এম আর হাসান:
মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে হাজার হাজার, হয়ত লক্ষ লক্ষ বছর অতিক্রম করেছে। এই দীর্ঘ সময়ে ধর্মীয় বিধান দিয়েই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়েছে। আমাদের এই ভারতবর্ষেও সুপ্রাচীন কাল থেকে রাজারা শাস্ত্র দিয়েই রাজ্য পরিচালনা করেছেন। ফেরাউন, নমরুদের মতো স্বৈরশাসকদেরকেও ধর্মের নাম দিয়েই রাজ্য চালাতে হয়েছে, পুরোহিত ধর্মযাজকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখতে হয়েছে, কারণ ধর্মের প্রতি একপ্রকার সামাজিক আনুগত্য ছিল, সে ধর্ম সঠিক বা বিকৃত যেটাই হোক না কেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা পশ্চিমা সভ্যতা থেকে যে রাজনৈতিক দর্শন আমদানি করে আমাদের দেশে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করছি, সেখানে তাত্ত্বিকভাবে ধর্মের জায়গাটা নিতান্তই গুরুত্বহীন। এই রাজনৈতিক দর্শনের নামই দেওয়া হয়েছে সেক্যুলারিজম যার অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা। এর তাৎপর্য হল, ধর্মের কোনো বিধান রাজনৈতিক জীবনে গৃহীত হবে না, রাষ্ট্রের উপর ধর্মের হস্তক্ষেপ চলবে না। ধর্ম হবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিষয়। ধর্মকে বাদ দিয়ে অথবা ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ পরিসরে সীমিত করার ইতিহাস মানুষের সুদীর্ঘ অতীতের ইতিহাসে খুবই বিরল।
রাজনৈতিক দল গঠনের ইতিহাস
১৫৩৪ সালে, ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি গির্জার আধিপত্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে গৃহীত অ্যাক্ট অব সুপ্রিমেসি আইনটি প্রণয়ন করা হয়, যার মাধ্যমে ইংল্যান্ডের গির্জার প্রধান হিসেবে পোপের পরিবর্তে রাজাকেই ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে, ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, লিবারেলিজম, ফ্যাসিবাদ এবং অ্যানার্কিজমের মতো মতবাদের উত্থান ঘটে। এই মতবাদগুলির ভিত্তিতে ১৮ শতকের শেষ এবং ১৯ শতকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে থাকে। ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, গণতান্ত্রিক নীতির উপর রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে। শিল্প বিপ্লবের সময় ইউরোপীয় দেশগুলো উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি ও সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্য আফ্রিকা, এশিয়া এবং মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮শ’ এবং ১৯শ’ শতকে, ইউরোপীয় শক্তিগুলি মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলিকে উপনিবেশে পরিণত করে, যেমন ভারতবর্ষ, মিসর, অটোমান সাম্রাজ্যের কিছু অঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল। তারা এসব এলাকায় তাদের তৈরি আইন, শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সাধন করে।
উপনিবেশযুগে ইউরোপীয় প্রভুদের উদ্দেশ্য কখনোই জনকল্যাণ সাধন করা ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল এসব ভূখণ্ডের সম্পদ শোষণ করা। এভাবে তারা প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর ধরে (১৫০০-১৯৫০) অন্যের সম্পদ লুট করে বর্তমানে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভারতবর্ষ তদানীন্তন অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার মতো কোনো অসভ্য বা বন্য সমাজের দেশ ছিল না, এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। ১৬০০ সালে যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসে, তখন উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করছিল। সে সময় মুঘল শাসনব্যবস্থা ছিল উন্নত, শক্তিশালী ও সুসংহত। ব্রিটিশরা আসার পর থেকে তারা জুলিয়াস সিজারের মত ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম – ঠবহর, ঠরফর, ঠরপর – এরকম কোনো সহজ বিজয় অর্জন করেনি। কারণ ভারতের সভ্যতা ও শাসনব্যবস্থা তাদের চেয়েও অনেক উন্নত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরুতে ভারতের শাসকদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং এই সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। তবে ১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে এবং বিভিন্ন অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে সুবিধা নিয়ে ব্রিটিশরা তাদের বাণিজ্যিক ও সামরিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী করতে থাকে। ব্রিটিশরা যখন সামরিক শক্তি প্রদর্শন শুরু করল, তখনই তারা স্থানীয় রাজাদের দ্বারা প্রবল বাধার মুখোমুখি হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবচয়ে বড় সশস্ত্র প্রতিরোধ। এরপর আরো ৯০ বছর তারা ভারতবর্ষকে শাসন ও শোষণ করে। কিন্তু এই পুরো সময়টাতে তাদেরকে ক্রমাগতভাবে ভারতীয়দের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয় এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর বুঝতে পেরেছিল যে হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্য তাদের শাসনের জন্য একটি বড় হুমকি। তারা পরিকল্পিতভাবে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করে। তাই তারা তাদের দেশের অনুকরণে এদেশেও রাজনৈতিক দল গঠনের উৎসাহ দেন।
অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম নামে একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের উদ্যোগে ১৮৮৫ সনে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কংগ্রেসও শুরুতে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করলেও এটি ক্রমশ উচ্চবর্ণ হিন্দুদের দখলে চলে যায়। তাই মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ১৯০৬ সালে ভারতের বিভিন্ন মুসলিম নেতা এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সহযোগিতায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দেরকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে বৈধতা দিয়ে জনগণের মনোযোগ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যারা সরাসরি সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল তাদেরকে শিক্ষিত সমাজ ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সমর্থ হয়েছিল। এভাবে রাজনৈতিক দল গঠনের এ সিদ্ধান্ত ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশকে আরো পঞ্চাশ বছর টিকিয়ে দেয়। এরই মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অবিশ্বাস ও ঘৃণা প্রকট আকার ধারণ করে। উভয় সম্প্রদায়ের কট্টরপন্থী অংশ দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে যা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগে গড়ায়।
বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতি
যাহোক, এবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রসঙ্গে আসি। ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে চলে গেল তাদের সযত্নে গড়ে তোলা সেই অনুগত রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দিয়ে গেল। ভারতে সরকার গঠন করল কংগ্রেস আর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ ভেঙে জন্ম নিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যা পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নাম নিয়ে সম্পূর্ণরূপে সেক্যুলার, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধারণ করে। মাও সেতুং ও কার্ল মার্ক্সের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯৪৮ সালে গঠন হয় বাংলাদেশের প্রথম বাম দল ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (ঈচই)’ এবং পরে ১৯৫১ সালে গঠন হয় ‘বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)’। ১৯৪১ সালে লাহোরে প্রতিষ্ঠিত ‘জামায়াতে ইসলামি’ দেশবিভাগের পর মুসলিম প্রধান পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও চেতনা নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (ইঘচ)। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৮০ এর দশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং এ সময় বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮৬ সালে গঠিত হয় জাতীয় পার্টি। বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোট রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৮টি হলেও, এদেশে সত্যিকার অর্থে দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থা বিরাজমান। এখানে প্রধান দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (ইঘচ) পালাক্রমে দেশ শাসন করে থাকে।
গত এক শতাব্দী ধরে বিকশিত হতে হতে এই রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যেকে একেকটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘিরে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, পরিকল্পনা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে। রাজনীতি করার অধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকার [বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯] ও মানবাধিকার [জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা, ১৯৪৮, ধারা ২১(১)] এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা দখল, সরকারের অন্যায় বিরোধিতা, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সহিংসতা, বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন, হরতাল অবরোধের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি, ভোট কারচুপি ও নেতাদের নৈতিক অবক্ষয়ের মতো নানা কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপকভাবে বিতর্কিত। তারা জন-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্মের প্রেক্ষাপট, নেতৃত্বের ধারা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কৌশল, নীতি ও আদর্শ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি ও ভোটার আচরণ, বৈদেশিক সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা প্রায় সবাই হয় কংগ্রেস অথবা মুসলিম লীগ মডেলের অনুসরণ করছে।
