রিয়াদুল হাসান:
মসজিদ অর্থ সেজদার স্থান। আল্লাহর উদ্দেশে ভূমিতে মাথা ঠেকানোই কেবল সেজদা নয়। নামাজের সেজদা হচ্ছে সর্বান্তকরণে আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করার অনুশীলন। সেজদার অর্থ যে আনুগত্য করা তা কোর’আনে সেজদা শব্দের ব্যবহার দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ বলেছেন, নভোমণ্ডলে ও ভূ-মণ্ডলে যা কিছু আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় আল্লাহকে সেজদা করে (সুরা রাদ ১৩:১৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘তারকারাজি ও বৃক্ষকূল আল্লাহকে সেজদা করে (সুরা রহমান ৫৫:৬, সুরা নাহল ১৬: ৪৯) )। মো’মেনদের ধর্মীয় জীবন ও পার্থিব জীবন আলাদা নয়, এক সূত্রে গাঁথা। তাই ইসলামের মসজিদ নিছক কোনো উপাসনালয় নয়, এটি ইসলামের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রশাসনিক কার্যালয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মসজিদ এমনই ছিল। রসুলাল্লাহ মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম যে কাজটি করলেন সেটা হচ্ছে মসজিদ নির্মাণ। এই মসজিদই ছিল ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও আধ্যাত্মিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। ফলে মসজিদ ছিল প্রাণবন্ত, কর্মচঞ্চল। বর্তমানে মসজিদকে শুধু নামাজের ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হয়, নামাজের সময়টুকু ছাড়া মসজিদ তালাবদ্ধই থাকে। এভাবে শত শত বছর থেকে সামাজিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক কার্যক্রম থেকে মসজিদকে পৃথক করে ফেলার দরুন সাধারণ মানুষের কাছে মসজিদের আকিদা (সামগ্রিক ধারণা) হারিয়ে গেছে এবং মসজিদ সকল কার্যক্রম হারিয়ে কেবল নামাজের স্থানে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর রসুলের সময় মসজিদে যেসব কার্যক্রম হত তার আলোকে মসজিদ সংক্রান্ত নীতিমালা আমরা হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংক্ষেপে উল্লেখ করেছি। সেই নীতি ও প্রস্তাবনাগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো।
প্রশাসনিক কার্যালয়:
রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে এবং জনগণের অবাধ যাতায়াতের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে জনবহুল স্থানে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা সদরে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে ‘জামে মসজিদ’ নির্মাণ করা হবে। তবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য পাঞ্জেগানা মসজিদ শুধুমাত্র সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে মুসল্লিদের অর্থায়নে নির্মিত হতে পারে। সকল মসজিদই রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার অধীনে পরিচালিত হবে এবং সেগুলোকে বহুবিধ জাতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হবে। মসজিদ কমিটির পদ বা ফেরকাগত দ্বন্দ্বের কারণে অন্যের জমি দখল করে কিংবা বিরোধপূর্ণ জমিতে, পাড়ার আনাচে কানাচে মসজিদ নির্মাণের সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। জামে মসজিদগুলোতে জুমার খোতবায় জাতিকে কী বার্তা বা তথ্য দেওয়া হবে, তা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। পাঞ্জেগানা নামাজ ও জুমার মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্রের নীতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আনুষ্ঠানিক বার্তা পাবে। এছাড়াও ইসলামের আমল ও আখলাক সংক্রান্ত মৌলিক শিক্ষাগুলো মুসল্লিরা সহজেই জুমার খোতবার মাধ্যমে গ্রহণ করবে। অন্যান্য ওয়াক্তের নামাজের পরও আমিরের মধ্যস্থতায় পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে বহু বিরোধ নিষ্পত্তি, সমস্যা সমাধান এবং তথ্য আদান-প্রদান হবে, যার ফলে গুজব ও অনৈক্য ছড়ানোর সুযোগ সীমিত হয়ে আসবে। বিশেষ করে মসজিদকে গুজব ও বিদ্বেষ প্রচারের স্থান হিসেবে অপব্যবহার করার কোনো সুযোগ রাখা হবে না।
অর্থনৈতিক কার্যালয়:
