনে হাজামও ছিলেন উম্মে দারদার ছাত্র। তিনি দামেস্কের মসজিদে নিজ ছাত্রদেরকে ইসলামের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান দান করতেন। এমনকি উমায়াই খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানও তাঁর কাছে শরিয়তের বিধি-বিধান শিক্ষা করতে যেতেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরেক বিদুষী নারী ছিলেন নাফিসা বিনতে আল হাসান (৭৬২-৮২৪)। তিনি রসুলাল্লাহর দৌহিত্র হাসানের (রা.) কন্যা ছিলেন। তিনি মদিনায় ইমাম মালিক ইবনে আনাসের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে যখন মুসলিম বিশ্বে তাঁর প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ল তখন ইসলামের দুই প্রধানতম ফকিহ ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইদ্রিস আল শাফী এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল উভয়ই তাঁর কাছে আসেন এবং ফেকাহসংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করেন। তাঁদের লেখা ফেকাহশাস্ত্রের অনুসারীরাই বর্তমানে যথাক্রমে শাফেয়ী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী।
এ হচ্ছে ইসলামিক রাষ্ট্র পরিচালনার জ্ঞান। বিচারক, খলিফা, আইনবিশারদগণ শিক্ষাগ্রহণ করছেন নারীদের কাছ থেকে এমন দৃষ্টান্ত প্রকৃত ইসলামের যামানায় থাকলেও আজ সেটা হওয়ার কোনো উপায় নেই। উপায় রাখেননি পরবর্তী যুগের আলেম সাহেবরা। নারীরা যে কেবল দীনের জ্ঞানই লাভ করেছিল তা কিন্তু নয়। সকল বিষয়ে তারা নিজেদের প্রতিভা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। স্পেন অঞ্চলে যখন ইসলাম পৌঁছাল তখন পুুুুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও সর্ববিষয়ক জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে এসেছিলেন। যেমন লাবানা অব কর্ডোবা, ফাতিমা আল ফিহরি, সুলতানা রাজিয়া, যয়নাব বিনতে ওমর আল কিন্দি, আয়েশা বিনতে তালহা প্রভৃতি। এঁদের প্রত্যেকের কীর্তিকে আলাদা করে তুলে ধরতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। তথাপি ফাতিমা আল ফিহরি সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। পৃথিবীর সর্বপ্রথম সনদ বিতরণকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ফাতিমা আল-ফিহরির নামটি ইতিহাসের পাতায় অবস্থান করছে। গিনেজ বুকের রেকর্ড অনুসারে মরক্কোর ফেজ নগরীর কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়ই (৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দ) হচ্ছে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
এমনিভাবে ‘রাদিয়া’ নামে এক সুপ-িত মহিলা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। যেহেতু তখন বই ছাপার প্রেস ছিল না তাই কোনো বইয়ের দ্বিতীয় কপি প্রয়োজন পড়লে সেটা হাতে লিখে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এই কাজটি করার ক্ষেত্রে জ্ঞানী পুরুষদের বাড়ির মেয়েরা স্ত্রী-কন্যা বোনেরা সহযোগিতা করতেন।
কিন্তু সেই মুসলিম জাতির আলেমসমাজ আজ থেকে কয়েকশ বছর আগেই নারীর এই অগ্রযাত্রায় বাধ সেধেছেন ফতোয়া আর মাসলার দোহাই দিয়ে। তাদের দাবি হচ্ছে এখন ফেতনার যুগ। এই ফেতনার যুগে নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিরাপদ নয়, মসজিদে তাই আর তাদের না গেলেও চলবে। বহু মসজিদে তারা এমন সাইনবোর্ড পর্যন্ত টাঙিয়ে দিয়েছেন যে মসজিদে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এমনকি মসজিদ সংলগ্ন পথ দিয়েও তাদের চলাচল নিষিদ্ধ। তাতে মসজিদের পবিত্রতা নাকি নষ্ট হয়ে যাবে, পুরুষদের ধ্যানমগ্নতায় বিঘœ হবে, তাদের ওজুও ভেঙে যেতে পারে সুন্দরী নারীরা মসজিদে নামাজ পড়তে আসলে ইত্যাদি।
