মো. মশিউর রহমান:
এ কথা সর্বসম্মত যে এ দীনুল হকের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ- এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। তওহীদ ব্যতিত কোনো ইসলামই হতে পারে না, তওহীদই ইসলামের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা করে তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। আরবের যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মোশরেকরাও আল্লাহর একত্বে, ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানতো না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কোরায়েশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল¬াহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মো’মেন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ছিল না। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে অর্থাৎ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় পরিপূর্ণ ছিল (কোর’আন, সুরা বাকারা ৩০)। তাদের স্রষ্টা আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে রসুল প্রেরিত হয়েছিলেন। রসুলও সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় (ইসলাম অর্থই শান্তি) একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। যেমন এখনকার খ্রিষ্টান, ইহুদী, হিন্দুরাও কেউ ত্রিত্ববাদী, কেউ মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও সৃষ্টিকর্তা হিসাবে একজনকেই মনে করে, কিন্তু তারা সেই একজন স্রষ্টার আনুগত্য করে না, তাদের জাতীয়, সামষ্টিক জীবন তাঁর হুকুম ও আইন দিয়ে পরিচালিত করে না। এই আনুগত্য না করাই তাদের কাফের মোশরেক হওয়ার প্রকৃত কারণ।
বর্তমানেও মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের ‘পুরোহিত’ অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বের আনুগত্য করে যাচ্ছে। এই প্রতিটি তন্ত্র আলাদা আলাদা একেকটি দীন (জীবনব্যবস্থা), ঠিক যেমন দীনুল হক ‘ইসলাম’ও একটি দীন। এগুলির সাথে ইসলামের একমাত্র পার্থক্য, এই মানবরচিত দীনগুলি মানবজীবনের বিশেষ কিছু অঙ্গনের উপর আলোকপাত করে, বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়। কোনো তন্ত্র মানুষের রাজনৈতিক জীবনের নীতি-প্রক্রিয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, কোনোটি জোর দেয় কেবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর, কোনোটি গুরুত্ব দেয় মানুষের সামাজিক জীবনের সমস্যা সমাধানের উপর। কিন্তু সমগ্র মানবজীবনের সকল অঙ্গনের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা এদের কোনোটিতেই রাখা হয় নি; পক্ষান্তরে দীনুল হক ‘ইসলাম’ মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গনের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়ে থাকে, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সামষ্টিক জীবন পর্যন্ত সকল অঙ্গনে এর অবাধ বিচরণ, এর পরিসীমা এমনকি সারা পৃথিবীর সম্পূর্ণ মানবজাতির সামষ্টিক কার্যক্রম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। বর্তমানের মুসলিম জনসংখ্যাটি খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইহুদীদের মতই তাদের জীবনের সামষ্টিক অঙ্গনে এই ‘বাদ’ ও ‘তন্ত্র¿’-গুলিরই (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সাম্যবাদ) আনুগত্য করছে, ঠিক যেমন প্রাচীন আরবগণ আনুগত্য করত মূর্তিগুলির পুরোহিত কোরায়েশ গোত্রপতিদের।