মসজিদ হবে রাষ্ট্রের নির্ধারিত কর এবং দানের অর্থ সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম, তবে আরও আধুনিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থা থাকতে পারে। এই অর্থ হিসাবরক্ষকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বায়তুল মালে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে, মসজিদের ইমাম এবং খতিবদের বেতন-ভাতা সরকার নির্ধারণ করবে, যা অন্যান্য মর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের বেতন স্কেলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। মুয়াজ্জিন ও মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণকারীদের বেতন-ভাতা সরকার প্রদান করবে। এর ফলে মসজিদের ইমাম এবং খতিবদের জনগণের দানে নির্ভরশীল হতে হবে না এবং মসজিদ নির্মাণের নামে রাস্তার পাশে টাকা তুলতে হবে না। বরং, মসজিদ থেকেই দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য দান ও মানবিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
বিচারালয়:
বিচারব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে জামে মসজিদকে বিচার-সালিশ কেন্দ্র হিসাবেও ব্যবহার করা হবে। এখানে সালিশি পদ্ধতির মাধ্যমে বিনা খরচে বিচার প্রদান করা সম্ভব হবে। ইসলামী আইন ও অন্যান্য প্রচলিত আইনের বিশেষজ্ঞ বিচারকগণ মসজিদের নির্ধারিত স্থানে সপ্তাহজুড়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন, শুনানি গ্রহণ করবেন, রায় দেবেন এবং রায় কার্যকর করবেন। যেহেতু জুমার দিনে সবাই মসজিদে একত্রিত হয়, সেদিন কিছু দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড জনসম্মুখে কার্যকর করা হবে। এর মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং ইসলামের ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। তবে, জটিল ও গুরুতর মামলাগুলি উচ্চ আদালতে প্রেরণ করা হবে। অধিকাংশ অভিযোগ স্থানীয় পর্যায়েই মীমাংসা হয়ে যাবে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র:
সালাত (নামাজ) হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া উম্মতে মোহাম্মদীর প্রধান চারিত্রিক প্রশিক্ষণ। এটি জাতিকে ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, সময়ানুবর্তিতা, দলগত কাজ (ঞবধস ড়িৎশ), ধৈর্যশীলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মনোযোগ এবং আধ্যাত্মিকতার প্রশিক্ষণ প্রদান করে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ছাড়াও মসজিদ হবে জাতির নারী-পুরুষ সকলের জন্য একটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র। এখানে দীনের বিজ্ঞ আলেমরা আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক নানা বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দেবেন। মসজিদ থেকে বিনা বেতনে কোর’আন শিক্ষা, প্রয়োজনীয় হাদিসের জ্ঞান, দৈনন্দিন মাসলা-মাসায়েল, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা, দীনের মৌলিক আকিদা ও ইসলামি সংস্কৃতি সম্পর্কিত শিক্ষা দেওয়া হবে। মসজিদের বাইরেও পৃথক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। কেবল জ্ঞানচর্চাই নয়, রসুলাল্লাহর সময় মসজিদ প্রাঙ্গণে শরীরচর্চা, খেলাধুলা, দৌড় প্রতিযোগিতা, কুস্তি, তীর-ধনুক, বর্শা নিক্ষেপের মতো শারীরিক কর্মকাণ্ডও করা হতো। রসুলাল্লাহ (সা.) সপরিবারে এসব খেলা উপভোগ করতেন এবং কখনো কখনো এতে অংশও নিতেন। এর মাধ্যমে যেমন বিনোদন লাভ হত, তেমনি জাতির তারুণ্যশক্তি হয়ে উঠত গতিময়, প্রাণবন্ত, পরিশ্রমী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সদাপ্রস্তুত।
আবাসন ব্যবস্থা:
মসজিদকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন গড়ে তোলা হবে। সেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বসবাস করবেন। আল্লাহর রসুল স্বয়ং মসজিদের সন্নিকটে বাস করতেন এবং একদল নিবেদিতপ্রাণ সাহাবি মসজিদেই বসবাস করতেন যাদেরকে আসহাবে সুফ্ফা (বারান্দার অধিবাসী) বলা হত। বিভিন্ন গোত্র বা রাজ্য থেকে আগত প্রতিনিধিদেরও আবাসন বন্দোবস্ত মসজিদেই করা হত। পরবর্তী খলিফা ও সুলতানদের যুগে একেকটি মসজিদ কমপ্লেক্স বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি হত। যেমন আব্বাসী খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের নির্মিত (৮৫৪ খ্রি.) ইরাকের সাম্বার মসজিদের আয়তন ছিল ২,০০,০০০ বর্গমিটার। মসজিদ চত্বরের সন্নিকটে সরাইখানা স্থাপিত হত, যেখানে পথচারী, মুসাফির, দুর্গত মানুষেরা খাবার ও আশ্রয় পেত। এসব সরাইখানাগুলো (ঈড়সসঁহরঃু ঈধহঃববহ) মূলত স্থানীয় অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোর দান, সাদকা, ফসলের উশর ইত্যাদি উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও দ্রব্যাদি দ্বারা পরিচালিত হত। বর্তমান সময়ের মতো জমকালো হোটেলব্যবসা ইসলামের সভ্যতায় দেখা যেত না, যেখানে অর্থ ছাড়া মানুষ মানুষকে চিনে না। না খেয়ে থাকলেও কেউ কাউকে দুটো ভাত খেতে দেয় না। এমন একটি মানবতাহীন সমাজকে পরিবর্তন করতে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।