এই ফেতনার যুগের অজুহাতে তারা শত শত বছর ধরে নারীদেরকে পিছিয়ে রাখতে রাখতে এখন তাদেরকে একেবারেই অক্ষম ও পরনির্ভরশীল জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছেন। যারা তাদের এই ফতোয়ার চোখ রাঙানিকে ভয় না করে শিক্ষিত হয়েছে তারা সেই ধর্মব্যবসায়ী প্রাচীনত্বের পূজারীদের চক্ষুশূল হয়েছেন। তারা সমাজ পরিবর্তনের কোনো চিন্তা না করে নারীদেরকে অবদমিত করে বোরকাবন্দী করার সরল পন্থাটি বেছে নিয়েছেন। ধর্মবিশ্বাসী নারীরা সেই ব্যবস্থাকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জাহান্নামের আগুনের ভয়ে মেনে নিয়েছে। ঠিক একইভাবে আলেম ওলামা শ্রেণি পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার বিধিবিধানকে মেনে নিয়ে সকল অন্যায়ের সামনে মাথা নত করে দিয়েছেন। তারা এই ফেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করা দূরে থাক, একটা শব্দও উচ্চারণ করতে ভীত। তারা দুনিয়াপূজারী, ভোগী। তাদেরকে দুর্নীতিবাজ প্রতারক ধর্মহীন শাসকগোষ্ঠী সামান্য মূল্যের বিনিময়ে কিনে নিয়ে নিজেদের পোষাপ্রাণীতে পরিণত করেন। তারাও স্বার্থ নিয়ে এক ধর্মীয় গোষ্ঠী আরেক ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গলা ফাটান। তারা ভুলে গেছেন যে, তাদের দায়িত্ব ছিল এই ফেতনাকে নির্মূল না করা পর্যন্ত লড়াই করা। সে দায়িত্ব আল্লাহ কর্তৃক মো’মেনদের উপর অর্পিত। আল্লাহ বলেছেন, “হে মোমেনগণ! তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না সকল ফেতনার অবসান হয় এবং জীবনব্যবস্থা (দীন) কেবল আল্লাহরই হয়। (সুরা আনফাল ৩৯)।”
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের আমির মওলানা শাহ আহমদ শফি একটি ওয়াজ মাহফিলে নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, “আপনাদের মেয়েদেরকে স্কুলে দিবেন না। খুব বেশি হলে ফোর ফাইভ পর্যন্ত পড়াবেন। যেন সে তার স্বামীর টাকা পয়সার হিসাব রাখতে পারে, স্বামীর কাছে চিঠি লিখতে পারে। যদি এর বেশি পড়ান তাহলে আপনার মেয়ে আপনার থাকবে না, অন্য পুরুষ মানুষ নিয়ে যাবে। আপনারা ওয়াদা করেন মেয়েদের ফোর ফাইভের বেশি পড়াবেন না।”
আল্লামা শফির এই মত কিন্তু তার একার মত নয়। আমাদের দেশে কোটি কোটি মাদ্রাসাশিক্ষিত মানুষের অধিকাংশই এই মতের পক্ষে রায় দেবেন। আমাদের সমাজে নারীরা আসলেই নিরাপদ নয়, তাদের সুশিক্ষা ও সম্মানের জন্য উপযোগী শিক্ষা-পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি আমাদের সমাজ। বস্তুত পশ্চিমা সভ্যতা নারী ও পুরুষ সকলকেই ধর্মের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে সর্বব্যাপী উদ্যোগ নিয়েছে। যার পরিণামে সমাজে ইভটিজিং থেকে শুরু করে ধর্ষণসহ সর্বপ্রকার নারী নিগ্রহ। নারী আজ পণ্যে রূপায়িত। তাই কট্টপন্থী আর রক্ষণশীল মহল মেয়েদেরকে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংশ্রব থেকে দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অশিক্ষিত করে রাখাটাও তো কোনো কাজের কথা নয়। এটা হবে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো সমাধান, তাদের মাথাব্যথা যাবে বটে কিন্তু জীবনও থাকবে না। তাহলে যেটা করা দরকার সেটা হলো, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন, সমাজের পরিবর্তন। আল্লামা শফিদের নারীদের পথরোধ না করে উচিত হবে এমন একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে তারা স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চা করতে পারবে। তাদের মেধার বিকাশ ঘটিয়ে সভ্যতার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে, যেমনটা রেখেছিল সোনালি যুগের মুসলিম নারীরা। রসুল এমন একটি নিরাপদ সমাজ কায়েম করেছিলেন যেখানে একজন নারী একাকী সারা গায়ে স্বর্ণালঙ্কার পরিহিত অবস্থায় দিনের পর দিন পথ চলতে পারত। নির্ভয়ে। আল্লামা শফিরা সে সমাজ কায়েম করতে পারবেন না, এটা তারা জানেন। ওপথ সংগ্রামের পথ, ত্যাগের পথ। তারা তো ভোগের পথে হাঁটতে অভ্যস্ত। তাই তারা সমাজ পরিবর্তনের আশাও করেন না, করেন মনগড়া ফতোয়াবাজি আর সেটা চালিয়ে দেন ইসলামের নামে। কিন্তু এমন অবস্থা তো চিরটাকাল চলতে পারে না। জনগণ এখন একটু একটু করে বুঝতে পারছে তাদের ভ-ামি। হয়তো অচিরেই সেই সময় আসবে যখন এই ধর্মবণিকদের সকল মুখোস জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে। মানুষ তাদেরকে বয়কট করবে, পরিত্যাগ করবে নির্ভয়ে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...