এমনকি বাম দলগুলোও অনেকাংশে তা-ই করছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রদত্ত রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দলের কোনো উল্লেখ নেই, তাই রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গণ-রাজনৈতিক ও জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে; তারা প্রকৃতপক্ষে দলীয় রাজনীতি যেমন, পরিবারতন্ত্র ও নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, মনোনয়ন বাণিজ্য, পদের জন্য লেনদেন ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ব্যস্ত। নির্বাচনকালীন মিথ্যা ওয়াদা, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ও হামলা এমনকি খুন, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ভোটচুরি, কেন্দ্রদখল, বাক্স ছিনতাই, ভোটের জন্য দুর্বল লোকদের হুমকি-ধামকি, মিছিল-মিটিংয়ে লোকবল ভাড়া ইত্যাদি কাজের জন্য ক্যাডার বাহিনী লালন ও তাদেরকে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে মদদ দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোতে সাধারণ ব্যাপার। দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতা দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রায়শই রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো এখন রাখঢাকের ব্যাপার নয়; এটাই আমাদের রাজনীতির বাস্তবতা। রাজনীতি এখন একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যে নেতা টিনের ঘরে থাকতেন, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি হয়ে যান হাজার কোটি টাকার মালিক। জনগণ মন্দের ভালো দলটিকে বেছে নেওয়ার জন্য পঞ্চবার্ষিকী ভোটাভোটির বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
হেযবুত তওহীদের প্রস্তাবিত রাজনীতির রূপরেখা
এখন যদি আধুনিক ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করার চিন্তা করা হয় তবে রাজনৈতিক দলগুলোকে যা খুশি তা করার লাইসেন্স দেওয়া যাবে না। অতীতে অনেক রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থ বা নির্দিষ্ট ইস্যুতে আন্দোলন করে দেশ বা সমাজের ক্ষতিসাধন করেছে। তাই রাজনৈতিক অধিকারের নামে দেশের ক্ষতি করার সুযোগ কাউকে দেওয়া যাবে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কোনোটা ভারতপ্রেমী, কোনোটা ভারতবিদ্বেষী, কোনোটা ধর্মনিরপেক্ষ, কোনোটা বামপন্থী, কোনোটা ধর্মভিত্তিক। কিন্তু ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন কোনো সুযোগ নেই, যেখানে বিভিন্ন আদর্শের দল গঠন করা যাবে এবং বিভিন্ন মতবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যাবে। রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা কখনোই নানামুখী আদর্শের উপর রাজনৈতিক দল গঠন করেননি। বরং মদিনা সনদের মাধ্যমে মুসলিম, আউস, খাজরাজের আটটি গোত্র, সেগুলোর অধীনে আরো তেত্রিশটি গোত্র এবং তিনটি ইহুদি গোত্র বনি কুরায়জা, বনি নাজির, বনি কাইনুকা ও তাদের অধীনে আরো বিশটি ছোট গোত্রকেও এক জাতিভুক্ত করেছিলেন। অর্থাৎ ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, বাদ-মতবাদ, সামাজিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শসহ সকল বিভেদের প্রাচীর ভেঙে মানুষকে এক জাতিভুক্ত হিসাবে ঐক্যবদ্ধ করা।
ইসলামের রাজনৈতিক অপব্যাখ্যা
শত শত বছর থেকে ইসলামকে ‘ব্যক্তিগত ধর্ম’ হিসাবে পালন করার কারণে ইসলামের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা কালের গর্ভে একপ্রকার হারিয়ে গেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনের যে রোডম্যাপ পশ্চিমা প্রভুরা রেখে গেছেন, ইসলামের রাজনৈতিক পদ্ধতি সেটার সঙ্গে খাপ খায় না। তবু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একদল ইসলামি পণ্ডিত ইসলামকে জোর করে গণতন্ত্রের মডেলের সাথে খাপ খাওয়াতে উঠে পড়ে লেগেছেন এবং গত শতাব্দী থেকে তারা ইসলামের এরকম একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা (Narrative) দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। তারা আবিষ্কার করেছেন ‘গণতান্ত্রিক ইসলামী দল’। তাদের ব্যাখ্যা মোতাবেক আল্লাহর রসুল সারাজীবন রাজনীতি করেছেন। তারা রসুলাল্লাহর জেহাদ বা সংগ্রামকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে মেলাচ্ছেন। তারা বলছেন যে এই যুগে নির্বাচনই হচ্ছে জেহাদ, আর ইসলামী দলের ব্যালট পেপার হচ্ছে জান্নাতের টিকেট। তাদের বয়ান মোতাবেক প্রকৃতপক্ষে ইসলামই হচ্ছে সবচেয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ ধর্ম। ইসলামের ইতিহাসকেও তারা সেভাবে বর্ণনা করেছেন, যেমন উমর (রা.)-এর শাসনে ‘শুরা’ বা পরামর্শ সভা ছিল এবং শাসক সিদ্ধান্ত নিতেন তবে জনগণের মতামতও নিতেন। সুতরাং উমর (রা.) গণতান্ত্রিক ছিলেন! আবার রসুলাল্লাহর (সা.) ওফাতের পর আবু বকর (রা.) খলিফা নির্বাচিত হন সাধারণ জনগণের মনোনয়নের ভিত্তিতে, কাজেই এ তো গণতন্ত্রেরই তদানীন্তন রূপ!
