হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সোনাইমুড়ীতে হেযবুত তওহীদের প্রধান জামাতের খুতবার সার-সংক্ষেপ

[দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর শান্তি-সমৃদ্ধি এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণ কামনায় ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য ও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারাদেশে হেযবুত তওহীদের উদ্যোগে পবিত্র ঈদুল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। হেযবুত তওহীদের প্রধান ও কেন্দ্রীয় জামাত অনুষ্ঠিত হয় সংগঠনের কেন্দ্রভূমি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার চাষীরহাটে। ভোর থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মুসল্লি জামাত স্থলে সমবেত হন। জামাতে ইমামতি ও খুতবা প্রদান করেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।]

আমরা এমন একটি সময়ে এই ঈদের জামাতে সমবেত হয়েছি, জমায়েত হয়েছি -যে সময়টি আমাদের জাতীয় জীবনের, রাষ্ট্রীয় জীবনের, সামগ্রিকভাবে মানবজাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। মানুষ এক মহাসংকটকাল অতিক্রম করছে।

আমি যদি বিশ্বের মুসলমানদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, ফিলিস্তিনে এক অবর্ণনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানে হাজার হাজার নারী ও শিশুকে হত্যার পর সমগ্র ফিলিস্তিন জনগণকে উদ্বাস্তু করে দেওয়া হয়েছে। তারা আজ মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েলি গণহত্যাকারীদের হাত থেকে ঈদের দিনেও রেহাই পাচ্ছেনা গাজার শিশুরা।

আমরা যদি মিয়ানমারের দিকে তাকাই, সেখানে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে তাদের ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রায় ছয় থেকে সাত কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু। সমগ্র বিশ্বে আজ মানবজাতি যুদ্ধ, রক্তপাত, হানাহানি, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্র মানুষের হাহাকার ও বঞ্চনার এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

এমন একটি সময়ে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ ও কোরবানির সুমহান বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে ঈদুল আজহা। আপনারা জানেন, নবী-রাসূলগণের আগমনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) -তিনি বিশ্বনবী, শেষ নবী এবং মানবজাতির সর্বশেষ পথপ্রদর্শক। তাকেও আল্লাহ হেদায়াহ ও সত্য দীন দিয়েছেন। আমরা জানি, হেদায়াহ মানে সঠিক পথ; “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বা “দীনুল হক”-আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা। এই দুইটি জিনিস দিয়ে আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন, যেন তিনি তা বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নবী করিম (সা.)-কে কী পরিমাণ কষ্ট, সংগ্রাম, ত্যাগ ও কোরবানি করতে হয়েছে -সেই ইতিহাস আপনারা জানেন। একের পর এক আঘাতে তিনি জর্জরিত হয়েছেন, নির্মমভাবে সাহাবিদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে, জেল-যন্ত্রণা সইতে হয়েছে।

সেই দীন প্রতিষ্ঠার বিস্ময়কর ইতিহাস যারা জানে না, তারা দুর্ভাগা ও হতভাগা। আজ মুসলমানদেরকে সেই ইতিহাস পুনরায় স্মরণ করতে হবে। ঘরে ঘরে অবশ্যই তা পাঠ করতে হবে।

আপনারা জানেন, রাসুল (সা.) সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার পর আরব সমাজে কী অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছিল। যেখানে মানবাধিকার ছিল না, সেখানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে; যেখানে ন্যায়বিচার ছিল না, সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে; অভাব ও দারিদ্র্য ছিল, পরে তা নির্মূল হয়ে সমৃদ্ধি এসেছে।

মাদক, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা -এসব দ্বারা সমাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; সেগুলো নির্মূল করে সেখানে মানুষ সভ্য, শালীন ও উন্নত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়েছে। নারীদের কোনো সম্মান বা ইজ্জত ছিল না, সেই নারীরা স্বাধীনতা পেয়েছে, তারা রণাঙ্গনে গিয়ে ভূমিকা রেখেছে।

এক কথায়, মানুষের সমাজে, রাষ্ট্রে, পরিবারে সকল ক্ষেত্রে মানুষের মন, মস্তিষ্ক ও মানসিকতায় এক চরম পরিবর্তন এসেছে। এই ঢেউ, এই ধাক্কা রাসুলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকালের পরেও কয়েক শতাব্দী ধরে অব্যাহত ছিল। সেই রেনেসাঁ, সেই বিপ্লব, সেই জাগরণের ফলে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী মুসলিম উম্মাহ জ্ঞান, বিজ্ঞান, সামরিক শক্তি, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতায় বিশ্বে শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইতিহাস পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে এই উম্মাহ রাসূলুল্লাহর দেখানো সেই পথ পরিত্যাগ করেছে। তাওহীদ পরিত্যাগের ফল, আল্লাহর রাস্তায় শুদ্ধ দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও সঠিক আকিদা ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ আমাদের উপর রুষ্ট হয়েছেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন দল, ফেরকা ও মতভেদের কারণে উম্মাহ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছে। উম্মাহর প্রাণশক্তি হারিয়ে গেছে, জিহাদের স্পৃহা নিঃশেষ হয়ে গেছে। একক নেতৃত্ব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। দীন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচির প্রত্যেকটি দফা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। ফলে শারীরিকভাবে উম্মাহ সম্প্রসারিত হলেও আত্মিকভাবে ভিতর থেকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