আজকের মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠী এটা উপলব্ধি করতে পারছে না যে, ১৪০০ বছর পূর্বের কাঠ পাথরের দেবতা ‘লাত’-এর স্থানে আজ গণতন্ত্র, মান্নাত-এর স্থানে সমাজতন্ত্র, হবাল-এর স্থানে একনায়কতন্ত্র, ওজ্জার স্থানে জাতীয়তাবাদ এবং যুল-কাফ্ফায়নের স্থানে রাজতন্ত্র প্রতিস্থাপিত হয়েছে, এবং তন্ত্রের প্রতিমার আনুগত্য করে এই জনসংখ্যাটিও সেই পৌত্তলিক আরবদের মতই কার্যত শেরক ও কুফরে ডুবে আছে। আল্লাহ রসুল এসে তাদেরকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অর্থাৎ তওহীদের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে আলল্লাহর একত্ববাদ (ওয়াহদানিয়াত) প্রতিষ্ঠা করেন নি, কারণ আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়ে সেই মোশরেকদের আগে থেকেই সুদৃঢ় ঈমান ছিল। না, সামান্য ভুল হল, বর্তমানের এই মুসলিম পরিচয়ের জনসংখ্যাটি সেই আরবদের মতই নয়, বরং তাদের চেয়েও জঘন্য শেরক ও কুফরে ডুবে আছে, কারণ সেই আরবিয়রা তাদের দেবদেবীর কোনটিকেই তাদের স্রষ্টা বা প্রভু ভাবতো না, তারা সেগুলির পূজা করত এই বিশ্বাসে যে সেগুলি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করবে এবং তাদের হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। সুতরাং মূর্তির পূজা-আরাধনার নেপথ্যে তাদের প্রকৃত উপাস্য প্রভু আল্লাহই ছিলেন। কিন্তু বর্তমানের মানবরচিত মতবাদের মূর্তিগুলির উপাসনার বেলায় এটুকুও খাটে না, কারণ এই সব মতবাদের মধ্যে কোথাও আল্লাহর কোনো স্থান নেই। প্রকৃতপক্ষে এই জীবনব্যবস্থাগুলি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই পুরোপুরি নির্বিকার। ফলে বর্তমানের মো’মেন মুসলিম হবার দাবিদারগণ যে শেরক ও কুফরে লিপ্ত তা নিঃসন্দেহে ১৪০০ বছর আগের আরবদের শেরক ও কুফরের চেয়েও নিকৃষ্টতর।
এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া অতীব জরুরী যে, কেন এই জনসংখ্যাটি যারা নিজেদেরকে মো’মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং দাবি করে তারা এগুলির একটিও নয়। আমি পাঠকবর্গকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগে এ বক্তব্যের পক্ষে যে যুক্তিগুলি পেশ করছি সেগুলি একটু গভীরভাবে ভেবে দেখার জন্য।
ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, এটাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (দ:) পর্যন্ত এ কলেমাই এই দীনের অপরিবর্তনীয় ভিত্তি যাতে কোনো দিনই “ইলাহ” শব্দটি ছাড়া অন্য কোনো শব্দই ব্যবহৃত হয় নি। আল্লাহর শতাধিক গুণবাচক নামের থেকে একটি নামও আল্লাহ তাঁর এক লক্ষ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী রসুলের কারো ক্ষেত্রেই কলেমার মধ্যে ব্যবহার করেন নি। সবার ক্ষেত্রে তিনি কলেমাতে অপরিবর্তনীয়ভাবে “ইলাহ” শব্দটিই ব্যবহার করেছেন, একবারের জন্যও ‘লা মা’বুদ ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই), ‘লা খালেক ইল্লাল্লাহ’ (আলল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই), ‘লা রব ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রতিপালক নেই) ইত্যদি বাক্যগুলি ইসলামের মূলমন্ত্র হিসাবে নির্বাচিত করেন নি। যদিও এটা সন্দেহাতীত যে আল্লাহই আমাদের একমাত্র উপাস্য, স্রষ্টা, পালনকর্তা ইত্যাদি, তবুও তাঁকে এই সিফতগুলির আধার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া এই দীনের ভিত্তি নয়, এই দীনের চিরন্তন ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এই কথায় বিশ্বাস না করে, এই কথার সাক্ষ্য না দিয়ে কেউ মো’মেন হতে পারবে না।
কলেমায় ব্যবহৃত ‘ইলাহ’ শব্দের প্রকৃত অর্থ, ‘যাঁর হুকুম মানতে হবে’ (He who is to be obeyed)। শতাব্দির পর শতাব্দির কাল পরিক্রমায় যেভাবেই হক এই শব্দটির অর্থ ‘হুকুম মানা বা আনুগত্য’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে হয়ে গেছে ‘উপাসনা, বন্দনা, ভক্তি বা পূজা করা (He who is to be worshiped)। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় কলেমার অর্থই শেখানো হয় – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মানে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। কোর’আনের ইংরেজী অনুবাদগুলিতেও কলেমার এই অর্থই করা হয় (There is none to be worshiped other than Allah)। কলেমার ‘ইলাহ’ শব্দটির অর্থ ভুল বোঝার ভয়াবহ পরিণতি এই হয়েছে যে সম্পূর্ণ মুসলিম জনসংখ্যাটি এই দীনের ভিত্তি থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেছে, ফলে তারা আর মো’মেন নেই। বর্তমানে এই জাতির আকিদায় আল্লাহর হুকুম মানার কোনো গুরুত্ব নেই, তাঁর উপাসনাকেই যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে সারা দুনিয়াতে এমন কোনো দল নেই, এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যারা তাদের সামষ্টিক, জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে, যা কিনা ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার চেয়ে বহুগুণ বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। জাতীয় জীবনে আল্লাহকে অমান্য করে তার বদলে উপাসনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি দিয়ে আসমান জমীন ভর্তি করে ফেলা হচ্ছে, কিন্তু সেই পর্বত সমান উপাসনাও বিশ্বময় তাদের করুণ দুর্দশার প্রতি দয়াময় আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, সকল জাতির হাতে তাদের অবর্ণনীয় নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, পরাজয়, অপমান, নিগ্রহ বন্ধ তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন আরো বেড়ে চলছে। এই জনসংখ্যার বর্তমানের অবমাননাকর শোচনীয় অবস্থার নিরিখে নিম্নের বাস্তবতাগুলি একটু ভেবে দেখুন।
১. মহান আল্লাহ আমাদেরকে বলছেন, “যদি তোমরা মো’মেন হও এবং আমলে সালেহ করো আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব (খেলাফত) দান করব” (কোর’আন- সুরা নুর ৫৫)। আমাদের হাতে কি এই পৃথিবীর কোনো কর্তৃত্ব আছে? বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর কর্তৃত্ব তো দূরের কথা আমরা পৃথিবীর সর্বত্র অন্য সব জাতি দ্বারা পরাজিত, অপমানিত, অবহেলিত, নিগৃহিত এবং প্রতিটি জাতির লাথি খাচ্ছি, সব জাতি আমাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখছে, আমাদের দেশগুলো আক্রমণ করে দখল করে নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে মো’মেন এর প্রতি আল্লাহর অঙ্গীকার থেকে বাস্তবতার দূরত্ব লক্ষ যোজন। সুতরাং বলতে হবে যে, আল্লাহ কি তাহলে তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন? (নাউযুবিল্লাহ) যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর চোখে আমরা মোমেন মুসিলম নেই। এবং মো’মেন না হওয়ার মানেই মোশরেক এবং কাফের হওয়া।
২. আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ যা নাযেল করেছেন সে অনুযায়ী যারা হুকুম (বিচার ফায়সালা) করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। এই আয়াতগুলিতে ‘হুকুম’ শব্দটি দিয়ে কেবল আদালতের বিচারকার্যই বোঝায় না, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন তাঁর নাযেল করা বিধান অর্থাৎ কোর’আন (এবং সুন্নাহ) মোতাবেক পরিচালনা করাকেও বোঝায়। মো’মেন মুসলিম হবার দাবিদারগণ এখন আর একটি সু-সংহত উম্মাহরূপে নেই, তারা ভৌগোলিকভাবে পঞ্চাশটিরও বেশী জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জাতির দাসে পরিণত হয়েছে, তাই তারা তাদের সামষ্টিক কার্যাবলী আল্লাহর নাযেলকৃত বিধান দিয়ে ফায়সালা করে না। ফলশ্রুতিতে তারা ফাসেক (অবাধ্য), জালেম (অন্যায়কারী) এবং কাফেরে (প্রত্যাখ্যানকারী) পরিণত হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানগুলিকে অপাংক্তেয় করে রেখে তারা ইহুদী-খ্রিষ্টানদের আইন, কানুনগুলি নিজেদের দেশে প্রবর্তন করে তা দিয়ে সামষ্টিক কার্যাবলী পরিচালনা করছে।