নারীদের অংশগ্রহণ:
আল্লাহর ঘর মসজিদে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে অবারিত। তারা দিনে রাতে যে কোনো সময় এবাদত বন্দেগিসহ যে কোনো সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে মসজিদে যেতে পারবেন। কেউ তাদের এই অধিকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। তারা সকল সালাতে, খোতবায়, বিচারিক কার্যক্রমে, বিয়ে-শাদি, আকিকা ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে, আলোচনা সভায় পুরুষদের মতই অংশ নিবেন, কোনো লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হবেন না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এত বেশি সংখ্যক নারী মসজিদে যাতায়াত করতেন যে খলিফা ওমরের (রা.) সময় নারীদের জন্য আলাদা দরজা বানাতে হয়েছিল। সেই সোনালি যুগে নারীদের বসার জন্য পৃথক কোনো বন্দোবস্ত ছিল না, নারী পুরুষ এক জামাতেই নামাজ পড়তেন, একসাথে বসেই আলোচনা শুনতেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামরিক কার্যক্রম:
একটি জাতির আইন-শৃঙ্খলা ও সামরিক বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রসুলাল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সাহাবিদের যুগে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মসজিদ। মসজিদের সম্মুখভাগে কিবলা নির্দেশক স্থানটিকে ‘মেহরাব’ বলা হয়, যার শাব্দিক অর্থ লড়াইয়ের মঞ্চ। আধুনিক যুগে সামরিক কার্যক্রম অনেক বিস্তৃত হয়েছে এবং এতে উন্নত প্রযুক্তি ও বিভিন্ন যুদ্ধ সরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে। যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, মিসাইল, সাবমেরিন, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার, নৌযান, গাইডেড মিসাইল, এফসিএল (ফোর্স ফিল্ড অ্যাটাক সিস্টেম) এবং রোবট সিস্টেমের মতো ভারী ও প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধ উপকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য এখন বড় এলাকাভিত্তিক সামরিক স্থাপনা, ক্যান্টনমেন্ট, মিলিটারি বেইজ এবং এয়ারবেস থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের নিয়মিত সামরিক বাহিনী সেসব স্থাপনা ব্যবহার করবে। তবে এর পাশাপাশি জাতির সকল সক্ষম নাগরিককে প্রাথমিক সামরিক শৃঙ্খলা, আনুগত্য, শরীরচর্চামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণের স্থান হিসেবেও মসজিদ ও মসজিদ প্রাঙ্গণকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কেননা মসজিদে সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ঘটে। দেশের লক্ষ লক্ষ মসজিদকে শুধু আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে নয় বরং দেশের জাতীয়, সামরিক, অর্থনৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হলে সেগুলো দেশের উন্নয়ন, শান্তি, সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সামাজিক অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির চর্চা:
বিয়ে-শাদি, আকিকাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান মসজিদে সম্পন্ন করা হবে। রসুলাল্লাহ (সা.) এর যুগে বিয়েশাদিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান মসজিদেই হত এবং এই অনুষ্ঠানগুলো মসজিদে সম্পন্ন করার ব্যাপারে রসুলাল্লাহ উৎসাহও দিয়েছেন। মসজিদ হবে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। অপসংস্কৃতি রোধ করে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চায় মসজিদ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও, মসজিদগুলোকে সামাজিক সহায়তা কেন্দ্র, পারিবারিক পরামর্শ সেবা কেন্দ্রসহ নানা বহুমুখী কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সরকারের পৃথক অফিস পরিচালনার খরচ কমানো সম্ভব হবে।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭১১২৩০৯৭৫]