বিষয়টি আসলে মোটেও এমন নয়। গণতন্ত্রের সূচক বা মাত্রা (Parameter) হল- স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা, ক্ষমতার ভারসাম্য, সরকারের জবাবদিহিতা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ, নারী-পুরুষের সম অধিকার, শক্তিশালী সাংবিধানিক কাঠামো, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সম-বণ্টন ইত্যাদি। বাস্তব অবস্থা সেই জনপ্রিয় প্রবাদের মত, গরু কেতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই। কিন্তু আমাদের সংস্কার প্রস্তাবে এই সকল কিছু নিশ্চিত করার জন্য এমন একটি ব্যবস্থার প্রস্তাব করছি যেখানে নানা মতবাদের উপর জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক দল তৈরির অনুমতি দেওয়া হবে না। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কোনো কর্মসূচিও দেওয়া যাবে না। সবাইকে রাষ্ট্রের মূল আদর্শের প্রতি অনুগত থেকে গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার দেওয়া হবে। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের নামে জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। যদি গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে এসব করতে দেওয়া হয় তাহলে গরু চিরকাল কেতাবেই থেকে যাবে। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা আল্লাহর দেওয়া নীতি ও পদ্ধতিতে এই প্রতিটি বিষয় নিশ্চিত করতে সক্ষম। ইসলামের ইতিহাস তার প্রমাণ। বরং অন্য কোনো ব্যবস্থায় এই মাত্রাগুলো কোনোদিন অর্জন করা সম্ভবই হয়নি। তাই শান্তির আশায় মানুষ বারবার ব্যবস্থা পরিবর্তন করেছে। রাজতন্ত্র থেকে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র, সেখান থেকে কমিউনিজম, সেখান থেকে ফ্যাসিজম, আবার সেখান থেকে গণতন্ত্র, সেখান থেকে আবার ফ্যাসিজম।
এভাবেই চলছে আমাদের রাজনৈতিক জীবন, বাস্তবে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। মানুষ কেবল ফুটন্ত কড়াই থেকে লাফ দিয়ে বাঁচতে গিয়ে জ্বলন্ত চুলার মধ্যে পড়েছে। আমাদের চর্চিত গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার আমাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আমরা মানুষের সামনে ইসলামের প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা উপস্থাপন করছি এবং একে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিচ্ছি।
রাজনৈতিক দলাদলি নিষিদ্ধ: বর্তমানে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুদলীয় রাজনীতি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ, বামপন্থী, ডানপন্থী, মধ্যপন্থী মতবাদ বা যে কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে গড়ে তোলা এই রাজনৈতিক দলগুলো সারাবছর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিবাদে লিপ্ত থাকে যা প্রায়ই রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করে। কারণ এই রাজনীতি স্বার্থের জন্য, জাতির কল্যাণের জন্য নয়। এই পরম সত্য উপলব্ধি করে আমরা এই প্রস্তাবনা দিচ্ছি যে, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমাদেরকে আপাতত রাজনৈতিক দলাদলি বন্ধ করতে হবে, এই রাজনীতিও বন্ধ করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতবাদ ফেরকার ভিত্তিতে ঐক্যনষ্টকারী সংগঠন করারও অনুমতি থাকবে না। বহুদলীয় রাজনীতি ইসলামের ঐক্য চেতনার পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, বাদ-মতবাদ, সামাজিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শসহ সকল বিভেদের প্রাচীর ভেঙে মানুষকে এক জাতিভুক্ত হিসাবে ঐক্যবদ্ধ করা। আল্লাহ চান, মো’মেনরা যেন গলিত সীসার মত নিচ্ছিদ্র ঐক্যের প্রাচীর গড়ে তোলে (সুরা সফ ৬১:৪), ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে (তওহীদ) ধারণ করে (সুরা ইমরান ৩:১০৩)। সুতরাং আমাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় জাতির ঐক্য সংহতি বিনষ্ট করে এমন রাজনৈতিক বা ইস্যুভিত্তিক দলাদলির কোনো সুযোগ থাকবে না।
সামাজিক দায়িত্ব পালন: রাষ্ট্রের মূলনীতি অর্থাৎ তওহীদভিত্তিক ঐক্যচেতনার প্রতি সম্মান ও আনুগত্য বজায় রেখে রাষ্ট্রের উন্নয়নের স্বার্থে জনগণের সমস্যাদি তুলে ধরার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরির অনুমতি থাকবে। তবে কোনো সংগঠন যদি মিথ্যা প্রচার, গুজব বা বিভ্রান্তিকর ইস্যু তৈরি করে জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, তাদেরকে সে কাজ করতে দেওয়া হবে না।
জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মসূচি: রাজনৈতিক অধিকারের নামে কিংবা বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্টকারী এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, রাস্তা আটকিয়ে সমাবেশ ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে।
[যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭৮৩৫৯৮২২২]