৩. আল্লাহ তাঁর কোর’আনে বলেছেন, “কাফেরদের সাথে তোমাদের যুদ্ধ হলে অবশ্যই তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে (অর্থাৎ পলায়ন করবে বা পরাজিত হবে)।” এর কারণ হিসাবে তিনি বলছেন, কাফেরদের কোনো ওয়ালী (অভিভাবক বা সাহায্যকারী) নেই, কেননা আল্লাহ নিজেই ওয়ালী হিসাবে মো’মেনদের পক্ষে থাকবেন। যখনই এবং যতবারই মো’মেন ও কাফেরদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে ততবারই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে অর্থাৎ মো’মেনরা বিজয়ী হবেন। এ কথা আল্লাহ পরের আয়াতেই জানিয়ে দিয়েছেন, “এটি তাঁর সুন্নাহ (নীতি, রীতি) যা পূর্ব থেকে চলে আসছে এবং যা অপরিবর্তনীয়” (সুরা ফাতাহ ২৩)। এই উম্মাহর প্রথম ৬০-৭০ বছরের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই আমরা আল্লাহ সুন্নাহর বাস্তবায়ন দেখতে পাই। নিত্য-উপবাসী, অস্ত্র-শস্ত্রে দুর্বল, শিক্ষা-দীক্ষাহীন মাত্র কয়েক হাজার মো’মেন তদানীন্তন বিশ্ব-শক্তিগুলির হাজার বছরের অহঙ্কার চুরমার করে দিয়েছিল, সেই সব বিশ্বশক্তিগুলির বহুগুণ বড়, বহু শক্তিশালী, উন্নত সমরাস্ত্রে সজ্জিত, সু-প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে একটার পর একটা যুদ্ধে পরাজিত ও বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মো’মেন হওয়ার দাবীদার এই জনসংখ্যাটি সেই একদা পরাজিত জাতিগুলির হাতেই একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছে এবং তাদের পদানত গোলামে পরিণত হচ্ছে, তাদের দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত ও নিগৃহিত হচ্ছে। গত পাঁচশ’ বছরে এই মুসলিম জনসংখ্যাটির দ্বারা ঐ জাতিগুলির বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধেও বিজয় লাভের ঘটনা আমরা দেখি না; তাদের ধারাবাহিক পরাজয়ের চলমান উদাহরণ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মো’মেন জাতির বিজয়কে আল্লাহ তাঁর নিজের সুন্নাহ হিসাবে ঘোষণা করেছেন, এবং তাঁর কথা মতই যদি এই সুন্নাহ অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে, তাহোলে অবধারিত সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় – এই জনসংখ্যাটি তাঁর দৃষ্টিতে মো’মেন নয়, এবং তিনি তাদের অভিভাবক নেই, তাদের পক্ষেও নেই।
৪. আল্লাহ আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে তাঁর কেতাবে বলছেন, “তোমরা হীনবল হয়ো না, সাহস হারিও না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মো’মেন হও” (সুরা এমরান ১৩৯)। কিন্তু আমরা বিগত কয়েক শতাব্দীতে কোনো যুদ্ধেই বিজয়ী হতে পারি নাই। সুতরাং আল্লাহর কালাম যদি সত্য হয়ে থাকে, (এবং তা সত্য), তাহোলে অবশ্যই আমাদের মো’মেন হওয়ার দাবি মিথ্যা।
১৬০ কোটির এই বিরাট জনসংখ্যাটি যে প্রকৃত বিচারে মো’মেন মুসলিম নেই, উম্মতে মোহাম্মদী হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না, তা বোঝানোর জন্য এমন আরো অগণিত আয়াত ও অখণ্ডনীয় যুক্তি উপস্থাপন করা যায়। সীমাহীন অজ্ঞতাবশত এই জনসংখ্যাটি নামাজ পড়ছে, হজ্ব করছে, যাকাত প্রদান করছে, রমজানের রোযা রাখছে আরো বহু এবাদত করছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না যে তাদের এই সব আমল বৃথা, অর্থহীন। এই জাতির ব্যাপারে আল্লাহর আর কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তিনি আর এদের ওয়ালী (রক্ষাকর্তা, অভিভাবক) নেই, তাঁর এদেরকে সাহায্য করার কোনো দায় নেই। তাঁর বিতৃষ্ণা, ঘৃণা, লানত, গজব সব এখন এই জনসংখ্যার ওপর, যা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা নিগ্রহ, অবিচার, পরাজয়, লাঞ্ছনা, অপমানরূপে নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্ষিত হচ্ছে, সেই সব জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা যারা একদিন এই জনসংখ্যারই পূর্বসূরীদের দিকে সমীহ, সম্ভ্রম ও সম্মানের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো। এই সকল হৃদয়বিদারক পরিণতির মূল কারণ হচ্ছে – প্রথমত, এই জনসংখ্যাটি কলেমার মধ্যে থাকা আল্লাহর আনুগত্যের অঙ্গীকারকে বদলে উপসনায় পরিণত করে ফেলেছে এবং শুধু উপাসনা ছাড়া জীবনের প্রতিটি বিষয়ে তাঁর অবাধ্য (মানে ফাসেক) হয়ে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের তৈরী জীবনব্যবস্থাগুলির আনুগত্য করে চলেছে এবং দ্বিতীয়ত, এই কাজ করে এই জনসংখ্যাটি আর ইসলামের সীমানার মধ্যে নেই।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ফোন: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৬২১৪৩৪২১৩, ০১৭৮৩৫৯৮২২২]