আজ আমরা পাশ্চাত্যদের অনুসরণ করছি -তাদের সুদভিত্তিক অর্থনীতি, রোমান ও ব্রিটিশ আইনকানুন ও দণ্ডবিধির আওতায় আমাদের বিচারব্যবস্থা চলছে। মুসলমানদের আচার, বিচার ও আদালতের আইন সবকিছুই চলছে তাদের পদ্ধতিতে।

তাদের হানাহানি, রাজনীতির প্রক্রিয়া, তথাকথিত পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। ফলে আজ একটি জাতি ৫৫টি সামরিক জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের মধ্যে হাজারও তর্ক, মারামারির মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় উম্মাহর আর কোনো আশা বা ভরসা নেই। সবদিক থেকেই তারা পরাজিত, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না।

আজ আমাদের জাতি চরম বিপর্যস্ত। সমাজে কোনো নিরাপত্তা নেই। আমরা যে দেশে বাস করছি, সেই দেশে গত ৫৪ বছরে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাত, আন্দোলন, বিক্ষোভ, সংগ্রাম, বিপ্লব ও পাল্টা বিপ্লব চলেছে। পুরো জাতি নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছে। বর্তমানে রাষ্ট্র বিলিয়ন ডলারের ঋণে জর্জরিত। সরকারকে প্রায় ১২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলছে। মানুষের জীবন আজ চরম সংকটে। ব্যবসায়ীদের হাহাকার, জনজীবন স্থবির। মানুষ আজ বিকল্প একটি জীবনব্যবস্থার সন্ধানে।

আমরা বলতে চাই, এমন এক সময়ে আমরা ঈদের জামাত করছি, যখন আমাদের রাষ্ট্র সাংঘাতিক নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। একদিকে ভারতবর্ষ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে চীনের সাম্রাজ্যবাদ, আরও একদিকে মার্কিন চক্রান্ত। সম্মিলিতভাবে এরা আমাদের রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই মিয়ানমার থেকে নতুন আপদ সৃষ্টি হয়েছে। রাখাইনে আরাকান আর্মি একটি সাংঘাতিক গোলযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে। ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মারামারি তো রয়েছেই।

সবকিছু মিলিয়ে আমরা আগামী দিনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় এবারের হজ এবং কোরবানির ঈদুল আজহা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা হওয়া উচিত -আমরা একটি জাতি, One Nation। আমাদের জাতীয় সত্তার ভিত্তি হতে হবে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাওহীদ। আল্লাহর হুকুম ও বিধান ছাড়া আমরা অন্য কারো হুকুম মানি না। আমাদের প্রত্যেক জাতির সদস্যের কর্তব্য হলো প্রকৃত কোরবানি -গরু জবাই নয়, বরং জান-মালের কোরবানি।
আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, নিজেদের জান-মাল কোরবানি দিয়ে কর্মসূচির আলোকে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আল্লাহ আমাদের গুনাহ মাফ করবেন, এই দুর্গতি বন্ধ হবে, হানাহানি থেমে যাবে।

কিন্তু আজ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে নিজেদের মধ্যে হানাহানি। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার কর্তৃত্ব থাকত না, ইসরাইলদের এই মাতব্বরি হতো না- যদি শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব না থাকত, যদি অন্তত ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্ক -এই তিনটি রাষ্ট্রকে কেউ একত্রিত করতে পারত। কোন একটা মন্ত্র বলে যদি তাদের একত্র করা যেত, তাহলে এমনটা হতো না।
তবে কে করবে? সবাই অহংকারে মত্ত, নিজেদের গদি রক্ষায় ব্যস্ত, নিজেদের প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত। কিন্তু মুসলমানদের রক্তের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। তাই আজকেই এ কথাটা বলতে হবে—হজের যে তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে প্রেরণা- সেটা যেন আমরা এখান থেকে শিখি।

আজকে আমাদের জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য সবাই যায় নিউইয়র্ক। কিন্তু আল্লাহর রসূল নিউইয়র্কে কোনো জাতিসংঘ ঠিক করে দেননি। আল্লাহর রসূল ঠিক করে দিয়েছেন কাবা, যেটাকে আমরা বলি কাবাতুল শরীফ। “আল্লাহু আকবার” বলে নামাজে দাঁড়ানো হয় এবং আরাফার ময়দানে, যেখানে সকল মুসলমান একত্রিত হয়ে একজন নেতার নেতৃত্বে জাতির সংকট সমাধানের চেষ্টা করবে -সেটা আজ আমাদের দরকার।

এই ঈদ শুধুমাত্র গরু জবাই করে গোশত খাওয়ার জন্য নয়। বরং এটি হওয়া উচিত নিজেদের জান-মাল কোরবানি করার প্রেরণা। পিতা ইব্রাহিম (আ.) যেভাবে তাঁর সন্তানকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন, আজকের পিতারাও যদি তাদের সন্তানদের আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার মানসিকতা নিয়ে প্রস্তুত থাকেন, তবে আমাদের জীবনের অন্ধকার কেটে যাবে।

সত্যিকার অর্থে কোরবানির ঈদ সেই দিনই সার্থক হবে, সেদিনই অর্থবহ হবে, সেই দিনই পূর্ণতা লাভ করবে -যেদিন আমরা সত্যিকারভাবে আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করতে পারব। আমরা সত্যিকারভাবে স্বাধীন হতে পারব। এবং এই ইবাদতগুলো হবে একটি স্বাধীন জাতিসত্তার ইবাদত। তাই সবাইকে এই কথাগুলো মনে রাখতে হবে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তওফিক দান করুন। এবং সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা -ঈদ মোবারক।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...